ছায়াবীথি শ্যামলিমার চিলতে গল্প ‘বাদশাহ ও বিধবা’
প্রকাশিত : জুলাই ২৭, ২০২২
আন্দালুসের স্বাধীন সুলতান মালিক শাহ। তার শখ ছিল হরিণ শিকার করা। তাই রাজকার্যে একটু ফুরসত পেলেই হরিণ শিকারের উদ্দেশে ইস্পাহানের জঙ্গলে বেরিয়ে পড়তেন।
একদিন কিছু সৈন্য নিয়ে তিনি হরিণ শিকারে বের হলেন। রাত হয়ে গেলে তিনি বনের পাশের এক গ্রামে অবস্থান নিলেন। সেই গ্রামে ছিল এক গরিব বিধবা মহিলা। সে তার সন্তানদের নিয়ে এক পর্ণ কুটিরে বাস করত। তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন বলতে ছিল একটি গাভী। যার দুধ পান করে তার তিনটি শিশু লালিত-পালিত হতো।
বাদশাহর অজান্তে সৈন্যরা সেই গাভীটি জবাই করে মাংস রেঁধে খেয়ে ফেলল। বিধবা তাদের কাছে অনেক কাকুতি-মিনতি করল, তার গাভীটি যেন তারা ছেড়ে দেয়। কারণ এটাই তাদের জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু সৈন্যরা তাকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিল। এতে অসহায় মহিলা চোখে অন্ধকার দেখল।
গাভী হারিয়ে সে পাগলপ্রায় হয়ে গেল। সৈন্যদের কাজে বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে গাভী জবাইয়ের দৃশ্য দেখা ছাড়া তার কিছুই করার ছিল না। রাতে সে ঘুমাতে পারল না। ক্ষুধার্ত শিশুদের বুকফাটা কান্না ও চিৎকার তার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করল।
হঠাৎ উৎকণ্ঠার কুহেলিকা ভেদ করে তার মনে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল। বাদশাহ যেহেতু ন্যায়বিচারক সেহেতু অবশ্যই তার কাছে এর সঠিক বিচার পাওয়া যাবে। এই ভেবে ভোর হলে বিধবা বাদশাহর কাছে যাবার জন্য মনস্থির করল। কিন্তু বাদশাহর কাছে পৌঁছানো তার জন্য বেশ মুশকিলের ছিল।
এরই মধ্যে সে জানতে পারল, বাদশাহ শিকারে বের হয়েছেন এবং অমুক স্থান দিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরবেন। বিধবা এই সুযোগ হাতছাড়া না করে ইস্পাহানের এক প্রসিদ্ধ পুলে দাঁড়িয়ে থেকে বাদশাহর আগমনের প্রহর গুণতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই অভিযোগ পেশ করার সেই মহেন্দ্রক্ষণটি উপস্থিত হলো।
বাদশাহ পুলের ওপর পৌঁছার সাথে সাথেই বিধবা সাহস ও দাপটের সাথে বলল, হে আন্দালুসের সুলতান, আমার ব্যাপারে এই পুলের ওপরেই ইনসাফ করবেন, নাকি আখেরাতের পুলছিরাতে? আপনার যেটা পছন্দ বেছে নিন।
বিধবার কথাগুলো যেন বিষাক্ত বাণ হয়ে বাদশাহর কলিজায় বিঁধে গেল। মহিলার এমন নির্ভীক ও অকপট কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় সৈন্যরাও একে অপরের দিকে তাকাতাকি করতে লাগল। বাদশাহ দ্রুত ঘোড়া থেকে নেমে সাগ্রহে বললেন, মা গো, পুলছিরাতের পুলে কিছু করার কোনোই সামর্থ্য আমার নেই। এই পুলেই আমি ফয়সালা করতে চাই। আপনি নির্ভয়ে আপনার অভিযোগ পেশ করুন।
বিধবা তাকে সবকিছু খুলে বলল। ঘটনা শুনে বাদশাহ অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন এবং তার চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল। সাথে সাথেই তিনি অপরাধী সৈন্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। আর সৈন্যদের এমন নিপীড়নে আফসোস ও দুঃখ প্রকাশ করলেন। বাদশাহ গাভীটির পরিবর্তে বিধবাকে ৭০টি গাভী প্রদান করলেন। বাদশাহর ইনসাফে বিধবা খুশি হলো এবং সন্তুষ্ট চিত্তে তার কুটিরে ফিরে গেল।