জগদীশচন্দ্র বসু: ভারতীয় বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার এক রূপ
জগলুল আসাদপ্রকাশিত : নভেম্বর ৩০, ২০২৪
ভারতীয় বা পশ্চিমি বিজ্ঞান বলে কিছু আছে কিনা বা বিজ্ঞানকে সুনির্দিষ্ট ভূগোলের আওতাধীন করে আলাদা আলোচনা করা যায় কিনা, এ প্রশ্নটা বিজ্ঞানের দার্শনিক মহলে প্রবলভাবেই জারি আছে এখনো। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও বিজ্ঞানকে ভূগোল, সমাজ বা সংস্কৃতির প্রশ্ন থেকে আলাদা করে বিবেচনা করাই পাশ্চাত্যের কয়েক শতাব্দির রীতি। বিজ্ঞান সর্বজনীন আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও সুনির্দিষ্ট; পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর প্রত্যক্ষ প্রমাণ নির্ভরতাই বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ঐতিহ্যে ধর্ম, সামাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির ভূমিকা ‘বিশুদ্ধ’ বিজ্ঞান চিন্তা বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রত্যাখ্যাত বা অস্বীকৃত। সপ্তদশ শতাব্দিতেই পশ্চিমা জগতে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়ে গেছে। এ সময়ে দর্শন থেকে আলাদা হয়ে পশ্চিমা বিজ্ঞান পরিণত হয় চর্চার স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে।
বিজ্ঞান বলতে পরীক্ষা বা প্রমাণযোগ্য ব্যাখ্যার আকারে বস্তুজগতকে জানার পদ্ধতিগত প্রচেষ্টাকে systematic enterprise বোঝানো শুরু হয়। বিজ্ঞান শুধু জ্ঞান নয়, এটি ‘জানা’র একটি বিশেষ পদ্ধতিও a way of pursuing knowledge। পশ্চিমা বিশ্বে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের ভিত্তিতে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির নিয়মকে জ্ঞান আকারে সূত্রাবদ্ধ করার প্রচেষ্টা নিলেন, যেমন নিউটনের গতিসূত্র। ঊনবিংশ শতাব্দিজুড়ে বিজ্ঞান শব্দটি ‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি’ scientific method অর্থেই ব্যবহৃত হওয়া শুরু করল। এম্পেরিকাল ও এক্সপেরিমেন্টাল সাইন্সকেই পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানের ধারক ও বাহকরা বিশ্বজুড়ে ফেরি করলেন ‘সর্বজনীন’ হিসেবে। পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ও জ্ঞানীয় আধিপত্যের হাত ধরে ‘পাশ্চাত্য জ্ঞান ও পদ্ধতি’ই ‘আধুনিক’ ও ‘আদর্শ’ হিসেবে প্রচারিত হলো বিশ্বজুড়ে, প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিও পেলো।
এ প্রবন্ধে আমরা যা কিছু পাশ্চাত্যের, তার-ই বিরোধিতার প্রকল্পের অংশ হিসেবে ‘পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও পদ্ধতি’কে সমালচনা করছি না, বরঞ্চ পাশ্চাত্য পদ্ধতিকে আদর্শায়িত করা, সর্বজনীন ও একমাত্র ‘নিখাদ’ বলার প্রবণতাকে প্রশ্ন করছি, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান চিন্তার মধ্যে মূল্যবোধ, অন্তর্জ্ঞান ও অন্যান্য সংস্কৃতি ও বিশ্বাস ব্যবস্থার নিবিড় ভূমিকাকে অস্বীকার করার পাশ্চাত্য প্রবণতাকেকে প্রশ্ন করছি, ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর (নভেম্বর ৩০, ১৮৫৮ নভেম্বর ২৩,১৯৩৭) ভাব, ভাষা ও পদ্ধতির আলোচনা প্রসঙ্গে। জগদীশচন্দ্রের গুরুত্বের একটি দিক এই যে, মানব সংস্কৃতির দুটি ভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত ভিন্ন দুটি চিন্তাধারার মিথস্ক্রিয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে। বিজ্ঞান নিয়ে ভাবনার উত্তর-উপনিবেশিক নিদর্শনও জগদীশের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি সহজেই।
প্রাচ্য ও প্রতীচীর জ্ঞানগত ঐতিহ্যের ভেতরে জগদীশের ভাবনা, অনুভূতি ও পদ্ধতির বিশিষ্টতা বুঝে নেয়ার অভিপ্রায়ে প্রাচ্য, যার একটি অংশ ভারতবর্ষ, ও পাশ্চাত্যের চিন্তাপদ্ধতির কিছু পার্থক্য, সরলীকরণের ভয় সত্ত্বেও, টুকে রাখছি:
এক. প্রাচীনকালে পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে সুসংবদ্ধ করেছিলেন এরিস্টটল। তা প্রায় দুই হাজার বছর ধরে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি হয়ে থাকলো। রনে দেকার্তের নাম অনুসারে কার্তেজিয়ান ডুয়ালিজম বা কার্তেজীয় বিভাজন নামে যা পরিচিত, তা-ই পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ভাবনার দার্শনিক ভিত্তি। মনকে বিচ্ছিন্ন করা হলো শরীর থেকে, বস্তুকে ভাব থেকে, মনোজগৎকে বস্তুজগত থেকে, বিষয়কে বিষয়ী থেকে; প্রতিটি মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়লো অনেকাংশে। কার্তেজীয় বিভাজন বিজ্ঞানীদের সুযোগ করে দিলো বস্তুকে মৃত, জড় ও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবার। জগৎকে বিভিন্ন বস্তুর পুঞ্জীভূত রূপ হিশেবে গ্রহণ করার যান্ত্রিক বিশ্ববীক্ষা ধারণ করতেন নিউটন। অপরদিকে, জগৎকে দেখবার প্রাচ্যীয় বা ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি ‘অর্গানিক’। প্রাচ্যের প্রজ্ঞার ধারা বা আধ্যাতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকলেও সবাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একত্বের অনুভবে একাট্টা। অদ্বৈতবাদী বা monistic দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচ্যের চিন্তা ও দর্শনের অন্যতম ভিত্তি।
দুই. পাশ্চাত্যে যাদের বিজ্ঞানী বা দার্শনিক বলা হয়, প্রাচ্যের ভোকাবুলারিতে তারাই সাধক, ঋষি বা গুরু। পাশ্চাত্যে যেটি বিজ্ঞান, প্রাচ্যে সেটির নাম দেয়া যেতে পারে প্রজ্ঞা Western Science, Eastern Wisdom । পাশ্চাত্যে যেটি ‘চর্চা’ বা ‘গবেষণা’, প্রাচ্যে সেটি আসলে ‘সাধনা’। ‘ল্যাবরেটরি’ শব্দের ব্যঞ্জনাকে বহুদূর বিস্তৃত করে ‘বিজ্ঞানমন্দির’ শব্দবন্ধটি (জগদীশ বসু ব্যবহৃত)।
তিন. পাশ্চাত্যের আধুনিক বিজ্ঞান পরীক্ষণনির্ভর, যার জন্য প্রায়শই প্রয়োজন হয় উচ্চমানের প্রযুক্তি ও দলীয় প্রক্রিয়া। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণগুলো যেকোনো সময় যেকোনো ব্যক্তি দ্বারা পুনরাবৃত্তিযোগ্য। অপরদিকে, ঋষি, সাধক বা মরমিরা জ্ঞান অর্জন করেন অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে, কোনও যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই, ধ্যানের নির্জনতার মাঝে। `অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তিযোগ্যতা’ প্রাচ্যীয় সাধনার জন্যও অপরিহার্য। মরমী সাধকদের আগ্রহ মূলত বাস্তবের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আস্বাদনের ব্যাপারে, ওই অভিজ্ঞতা বর্ণনার ব্যাপারে নয়। আর পদার্থবিজ্ঞানের আগ্রহ প্রাকৃতিক ঘটনার পর্যবেক্ষণ ও সুস্পষ্ট ভাষায় বা গাণিতিক সমীকরণে তা বোধগম্য করে প্রকাশের।
চার. প্রাচ্যের অভিজ্ঞতার সাথে প্রাচীন গ্রীসীয় অভিজ্ঞতা-ভাবনার মিল লক্ষ্যণীয়। পরীক্ষণনির্ভর আরোহী (ইন্ডাকশান) পদ্ধতি প্রাচীন গ্রিক মানসিকতায় প্রায় অপরিচিত ছিল। অন্তর্দৃষ্টির আলোয় মানুষের অভিজ্ঞাতায় জেগে ওঠা কিছু স্বতঃসিদ্ধ নীতিই অবরোহী পদ্ধতিতে উপলব্ধি বা যুক্তির যোগান দিত প্রাচ্যে। প্রাচীন ভারতের মিস্টিক ঐতিহ্যে ‘সত্য’ লাভ হয় বুদ্ধির জগতের বাইরে এসে নিজেরই অভ্যন্তরে গভীর ও নিবিড় ধ্যানমগ্ন দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণে। এই নিবিড় দৃষ্টির পরম্পরার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় সত্যানুভূতি।
পাঁচ. বিজ্ঞানের ভাষা গণিত; প্রায়শই বিজ্ঞানে বিশেষ বক্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশের প্রয়োজনে তৈরি করতে হয় সুনির্দিষ্ট ও সঙ্কুচিত পরিভাষা। ভারতবর্ষের প্রজ্ঞার ঐতিহ্যে, বিশেষত সনাতন ধর্মে, প্রতীক, রূপক, উপমা ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে বাক্য বা বিবৃতি পায় পুরাণের রূপ। আনন্দ কুমারস্বামীকে উদ্ধৃত করে ফ্রিটজফ কাপরা বলছেন, “পুরাণ অঙ্গীভূত করে পরম সত্যের সবচাইতে কাছাকাছি কোনওকিছু যা বর্ণিত হতে পারে ভাষায়।” পুরাণ বা কাব্যভাষা প্রাচ্যে প্রজ্ঞার প্রকরণ, ভাবের বাহন। সনাতন ধর্মে ‘মহাদেবের জটা’ ‘শিবনৃত্য’ ইত্যাদি পৌরাণিক অভিব্যক্তিগুলো প্রকৃতি ও বস্তুর স্বরূপ সম্পর্কে এদের রচয়িতার অন্তর্জ্ঞানকে বর্ণনা করে।
জগদীশচন্দ্র বসুর ভেতরে আমরা লক্ষ্য করব পাশ্চাত্য পদ্ধতি ও প্রাচ্যীয় প্রজ্ঞার অপুর্ব মেল-বন্ধন। যদিও পাশ্চাত্যের ‘নিখাদ বিজ্ঞান’ এর প্রবক্তারা এর সমালোচনা করেন। ইউরোপ তার নিজ ঘরানার বিজ্ঞানচর্চাকে মানদণ্ড বানিয়ে অপরাপর সকল পদ্ধতি ও চিন্তা-অভিজ্ঞতাকে যখন অবৈজ্ঞানিক ঠাওরান, তখন বিজ্ঞানের জাতীয়তাবাদী, ঐতিহ্যিক ও বিকল্প বিজ্ঞানের পারাডাইম তৈরি হয়। প্রতীক চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, “ভারতের সনাতন ধর্ম ও সংস্কৃতির বৃহত্তর পরিসর থেকে জগদীশের কাজ ও গবেষণা সংগ্রহ করেছে শক্তি ও শাঁস।“ ইউরোপীয় ‘বিজ্ঞানবাদ’ scientism এর সর্বজনীনতার ধারণার বিপরীতে বিজ্ঞানের ‘স্বদেশি’ রূপ জগদীশের নতুন প্যারাডাইম।