জগলুল আসাদের কলাম ‘ইসলামে চিন্তার ঐতিহ্য’

প্রকাশিত : মে ০৫, ২০২০

ইসলামের ভেতরে চিন্তার যে ঐতিহ্য আছে, তার দিকে তো নজর ফিরাতে হবেই ও তাকে পাঠও করতে হবে। আমাদের ইতিহাসে যেসব আলিমরা সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, রাষ্ট্র, মানবিক-সম্পর্কের বিবিধ অভিব্যক্তি নিয়ে কাজ করেছে, তাদের পুনর্পাঠ ও পুনর্বিচার জরুরি। এই পাঠের উদ্দেশ্য ত্রিবিধ। ১. তারা কী কী নিয়ে চিন্তা করেছে ও ২. কীভাবে চিন্তা করেছে এবং ৩. তারা তাদের সমকালের অপরাপর চিন্তাকে উপস্থাপন করেছে কিনা ও ইসলামের নাম নিয়ে যে চিন্তা সেটির সাথে সেগুলোকে কীভাবে সমন্বিত করেছে বা বৈপরীত্য দেখিয়েছে।

পাশ্চাত্যে জগতে প্রায় সব বিষয় নিয়েই বিপুল পরিমাণ চিন্তা হয়েছে। ইসলাম কিন্তু কোনও রুদ্ধদ্বার কক্ষ নয়, এখানে অপর চিন্তাকে গ্রহণ করবার সুযোগ আছে যদি না তা ইসলামের মূল স্পিরিটের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। সমাজ-রাজনীতি ও ইহজাগতিক কায়কারবার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ফুকোটুকো, দুর্খেইম, হেবারমাস, আগামবেনকে ব্যবহার করা যেতেই পারে, অসুবিধা নেই। কিন্তু তাতে পরিপূর্ণ অবগাহন, একীন ও নির্ভরশীলতায় সমস্যা আছে। আমাদের অপছন্দ হলেও, ইসলাম নিজের কাঠামোর স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেই অপর কোনও চিন্তাকে গ্রহণ করে।

আমাদের পছন্দ হোক বা নাহোক, ইসলাম পরকালকে সামনে রেখে ইহকালকে সাজাতে বলে। ইহকাল বুঝতে, ইসলামের ভাষায় যাকে ‘জাহিলিয়াত’ বা ‘জাহালাত’ বলে তাকেও বুঝতে পশ্চিমা-অপশ্চিমা নানা চিন্তকদের ব্যবহার করতে তো পারিই। কিন্তু সামগ্রিক কেবলা যেন ওই মক্কামুখী পশ্চিমই হয়, অপরাপর পশ্চিম যেন না হয়, এই নজর ইসলামের থাকে। বিশ্ববীক্ষায় না মিললেও ‘আধুনিক চিন্তা’র অনেক কিছু ইসলামের সমাজ বা রাজনীতি ভাবনার সাথে মিলে যেতে পারে, বা ইসলামের অনেক অনুষঙ্গও মানুষের কাছে ঐশী বার্তা ছাড়াও চিন্তার উৎপাদক হিসেবেও উপস্থিত হতে পারে।

মানুষের চিন্তাশক্তি দিয়েও সত্যের অনেক আঁচ পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া নবুয়তি চিন্তার আঁচ জগতের বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে আছে। কেননা প্রত্যেক জাতি-সম্প্রদায়ের কাছেই নবি এসেছিলেন (সুরা ইউনুস-৪৭) বলে বলা হয়েছে। সেই আঁচের নিকটবর্তী বা দূরবর্তী সংস্পর্শে অনেকেই ‘শুদ্ধ চিন্তা’ করতে পারে। বা মানুষ যেহেতু আকলমান্দ প্রজাতি, তাই তার চিন্তাশীলতার ফল হিসেবেও অনেক কিছু তার সামনে উদ্ভাসিত হতে পারে। মানে ইসলামে চিন্তায় চিন্তায় মোলাকাত অস্বীকৃত হওয়ার কথা না। তবে ইসলামের তাওহিদ-রিসালাত-আখিরাতের যে কাঠামো সেই কাঠামোর ভেতর থেকে যে শব্দাবলি বা পরিভাষা উদগত হয়েছে, সেই পরিভাষাকে ব্যবহার করে অন্য আধুনিক চিন্তাকে সমুন্নত করা ও সাবস্ক্রাইব করাকে ইসলামি চিন্তায় সমস্যাজনক মনে করা হয়।

অনেক চিন্তাই আছে যেগুলোকে ইসলাম তার নিজস্ব বলে দাবি করে, যদিও সেইসব চিন্তার ঐতিহাসিকতা আছে এই অর্থে যে, ইসলাম কোনও নতুন ধর্ম হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে না। ইসলামি চিন্তাকে প্রাসঙ্গিক করতে হলে ইসলামের ভেতরে যে চিন্তাস্রোত আছে তাকে তো আনতে হবে সামনে এবং এ কালের মানুষের বোধগম্য ভাষায় তা উপস্থাপনের জরুরতও আছে। ‘ইসলামগন্ধী আধুনিকচিন্তা’ বা ‘আধুনিকতাগন্ধী ইসলাম চিন্তা’ তো দেখিই আমরা। এটি নিয়ে পরে আলাপ করবার ইচ্ছে। তবে ইসলামের নেটওয়ার্ক অব কনসেপ্ট দিয়ে গ্রহণযোগ্য, অগ্রহণযোগ্য, ইসলামি-অনইসলামি, পছন্দনীয়, অপছন্দনীয় বোঝা সম্ভব।

আর ইসলাম কিন্তু উৎসনির্বিশেষে চিন্তার অন্তর্নিহিত গুণকে মূল্য দেয়, যেমন সহিহ বুখারিতে উল্লেখিত আছে যে, আবু হুরায়রা (রা.) আয়াতুল কুরসির সত্য ফজিলত জেনেছিলেন শাইতানের কাছ থেকে এবং এ প্রসঙ্গে নবি (সা.) বলেছিলেন, “সে তোমাকে সত্যই বলেছে, যদিও সে মহা মিথ্যাবাদী”। আবার সুরা হুজুরাতের ৬ নং আয়াতে খবর ও খবরের উৎস দুটোকেই যাচাই করার কথা বলা হয়েছে। জ্ঞানকে তার অন্তর্নিহিত মূল্যে যাচাই এবং প্রয়োজনবোধে খবরদাতা বা উৎপাদনকারীর আদত ও আদালাত নিরীক্ষণও ইসলামের জ্ঞানবিচার পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া জ্ঞান (আল-কালিমাতুল হিকমাহ) মুমিনের হারানো দৌলত (সুনান আল তিরমিজির হাদিস) এটাও কিন্তু মনে রাখার মতো বিষয়; বিশ্বের যেকোনো স্থানে যে-জ্ঞানশাস্ত্র বা বিশ্লেষণপদ্ধতির জন্মই হোক, তাতে অংশগ্রহণ করা ও উপকৃত হওয়া মুমিন তার জন্যে প্রয়োজনীয় ভাবে।

নিজেদের সমাজকে বিনির্মাণ করতে কোরান-হাদিস ও তার চিন্তন-কাঠামোকে ব্যবহার ক`রে সমাজ-রাষ্ট্র, সমাজ-সভ্যতা নিয়ে যা যা চিন্তা করা হয়েছে এবং একালের বিশ্বচিন্তাকেও বিবেচনায় রেখে ও বিচার করে আমাদের সামনে এগুনোর জোর প্রস্তুতি নিতে হবে। এবং একটা প্রজন্মও গড়ে তুলতে হবে যারা এভাবে উম্মাহকে এগিয়ে নিবে রাহবার হয়ে। ইসলাম শুধু আল্লাহ ও রাসুলের কথাতেই ‘শুনলাম আর মানলাম’ বলে আত্মসমর্পণ করতে বলে আর জগতের সব ব্যাপারে, প্রায় সবক্ষেত্রেই কোনো-না-কোনো মাত্রায় বিচারমূলক পদ্ধতি গ্রহণের কথা বলে।