জগলুল আসাদের কলাম ‘ইসলামে যা গজব, বিজ্ঞানে তা দুর্যোগ’

প্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০২০

জগৎ ব্যাখ্যায় ইসলামের নিজস্ব কিছু পরিভাষা আছে, যেমন বিজ্ঞানেরও আছে আলাদা পরিভাষা। বিজ্ঞান ও ধর্ম দুটোরই ভাষিক পরিমণ্ডল মূলত আলাদা। ইসলাম যাকে আজাব বা গজব বা পরীক্ষা বলবে, ইসলাম যাকে বলবে মানুষের দু`হাতের কামাই; বিজ্ঞান ভিন্ন ভাষায় তাকে বলবে বিপর্যয়, দুর্ঘটনা, দুর্যোগ ইত্যাদি। ইসলাম মানুষের আখলাক ও সোহবত ঠিক করতে বলবে, বলবে তাওয়াক্কুল ও সবর করার কথা। মনে করিয়ে দেবে মৃত্যুর অনিবার্যতার কথা, স্মরণ করিয়ে দেবে প্রয়োজনীয় আসবাব ব্যবহার করবার কথাও। কিন্তু বিজ্ঞানের কথা বলবার রীতি এমন নয়। বিজ্ঞান কোনও বিপর্যয়ের ঐশিতা খুঁজবে না, সে জাগতিক কারণ খুঁজবে ও তা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বস্তুগত উপায় ও উপকরণের শরণ নেবার কথা বলবে।

বিজ্ঞান এইভাবে অভিনিবেশ করবে বস্তগত করণ ও কারণে। আবার বিজ্ঞানের পুঁজিবাদী ব্যবহার যেকোনো `আজাব` বা `বিপর্যয়`কে `ক্যাশ` করতে চাইবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি চাইবে এই ফাঁকে শত্রুকে বিপদে ফেলতে, প্রচারণার মধ্যমে রাজনৈতিক `অপর`কে ঘায়েল করতে ইত্যাদি। বিজ্ঞান যেদিকে মানুষের মনোযোগ ফিরাবার দায় বা কর্তব্য বোধ করে না, ইসলাম চাইবে মানুষের মনোযোগ সেই দিকে ফেরাতে।

আস্তাগফির পাঠ বা সকাল-সন্ধ্যার অজিফা পাঠ করবে মুমিন। সে পাঠ করবে, আল্লাহুম্মা ইন্নি আওজুবিকা মিনাল বারস ওয়াল জুনুন ওয়াল জুযাম ওয়া মিন সায়্যিল আসকাম। অর্থাৎ, হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট ধবল, কুষ্ঠ এবং উন্মাদনাসহ সকল কঠিন-দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে পানাহ চাই। তার এসব দোয়া-পাঠ, তাওয়াক্কুল ছাড়াও সে বিজ্ঞানের সব রকম ব্যবহারিক নির্দেশনা মেনে চলবে, কিন্তু অন্তরটাকে সে খোদা নির্ভরতায় পূর্ণ রাখবে।

যেকোনো বিপর্যয়, আজাব বা গযবে বা পরীক্ষায় মুমিনের প্রস্তুতি এমনই হবে। তাওয়াক্কুল ও প্রার্থনা, আসবাব (জাগতিক উপায় উপকরণ/বিজ্ঞান) ও সতর্কতা অবলম্বনের মধ্য দিয়ে মুমিন প্রস্তুত থাকে আজাব, গজব ও বিপর্যয় মোকাবেলার। আনাস বিন মালিক (রা.) বর্ণিত তিরমিজিতে একটা হাসান হাদিস আছে। যেখানে নবিজী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর উপর ভরসা করো ও উটটাকে বেঁধে রাখো।’ সতর্কতা, পূর্বপ্রস্তুতি ও সচেতনতা তাওয়াক্কুলের বিরোধী নয়।

বিজ্ঞান বা পার্থিবতার প্রস্তুতি একমাত্রিক, আর মুমিনের প্রস্তুতি বহুমাত্রিক। যেখানে জায়গা থাকে বিজ্ঞানের জগৎ ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয় অন্তর্দৃষ্টিরও। মুমিনের দৃষ্টি শুধু জমিনে থাকে না, জমিন পেরিয়ে তা আসমানমুখিও। সর্বোপরি, মুমিন মনে রাখে, ‘প্রত্যেক প্রাণকেই মৃত্যুর সাধ গ্রহণ করতে হবে।’ এছাড়া সে মনে রাখবে আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালার সেই অমোঘ বাণী, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন, কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ। তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাময়।’ (মূলক ১-২)।

বিপর্যয়ের স্রষ্টা যিনি, যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, যিনি মানবীয় চিন্তায় সমস্ত আপাত অসম্ভবকে সম্ভবকারী, সমস্ত নিরাময়ের উপকরণকে যিনি কার্যকারিতা দেন, যিনি সমস্ত কারণ ও ফলাফলের প্রকৃত স্রষ্টা, তাঁকে ভুলে কোনও জাগতিক প্রস্তুতিকে ইসলাম মুমিনের জন্যে যথাযথ ও যথেষ্ঠ মনে করে না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক