জগতে চিন্ময় জ্ঞানের তুল্য আর কিছু নাই
আজহার উদ্দিনপ্রকাশিত : মার্চ ০৩, ২০২১
গেল ভাষার মাসে পড়লাম বাংলাভাষার স্পষ্টভাষী ও তেজস্বী কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের এবারের উপন্যাস `উজানবাঁশি`। কাহিনি সুবিন্যাসের মুনশিয়ানার কারণে একটানাই পড়ে শেষ করতে হয়েছে ৪১৬ পৃষ্টার বইটি। উপন্যাস পাঠের দীর্ঘ ১৯ বছরের বিরতির কারণে কিনা জানি না, স্বকৃত নোমানের স্বকৃত উপন্যাস উজানবাঁশি পাঠ আমাকে দিয়েছে এক নতুন অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান। বলা যায়, ১৯ বছর পর উপন্যাস পড়েছি। পড়েছি, থেমেছি, আর ভেবেছি এবং আবার পড়েছি। উজানবাঁশির উজানস্রোত আমাকে উজিয়ে টেনে নিয়ে গেছে দীর্ঘ ইতিহাস ও চাক্ষুষ ঘটনা পরম্পরায়। পড়তে পড়তে কোনো কোনো অনুচ্ছেদে বইয়ের মলাট বন্ধ করে আমাকে ভাবিয়েছে। এ বিষয়ে আবেগমথিত হয়ে পড়ার কোনো এক ফাঁকে ফেসবুকের স্ট্যাটাসে লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম, যে গ্রন্থ পড়তে পড়তে পাঠককে ভাবায় না, থামায় না; সেটি আর যাইহোক কোনো মননশীল গ্রন্থ নয়।
আমি কোনো পেশাদার গ্রন্থ সমালোক নই। এমনকি ধীশক্তিসম্পন্ন বোদ্ধা পাঠকও নই। আমি যে কোনো বৈদগ্ধ্যপূর্ণ গ্রন্থ বা বইয়ের পাতায় পাতায় পাঠে পাঠে সুখ পাই, তাই পড়ি। সেই অর্থে আমি এক সাধারণ পাঠক মাত্র। সুতরাং শক্তিশালী ঔপন্যাসিক স্বকৃত নোমানের `উজানবাঁশি`র কোনো পাঠ রিভিউ লেখা বা মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, এবং সে ধৃষ্টতা ও যোগ্যতাও আমার নেই। আমি জাস্ট আমার পাঠপ্রতিক্রিয়া বলছি।
উপন্যাসের নাম `উজানবাঁশি`। অর্থাৎ যিনি প্রচলিত সমাজব্যবস্থার কঠিন বিপরীতে বসে উজান বাওয়ার বাঁশি বাজান নতুন নতুন সুরে। এর লেখককে আগে থেকেই যৎকিঞ্চিৎ চিনি তার লেখালেখির কারণে। তাই নাম শুনেই মনে হয়েছে, এ উপন্যাসে উজানস্রোতের কোনো বার্তা আছে। অচলায়তন ভাঙার ইশারা-আহ্বান আছে, যেটি ঔপন্যাসিক স্বকৃত নোমানের সহজাত ও স্বভাবজাত। এবং বক্তব্যের মেরুদণ্ডে তিনি ঋজু ও সাহসী। যা বর্তমানে সচরাচর দেখি না আমি। তবে কি আমার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে গেছে! জানি না। হতে পারে।
কথাশিল্পী স্বকৃত নোমান মনস্বী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতো সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে স্পষ্ট কথা বলেন। কথা বলেন, রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে, অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে, তিনি দৃঢ়কণ্ঠে কথা বলেন অপসংস্কৃতির আস্ফালনের বিরুদ্ধে, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। দেশের কোথাও কোনো শিল্পী-বাউল-লেখক কোনো অপশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হলে তিনি কলম ধরেন এইসব নির্যাতিতের পক্ষে। উজানবাঁশির বয়ানে তিনি সমাজরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের কূপমণ্ডূকতা, ভুল জানা-বিশ্বাস নিয়ে কী সহজ-সরল ভাষায় কথা বলেছেন। যাকে বলে বৈদগ্ধের মিশেলে প্রাঞ্জলতাপূর্ণ এক উপন্যাস। এটি লেখকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কিনা, সেটা স্বয়ং লেখকই ছেড়ে দিয়েছেন বর্তমান ও ভাবীকালের পাঠকের বৈদগ্ধপূর্ণ পাঠের কাছে।
উজানবাঁশি উপন্যাসের মলাট ফ্ল্যাপে লেখা, চল্লিশ বছর পর বাঘের পেট থেকে বেরিয়ে আসে নগ্ন এক মানুষ। পৌষের কুয়াশাঢাকা এক হিমভোরে তাকে দেখা যায় নয়চরে। পায়ের কাছে সাপ নিয়ে বসে থাকে, ব্যাঙের মতো জলের ওপর হাঁটতে পারে, ঈগল পাখির ঠ্যাং ধরে উড়তে পারে। উজানগাঁর ভূস্বামী তাকে আবু তোয়াব বলে শনাক্ত করেন। ধীরে ধীরে তিনি বাঘামামা নামে হয়ে ওঠেন প্রণম্য। বদলে দেন নীলাক্ষি-তীরের জনপদের সংস্কৃতি। কিন্তু মানুষ কি বাঘের পেটে চল্লিশ বছর থাকতে পারে? প্রশ্ন তোলেন আবদুল কায়েদ। একদিন মাটি খুঁড়তে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন এক প্রাচীন শিলালিপি। সেই লিপিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার ছেলে মোহন রেজা শুরু করেন জ্ঞান অন্বেষণ। তার গায়ে ভেসে বেড়ায় বুনো কলমির ঘ্রাণ, ঘুমে-জাগরণে শুনতে পায় হট্টিটি পাখির ডাক। ওদিকে ভরা পূর্ণিমারাতে মানুষ, পশুপাখি আর কীটপতঙ্গ জেগে থাকে অন্ধ বাঁশিওয়ালা শেকার বাঁশির সুরে। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সমাজ ও রাজনীতি, রক্ষণশীলতা ও উদারপন্থা, জ্ঞান ও নির্জ্ঞান এবং বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব নিয়ে রচিত এই উপন্যাস স্বকৃত নোমানের শিল্পযাত্রার এক অনন্য স্বারক, যেখানে তিনি করেছেন সৃজনশক্তির জাদুকরী প্রয়োগ।
আসলেই তাই। উপন্যাসে চিত্রিত গ্রাম-ঠিকানার নামগুলো আমার কাছে কী-যে ভালো লেগেছে। আমার ইচ্ছা করে সবকিছু পেছনে ফেলে চলে যাই নীলাক্ষি-তীরের উজানগাঁয়, বসন্তপুর, নয়নচর, বিরলগঞ্জ, কাঠিমারি, মেলাতলি, মধুগঞ্জ, গগনতলা ও রাজকাটার মতো নিবিড় নৈঃশব্দ্যময় সবুজ গাঁয়ে, যেখানে শুনা যায় বাঁশির করুণ-মধুর সুর এবং হট্টিটি পাখির অনির্বচনীয় গান।
উপন্যাসের নায়ক মোহন কাননডাঙায় পড়তে এসে জানতে পারেন দুনিয়া নামক এক অদ্ভুত ডাইনির কথা। যে ডাইনির আহ্বানে পৃথিবীর সবাই দুরন্তবেগে ছুটে চলে নিরন্তর। আর সেই অদ্ভুত ডাইনী হচ্ছে, দুনিয়ার অপার সুখ-উপভোগের নাম। এই দুনিয়ার অপার সৌন্দর্যময় রূপরসগন্ধ ও সুখ-উপভোগকে ডাইনি বুড়িরূপে চিত্রিত করেছেন নায়ক মোহনের পিতা আবদুল কায়েদ মাওলানা। মোহন আরেক প্রকার অদ্ভুদ ডাইনির দেখা পায় কাননডাঙার এক মাদ্রাসায়। মোহন কলেজে আসার আগ পর্যন্ত পড়েছে মাদ্রাসায়, তার মৌলবি পিতার নির্দেশে। তাই `দেশে এমন মাদ্রাসা থাকতে পারে, মোহন কখনো ভাবতেই পারেনি। উজানগাঁ মাদ্রাসায় কখনো অ্যাসেম্বলি হতো না, কখনো জাতীয় সংগীত গাওয়া হতো না। কেননা গান-বাজনা ইসলামে হারাম। তা ছাড়া জাতীয় সংগীত তো হিন্দু কবির লেখা। হিন্দুর লেখা গান মাদ্রাসার ছাত্ররা গাইবে কেন? কাননডাঙা মাদ্রাসায় তার উল্টো চিত্র। স্কুল-কলেজের মতো প্রতিদিন অ্যাসেম্বলি হয়, পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে ছাত্ররা জাতীয় সংগীত গায়। কেউ গোল জোব্বা আর পাঁচ তালির টুপি পরে না। ছাত্র-শিক্ষক সবার পোশাক সাদা প্যান্ট কাটা পাঞ্জাবি। মোহন তো জোব্বা পরে সেই দশ বছর বয়স থেকে, যখন তাকে বাইশকোপ স্কুল থেকে এনে উজানগাঁ মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। (পৃষ্ঠা ১৫১)
এভাবেই এগোতে থাকে উজানবাঁশির আখ্যান। মোহন কলেজে এসে একাডেমিক বইয়ের চাইতে গুরুত্ব দিতে থাকে লাইব্রেরির বইগুলোকে। ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে। এই সংস্কৃত শ্লোকটির অর্থ, এই জগতে চিন্ময় জ্ঞানের তুল্য আর কিছু নাই। সেই চিন্ময় জ্ঞানরূপী কথিত ডাইনির ফাঁদে পড়ে মোহন পড়তে থাকে একের পর এক বিশ্বসাহিত্যের নানারকম বইপত্র। একসময় মোহন লেখালেখি করে। `মানুষের সাধনা` শিরোনামে সে লেখে, `মানুষ এক জীবনে সব কাজ নিজের জন্য করে না, বেশির ভাগই করে অপরের জন্য। মানুষের সবকিছুতেই ‘অপর’ জড়িত। লেখক যে লেখেন, গায়ক যে গান করেন, শিল্পী যে ছবি আঁকেন... এসবের পেছনের মূল কারণ অপর।
উজানবাঁশির নায়ক মোহনকে সবচে বেশি তাড়িয়ে নেয় প্রাচীন শিলালিপিতে খোদিত সংস্কৃত ভাষার একটি শ্লোক। এই শ্লোক ভারতবর্ষের কোন গ্রন্থে মুদ্রিত আছে তাও সে জানে না, এর অর্থ জানা তো দূরস্থান। অথচ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণে এটি তাকে জানতেই হবে। বহু বই পড়তে পড়তে একদিন মোহনের হাতে আসে শ্রীমদ্ভগবত গীতা। গীতার প্রথম তিন অধ্যায় পড়তে লেগে গেল সাতদিন। অষ্টমদিন শুরু করল চতুর্থ অধ্যায়, জ্ঞানযোগ। এখানে এসেই মোহন থমকে গেল। মোহন বিমূঢ়-বিহ্বল হয়ে গেল। পাওয়া গেছে সেই আরাধ্যের গুপ্তধন, প্রাচীন শিলালিপির সংস্কৃত শ্লোক, যার বাংলা অর্থ, তুমি যদি সমস্ত পাপীর থেকেও পাপিষ্ঠ বলে গণ্য হয়ে থাকো, তা হলেও এই জ্ঞানরূপ তরণীতে আরোহণ করে তুমি দুঃখ-সমুদ্র পার হতে পারবে। প্রবলরূপে প্রজ্বলিত অগ্নি যেমন কাষ্ঠকে ভস্মাৎ করে, হে অর্জুন! তেমনই জ্ঞানাগ্নিও সমস্ত কর্মকে দগ্ধ করে ফেলে। এই জগতে চিন্ময় জ্ঞানের মতো পবিত্র আর কিছুই নেই। এই জ্ঞান সমস্ত যোগের পরিপক্ব ফলাভগবদ্ভক্তি অনুশীলনের মাধ্যমে যিনি সেই জ্ঞান আয়ত্ব করেছেন, তিনি কালক্রমে আত্মায় পরাশান্তি লাভ করেন।
এর পরের ইতিহাস কৌতূহলী পাঠকমাত্রই জেনে নেবেন বা পড়ে নেবেন `উজানবাঁশি` উপন্যাস থেকে।