চৌধুরী শাহজাহানের গদ্য ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’
প্রকাশিত : নভেম্বর ১৯, ২০২১
বাংলা কথাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন যে কয়জন সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক তাদের মধ্যে অন্যতম। বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার যবগ্রাম নামক গ্রামে ১৯৩৮ সালে তার জন্ম। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৯৬০ সালে সমকাল পত্রিকার মাধ্যমে হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যজীবনের সূত্রপাত হয়। সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় তাঁর শকুন গল্প প্রকাশিত হয়। এই গল্পের জন্য তিনি ব্যাপকভাবে আলোচিত হন। এই সময়েই তাঁর আজিজুল হক নামের পূর্বে হাসান শব্দটি যুক্ত হয়। এরপর তিনি হাসান আজিজুল হক নামেই লিখতে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ছোটগল্পের জনক। রবীন্দ্র্রনাথের হাতেই বাংলা ছোটগল্পের উৎপত্তি ও বিকাশ লাভ করে। তাঁর গল্পে সমাজের বিচিত্র শ্রেণীর মানুষ স্থান লাভ করেছে। বাংলার প্রবহমান গ্রামীণ জীবনকে গল্পে তুলে আনেন রবীন্দ্রনাথই প্রথম। রবীন্দ্রনাথের পর মানিক বন্দোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) তাঁর কথাসাহিত্যে সমাজ ও জীবনের অবক্ষয়ের প্রধান কারণ হিসেবে মানুষের কামতাড়িত জীবনাচরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ আত্মজা ও একটি করবী গাছ-এর কয়েকটি গল্পে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের প্রভাব সুস্পষ্ট। ত্রিশের উপান্তে মানিক বন্দোপাধ্যায় মার্কসীয় মতবাদের দ্বারা আকৃষ্ট হন। চল্লিশের দশক থেকে মানিক বন্দোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যে সমাজ জীবনকে বিশ্লেষণ করেছেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সাহায্যে।
হাসান তাঁর প্রথম গ্রল্পগ্রন্থ সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য ও দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ আত্মজা ও একটি করবী গাছ-এর অধিকাংশ গল্পে যৌন সর্বস্বতাবাদে ধারাটিকে অল্প-বিস্তর অব্যাহত রাখলেও তৃতীয় গল্পগ্রন্থ জীবন ঘষে আগুন-এর পর থেকে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের আদর্শ অনুসরন করে সমাজবাদী ধারার গল্প লেখা শুরু করেন। ভাষা প্রয়োগের ভঙ্গির দিক থেকে হাসান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে গদ্যরীতিতে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের প্রভাব সুস্পষ্ট। কমলকুমার মজুমদার, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ ও সোমেন চন্দ দ্বারাও তিনি কোনো কোনো সময়ে প্রভাবিত হয়েছেন। রাঢ়বঙ্গের উত্তরাধিকার হলেও হাসানের গল্পের ভৌগলিক পটভূমি বাংলাদেশ। এই দেশের ভূমিতে বাস করে হাসান ছোটগল্প রচনা করেছেন।
আত্মজা ও একটি করবী গাছ গ্রন্থে মোট আটটি গল্প সংকলিত হয়েছে। গল্পগুলো হলো, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, পরবাসী, সারাদুপুর, অন্তর্গত নিষাদ, মারী, উট পাখি, সুখের সন্ধানে, ও আমৃত্যু আজীবন। গল্পগুলো নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের বাস্তবচিত্র নিয়ে লেখা। গ্রাম বাংলার কৃষকের শোষিত জীবন সংগ্রাম ও হতাশা গল্পগুলোতে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। আত্মজা ও একটি করবী গাছ গল্পটি আমাদের সমাজ জীবনের একটি পরিবারের অবর্ণনীয় বেদনা ও যন্ত্রণার কাহিনী। ইনাম, ফেকু ও সুহাস ক্ষয়িষ্ণু সমাজের তিনটি প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্র। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে বৃদ্ধ কেশো-বুড়ো দুটো টাকার বিনিময়ে নিজের মেয়েকে তুলে দেয় সুহাস ও ফেকুদের কাছে। লেখক বর্ণনা করেছেন এভাবে- তোমরা দিচ্ছ, তুমি আর সুহাস? দাও। আর কত যে ধার নিতে হবে তোমাদের কাছে। কবেই বা শুধতে পারবো এইসব টাকা? সুহাস উঠে দাঁড়ায়। চলে যাবে এখন? এত তাড়াতাড়ি? রুকু রাগ করবে-চা করতে দিলে রা ওকে। ওর সঙ্গে দেখা না করে গেলে আর কোনদিন কথা বলবে না। দাঁড়াও- হারিকেনটা রেখে বুড়ো বেরিয়ে যায়। ছায়াটা ছোট হতে হতে এখন নেই। মুরগিগুলো আবার কঁ কঁ করে ওঠে, কথা বলে ওঠে এক বৃদ্ধা স্ত্রীলোক, তীক্ষ্ন গালাগালি অন্ধকারকে ফাড়ে, চুপ, চুপ,মাগী, চুপ কর, কুত্তী এবং সমস্ত চুপ করে যায়। বুড়ো ফিরছে এখন-মাথা নামিয়ে কাঁধ ঝুলিয়ে ঘরে ফিরে এসে ফিস ফিস করে যাও তোমরা, কথা বলে এসো, উই পাশের ঘরে।’
এখানে অধঃপতিত সমাজের ভাবটি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। অর্থের বিনিময়ে নিজের যুবতী মেয়েকে যুবকদের হাতে সঁপে দেয়ার মধ্য দিয়ে বৃদ্ধের জীবনের চরম লজ্জা উন্মোচিত হয়েছে। এরপর বুড়ো ইনামের সঙ্গে গল্প করতে বসে। এটা তার বাস্তব জীবনের গল্প। লেখকের ভাষায়- বুড়োটা গল্প করছে, ভীষণ শীত করছে ওর গল্প করতে, চাদরটা আগাগোড়া জড়িয়েও লাভ নেই। শীত তবু মানে, শ্লেষ্মা কিছুতেই কথা বলতে দেবে না তাকে! আমি যখন এখানে এলাম, সে গল্প করেই যাচ্ছে, আমি যখন এখানে এলাম, হাঁপাতে হাঁপাতে কাঁপতে কাঁপতে বলছে, সারারাত ধরে বলছে, আমি যখন এখানে এলাম, আমি যখন এখানে এলাম, আমি একটা করবী হাছ লাগাই বুঝলে? বলে থামলো বুড়ো, কান্না শুনল, হাসি শুনল, ফুলের জন্য নয়, বুড়ো বলল, বিচির জন্যে, বুঝেছ করবী ফুলের বিচির জন্য। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে।
আত্মজার যন্ত্রণাদগ্ধ অবস্থাকে ভুলে থাকার জন্য বুড়োরই বানানো গল্পের অবতারণা। সব মায়াই মিথ্যা হয়ে যায়, ভিতরে ভিতরে বিষ সঞ্চারিত হয়ে যায় বহুদূর। এক অনিবার্য মৃত্যুর ডাক শোনা যায় শুধু। বুড়োর অসহায় অবস্থা লক্ষ করে ইনাম যতই বলুক ‘এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ?’ তার তিক্ততা সত্ত্বেও ঐ কান্নাতেই ধরা পড়ে বিপর্যয় অসহায়ত্ব।
পরবাসী গল্পের পটভূমি নির্মিত হয়েছে দুই বাংলার হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের দাঙ্গার ইতিহাসকে আশ্রয় করে। সাধারণ মানুষকে একেক সময় তার নিজস্ব নীতিবোধ হারিয়ে ইতিহাসের সংকটের শিকার হতে হয়-সেটাও এক ধরনের অসহায়ত্ব। শুধু অর্থনৈতিক চাপের সামনেই মানুষ যে অসহায় তা নয়, মূল্যবোধ নানাভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে। বশির এরকমই প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হওয়া এক মানুষের অসহায়ত্বকে প্রকট করে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আকস্মিক আক্রমণের ভয়ঙ্কর ছোবলে তার ছাব্বিশ বছরের যুবতী স্ত্রী ও সাত বছরের ছেলেকে হারিয়েছে। হারিয়েছে তার চাচা ওয়াজদ্দিকে। সব হারিয়ে বশির কোন মতে প্রাণ রক্ষার তাগিদে পাকিস্তানের পথে পা বাড়িয়েছে। চলার পথে এক সময় সে একটি শুকনো খালে আশ্রয় নির। হঠাৎ খালের উঁচু পাড়ে ধূতি পরিহিত মানুষটিকে দেখার সাথে সাথে বশিরকে তাড়া করে আদিম প্রাগৈতিহাসিক নিষ্ঠুর হিংস্রতা।
আগন্তুকটির বাঁক থেকে কুড়াল নিয়ে সে প্রচণ্ড আঘাতে তাকে হত্যা করে। এ গল্পটির মানবিক আবেদন অবিস্মরনীয়। খণ্ডিত বাংলার আত্মখণ্ডিত মানুষের ক্রুরতা রাজনৈতিক ঘটনারই ঘৃণ্য পরিণতি। গ্রামের কৃষিজীবী সাধারণ মানুষ ওয়াজদ্দি যখন তার বুদ্ধি ও বিবেচনার সাহায্য নিয়ে মন্তব্য করে ’তোর বাপ কটো? এ্যাঁ-কটো বাপ? মা কটো? একটো তো? দ্যাশ তেমনি একটো! বুইলি?’
সাধারণ মানুষ রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে বলেই দেশ সম্পর্কে তাদের কোন সুস্পষ্ট ধারণা নেই। জন্মদাতা যেহেতু একাধিক হতে পারে না তেমনি দেশও একাধিক হতে পারে না। এই প্রগাঢ় বিশ্বাসে ওয়াজদ্দি বিশ্বাসী। জন্মভূমিকে তারা জন্মদাতার সমান বিবেচনা করেছে । দেশ সম্পর্কে এই বিশ্বাসের হলো অপমৃত্যু । মৃত্যুর বীভৎস্য তান্ডবলীলা দেখে বশিরের মন ভেঙ্গে যায়। লেখকের ভাষায়- ‘বাড়িটা ততক্ষণে পুড়ে শেষ। ওরা চলে গেছে। বল্লম দিয়ে মাটির সাথে গাঁথা বশিরের সাত বছরের ছেলেটা। ছাব্বিশ বছরের একটি নারীদেহ কালো একখন্ড পোড়া কাঠের মতো পড়ে আছে ভাঙ্গা দগ্ধ ঘরে। কাঁচা মাংস-পোড়ার উৎকট গন্ধে বাতাস বিষে ভারি।’ প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক পাশাপাশি রুপায়িত হয়ে এখানে গল্পের বক্ত্যকে এক আলাদা মাত্রা নিয়ে আসে। গল্পে যে ট্র্যাজেডি, তা সাধারণ মানুষের ট্র্যাজেডি। ছোটগল্পের জগতে এই গল্প নিঃসন্দেহে আলাদা এবং অনন্যও বটে।
সারা দুপুর গল্পে সমাজের নারী পুরুষের অবক্ষয় ও অসঙ্গতি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এই গল্পের প্রধান চরিত্র কাঁকন। সে অনেক ক্ষেত্রেই যেন অসহায়। পিতার আদর থেকে বঞ্চিত কাঁকনের মনোজগত এবং মায়ের প্রতি জেগে ওঠা প্রবল ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে এই গল্পে। নিঃসঙ্গ দুপুরে কাঁকনের বেদনার্ত অন্তর্জগৎ উন্মোচন করেছেন লেখক এভাবে-‘সেই মরে যাওয়ার ইচ্ছাটা ফিরে আসে। আহারে যদি মরে যেতাম-কত ভালো হতো-হরতো হাঁসগুলোর মতো উড়তে পারতাম। তার বদলে দাদুটা মরে যাচ্ছে। হয়তো এক্ষুনি দাদু মরছে। একটা বালিহাঁস খেতে চেয়েছিল দাদু। দাদু মরে গেলে চেয়েচিন্তে একটা বালিহাঁস খেলেও খেতে পারবে। এই সঙ্গে মায়ের কথা মনে পড়ল কাঁকনের আর ওর বুকটা যেন ফেটে যেতে চাইল। মা-টাও মরে গেছে বলে মনে হয় যে আমার! আব্বার সঙ্গে বিকেলে কি আর দেখা হবে? সেই মেয়েলোকটা কি আসবে?’
কাঁকন নামের একটি কিশোরের চোখ দিয়ে দেখা তার চারপাশের জগৎ, তার কালিমালিপ্ত অন্ধকার, নৈরাশ্য, আনন্দ এবং কৌতূহলের জিজ্ঞাসায় ঘেরা নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের কথা এই গল্পে স্থান পেয়েছে। একদিকে মৃত্যুপথযাত্রী দাদু অন্যদিকে স্বামী পরিত্যক্তা তার নিজের মা, যার শয্যায় একদিন দেখতে পেয়েছে ফর্সা রঙের একজন মানুষকে, যার প্রতি অক্ষম ক্রোধে গুমরে মরে কাঁকন। নিঃসঙ্গ কাঁকনের অবস্থা লেখক বর্ণনা করেন এভাবে-‘শীতে গাছের পাতাগুলোকে বিশ্রী দেখাচ্ছে, পথের ওপর ছায়া ভয়ানক ঠান্ডা আর ঘাসের ভেতরে রাস্তার রং দুধের মত সাদা। ঘাস এখনো হলদে হয়নি-হবে হবে করছে। এই সব আধ-মরা ঘাসের ওপর শিশির আধাআধি শুকিয়েছে এতটা বেলা হয়েছে। রোদ কেবল এই সময়টায় একবার চড়াৎ করে উঠেছে, খেজুর গাছে ঘুঘু ডাকছে, অমনি মন কেমন করে উঠলো কাঁকনের। সব মরে যাচ্ছে গো-কাঁকন এই কথাটা শোনাবার মত লোক খুঁজে পেল না।’ আব্বা একটা মাগীর সঙ্গে চলে যাচ্ছে? কাঁকন মাকে জিজ্ঞেস করে ‘মাগী কি?’-‘প্রচন্ড একটা চড় কষে ওর মা ফেটে পড়ে, রাত দুপুরে শয়তানী। পাজী কোথাকার! হাড়ে হাড়ে বজ্জাতী তোমার। মাগী ককে বলে জানিস না-‘আমি একটা মাগী।’ এই নির্মম সত্যের অনুভব নিয়ে কাঁকনের মরে যেতে ইচ্ছে করে।
একদিকে মৃত্যুপথযাত্রী দাদু, অন্যদিকে মৃত্যুগুহায় ডুবন্ত তার মা-এই দুয়ের টানাপড়েনে কাঁকনের মনেও উঁকি দেয় মৃত্যুচেতনা। একবার নয়, দুইবার নয়, তিনবার গল্পের শেষে ‘কাঁকন ছেলেটার মনে কি রকম মরে যাবার ইচ্ছা প্রবল হয়। দারুণ শীতের জন্য সেই সময় ঘাসপাতা, আকাশ রোদ সব কিছু মরছিল বা মরণাপন্ন ছিল।’ গল্পটি এভাবে শেষ হযে যায়। নিঃসঙ্গ এক কিশোরের চোখ দিয়ে দেখা এই জগতে নেই কোনো উৎফুল্লের আনন্দধ্বনি। মৃত মানুষের জগতে সেই কিশোর বেলাতেও যার মরে যেতে ইচ্ছে করে সেই কাঁকনের প্রতি সহমর্মিতায় আমাদের অন্তরও কি কেঁদে ওঠে না?