ছড়াসাহিত্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র জাহাঙ্গীর আলম জাহান

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুলাই ১৯, ২০২০

যাকে নিয়ে লিখতে গেলে মহাকাব্য সৃষ্টি হয়! যাকে নিয়ে লিখতে গেলে একের পর এক নান্দনিক ছড়ার উদাহরণ এসে যায়! যাকে নিয়ে লিখতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়া হয়ে যাই। যাকে নিয়ে লিখতে গেলে কিশোরগঞ্জের মানুষের মুখ মনে পড়ে যাই। যাকে নিয়ে লিখতে গেলে ছড়া উৎসবের কথা স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। তিনি আর কেউ নয়, তিনি গদ্য পদ্যে সমান পারদর্শী লেখক, সফল ছড়াকার, গুণী শিশুসাহিত্যিক, দক্ষ সংগঠক জাহাঙ্গীর আলম জাহান। আমার জাহান ভাই।

ছড়া আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি। সাহিত্য আকাশে যতদিন বাংলা ছড়ার জয়জয়াকার থাকবে, ততদিন জাহাঙ্গীর আলম জাহানের নাম থাকবে। যতদিন শিশুসাহিত্য থাকবে, ততদিন জাহাঙ্গীর আলম জাহান থাকবেন। যতদিন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা হবে, ততদিন জাহাঙ্গীর আলম জাহানের কথা মানুষের মনে পড়ে যাবে। অভূতপূর্ব অন্তমিলের দক্ষতা, ছড়ার গতিময়তা, নিত্য নতুন বিষয় নির্বাচন, তাকে সফল ছড়াকার করে তুলেছে। যে ক`জন ছড়াকারের প্রতিটি ছড়ায় অনন্য হয়ে উঠে, জাহাঙ্গীর আলম জাহান তাদের মধ্যে অন্যতম। তার অন্যান্য গুণের মধ্যে অন্যতম যে গুণটি সবার নজর কাড়ে সেটি তার অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা। তিনি তার নিজ শহর কিশোরগঞ্জে অসংখ্য সফল ছড়া সম্মেলন করেছেন। সৃষ্টিশীলতা, সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাকে সদা জাগ্রত রাখে।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান ভাইয়ের সাথে প্রথম কোথায় দেখা হয়, আজ আর সেটা মনে নেই। তবে যেটা মনে আছে, সেটা তার আতিথিয়তার কথা। কিশোরগঞ্জের ছড়া সম্মেলনের কথা। এ জীবনে যার কথা কখনোই ভুলতে পারব না। একরাশ মুগ্ধতার সাথে নিত্য ফিরে আসে সেসব স্মৃতি, স্মৃতির মনিকোঠায়। কয়েকমাস আগে পড়েছিলাম সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখের অধিকারী এই মানুষটির `ছড়া কত কড়ারে` বইটি। চুয়াল্লিশটি ছড়া নিয়ে এই বইটি মলাটবদ্ধ হয়েছে। বইটির সবগুলো ছড়াই উৎকৃষ্ট । এ বইটির প্রথম ছড়ার নাম `আমার অহঙ্কার`। তিনি লিখেছেন:

তোমার সাথে আমার
তফাৎ গায়ের জামার।
তুমি থাকো স্যুটেড-বুটেড
আমার ছেঁড়া শার্ট
আমি সরল-বোকার মতো
তুমি দারুণ স্মার্ট।

তোমার আছে অনেক টাকা
আছে বাড়ি-গাড়ি
তোমার সাথে টেক্কা দিতে
আমি কি আর পারি?

কিন্তু আমার যা আছে
তোমার কি ভাই তা আছে?
আমার আছে সৎ-সততা
নৈতিকতার জোর
তোমার মতো অসৎ কাজে
রাত করি না ভোর
কারণ আমার ভিত্তিভূমি
মহান একাত্তর।

একজন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পিতার সন্তান হিসেবে তার কাছ থেকে এ ধরনের ছড়াই প্রত্যাশিত। ছড়া চেতনায় কোন পক্ষের প্রতি তার কোন অনুকম্পা নেই। তিনি নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায় লেখেন। একজন লেখক হিসেবে এমন সৎ সাহস সবার থাকে না। জাহাঙ্গীর আলম জাহানের সেটা আছে। আমাদের ছড়া ভুবনে অনেকেই আছেন, যাদের ন্যূনতম ছন্দজ্ঞান নেই। ছন্দজ্ঞান না থাকাটা দোষের নয়, কিন্তু তারা সেটা অর্জনের কোন চেষ্টা করে বলেও মনে হয় না। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ভুল ছন্দে, ভুল অন্তমিলে, তারা দিব্যি লিখে চলেছেন।

আবার আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা নিজেদেরকে শিশু-সাহিত্যিক হিসেবে দাবি করে, অথচ তাদের লেখায় শিশু মনস্তত্ত্বের উপযোগী কোন বিষয় খুঁজতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। শিল্পী দিয়ে রঙিন ছবি আঁকিয়ে, রঙচঙা কভারে মলাটবদ্ধ হয়ে তাদের অপাঠ্য বই প্রতিবছর বাজারে আসে। চকচকে কাজ দেখে অনেক পাঠক সে বই কিনে প্রতারিত হন। তাদের উপর অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়ে ছড়াকার জাহাঙ্গীর আলম জাহান এ বইতে কয়েকটি ছড়া অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যার একটি ছড়ার নাম `হবু আর গবুরা`। তিনি লিখেছেন:

ছন্দের ন্যূনতম জ্ঞান নেই তবু
ছড়াকার হতে চায় হবু আর গবু।
যার যেটা কাজ নয় হতে চায় সেটা
বিড়ালকে যত তুমি কর লাঠিপেটা
তাই বলে বিড়াল কি হয়ে যায় বাঘ
গাধারাও কোনোদিন হয় নাতো ছাগ।

অতএব ছড়া নয় যার-তার কাজ
ছড়া নয় হবু আরও গবুর স্বরাজ।
ছন্দের সুনিপুণ কারিগর ছাড়া
হয় নাতো কোনোদিন ছড়া মনকাড়া
মনকাড়া ছড়া যদি লিখতে না-পার
হবু আর গবুরা ছড়া লেখা ছাড়ো।

`ছড়ার টিপস`, `গণ্ডার-বৃত্তান্ত` ও `লেখক-খ্যাতি` এ ধরনেরই আরো তিনটি ছড়া। এই ছড়া গুলোতেও তিনি চমৎকার ভাবে অছড়াকারদের নিয়ে লিখেছেন। `ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট` নিয়ে তিনি লিখেছেন:

যার নিজেরই ক্যারেক্টারের
ঠিক নেই,
চরিত্রে যার একটি ভালো
দিক নেই।
সেই ব্যক্তি সচ্চরিত্রের
ভান ক`রে,
ক্যারেক্টারের সার্টিফিকেট
দান করে।
অসৎ করে সৎ-সততার
সার্টিফাই,
তাই দেশটায় সবকিছুতেই
ডার্টি পাই।

ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেওয়া নিয়ে অনেক কথা অনেকের মুখেই শুনেছি। কিন্তু এমন একটি ছড়া কি কখনো পড়েছি? না, পড়িনি। এমন ছড়া জাহাঙ্গীর আলম জাহানই লিখতে পারেন। জাহাঙ্গীর আলম জাহানের অন্তমিল বৈচিত্র্যময়। তিনি লিখেছেন:

রিমোট হাতে টিভি`র প্রতি
সবাই করে ধিক জ্ঞাপন
অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে
ভাল্লাগে না বিজ্ঞাপন।

এই যে ধিক জ্ঞাপনের সাথে বিজ্ঞাপনের মিল আনা। এটা যে সে পারে না। তিনি পেরেছেন বলেই তিনি অনন্য। তিনি ছড়াঘাতে সমাজকে শুদ্ধ করতে চেয়েছেন। তার সে প্রচেষ্টা সফল হোক। ‘ছন্দ ছড়ায় বঙ্গবন্ধু’ জাহাঙ্গীর আলম জাহানের অসাধারণ একটি ছড়ার বই। বইটি পরপর চারদিনে চার বার পড়েছিলাম। ছন্দের কারুকাজ। অন্তমিলের চমৎকারিত্ব। সবমিলিয়ে জাহান ভাই এর লেখনির মুন্সিয়ানায় বইটি অবিনশ্বর হয়ে উঠেছে। বইটি প্রত্যেক বঙ্গবন্ধু প্রেমীর পড়া উচিত। বইটির প্রশংসা করার যথোপযুক্ত ভাষা আমার জানা নেই। বইটি আমি আবারও পড়তে চাই। পড়ে প্রাণের তৃষ্ণা মেটাতে চাই।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম ছড়াটি রচনা করেছিলাম। এরপর একে একে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রায় দুইশত ছড়া-পদ্য রচনা করেছেন তিনি। সেই ছড়া থেকে বাছাই করে ২০১৩ সালে `ছন্দ-ছড়ায় বঙ্গবন্ধু` এবং ২০১৭ সালে `জনক তুমি কনক-প্রভা` নামে দুটি বই প্রকাশ করেন তিনি। এবার মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে উল্লিখিত দুই বইয়ের লেখা এবং আরও কিছু নতুন লেখা নিয়ে `ছড়া-পদ্যে বঙ্গবন্ধু` প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

`দিঘির জলে জোনাক জ্বলে` জাহাঙ্গীর আলম জাহান ভাইয়ের একটি নান্দনিক শিশুদের ছড়ার বই। বইটি পড়েছিলাম এবং যথারীতি মুগ্ধ হয়েছিলাম। বইটি বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত। জাহাঙ্গীর আলম জাহানের ছড়া মানেই অনবদ্য কিছু। তিনি বাংলা ছড়াসাহিত্যের এক উজ্জ্বল প্রতিভা। তার এমন একটি ছড়াও নেই, যে ছড়াটিকে খারাপ বলা যায়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর মতো করে খুব কম ছড়াকার লিখতে পেরেছেন। তিনি যেমন বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে লিখেছেন, তেমনি বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী ও ভণ্ডদের ঘৃণা ছুড়ে দিয়েছেন।

বইমেলায় আমরা প্রচুর বই কিনছি। মান বিচার না করেই। কেউ যদি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মানসম্মত একটি ছড়ার বই কিনতে চান, তবে `মুজিবের নাম লিখে রাখলাম` বইটি কিনুন। আপনারা নিশ্চিত ঠকবেন না। অসংখ্য অছড়া-কুছড়ার ভীড়ে একটি অবিশ্বাস্য সুন্দর ছড়ার বই এটি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিবেদিত ছড়াগুচ্ছ- ‘মুজিবের নাম লিখে রাখলাম"। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অজস্র ছড়া লিখেছেন তিনি। ৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাই বইটি পড়লে। বইটিতে ৮৭টি ছড়া আছে। যার প্রত্যেকটি ছড়াই অতুলনীয়। তেমনি একটি ছড়া `বরপুত্র`

গান কবিতা কিংবা ছড়া
কোথায় মুজিব নেই?
মুজিব আছেন মধ্যবুকে
মনের সীমান্তেই।
হৃদয় কোণে-ফুলের বনে
পাখ-পাখালির গুঞ্জরণে-
ভরদুপুরে রাখাল ছেলের
উদাস করা সুরে
মুজিব আছেন খুব নিকটে
মন থেকে নয় দূরে।
ছলাৎ ছলাৎ বৈঠা-তালে
মাঝির গানে-নায়ের পালে-
মধুমতি পদ্মা গড়াই
তার নামে যায় বয়ে
মুজিব আছেন উদ্দীপনার
বরপুত্র হয়ে।
মুজিব মানে জাতির পিতা
স্বাধীন দেশের রচয়িতা-
বাঙালিকে তিনিই দিলেন
স্বপ্ন বোনার সূত্র
এই কারণেই ইতিহাসে
মুজিবই বরপুত্র।

`মুজিবের নাম লিখে রাখলাম` যেমন জাহাঙ্গীর আলম জাহানের একটি বই, তেমনি একটি ছাড়াও।

মুজিবের নাম লিখে রাখলাম
রক্তের প্রতি কণিকায়
শেখ মুজিবুর আজও ভরপুর
মানুষের মন-মণিকায়।

শুনে তার ডাক পৃথিবী অবাক
জাতি হয় উদ্বুদ্ধ
হয়ে যায় শুরু ঝড় গুড়ু-গুড়ু
বাঙালির জনযুদ্ধ।

সব হানাদার করে চুরমার
হই বিজয়ী যোদ্ধা
মুজিবের নাম তাই লিখলাম
নিয়ে সমুদয় শ্রদ্ধা।

`মুজিবের নাম লিখে রাখলাম` বইটির একটি নান্দনিক ছড়া এটি,

রক্তের ঋণ শোধ হয় না জানি
তাই তো আমি একটা কথাই মানি
আদর্শকে রাখতে গিয়ে উন্নত
যে লোকটা কথায় কথায় খুন হতো
সেই লোকটা আমার প্রিয় শেখ মুজিব
ইতিহাসে আজও যিনি চিরঞ্জীব।

শেখ মুজিবের রক্তঋণেই ঋণী
তাই শুধু তার আদর্শকেই চিনি
তার সে মহান বজ্রধ্বনির সুরে
আজও আমার হৃদয়-সমুদ্দুরে
উথালপাথাল ঢেউ ওঠে হুঙ্কারে
হায় এদেশে কে করে খুন কারে!

আমার বুকে ‘মুজিব-মুজিব’ ধ্বনি
মুজিব আমার দুই নয়নের মণি
মুজিব আমার রক্তে পাওয়া ভাষা
মুজিব আমার স্বপ্ন-ভালোবাসা।

বইটি আমি পড়েছি। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি। যিনি ছড়া বোঝেন, ছড়া ভালোবাসেন, বইটি পড়লে তিনি নিশ্চিত মুগ্ধ হবেন। প্রত্যেক ছড়াকারদের, বিশেষ করে নবীন ছড়াকারদের, যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখতে চান, তাদের বইটি পড়া অবশ্য কর্তব্য।

বইটি প্রকাশ করেছে, `গতিধারা`। মূল্য মাত্র ২০০ টাকা। বইটিতে ১২৯ টি নান্দনিক ছড়া আছে।

ধন্যবাদ জাহান ভাই। বইটি উপহার দিয়ে আপনি আমাকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছিলেন। আপনার ছড়া ছড়িয়ে যাক বিশ্বময়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তিনি অসংখ্য ছড়া লিখেছেন। তেমনি একটি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ছড়া `আলোর ছটা`

কী যে কঠিন দিন গিয়েছে পাইনি দিশা পথেরও
ঠিক তখনই মার্চ মাসের তারিখ ছিল সতেরো।
ওই তারিখেই টুঙ্গিপাড়ায় জন্মালো এক খোকা
ভীষণ জেদি, দেশ-দরদি, ডানপিটে-একরোখা।

বড় হয়ে সেই খোকাটিই গর্জে ওঠেন বিকট
স্বাধীনতার স্বপ্ন ছড়ান স্বদেশবাসীর নিকট।
স্বপ্নটা তার পূরণ শেষে করেই ছাড়েন তিনি
জাতির পিতা মুজিব নামে আমরা তাঁকে চিনি।

তাই সতেরো মার্চে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই গভীর
মুজিব মানে আলোর ছটা নতুন কোনো রবির।

`শেখ মুজিবের ডাক না পেলে` শিরোনামে জাহাঙ্গীর আলম জাহানের একটি লেখা আছে। সেখানে তিনি সত্য উচ্চারণ করে লিখেছেন,

তিনি যদি ডাক না দিতেন
কে ভাঙাতো নিদ্রা
কোথায় তখন ছিলেন বলুন
সে রাজনীতিবিদরা?

তাঁর বিরুদ্ধে মন্দ কথা
বলতো যারা যথা-তথা
সেই নেতারা ঘুম ভাঙানোর
দেননি তেমন চিৎকার
তারাই পরে প্রশ্ন তোলেন
মুক্ত দেশের ভিত কার?

শেখ মুজিবের বজ্রহাঁকে
পড়লো ঘাতক দুর্বিপাকে
তাই পালালো লেজ গুটিয়ে
আমরা পেলাম জয়
সেই কারণে শেখ মুজিবুর
জাতির পিতা হয়।

মুজিব ছাড়া স্বাধীনতা
পায় না জানি যথার্থতা
শেখ মুজিবের ডাক না পেলে
ছাড়তো না কেউ ঘর
মুজিব মানেই ছাব্বিশে মার্চ
ষোলই ডিসেম্বর।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক। বাঙালি পরিত্রাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা অনবদ্য একটি ছড়া এটি। তিনি আরেকটি ছড়া লিখেছেন `পথদিশারী` শিরোনামে।জাহাঙ্গীর আলম জাহান বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত। শহীদ পিতার সন্তান। `পথদিশারী` ছড়াটি তাই তার মতো লেখকের হাতেই রচিত হয়।

স্বাধীনতার ভিত্ রচনা হয়নি তো ভাই আচমকায়
সেই কাহিনী শুনলে পরে অদ্যাবধি গা` চমকায়।
দীর্ঘ দু` যুগ লড়াই করে
শেখ মুজিবুর একাত্তরে
যেই দিয়েছেন যুদ্ধে যাবার ঐতিহাসিক ডাক
অস্ত্র হাতে পুরো জাতি নামলো ঝাঁকে ঝাঁক।

লড়াই হলো সারা দেশে
অনেক ত্যাগে অবশেষে
আমরা পেলাম জয়
বীর বিজয়ী এই বাঙালি আর পরাধীন নয়।

মুজিব যদি জাতির পিতা ভয় কি তবে আর?
তিনিই হলেন পথদিশারী এই জাতিসত্তার।

বঙ্গবন্ধুকে, স্বাধীনতা, নিয়ে যেমন তিনি লিখেছেন। তেমনি বঙ্গবন্ধুকে পূঁজি করে যারা চলে, তাঁকে অবলম্বন করে যারা দুষ্ট বুদ্ধি আটে , জাতির পিতার নামের সুবিধা নিতে চায় যারা। সেই সব রঙ বদলের বহুরূপী, সুবিধাবাদী মানুষদের নিয়ে তিনি লিখেছেন `বাস্তবতা` নামের ছড়া।

দেশে প্রচুর লীগ বেড়েছে, যায় না পথে পা` ফেলা
যেদিক তাকাই দেখি শুধু নব্য লীগের কাফেলা।
অন্য কোনো দল দেখি না, দেখি মুজিব কোট বেশি
সব জা`গাতেই নব্য লীগের দাপট এবং চোট বেশি।

হাল-হকিকত খুব ভালো না, লক্ষণও নয় সুস্থ রে
প্রধান নেতা বাস্তবতা আজকে যদি বুঝতো রে!
লাগাম টানা খুব জরুরি, টানবে লাগাম লোক কই?
সবাই দেখি এক কাতারে- নব্য লীগের পক্ষই।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান `তলে তলে` শিরোনামে পঁচাত্তরের ঘাতক মোস্তাকদের মতো ধামাধরা কিছু ছদ্মবেশীদের নিয়ে লিখেছেন একটি ছড়া।

এই সমাজে আছে কিছু
মানুষ নামের কু-জীব
তাদের মুখেই ঘন ঘন
শুনছি `মুজিব-মুজিব`।

এরা মুজিব ভক্ত না
ভিত্তি এদের শক্ত না

গা` বাঁচানোর জন্য এরা
উঠলো এসে নায়ে
তলে তলে এরাই থাকে
ক্ষতির অভিপ্রায়ে।

`দুলকি চালে ফুলকি ছড়া` জাহাঙ্গীর আলম জাহানের রাজনৈতিক ও সমাজ সচেতনতামূলক একটি প্রতিবাদী ছড়াগ্রন্থ। বইটিতে ৫৮ টি ছড়া মলাটবদ্ধ হয়েছে। বহুমাত্রিক বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে এ বইটির এক একটি ছড়া। বইটির প্রথম ছড়াকবিতার নাম `কবির বৈশিষ্ট্য` সেখানে তিনি লিখেছেন-

কবিদের টাকা নেই
বাড়িঘর পাকা নেই
সৃষ্টির তাড়নায়
সুখ ঝাকানাকা নেই।

কবিদের লোভ নেই
অকারণ ক্ষোভ নেই
সাধনার ক্ষেত্রে
তার শনি-রোব নেই।

কবিদের ভয় নেই
মিছে পরাজয় নেই
তার যত সৃষ্টির
ক্ষয় নেই, ক্ষয় নেই।

কবিদের কী কী নেই?
প্রাণে ঝিকিমিকি নেই
বই-টই লিখলেও
সেই বই বিকি নেই।

কবিদের কিছু নেই
তবু তার পিছু নেই
সঙ্কটে কবিদের
শিরদাঁড়া নিচু নেই।

কবিদের নিয়ে একটা দারুণ মূল্যায়ন, এমন স্পষ্ট সত্য, এমন সোজা কথা, ক`জন বলতে পারে বলুন তো? সবাই পারে না, জাহাঙ্গীর আলম জাহান পারে। তিনি পারে বলেই ছড়া সাহিত্যে তিনি অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করছেন।

এই বইটিতেই তিনি লিখেছেন `এই দেশ আমাদের` নামে একটি চমৎকার ছড়া।

এই দেশ আমাদের
নয় ভীরু গামাদের
নয় কোনো চাটুকার, ধামাধরা চামচার
এই দেশ হবে না তো গাধা আর রাম ছা’র।

এই দেশ সমতার
সম্প্রীতি মমতার
নয় কোন ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আটকা
ফুল-ফল, নদী-জল অবিরল টাটকা।

এই দেশ কর্মের
যার যার ধর্মের
মসজিদ-দেবালয়-মন্দির-গীর্জার
এই দেশ শুধু তার--উন্নত শির যার।

`দুলকি চালে ফুলকি ছড়া` বইটিতে তার `অবাক প্রশ্ন` লেখাটি আমাকে হাসিয়েছে। তিনি লিখেছেন-

ছোট্ট ছেলের কৌতুহলের
নেই যে অাদি-অন্ত
এটা-ওটা প্রশ্ন মাকে
করবে সারাক্ষণ তো।

সেদিন ছেলে প্রশ্ন করে
মায়ের কাছে এসে
ঈদুল ফিতর হচ্ছে কি মা
আজকে সারা দেশে?

মা বললেন- না তো বাছা
ঈদ কেন আজ হবে!
বলল ছেলে- ঈদ না হলে
আমায় বল তবে-
বাবা কেন পাশের বাড়ির
আন্টিমণির সাথে
আজ সকালে কোলাকুলি
করল নিরালাতে?

মা হারালেন খেই-
কিছু কিছু প্রশ্ন আছে
জবাব জানা নেই।

হা হা হা, না হেসে উপায় আছে। এধরণের হাস্য পরিহাসে পরিপূর্ণ অপূর্ব ছড়া-কবিতার মিশেল ঘটেছে বইটিতে।

"দুলকি চালে ফুলকি ছড়া" বইয়ের আরেকটি ছড়া এমন-

বৃষ্টি বুঝে ছাতা ধরার
ফন্দি করিস আবিষ্কার
বল তাে শুনি সােনামণি
রাষ্ট্রটাকে ভাবিস কার ?

রাষ্ট্র কিরে পিতৃ তালুক
নাকি দাদার জোতদারি
পরের ধনে আর কতকাল
করবি তােরা পােদ্দারি ?

স্বার্থ বুঝে দেশের প্রেমে
যতই ভায়া হও কাতর
পাবলিকেরা ঠিক বুঝেছে
জারিজুরি , মওকা তাের ।

মওকাবাজি ছাড় বাবাজি
ধান্দাবাজির দিন নাই
তােদের নামে জনমনেও
বাড়ছে কেবল ঘিন্নাই ।

তোষামোদকারীদের, চাটুকারদের নিয়ে লেখা কী অনবদ্য ছড়া এটি! যারা গিরগিটির মতো রঙ বদলায়, যারা সুবিধা বুঝে রূপ বদলায়, তাদের জন্য চপেটাঘাত এই ছড়াটি।

একই বইতে তিনি "খাপছাড়া" ছড়ায় লিখেছেন-

"আয় বেড়েছে যেমন তেমন
ব্যয় বেড়েছে খাপছাড়া
ঠান্ডা জলে চাল ফোটে না
আগুন এবং তাপ ছাড়া ।

তাই বাজারে আগুন দিয়ে
মূল্য বাড়ায় মাপ ছাড়া
এই অরাজক পরিস্থিতি
কমবে নাতাে চাপ ছাড়া ।

চাপে চাপে দেশের মানুষ
হচ্ছে এতিম বাপ ছাড়া
পরিস্থিতি বদলাবে না
খােদার অভিশাপ ছাড়া ।

খোদার অভিশাপ ঠিকই পড়েছে। দেশে কোভিড-১৯ এসেছে। কিন্তু পরিস্থিতি কি বদলেছে? বদলায়নি, বদলাবে না। জাহাঙ্গীর আলম জাহানেরা লিহে যাবেন, আমরা পড়ে যাব। ব্যাস এতটুকুই। আমাদের দুর্দমনীয় লোভ, আমাদের মূল্যবোধহীনতা, আমাদের অনৈতিকতা, আমাদের মই ধরে বড়লোক হবার মানসিকতা আমাদেরকে বদলাতে দেবে না।

তিনি "সাচ্চা গণতন্ত্র" ছড়ায় লিখেছেন এভাবে-

বাবার কাছে প্রশ্ন রাখে
ছােট্ট মেয়ে অর্পা কর
সব আমলে পুলিশ কেন
করে এত ধরপাকড় ?

সব বিরােধী কর্মী - নেতা
থাকেন কেন টার্গেটে ?
বাবা বলেন - এসব বিষয়
কী প্রয়ােজন আর ঘেঁটে ?

অর্পা বলে - যখন যারাই
এই দেশে যায় ক্ষমতায়
কেন তারা কেউ থাকে না
নিয়ম মানার সমতায় ?

বাবা বলেন - এটাই হলাে
সরকারি মূলমন্ত্র মা
আমার দেশে একেই বলে
সাচ্চা গণতন্ত্র মা ।

এটি তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ একটি ছড়া। `রাজা আসে রাজা যায়, ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যায়`। এ কথটিই যেন নতুন করে বলেছেন তিনি।

কবি এই বইটিতে লিখেছেন -

হুজুর , আমি কুকুর শাবক
আপনি আমার অভিভাবক
কিংবা আমার বাপ ,
হুজুর বলেন - বেশ বলেছিস
মিলছে খাপে খাপ ।

কুকুর ছানার পিতা হলে
আমি নিজে কী তাহলে ?
কুত্তাই তাে , নাকি ?
তুই আমাকে কুত্তা বলার
রাখিসনি তাে বাকি ।

কথার প্যাচে কুকুর বলা
বিষয়টা নয় ফানি
মানুষ এখন ককুর - সমান
জঘন্য এক প্রাণী ।

বইটি প্রকাশ করছে গতিধারা। মূল্য ২০০ টাকা। চমৎকার এ বইটি ছড়াপ্রেমীদের মুগ্ধ করবেই। মুগ্ধ না করলে বুঝতে হবে, যে পড়ছে, সে রামগরুড়ের ছানা।

তিনি একবার শাহবাগ গণগ্রন্থাগার পার হয়ে ফুটপাত ধরে টিএসসি`র দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ফুটপাতে বসা বইয়ের পসরার মাঝে নিজের লেখা `ট্যাক্সো ছাড়া একশো ছড়া` বইটি দেখে থমকে দাঁড়ালেন। এখানে এই ফুটপাতের দোকানে তার বই এলো কোত্থেকে! কাছে গিয়ে বইটি হাতে তুলে নিলেন। পাতা উল্টিয়েই জাহাঙ্গীর আলম জাহানের আক্কেলগুড়ুম। মনে মনে বলে উঠলেন, `হায় আল্লা!` দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় ছড়াকারকে নাম লিখে বইটি উপহার দিয়েছিলেন তিনি। সেই বই তার ঘর ছেড়ে এই ফুটপাতে এলো কী করে! তিনি যে বইটি না পড়েই পরিত্যক্ত কাগজের সাথে হকারের কাছে সের দরে গছিয়ে দিয়েছেন সেটি বুঝতে আর বাকি থাকলো না লেখকের। তিনি মনে মনে বুঝে নিলেন, বড় লেখকদের কাছে তার মতো মফস্বলীয় লেখকরা কতটা অপাঙক্তেয় হলে, উপহার দেয়া বই তারা ফুটপাতে চালান করে দেন সেটি আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই! সেই থেকে বড় লেখক ও কথিত সেলিব্রেটিদের আর বই-টই দিতে মন চায় না তার। দেয়ও না। তার মনে হলো এরা একেকটা বজ্জাতের হাড্ডি।

এরপর থেকে যারা তার বইয়ের প্রকৃত পাঠক। তাকে সম্মান করে, তার গুণমুগ্ধ, তিনি তাদেরকেই বই পাঠাতেন। আমার মতো পরিচিত অনেকেই তার বই পেয়েছে। আমি যেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার বই পড়ি, নিশ্চয় তারাও একইভাবে জাহাঙ্গীর আলম জাহানের বই পড়ে মুগ্ধ হয়।

বহুমাত্রিক ছড়ার সংকলন- ‘কাননে কুসুমকলি’। বইটি পড়ে আমি যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছি। ৪২টি রঙবেরঙের ছড়া দিয়ে সাজানো ‘কাননে কুসুমকলি’ বইটির ভালো লেগেছে প্রত্যেক’টি ছড়া। প্রথম ছড়াটির নাম `জীবনপদ্য`

জীবন মানে ছুটে চলা, জীবন মানে গতি
জীবন মানে ফুলের টানে মুগ্ধ প্রজাপতি।
অর্ধ জীবন যায় ঘুমিয়ে, অর্ধ জীবন কাজে
ধন্য জীবন হতে পারে পরের হিতের মাঝে।
জীবন মানে আলস্য নয়, কর্মমুখর থাকা
জীবন মানে বোধ-চেতনা খুব শাণিত রাখা।
সরল সোজা শুদ্ধ পথে বিবেক নিয়ে চলা
সত্য এবং ন্যায়ের কথা বুক ফুলিয়ে বলা।
জীবন মানে মানবতা আর মানবিক বোধ
জীবন মানে মনের থেকে দূর করা সব ক্রোধ।
হিংসা-বিভেদ-অহঙ্কারের খোলস খুলে ফেলা
কারও প্রতি নয় অকারণ তুচ্ছ অবহেলা।
জীবন মানে সবার প্রাণে উচ্ছলতার ঢেউ
জীবন মানে কারও কাছেই নগন্য নয় কেউ।
সবাই মানুষ সবার প্রতি শ্রদ্দা-ভালোবাসা
নিজের কাছে বারেবারে নিজের ফিরে আসা।
জীবন মানে কাব্য-গানে অনুক্ত সেই কথা
জীবন মানে শেকল ভেঙ্গে মুক্তি স্বাধীনতা।
সবার আগে মানুষ এবং সবার ওপর মানুষ
জীবন তো নয় অবহেলার তুচ্ছ কোনো ফানুস।
জীবন মানে সসম্মানে বেঁচে থাকার লড়াই
জীবন মানে মানুষ হয়ে মানুষ থাকার বড়াই।
এক জীবনেই সাফল্যকে হাতের মুঠোয় আনা
মানবজীবন ধন্য জীবন তবেই ষোল আনা।

`এই চিঠিটা` কাননে কুসুমকলি বইয়ের একটি অপূর্ব ছড়া। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ পিতাকে নিয়ে সন্তানের মনের অনুভূতি মেশান একটি লেখা। লেখাটি সেই সন্তানের, যে পিতার লাশটি পর্যন্ত পায়নি।

এই চিঠিটা লিখছি বাবার নামে
বাবা তুমি ফিরবে কবে ঘরে
জবাব লিখো ফিরতি কোনো খামে--
প্রাণ দিয়েছো কোথায় একাত্তরে?

লাশটি তোমার পাইনি খুঁজে বাবা
পাওনি তুমি এক কবরের মাটি
দুই চোখে তাই অগ্নিগিরির লাভা
ধারণ করে হলাম জীয়নকাঠি।

বাবা তোমার রক্ত দিয়ে কেনা
এই পতাকা এবং স্বদেশ ভূমি
রাখতে হবে অকুতোভয় সেনা
লাল-সবুজে জড়িয়ে আছো তুমি।

মুক্তিসেনা হে প্রাণাধিক প্রিয়
এই চিঠিটা বাবার হাতে দিও।

`কাননে কুসুমকলি` বইটিতে `কাননে কুসুমকলি` নামে একটি ছড়া আছে। কবি দেশকে নিয়ে ভাবেন। দেশের চিন্তা করেন। দেশের অতীত বর্তমান নিয়ে কবির ভাবনা ফুটে উঠেছে এই লেখাতে।

অপরূপ ছিল আমাদের দেশে
শান্তির সুবাতাস ছিল পরিবেশে
বনে বনে পাখিদের ছিল কলতান
দেশটাকে মনে হতো স্বর্গ-সমান।

ছায়ময়-মায়াময় এ আমার দেশ
বায়ু ছিল নির্মল, সুশীতল ফ্রেশ
সকলের সাথে ছিল সকলেরই মিল
প্রাণে প্রাণে সুখ ছিল কত অমলিন!

আমাদের দেশ ছিল সুখে ভরপুর
মনে ছিল সুবাসিত ধূপ-কর্পূর
কাননে কুসুমকলি সুবাস ছড়ায়
রূপময় দেশ ছিল বসুন্ধরায়।

ভরাট করেছি খাল, বিল-ঝিল কত
দূষণে দূষণে নদী বিষে পরিণত
উজাড় করেছি বন, বৃক্ষের সারি
এই দেশ নেই আর সেই মনোহারি!

আমাদের এই দেশ সেই দেশ নাই
সুখময় শান্তির দেশ ফিরে চাই
কাননে কুসুমকলি আবার ফুটুক
আলোর ঝলকে ফের সূর্য উঠুক।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা এক অপূর্ব ছড়া এটি। তিনি `আমার স্বাধীনতা` শিরোনামে ছড়াটির শেষের অংশে লিখেছেন,

সেই ছেলেদের ত্যাগের ফসল আমার স্বাধীনতা
যাইনি ভুলে সেই স্মৃতিময় একাত্তরের কথা।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এক অনন্য অনুভূতি। সাধারণ লেখকদের থেকে ভিন্ন মেজাজের ছড়া লেখেন তিনি। তিনি চমৎকার অন্তমিল দিয়ে `বৃষ্টির পরশে` ছড়ায় রচনা করেছেন এই দুটি পঙক্তি,

ঝরঝর আষাঢ়ের অবিরাম এ ধারায়
অপরূপ রূপ দেখি বসে বসে কেদারায়।

আবার তিনি `ও চাঁদ` ছড়া টির অন্তমিলে অভিনবত্ব এনে লিখেছেন,

ও চাঁদ তুমি নীল আকাশের কন্যা কি
হারিয়ে যাওয়া আমার ছোট বোন নাকি?

জাহাঙ্গীর আলম জাহান প্রচুর সমকালীন ও রাজনৈতিক ছড়া লিখেছেন। একজন সমাজ সচেতন, একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ হিসেবে তিনি যে এ ধারায় ছড়া লিখবেন, সেটা অাশ্চর্য হবার কিছু নেই। আশ্চর্য হতে হয় তার ছড়ার বিষয় বৈচিত্র ও নান্দনিকতা দেখে। তিনি `সরল বয়ান` ছড়ায় লিখেছেন।

বলতে কোনো বাধা নেই
আমার দেশে গাধা নেই
যা আছে তা ছাগল,
কিছু আছে ধূর্ত শেয়াল
আর বাকিরা পাগল।

পাগলগুলো ছাগল পোষে
আর জনগণ আঙুল চোষে
মুরগি ধরে শেয়াল,
দায়িত্ববান হিজড়াগুলোর
নেই সেদিকে খেয়াল।

আমরা এমন দুর্ভাগা যে
এসব নিয়েই আছি,
রাতের বেলা মারছি মশা
দিনের বেলা মাছি।

তিনি `রাজনীতির পলিটিক্স` নামে একটি ছড়ায় লিখেছেন,

তেলের সাথে জল মেশালে
হয় না যেমন মিক্স,
রাজনীতিতে তেমন করেই
ঢুকলো পলিটিক্স।

সেই পলিটিক্স রাজনীতিতে
খবরদারি ফলায়,
এক হাঁড়িতে ঝগড়া চলে
আদা ও কাঁচকলায়।

রাজনীতিতে নেইতো নীতি
বাড়ছে কথার দূষণ,
নোংরা পলিটিক্স-ই এখন
রাজনীতিকের ভূষণ।

ভুল পলিটিক্স ঢুকল যেদিন
রাজনীতিতে প্রথম,
সেদিন থেকেই সুস্থ ধারার
রাজনীতি হয় খতম।

এরকম করে চপেটাঘাত ক`জন করতে পারে।ক`জন বলতে পারে সত্য। ক`জন লিখতে পারে `গাধাকাহন`

ঘোলা করে তারপর
জল খায় গাধারা,
কার গুণ কী রকম
চেনা যায় তা দ্বারা।

এক কান কাটা যার
হাঁটে নতশিরে সে,
দুই কান কাটা হলে
চলে ঘুরেফিরে সে।

চোখে যার লজ্জার
নেই ছিটেফোঁটাও-
হয় না সে বিব্রত,
দাও যত খোঁটাও।

কাদা মেখে গাধারাই
সেরা আজ সমাজে,
দেখেশুনে বুকে আজ
ঘৃণা হয় জমা যে!

ঘৃণা জমা হচ্ছে জাহাঙ্গীর আলম জাহানের বুকে। সেই জমাকৃত ঘৃণা থেকেই বেড়িয়ে আসছে `নিজের ঢোল` নামক ছড়া,

অনেক জ্ঞানী মানুষ তুমি-
পাও না তবু দাম?
নো চিন্তা, শোনো তোমায়
ফর্মুলা বললাম।

দাম আদায়ে করতে হবে
গোপন চটকদারি,
নিজের হাতে নিজের ঢোলে
জোরসে মারো বাড়ি।

দেখবে তবে তোমায় নিয়ে
করবে সবাই গোল,
বুদ্ধি করে নিজেই যদি
বাজাও নিজের ঢোল।

ঢোলক বাজাও মাত্রা বুঝে
বুদ্ধি কিছু এঁটে,
পরের হাতে ঢোল দিও না-
যেতেও পারে ফেটে।

তিনি অফিসের ঘুষের কারবার দেখে, নৈতিকতা বর্জিত মানুষ দেখে, অসৎ মানুষের অাস্ফালন দেখে লেখেন `লালচান` নামক ছড়াটি,

অফিসের লালচান
সব কাজে মাল চান
নীতিকথা কপচান
দুনিয়ার সব চান
নাম চান দাম চান
যাকে-তাকে খামচান।

রিলিফের টিন চান
বিনা সুদে ঋণ চান
মুরগির রান চান
আর অনুদান চান
কাবিখার গম চান
চায়ে চিনি কম চান।

অফিসের লালচান
রিলিফের চাল চান
হাল চান জাল চান
স্বপ্নেও মাল চান।

এরকম অজস্র সমকালীন ও রাজনৈতিক ছাড়া ছড়িয়ে আছে জাহাঙ্গীর আলম জাহানের লেখনিতে।

`সুদূরপ্রসারী` ছড়ায় জাহাঙ্গীর আলম জাহান লিখেছেন,

অযোগ্যরা যোগ্য চেয়ার
নির্বিবাদে দখল নেয়ার
করছে নানান চেষ্টা
সেই কারণে উচ্ছন্নে
যাচ্ছে বুঝি দেশটা।

এডিস মশা যেমন করে
ডেঙ্গু ছড়ায় ঘরে ঘরে
না টানালে মশারি
অযোগ্যরা তেমনি বাড়ায়
কষ্ট সুদূরপ্রসারী।

একইভাবে `তিক্তকথা` ছড়ায় জাহাঙ্গীর আলম জাহান যেন ছড়ার ঘায়ে দুষ্টদের চাবুক পেটা করেছেন। তিনি লিখেছেন,

পত্রিকাতে নিয়মিতই ছাপছে তোমার ছড়া
তাই ধরাকে ভাবছো তুমি সরা
তোমায় নিয়ে কী আর যাবে করা!

গাছের সাথে মাছ মিলিয়ে
ভাতের সাথে হাত
ভাবছো তুমি ছড়া লিখেই
করছো বাজিমাৎ।

কিন্তু ছড়া নেই যে আগের ধাঁচে
সে বিষয়ে খেয়াল তোমার আছে?

ছড়ার সাথে তাল মিলিয়ে
চলতে শেখো আগে
তবেই-না ভাই সুনাম পাবে ভাগে।

পত্রিকাতে ছাপছে বলে ঢেঁকুর যদি তোল
তবেই তোমার অকাল মরণ হলো।

তিনি `সরল বিশ্বাস সমাচার` ছড়ায় বিদ্রুপ করেছেন ভন্ডদের। জাহাঙ্গীর আলম জাহানের এই বিদ্রুপে নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে ভন্ডদের পিতা-প্রপিতামহের কাছ পর্যন্ত। তখন কি তারা এর অর্থ বুঝতে পারবে? জানি না। বুঝতে পারলে ভালো। না পারলেও ক্ষতি নেই।

এই কথাটি বলতে পারি
নির্ভয়ে এক নিশ্বাসে-
আকাম আমি যা করেছি
সবই সরল বিশ্বাসে।

এসব কথা বলার আগে
সুগন্ধিটা দিস শ্বাসে
তবে আকাম বৈধ হবে
করলে সরল বিশ্বাসে।

দুষ্কর্মের কামাই-রুজির
চাইবে নাকো হিস্যা সে
গা ভাসালেও দুর্নীতিতে
করবে নাতো ঈর্ষা সে।

মানুষ সত্যি সত্যিই `আজব প্রাণী` এই আজব প্রাণী মানুষের বিচিত্র চরিত্র নিয়ে জাহাঙ্গীর আলম জাহান লিখেছেন,

কী যে ভীষণ শ্রদ্ধা জানাও সামনে এসে দাঁড়ালে
তুমিই আবার মুখ বাঁকিয়ে নিন্দা করো আড়ালে।
অবাক করা এই আচরণ দেখায় যারা দুই রূপে
হৃদয় জুড়ে তারাই ঢোকে ছোট্ট অতি সুঁই রূপে।

মওকা বুঝে দাঁড়ায় এরা সব মানুষের কাল হয়ে
সুঁইয়ের মতো ঢোকার পরে বেরোয় বড় ফাল হয়ে।
মানুষ বড়ই আজব প্রাণী, চরিত্র তার ভয়ানক
পাঁচ আঙ্গুলে খামচি দিতে তৈরি রাখে নয়া নখ।

কিছুদিন আগে পাশের দেশ পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে হঠাৎ অসাধু ব্যাবসায়িরা কারসাজি করে পেঁয়াজের দাম অাগুণ মূল্য করে ফেলে। তখন তিনি `দ্বন্দ্বকথা` শিরোনামে একটি ছড়া লেখেন। সেখানে জাহাঙ্গীর আলম জাহান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে লেখেন,

জিনিসপাতির দাম বাড়লেই
হয় কিছুদিন চেঁচামেচি
অধিক দামে সেই জিনিসের
চলতে থাকে বেচাবেচি।

দাম বেড়েছে বলেই কি আর
বন্ধ থাকে কেনাকাটা?
যে যার মতোই সবাই কেনে
কণ্ঠে বেঁধার চেনা কাঁটা।

সেই কাঁটাটাই বিঁধলে গলায়
কিছুদিনেই গা সয়ে যায়
বাড়তি দামের বাজার দরও
জনমতেই পাশ হয়ে যায়।

পেঁয়াজ মশায় সেই যে কবে
দাম বাড়িয়ে আর নামে না
ভোক্তাগণের মাথা থেকেও
বাড়তি চাপের ভার নামে না।

তাই বলে কি পেঁয়াজ খাওয়া
কেউ রেখেছে বন্ধ আজও?
খাবো নাকি ছাড়বো পেঁয়াজ
চলছে গোপন দ্বন্দ্ব আজও।

প্রকৃত ছড়াকাররা সংকট কালে ও জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বাক পরিবর্তনের সময়ে ছড়া লিখে থাকেন। ছড়ার ঝংকারে প্রতিবাদ করেন। মানুষের মনে প্রতিবাদের প্রেরণা যোগান। মানুষের সামনে সত্য উন্মোচন করেন। মানুষকে সত্য চিনতে সাহায্য করেন।
`ওই চোরারাই` ছড়ায়, ছড়াকার জাহাঙ্গীর আলম জাহান কোভিড-১৯ এর সময় অসৎ ব্যাবসায়ী, মুনাফালোভী, প্রতারকদের নিয়ে লিখেছেন,

কেমন দেশে আছি রে ভাই কেমন দেশে থাকি
জন্মগত চোরের স্বভাব কী দিয়ে অাজ ঢাকি?
মরণব্যাধির হরণ খেলায় দেশটা যখন নাকাল
নিম্নআয়ের সব মানুষের সামনে যখন আকাল
মহামারির ভাইরাসে আজ বাতাস যখন ভারী
তখনও কি চুরির স্বভাব পাল্টাতে ভাই পারি?
আমরা মহাচোরের জাতি
সব বিষয়েই আত্মঘাতি
মরার আগেও চুরির নেশা যায় না স্বভাবদোষে
আমরা যখন চুরি করি সবাই আঙুল চোষে।
কেমন দেশে আছি রে ভাই কেমন দেশে বাস
দেশের জন্য ওই চোরারাই করোনা ভাইরাস।

একদম সত্য লিখেছেন তিনি। সত্য উন্মোচন করেছেন তিনি। জাতীয় জীবনে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি হচ্ছে করোনা ভাইরাস। মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ীরাই হচ্ছে করোনা ভাইরাস। চোরেরাই হচ্ছে বড় করোনা ভাইরাস।

জাহাঙ্গীর আলম জাহানের শিশু-কিশোর উপযোগী ছড়ার পরিমান অনেক। গুণে মানে অদ্বিতীয়। শিশু-কিশোরদের মনের ঠিকানা রাখেন তিনি। শিশুরা পড়ে মুগ্ধ হয়। একইভাবে ছোটদের ছড়াগুলোয় যখন বড়রা চোখ বুলায়, তখন বড়রা হারিয়ে যায় ফেলে আসা শৈশবে। `মেঘকাব্য` জাহাঙ্গীর আলম জাহানের তেমনি একটি মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাওয়া ছড়া।

আকাশ পাড়ে মেঘমেয়েরা ধরে কত রূপ
কখনও সে শান্ত-সুবোধ, এক্কেবারেই চুপ
দেখবে হঠাৎ মেঘ যেন নয়-
মস্ত হাতির শূড়
কী যে বলেন, ধুর!
আজ আকাশে মেঘ বানালো
জলের সমুদ্দুর।

ঐ যে দ্যাখো
সাদা-কালো মেঘের আশেপাশে
রবীন্দ্রনাথ হাসে
বাবরি মাথা নজরুলেরও সেই চেহারা ভাসে।

আরে না-না, ঐ দেখা যায় লম্বা বেণি চুলের
গরম জামা উলের
ধুত্তুরি ছাই! ওটা চাদর নকশি আঁকা ফুলের।

মেঘ উড়ে যায় দূর নীলিমায়
মেঘের কতই রূপ
কে করেছে আকাশ পাড়ে মেঘের দলা স্তুপ?

মেঘের চাপায় সূর্য ঢাকা, নেই রৌদ্রের দেখা
তাইতো একা একা
ভাবুক কবির মেঘকাব্য চলছে আজও লেখা।

নদী ভাঙনে সব হারানো পথশিশুদের অাত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি লিখেছেন `হার না মানা সাহস`।

কিরে তোর বাড়ি কই রোদে কেন ঘুরছিস
গনগনে সূর্যের তাপে কেন পুড়ছিস?
বাড়ি ছিল যমুনার ওই পাড়ে এক গাঁয়
তাই পাই নদীভাঙা ভবঘুরে ট্যাগ গা`য়।

আরে শোন ভাই-বোন পিতা-মাতা নেই তোর
ফুটফুটে ছেলে তুই, দশা কেন এই তোর?
যার নেই বাড়িঘর এই দশা তারই হয়
টের পায় সে কেবল এ-রকম যারই হয়।

যমুনার ভাঙনেই গেছে সব আমাদের
এই নিয়ে মাথাব্যথা নেই ওই গামাদের।
গামা মানে ধনবান সেইসব খান্নাছ
ক্লাবে গিয়ে যারা করে হইচই, গান-নাচ।

তারা নয় মানবিক, নেই মনে করুণাই
ধনীদের ধ্যান-জ্ঞান এতটুকু সরু নাই।
তাই ওই ব্যাটাদের ধার-টার ধারি না
ভেঙে যাই তবু ভাই মচকাতে পারি না।

`ইচ্ছে করে গাঁয়ে যেতে` জাহাঙ্গীর আলম জাহানের শহরের শিশুদের মনস্তত্ত্বকে অবলম্বন করে লেখা। শহরের শিশুরা খাঁচায় বন্দী পাখিদের মতো। উড়তে পারেনা, ঘুরতে পারে না, নিজের ইচ্ছা মতন। তিনি শিশুদের মনের কথা, মুখের কথা তুলে এনেছেন তার লেখায়।

কিচ্ছু আমার ভাল্লাগে না, মনটা উড়ু উড়ু
কী যে হলো শুরু-
মনের ভেতর বাজে শুধু মেঘের গুড়ুগুড়ু।

ইচ্ছে করে শহর ছেড়ে গ্রামের ছেলে হই
গ্রামেই পড়ে রই-
ভাল্লাগে না এই শহরের অসহ্য হইচই।

কোথায় যাবো
কোথায় পাবো
মন রাঙানোর রং
বিদ্যালয়ের ঘণ্টা বাজে দুই কানে ঢং ঢং।

বইয়ের পড়া
কাব্য-ছড়া
অংক-ভূগোল পাঠ
ভালোই লাগে; তবু মনের যাচ্ছে না বিভ্রাট।

বাইরে যাবার সুযোগ পেলে
উড়তে পেতাম পাখনা মেলে
মনের জমা ঘুণগুলোকে
করতে পেতাম সাফ
ইচ্ছে করে তালপুকুরে একটু দিতে ঝাঁপ।

আমার মনের সাধগুলোকে
কেউ বোঝে না, তাই
ইচ্ছে করে গাঁয়েই ফিরে যাই।

ইচ্ছে আমার ধানের মাঠে মন উড়িয়ে হাঁটি
ভালো লাগে সবুজ গাঁয়ের
অবুঝ অবুঝ মাটি।

তিনি `চুপ চুপ` শিরোনামে শিশু-কিশোরদের উপদেশ দিয়ে লিখেছেন একটি ছড়া। জাহাঙ্গীর আলম জাহান যেমন শিশুদের পাখির মতো মুক্ত হতে বলেছেন, তেমনি লেখাপড়ায় সচেতনও জগতে বলেছেন। পাশাপাশি স্রষ্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাস স্থাপনের কথাও বলেছেন।

চুপ চুপ কথা কম কলি জেগে উঠবে
এইবার বাগানের ফুলগুলো ফুটবে
থাম থাম কাজ-কাম আপাতত রাখ-না
পাখিদের ছানাগুলো মেলবেই পাখনা
দূর ছাই ভালো নাই এই পোড়া মনটা
ইশকুলে চারটায় বাজাবেই ঘণ্টা
চুপ চুপ কথা কম এক্সাম সামনে
পাস যদি পেতে চাস আল্লা`র নাম নে
মন দিয়ে বই পড় সাকসেস আসবে
তবে ঠিক সকলেই খুব ভালো- বাসবে।

কবিরা কবিদের বিপদে পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। তবুও সবাই পাশে দাঁড়ায় না। আমরা সবাইকে পাশে পাই না। বরিশালের মানুষ। প্রিয় কবি হেনরী স্বপন যখন মিথ্যা অভিযোগে জেল খানায় বন্দী তখন কবির পাশে কবি দাঁড়ালেন। কবি হেনরী স্বপনকে নিয়ে জাহাঙ্গীর আলম জাহান লিখলেন `আর দেখতে চাইনে`

হেনরী স্বপন স্বপ্ন বপন আর করো না তুমি
দুঃস্বপ্নে বিভোর এখন তোমার জন্মভূমি।
জেলখানাতে স্বপ্নগুলো বপন করে রেখো
সেই স্বপ্ন স্বপ্ন-আলো ঠিক ছড়াবে দেখো।
হেনরী স্বপন স্বপ্ন বপন কাব্যে যেমন করো
নতুন করে স্বপ্ন-পথের সেই তালিকা গড়ো।

নব্য ধনী হওয়া আহম্মকদের মননের দীনতা নিয়ে তিনি লিখেছেন `মানসিকতা` নামক ছড়াটি।

তুমি না-হয় স্যুটেড-বুটেড
সোসাইটিতে দাম আছে
কিন্তু তোমার দেশ গঠনে
কত্তোটুকু ঘাম আছে?

ঘামের হিসেব কষতে গেলে
জুটবে জিরো কপালে
শ্রমিক-মজুর দেখলে তবু
যাও পিছিয়ে ছ` ফালে।

কারণ তোমার চরিত্রটাই বুর্জোয়ার
তাই দেখনি দিনবদলের সূর্য আর।

`ইলিক ঝিলিক` নামে একটি বই আছে জাহাঙ্গীর আলম জাহানের। সে বইয়ের একটি ছড়া `শেয়াল`

শেয়াল বসে খেয়াল গায়
মগ্ন হয়ে তানপুরায়
নেড়ি কুকুর দেখলে পরে
সব শেয়ারের গান ফুরায়।

গান ফুরালো তান ফুরালো
বন্ধ হলো খেয়াল
কুকুর দেখে দৌড়ে পালায়
ধূর্ত বনের শেয়াল।

শরৎকাল নিয়ে `ইলিক ঝিলিক` বইটিতে তিনি লিখেছেন,

নীল আকাশে সাদা মেঘ
আর বাতাসে হাল্কা বেগ।
নদীর পাড়ে কাশের ফুল
হয় না কারো বুঝতে ভুল।
উড়ছে রঙিন নায়ের পাল
এটাই বুঝি শরৎকাল।

শরৎকাল নিয়ে মাত্র ছায় লাইনে এমন চমৎকার লেখা আর কোথাও দেখিনা। `ইলিক-ঝিলিক` বইটির `লোপা` শিরোনামে তিনি লিখেছেন,

ছোট্ট মেয়ে লোপা
বাঁধতে জানে খোঁপা
নেই যদিও চুল
খোঁপায় বাঁধে ফুল
ফুল দিয়ে হয় বেণী
চাটগাঁ থেকে ফেনী।

প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে তিনি লিখেছেন `সবাই ভালোবেসো`
জাহাঙ্গীর আলম জাহান শুধু একজন ছড়াকারই নয়, তিনি একজন প্রকৃতি প্রেমিকও।

আচ্ছা ধরো- হঠাৎ করে যদি
প্রশ্ন শুধায় নদী-
আমার গতি- কে করেছে রোধ?
কোথায় যাবে- তোমার বিবেকবোধ?

কিংবা ধরো- বন-বনানী গভীর
হয়েই গেল স্থবির।
তারপরে সে- জানতে যদি চায়
আমার গায়ে- কুড়াল কে চালায়?

কে করেছে- উজাড় বনভূমি
তখন জবাব- কী দেবে ভাই তুমি?

এই প্রকৃতি- পাহাড় নদী বন
সবার প্রয়োজন।
এদের প্রতি- দরদ বাড়াই এসো
প্রকৃতিকে- সবাই ভালোবেসো।

কবিদের মানুষ হতে হয়। মানুষের মতো মানুষ হতে হয়। মানুষ হবার জন্য দরকার মানুষকে সম্মান করা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে মানুষ রূপে দেখা। `নারীদিবসের পদ্য` নাম দিয়ে তিনি `নারীর সম্মান` শিরোনামে তিনি লিখেছেন এই ছড়াটি।

নারীদের প্রতি নয় অবহেলা কাম্য
নারীরাই সমাজের রাখে ভারসাম্য
নারী আর পুরুষে
করে যদি শুরু সে
একসাথে মিলেমিশে প্রগতির যাত্রা
অপরূপ রূপ পাবে বিজয়ের মাত্রা।

নারীরাও হতে পারে কাজে সমকক্ষ
ওরা নয় সমাজের কারও প্রতিপক্ষ
সব কাজে কে সমান
নারীরাও সে প্রমাণ
দিচ্ছেই পদে পদে নেই তারা পিছিয়ে
প্রগতির পথে ওরা ফুল রাখে বিছিয়ে।

এসো তাই ভুলে যাই ভেদাভেদ-রেখাকে
জীবনের পথে আজ হাঁটে বলো একা কে
ধর্মের বাণীতেও কারও নয় কম মান
দিতে হবে নারীদেরও যথাযথ সম্মান।

আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন যে স্বাধীনতার ভীত রচনা করে সেটা আজ আমরা সবাই জানি। একটি কাল্পনিক রাষ্ট্র তৈরি করা হয়েছিল সাতচল্লিশে। সেই কাল্পনিক রাষ্ট্রের নিয়মকানুন ছি্ আরো বিদঘুটে। তারা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। আমাদেরকে সংস্কৃতি শূন্য করতে চেয়েছিল। আমাদের পূর্ব পুরুষ সেটা মেনে নেয়নি। তারা একুশ এনেছিল। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে একুশ এনেছিল। সেই একুশেই লেখা হয়েছিল একাত্তরের নাম। সেই ইতিহাস `শেকড়কথা` শিরোনামের ছড়ায় তুলে এনেছেন জাহাঙ্গীর আলম জাহান।

স্বাধীনতা দয়ার ছলে কেউ করেনি দান
যুদ্ধ করে আনলো কিছু গর্বিত সন্তান।
ফেব্রুয়ারির একুশ ছিল
স্বাধীনতার ভিত্
ভাষার দাবির মধ্য দিয়ে
জেগেছে সম্বিৎ।
এই দাবিতেই সর্বপ্রথম রক্ত ঝরে লাল
ক্ষুব্ধ জাতি হয়েছিল বিক্ষোভে উত্তাল।

আত্মত্যাগে অবশেষে অর্জিত হয় ফল
বীর বাঙালি যুদ্ধ শেষে মুক্ত প্রাণোচ্ছল।
ফেব্রুয়ারির একুশ ছিল স্বাধীনতার মূল
এই দিবসে প্রাণে প্রাণে তাইতো হুলস্থুল।
স্বাধীনতার শেকড় পোঁতা
ফেব্রুয়ারির মাঝে
শহিদ মিনার সজ্জিত হয়
ফুলের কারুকাজে।
রক্তরাঙা ফেব্রুয়ারি সাহস বাড়ায় মনে
ভক্তি এবং শ্রদ্ধা করি ভাষার প্রয়োজনে।

আমাদের মহান ছড়াকার জাহাঙ্গীর আলম জাহানের পিতা বীব মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন। তাঁর লাশটিও খুঁজে পাইনি কবি। বিশ্ব বাবা দিবসে শহিদ বাবার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি লিখেছিলেন `গর্ব আমার এই` ছড়াটি,

তখন আমি অনেক ছোট- ছাত্র ছিলাম সিক্সে
বাবা তখন যুক্ত ছিলেন দেশের পলিটিক্সে।
এরই মাঝে দেশ স্বাধীনের লড়াই হলো শুরু
মায়ের বুকে ভয়ের কাঁপন জাগলো দুরু দুরু।

বাবা বলেন- ভয় পেয়ো না স্বাধীন হবে দেশ
এই মাটিতে সব হানাদার হবেই যে নিঃশেষ।
এই কথাটি বলেই বাবা অস্ত্র নিয়ে হাতে
বেরিয়ে গেলেন দৃপ্ত পায়ে একাত্তরের রাতে।

ন` মাস ব্যাপী যুদ্ধ হলো স্বাধীন হলো মাটি
যে মাটিতে আমরা এখন বুক ফুলিয়ে হাঁটি।
যুদ্ধ শেষে ফিরলো ঘরে বীর সেনানী যারা
স্বাধীনতার গর্বে আমরা হই যে আত্মহারা।

সবাই আছে- সবই আছে, বাবাই শুধু নেই
বীর শহিদের ছেলে আমি- গর্ব আমার এই।

ছড়াটি `ট্যাক্সো ছাড়া একশো ছড়া` বইতে মলাট বদ্ধ হয়েছে। তিনি কিশোরগঞ্জের মানুষ। কবি চন্দ্রাবতির অঞ্চলের মানুষ। কিশোরগঞ্জের ভাষায় `কিশোরগইঞ্জা ছড়া` লিখেছেন তিনি `কইলজা খালি জ্বলে` শিরোনামে।

তুমার লাগি পেটটা পুড়ে, কইলজা খালি জ্বলে
এইতা কথা আছিন না তো বাঁশবাগানের তলে।
চান্নি রাইতে দিছলা কথা বইয়া বাঁশের ঝাড়অ
দিনে দিনে আমডা পিরিত বাড়বো বুলে আরও।

জান গেলেগাও আমার নামডা লইবা দমে দমে
ভুলতা না এই প্রেমের কথা টানলে মরার যমে।
বাপে-মায়ে মাইরা ফাল্লেও ছাড়তা না এই আত
হেই তুমিডা কেমনে যে খাও অন্য বাড়ির ভাত!

কেমনে তুমি ভুইল্যা গেলা আমার পিরিত-কথা
মানছো কিবায় অন্য ব্যাডার প্রেমের অধীনতা?
একবারও কি এই অধমের নাম পড়ে না মনঅ
তুমার খবর আইন্যা দিবো নাইগা ত একজনও।

তুমার লাগি আইজও আমার পেটটা বড় পুড়ে
পক্ষির লাহান মনডা খালি দূর আসমানে উড়ে।
ভুলতারি না তুমার কথা, কইলজা খালি জ্বলে
মনঅ কি নাই কী কইছিলা বাঁশবাগানের তলে?

ও পাষাণী! কেমনে তুমি ভুললা আমার নাম
কইলজা পুড়া কষ্ট আমার কেমনে দেহাইবাম?

জাহাঙ্গীর আলম জাহানের জন্ম ১৯৬০ সালের ১২ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ জেলায়। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৪৪টি। তিনি সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের বার্ষিক ছোটকাগজ ‘দৃশ্যপট’, ষান্মাসিক ছোটকাগজ ‘বাংলাঘর’, ত্রৈ-মাসিক ছড়ার কাগজ ‘আড়াঙ্গি’, ত্রৈ-মাসিক সাহিত্যের কাগজ ‘উজান’। তিনি একাধিক ছড়া সম্মেলন সফলভাবে শেষ করেছেন। গুণী এই মানুষটিকে জানায় অন্তরের অন্তস্তল থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা।