ঘৃণা, খেলাধুলা ও ক্রিকেটে ভারতের জয়-পরাজয়
প্রকাশিত : নভেম্বর ২৩, ২০২৩
প্রাচীন যুগে গ্রিসে শরীরচর্চা ও খেলাধুলা ছিল মানুষের সুস্থ থাকার কৌশল। মনে করা হতো, মানসিক সুস্থতার জন্য শরীরচর্চা বা শারীরিকভাবে ভালো থাকাটা খুব দরকারি। যখন ইউরোপে নবজাগরণ আরম্ভ হয়, মস্তিষ্কচর্চার পাশাপাশি শরীরচর্চা বা খেলাধুলার প্রতি সমান গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। শরীরচর্চা বা খেলাধুলার মানে হলো, খেলাধুলার নামে অন্যদের প্রতিযোগিতা দেখে সময় কাটানো নয়। নিজের শরীর সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত নিজেকেই শরীরচর্চায় অংশগ্রহণ করা।
নিজে চুপচাপ ঘরে বসে থেকে অন্যদের প্রতিযোগিতা দেখে নিজের শরীরকে সুস্থ রাখা যায় না। মানসিক পরিশ্রমের পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রম করা সুস্থ থাকার জন্য সবারই প্রয়োজন। শরীরচর্চা যাতে একঘেয়ে না হয়ে আনন্দদায়ক হয় তার জন্যই খেলাধুলার কথা বলা হয়েছে। প্রতিযোগিতা করে মারামারি লাগিয়ে দেয়ার জন্য খেলাধুলার প্রতি অতীতকাল থেকে এতটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চিন্তাই ছিল এসব প্রতিযোগিতা আয়োজনের পিছনে।
গ্রিসের এথেন্সে চার বছর পর পর অলিম্পিক খেলার আয়োজন করা হতো, যাতে দূর দেশে থাকা মানুষগুলো চার বছর পর অন্তত এই উৎসবকে ঘিরে একত্রিত হয়। মিলনের সুর ছিল সেখানে, বিচ্ছেদ বা বিরোধের নয়। ইউরোপের নবজাগৃতির কালে খেলাধুলাকে শারীরিক সুস্থতা ওএ মানসিক বিকাশের কারণ হিসেবে দেখা হয়েছিল। প্রতিযোগিতা সেখানে লক্ষ্য ছিল না, ছিল উপলক্ষ। বর্তমানে বাণিজ্যিক স্বার্থে খেলাধুলায় মুনাফা ও প্রতিযোগিতাই প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর সঙ্গে যুক্ত বিলিয়ন বিলিয়ন টাকার মুনাফা। খেলাধুলা একই সঙ্গে এখন সর্বক্ষেত্রে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রতীক। ব্যবসায়ীরা তাদের স্বার্থে প্রতিদিনই এটাকে সেই ধারায় পরিচালিত করে চলেছে। খেলাধুলার মধ্যে এখন মানসিক বিকাশের কিছু নেই, আছে আর্থিক সুবিধা লাভ। আছে কখনো কখনো হিংস্রতা। সেই কারণেই এখানে তৈরি হয় পরস্পরের প্রতি কঠিন এক ঘৃণার জগৎ বা উন্মাদনা। যা মানসিক বিকাশের চেয়ে মানসিক অসুস্থতার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
ভারত অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ফাইনালে যা ভীষণ রকমভাবে প্রতিভাত হয়েছে। এর আগেও এমনটা বারবার দেখা গেছে। খেলা দেখার আনন্দ নিয়ে বেশিরভাগ দর্শকরা খেলা দেখতে বসেন না। প্রতিপক্ষের পরাজয় বা নিজ পক্ষের জয় দেখার জন্য বিরাট উন্মাদনা নিয়ে প্রায় সবাই অপেক্ষা করেন। মানুষে মানুষে মিলনের চেয়ে খেলা এখন যুদ্ধের প্রতীক। দু’দলের খেলার নৈপুণ্য দেখে আনন্দলাভ বা খেলোয়াড়ের দক্ষতা উপভোগ করার চেয়ে প্রতিপক্ষের নৈপুণ্যকে তা ঘৃণা করতেই শেখায়।
ঘৃণা আর ক্রোধ অন্ধ করে রাখে দর্শকদের। ফলে নিজ দল হেরে গেলেও তার প্রতি ক্রোধে অন্ধ হয়ে আক্রমণ চালাতে পর্যন্ত দ্বিধা করেন না। যুক্তি দ্বারা বিচার করতে রাজি নন কেউ, দখলদারির উন্মাদনা ঘিরে রাখে তাদের মনমানসিকতাকে। দখলদারির মানসিকতা নিয়েই যেন খেলা দেখতে বসেন সবাই।
ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়নি বলে এইবার তার শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করার সামান্য সুযোগ নেই। পুরো খেলায় পারদর্শিতা দেখিয়ে একটি খেলায় হেরে যাবার জন্য তাকে কাপ না দেয়া হতে পারে, কিন্তু সত্য হচ্ছে ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলই এবারের মুকুটহীন ও কীর্তিমান শ্রেষ্ঠদল। রাজনৈতিক ঘৃণাকে রাজনীতির মাঠেই রাখা দরকার, খেলার প্রতিযোগিতার মধ্যে নয়। খেলার প্রতিযোগিতা হওয়া দরকার সর্বাঙ্গীন সুন্দর। খেলার মাঠে সকল প্রতিপক্ষের প্রতি ন্যায় এবং সম্মান প্রদর্শন করা দরকার, ভারতীয় ক্রিকেট খেলোয়াড়দেরও সেই কথাটা স্মরণ রাখতে হবে।
ভারতীয় বহু কীর্তিমান ক্রিকেট খেলোয়াড় সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বারবার। কিন্তু কীর্তির সঙ্গে ন্যায় স্থান পেলেই তা আরো বড় কীর্তি তৈরি করে। ফুটবলার পেলে তার উদাহরণ। ভারতেও এমন উদাহরণ অনেক আছে।
লেখক: শিক্ষাবিদ