চলচ্চিত্রকর্মীদের জাতীয় চলচ্চিত্র সম্মেলন
বেলায়াত হোসেন মামুনপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৯, ২০১৯
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকর্মীদের কখনো একত্রিত হওয়া হয়নি। কারণ চলচ্চিত্রকর্মী কে বা কারা তা আজও প্রতিষ্ঠিত নয়। চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী, চলচ্চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, প্রযোজক, পরিবেশক, শব্দ-গ্রাহক, চলচ্চিত্র সমালোচক, লেখক, গবেষক অথবা চলচ্চিত্র শিক্ষক অথবা চলচ্চিত্র সংসদকর্মী বা চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজক এমন অনেক শব্দে চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট সকল মানুষ চিরকাল আপন আপন ব্যক্তিগত বর্গের বাসিন্দা হয়ে থাকেন। তাদের একত্রিত হয়ে কখনো বলা হয় না যে, আমি চলচ্চিত্রের জন্য যা করি তা আমার বিশেষায়িত ক্ষেত্র কিন্তু আমি কার্যত একজন চলচ্চিত্রকর্মী। আমরা অনুভব করি `চলচ্চিত্রকর্মী` শব্দটি দিয়ে চলচ্চিত্রের সাথে সম্পৃক্ত সকল মানুষকে একত্রিত করা সম্ভব। এই একটি শব্দ চলচ্চিত্রের সবাইকে একাই ধারণ করবার ক্ষমতা রাখে।
আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সবচেয়ে অবহেলিত অংশটি হলো বাংলাদেশের তরুণ বা নবীন চলচ্চিত্রকর্মীরা। যারা আগামী এবং যারাই মূলত রচনা করবে বা করছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বা চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির বাতাবরণ, তাদের কণ্ঠস্বর সরব হয় না। তরুণদের নিজেদের চিন্তা ও পরিকল্পনা কেউ শুনতে চায় না। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে তরুণরা কি ভাবছে তা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ধ্বনিত হয় না। বরং তরুণদের জন্য কি ভালো হতে পারে এই ভাবনা আরোপ করেন যারা কার্যত পুরোনো সময়ের মানুষ।
চলচ্চিত্র সদাপরিবর্তনশীল একটি মাধ্যম। এর কেবল যে প্রযুক্তি বদলাচ্ছে প্রতিদিন তা নয়। বদলাচ্ছে ভাষা, বদলাচ্ছে বক্তব্য, বদলাচ্ছে সকল প্রতিষ্ঠিত কাঠামো। কিন্তু আমরা যেন বদলাবো না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। আমরা তরুণদের স্বরকে মুক্ত করতে চাই না, আমরা তরুণদের নিরীক্ষাকে নিরুৎসাহিত করি। যখন কোনো তরুণ নিরীক্ষার চেষ্টা করে তখন আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠিত কাঠামোয় তাকে দমবন্ধ করে হত্যা করার চেষ্টা করি। কখনও নীরবতার মানসিক চাপে, কখনও সরব হয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের প্রকরণে। আমরা যা করি তা মূলত আমাদের আগামীকে হত্যা। আমরা প্রতিদিন আমাদের বিকাশকে রুদ্ধ করি, সম্ভাবনাকে হত্যা করি। এই পরিস্থিতির বদল হওয়া দরকার।
বাংলাদেশে দরকার এমন একটি পরিবেশ যেখানে একজন তরুণ বা নবীন চলচ্চিত্রকর্মী তার চলচ্চিত্রের ন্যূনতম সুরক্ষা পাবে। দরকার এমন পরিবেশ যেখানে একজন তরুণের চলচ্চিত্রকর্মী হিসেবে বেঁচে থাকবার জন্য পেশাগত সুরক্ষা থাকবে। দরকার এমন পরিবেশ যেখানে একজন তরুণ চলচ্চিত্রকর্মী তার অভিনীত, নির্মিত, প্রযোজিত চলচ্চিত্রের বিতরণ ও প্রদর্শনের নিশ্চয়তা পাবে। বাংলাদেশে প্রয়োজন এমন চলচ্চিত্রময় পরিবেশ যেখানে চলচ্চিত্রকর্মী চলচ্চিত্রচর্চায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঋদ্ধ পরিবেশে বেড়ে উঠবে। প্রয়োজন এমন পরিবেশ যা তরুণদের সাহস দেবে, দেবে অনুপ্রেরণার উৎসাহ। বাংলাদেশের সকল চলচ্চিত্রকর্মী যদি পরস্পরের পাশে থাকে, হাতে হাত ধরে সহমর্মী হয় তবে এমন পরিবেশ তৈরি আমাদের জন্য খুব দূরের কোনো গন্তব্য নয়।
আমরা আশাবাদী। কারণ বাংলাদেশ আমাদের দেশ। এই দেশের ১৬ কোটি মানুষ আমরা এবং দুনিয়ার সকল বাংলাভাষাভাষী মানুষ আমাদের স্বজন। বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় বাংলাভাষা যা প্রতি দুই তিন কিলোমিটার দূরত্বে বদলায় তার স্বর ও ভঙ্গি তা আমাদের সম্পদ। আমাদের সম্পদ আমাদের পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা ও যাপনের নিজস্ব ধরন। আমরা আমাদের চারপাশে চোখ মেলে আমাদের জীবনকে ব্যাখ্যায়-বিশ্লেষণে, নিজস্ব ব্যক্তিগত সৃজনশীল অনুভব-উপলব্ধিতে গড়ে তুলতে পারি শিল্প, রচনা করতে পারি মানুষের জীবন বদলের কাব্য। এসব সম্ভব। সম্ভব আমাদের সামষ্টিক উত্থানের। আমাদের ব্যক্তিগত কোনো কিছুই সমষ্টির যত্ন ও মনোযোগ ছাড়া অর্জিত হতে পারে না। শিল্প ব্যক্তিগত। শিল্পানুরাগ ব্যক্তিগত। কিন্তু শিল্পসৃষ্টির আধার সামষ্টিক। শিল্পসৃষ্টির জন্য প্রয়োজন অনুকূল অথবা প্রতিকূল পরিবেশ এবং মানুষের উষ্ণ সম্মেলন।
বাংলাদেশের তরুণ-নবীন ও সকল চলচ্চিত্রকর্মীদের আমরা সম্মিলিতভাবে দেখতে চাই। আমরা চাই তরুণরা ভাবুক যে, দেশের মানুষের সাথে বা দেশের অপর কোনো তরুণের সাথে আপনার বা আমার কোনো প্রতিযোগিতার সম্পর্ক নেই। আমাদের সৃজনশীলতার প্রতিযোগিতা দুনিয়ার সাথে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সকল চলচ্চিত্রকর্মীর সাথে। তাই বাংলাদেশের সকল চলচ্চিত্রকর্মী আজ এবং আগামীকাল পরস্পরের সহমর্মী ও সহকর্মী। বাংলাদেশের সকল চলচ্চিত্রকর্মী মূলত একটি পরিবারের সদস্য। পরিবারের যেমন সকল সদস্য একই মানের ও গুণের অধিকারী হয় নাক, তেমনি আমরাও পরস্পরের থেকে পৃথক ও বৈচিত্র্যময় সামর্থ্যের অধিকারী। আমাদের এই বৈচিত্র্যময় সামর্থ্য ও সক্ষমতা আমাদের সম্পদ। আমরা যদি সম্মিলিত হতে পারি তবে এই সম্পদ আমাদের ঐশ্বর্য হবে। আর আমরা যদি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকি তবে এই সম্পদ আমাদের ব্যক্তিগত অস্ত্র হয়ে পরস্পরকে বিনাশ করার উপকরণে পরিণত হবে। যা আমরা ৬২ বছর ধরে দেখে এসেছি। কিন্তু আগামীর ৬২ বছরের গল্প অন্যরকম হতে পারে। যদি আমরা সকলে তা চাই।
আমরা বাংলাদেশের সকল চলচ্চিত্রকর্মীদের জাতীয় সম্মেলনের আহ্বান জানিয়েছি। জাতীয় সম্মেলনের আগে আমরা দেশের আটটি বিভাগে বিভাগীয় সম্মেলন আয়োজন করছি। বিভাগীয় সম্মেলনে চলচ্চিত্রকর্মীরা বলবে তাদের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের গল্প, বলবে তাদের চলচ্চিত্রচর্চার প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনার গল্প, চলচ্চিত্রকর্মীরা বলবেন স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে কি ধরনের নীতিমালা তৈরি করলে দেশের ও সকলের জন্য চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির বিকাশ হতে পারে।
এসব আমরা বলতে ও শুনতে, লিখতে ও নথিভুক্ত করতে এই সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আমরা সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আগামীর পথ সৃষ্টি করতে চাই। দেশ আমাদের, চলচ্চিত্রও আমাদের। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-ইন্ডাস্ট্রিও আমাদের। আমাদের যা কিছু তা আমাদের করে পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রয়োজন চলচ্চিত্রকর্মীদের ঐক্যবদ্ধতা। আর তা হতে যাচ্ছে। জাতীয় ও বিভাগীয় চলচ্চিত্রকর্মীদের সম্মেলন সফল করতে হলে আপনাকে ভূমিকা রাখতে হবে। আপনার সক্রিয়তাই পারে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে। তাই আপনি আজ, এখনই সক্রিয় হোন। কারণ এই সম্মেলন আপনার সমমনা মানুষকে আপনার বন্ধু বানাবে আর আপনার প্রতিপক্ষকে করবে স্পষ্ট। চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির এই লড়াইয়ে আপনার পক্ষ ও প্রতিপক্ষ আপনাকেই নির্ধারণ করতে হবে।
তাই আসুন আলোতে, প্রকাশ্যে, সদলবলে। দেখা হবে বন্ধুরা, সম্মেলনে।
লেখক: আহ্বায়ক, জাতীয় পর্ষদ, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকর্মীদের জাতীয় চলচ্চিত্র সম্মেলন