চয়ন খায়রুল হাবিবের তিনটি কবিতা
প্রকাশিত : মে ০৮, ২০২১
খরগোস এলো চিলেকোঠায়
`চাঁদনি, তুমি যা ভালোবাসো তার অবয়ব আঁকো।
তুমি কি ভালোবাসো?` সুধালো অমিত।
চাঁদনি, আমি খরগোস ভালোবাসি।
অমিত, তাহলে একটা খরগোস কিনে ফেলো, খরগোসটাকে পালো।
চাঁদনি থাকে শহর প্রান্তে এক পুরানো বাড়ির চিলেকোঠায়।
সেখানে ও লাগোয়া ছাদে খরগোসের ছোট্ট বাসা বানালো।
খরগোসটাকে খাওয়ায় দাওয়ায়,
ছাদের কলতলায় গোসল করায়।
অমিতের কাছে খরগোসের কিচ্ছা শুনায়,
খরগোস আনুষঙ্গিকতা এঁকে এঁকে দেখায়।
এই য্যামন খরগোসের বাসাটা, খাবারের পেয়ালাগুলো,
এটা ওটা খেলনা, এমনকি একটা মিনিয়েচার দোলনা।
মাস কয়েক পর অমিত বলে, এবার খরগোসটাকে আঁকো।
চাঁদনি অনেক, অনেক আঁকাআঁকি নিয়ে অমিতকে দেখায়।
বলে, এই যে খরগোসটা।
ভ্যাবাচেকা অমিত বলে, খরগোসটা কোথায়?
বিমূর্ত ইত্যাদি রং, রেখা, জ্যামিতির তেলেশমাতি দেখিয়ে,
চাঁদনি বলে, এই যে খরগোসটার কান,
এই যে খরগোসটার সামনের দুটো পা,
যেগুলো আসলে হাত, এই যে তুলতুলে পেট।
অনেক সালাদ, শসা খেয়ে এই রেখাটাতে খরগোসটা সুখী,
আর ঐ রেখাটাতে খরগোসটা দুখী,
ঐ রেখাটাতে `পুরানো সেই দিনের কথা বলবি কি রে হায়`!
হতাশ অমিত বারবার জানতে চায়, খরগোসটা কোথায়?
বলে, এদ্দিনেও জানলাম না খরগোসটা সাদা না কালো।
চাঁদনী জানায়, এই যে এই রেখাগুলো জানান দিচ্ছে,
খরগোসটার দেহ সাদা, তবে একটা কান কালো।
আদুরে ভঙ্গিতে বলে, খরগোসটা এত চঞ্চল,
এক মুহূর্ত স্থির থাকতে চায় না,
পেশাদারী মডেলিং কি তা বুঝলে মন্দ হতো না।
অমিত বলে, খরগোসটার অবয়ব ধরবে তোমার মনের আয়না।
যখন বলো, এই রেখায় দুক্ষ, ঐ রেখায় সুখ, তখন তা ভ্রান্তিবিলাস।
আর যদি আমাকে বোঝাতে হয়, এই রেখা কান ঐ রেখা মুখ,
তখন আসলে ঐ অবয়ব হারিয়ে গেছে অনির্দিষ্ট বিমূর্ততায়।
যদি বলো, এটা কান, সেটা কান হিশেবে দাড়াতে হবে বলার আগে।
গাজর খরগোসকে খাবে? না কি খরগোস গাজরকে খাবে?
চাঁদনি বলে, গত রাতে খরগোসটার নাম অমিত থেকে বদলেছি অমিতায়।
অমিত চার পাঁশে তাকায়, জানতে চায়, তাহলে বলো অমিতা কোথায়?
চাঁদনি খরগোসটাকে বাঁচালো কোভিড থেকে
চাঁদনি খরগোসটার নাম দিলো অমিতা।
অমিতা জানতে চাইলো, খরগোসটা কোথায়?
খরগোসটা জানতে চাইলো, অমিতা কোথায়?
ঘটনাপ্রবাহের শুরু চাঁদনির খরগোস আঁকার চেষ্টায়।
খরগোস জানালো,
আমার ফুটোগুলো দিয়ে অমিতার অবয়বে পৌঁছাবে।
চাঁদনি, মানে তোমার কান, নাক, চোক, মুখ?
খরগোস, উহু, ন্যাকামি ছাড়ো, প্রত্যেকটা লোমকূপ।
অমিতাও জানালো একই উত্তর।
তারপর খরগোস ও অমিতা সমস্বর:
এরপর বুঝতে পাবে, কোভিড সাবধানতায়
কোন অঙ্গ, কোথায়, কখন ঢাকতে হবে।
খরগোস নামে পাও কি আমার তুলতুলে অনমেটাপেইয়া?
পটচিত্রের মোটা, টানা পোঁচে না কি রিক্সাচিত্রের চিকন, ছোট টানে,
কালের মিনিমালিজমে, না কি মহাকালের টাইমওয়ার্প ধাবমানতায়
ছোবে আমার দেহাবেগের হেইয়া হো হেইয়া?
এই যে আমার নাম দিলে অমিতা,
তোমার নাম যেরকম কেউ দিয়েছিল চাঁদনি।
কেউ বলে নামে কি বা আসে যায়,
নাম দিয়ে বাঁধা স্মৃতি, সংসার ও সম্পদের চাকা।
ঐ সে ঢাকায় ছিলো দীপা নামে এক শিল্পী,
ঐ সে ঢাকায় ছিলো ডলি নামের এক অভিনেত্রী।
ওদের মৃত্যু হলো,
ঘনিষ্ঠদের স্মৃতি ও সম্পদ অন্য সম্পর্কে ঘুরে গেল।
তাই এক সাথে লোকে বুড়ো হয়,
সম্পদ জমায়, নিজেদের ছোট করে অভ্যাসের বাতিকে।
সেই ছোট ঠিক খরগোসের ছোট নয়,
সেই ছোট শিকারি ভাইরাসের সাথে আমাদের দেহের দূরত্ব।
নিজেই জমায়েছে সম্পদ, নিজেই ছুড়েছে বুলেট,
চারপাশে দেয়াল তুলে মাস্ককে বলেছে বাসাবাড়ি,
তারপর ভ্যাকসিনের খোজে পাশের লোকটার দিকে তাকায়,
হাবিলের দিকে যেভাবে তাকায়েছিল হত্যাকারী কাবিল।
শোনো সেই পেহেলগাম পাহাড়ি গাওয়ে কিশোরী রুবিনার যাপন,
পর্যটকদের খরগোস দেখায়ে যে জোটায় আটজনের আহার।
পড়ো, আপডাইকের গল্পে খেলোয়াড় র্যাবিটের অবসাদগ্রস্ত বাস্তবতা,
ক্রিস্টিতে বিকায় জেফ কুনের মিলিয়ন ডলারের খরগোসি বিহ্বলতা!
`ওগো আমার অমিতা-খরগোস,
এত কিছু, এত কিচ্ছা কিভাবে জানতে পেলে?`
`ও মা, তুমিইতো আমাকে
ওয়ান্ডারল্যান্ড থেকে এই রাতকানাদের হাটে আনলে!`
চাঁদনি দেখতে পেল, চিলেকোঠায় ওর লাগোয়া ছাদে
অমিতা ঘুরে বেড়ায়, খরগোসটা ছুটে বেড়ায়।
খোলাকাশে, খোলা বাতাসের মর্মরে স্পষ্ট দেখতে পায়
খরগোস ও অমিতার প্রত্যেকটা লোমকূপ মনের আয়নায়।
লোম থেকে লোমে, বিন্দু থেকে বিন্দুর পরমে,
পরশের আঙ্গুল থেকে রক্তকলসের রিক্ততায়,
কেটি মিটারের মাপামাপির বাইরে,
হৃতপিণ্ডের হাওয়াই ঘণ্টি দোলে বাসন্তী দোলনায়।
চাঁদনী অমিতের কাছে দৌড়ে যায়, আঁকার খাতা খুলে দেখায়,
চিৎকার দিয়ে বলে এই যে খরগোসটা, এই যে অমিতা।
সেখানে রেখার ধাঁধা নাই, কেবল নগ্নতার ছন্দ ও গড়ন,
উদারা, মুদারা, তারার স্বর ছাড়িয়ে লাবণ্যের একাকিত্বের ঘর।
চাঁদনির মন, চাঁদনির আপেল বাগান
মাঝখানে দূরত্ব রেখে সেতু দুই তিরে সরে গেছে।
এখন কেউ সেতু পার হতে পারবে না।
বরফ-ঝড়ের অঞ্চলে তুষারপাতের সময় সেতু পারাপার বন্ধ,
গরমকালের শুরুতে আবার সেতুর ফাঁকটুকু জুড়ে দেয়া হয়।
চাঁদনি ওর ভেতরের বরফ ঝড় দ্যাখে,
অথচ জীবনেও তুষারপাত দ্যাখে নাই।
ফ্রিজের বরফ ভেঙে
বরফ-কুচিতে রাখে কামড়ানো আপেল
এবং অনুভব করে আপেল বাগানের শুচি।
চাঁদনি সেতু পার হয়।
এবং সেতু চাঁদনি পার হয়।
ছাই উড়ে আসে সেতু ও চাঁদনির গালে, কপালে, চুলে।
মায়ের ছাই,
যে শিশু এখনো জন্মায় নাই।
মেহেরুন্নেসা ক্লিনিকে আরো কিছু খালি বিছানার ভিড়ে,
একটা বিছানায় এলোমেলো রাতের পোষাকে হাঁটু গেড়ে,
এনেস্থেশিয়ার ঘোরে, চাঁদনি বলেছিল:
`আমাকে পুরা একটা আপেল বাগান দিও।`
তার পর একদিন খোলা সেতুর দুই পারে দুইজন,
মাঝখান দিয়ে একের পর এক আপেলের বাগানবাহী জাহাজ।
সেনের সাথে যাপন বদলায় বুড়িগঙ্গা।
মিরাবোর ধার ঘেঁসে চাঁদনি দাঁড়ায়,
এক লাফে আপেলের বাগানবাহি জাহাজে উঠে যায়।
আপেলের বিচিতে ও খরগোসের চোখের মণি দ্যাখে।
আপেল কামড়ে কামড়ে খরগোসের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আঁকে।
মকবুল ফিদার তুলি ও ক্যানভাসের দিকে
যেভাবে মাধুরী দীক্ষিত নির্নিমেষে তাকায় থাকে।
মাধুরী কি সুন্দর,
ফিদা কি বালকসুলভ,
খরগোস কি তুলতুলে,
আপেলটা কি মিষ্টি,
চাঁদনী ক্যানভাস থেকে বেরিয়ে যায়,
চাঁদনি স্টুডিও থেকে বেরিয়ে যায়।
আপেল বাগান এখন সেতু,
সেতু হাত বাড়ায় রান্নাঘরের সিঙ্কে জমানো বাসনকোসনে,
কল খোলা গরমকালের কলকল খরগোস শরীরে
রক্তচাঁদ চাঁদনির রক্তেল সরবতা ধীরে ধীরে ঝরে।