গড়মিল
মারুফ ইসলামপ্রকাশিত : নভেম্বর ০২, ২০১৮
সেঁজুতি ফোন করেই যাচ্ছে করেই যাচ্ছে অথচ শাকিলের কোনো পাত্তা নেই। ছেলেটা যে কী! তিনবার রিং বেজে কেটে যাওয়ার পর চতুর্থবারের বেলায় ফোন কব্জা করে শাকিল। ফোন ধরেই ওপাশ থেকে শুনতে পায় সেঁজুতির অস্থির কণ্ঠ।
বাবু জানিস, আজ একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। তোকে বলবো বলে সেই কখন থেকে ফোন করছি অথচ তোর খবর নাই। কোথায় থাকিস, হ্যাঁ?
এই তো একটু বাথরুমে গেছিলাম। তা কি এমন মজার ঘটনা ঘটল?
আর বলিস না! আজ ওই ছাগলটা আমার বাসার সামনে এসেছিল। দুই ঘণ্টা দাঁড় করাই রাখছিলাম। হি হি হি...
কোন ছাগলটা?
আরে ওই যে ওই রাম ছাগলটা। তোর প্রতিদ্বদ্বী!
ও বুঝছি। ওই আঁতেল কবিটা?
হুম।
কখন এসছিল?
এই তো সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে। আমাকে ফোন করে বলে কী, মায়াবতী একটু বারান্দায় আসবা? শুনে তো আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এটা একটা কণ্ঠ হলো? কোনো মাধুর্য নাই!
তারপর? তুই কী বললি?
বললাম যে আমি বাসায় নাই। আন্টির বাসায় আসছি।
তারপর?
ও তো জানে যে আন্টি আমাদের বাসারই নিচ তলায় থাকে। তো বলল, যখন উপরে যাবা তখন একটু বান্দায় দাঁড়িও। এক মিনিটের জন্য।
তারপর তুই দাঁড়াইলি?
আরে নাহ্। পাগল হইছিস? আমি বললাম, পারবো না। তারপর ফোন রেখে দিছি।
তারপর আঁতেলটা চলে গেল?
নারে বাবা! শুনবি তো কাহিনি। তারপর প্রায় এক ঘণ্টা পর একটা এসএমএস এলো আমার মোবাইলে। কী যে হাস্যকর সব কাথাবার্তা। তুই পড়লে হাসতে হাসতে হিসু করে দিবি। লিখেছে কী, অসুস্থ চাচীকে রুমে একা রেখে আসছি। একটু দয়া করো, মায়াবতী। তোমাকে একনজর দেখেই চলে যাব।
চাচী মানে?
আরে ওর মা তো মরে গেছে ওর ছোটবেলায়। তারপর চাচীর কাছে মানুষ। ওই চাচী এখন অসুস্থ। ক্যান্সার ফ্যান্সার কিছু একটা হইছে মনে হয়। এরকমই শুনছিলাম একবার। সেই চাচীকে ডাক্তার দেখানোর জন্য মাঝে মাঝে নিয়ে আসে ঢাকায়। এখন মনে হয় ঢাকাতে নিয়ে আসছে আবার। তারে রুমে একা রেখে আমার বাসার সামনে আসছে একনজর দেখতে! হা হা হা! কত প্রেম দেখেছিস!
আহারে! বেচারা মজনু!
হিঃ হিঃ হিঃ! একদম ঠিক কইছস। পিরিতের ঠেলায় একেবারে দিউয়ানা হয়ে পড়ছে! আমি একবার বারান্দায় এসে শুকাতে দেয়া কাপড়ের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, মজনুর মতোই বড় বড় দাড়ি রাখছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তুই যদি দেখতি..। ও গড! একে তো চেহারা বলতে কিচ্ছু নাই। কালা, বাইট্টা, নরকঙ্কাল। শরীরে নাই এক তোলা মাংস। পাঠকাঠির মতো হাত পা। হাতের রগগুলো কেমন ঠেলে বের হয়ে থাকে। কি যে বিচ্ছিরি লাগে দেখতে! শার্ট, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট যাই পড়–ক, মনে হয় হ্যাঙ্গারে কাপড় ঝুলতেছে! সে আবার রাখছে দাড়ি! হা হা হা! কী যে কিদ্ভূত দেখাইতেছিল! মনে মনে কইলাম, হ্যারে কেউ ধইরা চিড়িয়াখানায় বাইন্ধা রাখে না ক্যারে...!
হা হা হা। তুই পারিসও। এভাবে কেউ বলে!
গড সয়্যার। তুই দেখলে তুইও তাই কইতিস। আল্লাহ মাফ করুক! একটা মানুষ এত কুৎসিত হয় কী করে!
কিন্তু ওই কুৎসিত চিড়িয়াকেই তো তুই এক সময় ভালোবাসতি।
আরে নাহ। কে বলেছে তোকে এইসব? কয়েকটা দিন একটু ভালো করে কথা বলেছিলাম ফোনে, তাতেই বলদটা মনে করছে তাকে আমি ভালোবাইসা ফালাইছি। আস্ত একটা বলদ!
বেচারা তোকে মনে হয় অনেক ভালোবাসে রে।
বাল বাসে! ও আমারে কোনোদিন নিজে থাইকা ভালোবাসার কথা বলে নাই। কোনোদিন একটা কিছু গিফট করে নাই। সামান্য কয়টা কাঁচের চুড়ি আর টিপ চাইতে চাইতে গলা ব্যথা কইরা ফালাইছি। দেয় নাই। ফকিন্নির ঘরে ফকিন্নি একটা...। আমিই বরং অনেক কিছু দিছি ওরে। আব্বু হজ থেকে আসার সময় অনকেগুলো পারফিউম আনছিল। সেখান থাইকা চুরি কইরা ওরে একটা দিছিলাম। ফকিন্নির বাচ্চা মনে হয় জীবনে ওই একটাই পারফিউম ইউজ করছে!
ছিঃ। এভাবে কেউ বলে নাকি!
আমি ভুল কিছু বলি নাই, বাবু। যা সত্যি তাই বলছি। ও সত্যিই একটা ফকিন্নি। না আছে ওর নিজের কিছু। না আছে ওর বাপের কিছু। সারাদিন খালি অভাব আর দারিদ্রের প্যানপ্যানানি শুনাইতো আমারে। অসহ্য লাগতো!
ওর ফ্যামিলিটা বোধহয় খুব গরিব, তাই নারে?
কী জানি! আমি কি দেখতে গেছি নাকি! তবে ও যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত স্রেফ টোকাইয়ের মতো লাগত দেখতে। কী সব কমদামি শার্ট প্যান্ট পরে আসত। পায়ের স্যান্ডেলটাও থাকত আধাছেড়া। খ্যাত...আস্ত একটা খ্যাত বুঝলি। জঙ্গল থাইকা উইঠা আসছে।
হুম বুঝলাম। তারপর কী হলো সেটা বল। সেই যে এসএমএস দিয়ে আকুল আবেদন জানালো তোকে বারান্দায় আসার জন্য। তারপর?
তারপর আর কী! এসএমএস দেখে রেখে দিলাম। তোর চাচীকে রুমে একা রেখে আসছিস তো আমি কী করবো? আমি তোকে আসতে বলেছিলাম নাকি আমার বাসার সামনে? যত্তসব ফালতু ইমোশনাল কর্থাবার্তা।
তারপর কী সে চলে গেল?
আরে নাহ্। বিরাট প্রেমিক সে। প্রেমিকাকে এক নজর দেখার জন্য এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে, এখনই যাওয়ার জন্য নাকি! এসএমএস করারও প্রায় এক ঘণ্টা পর ফোন দেওয়া শুরু করল। একবার, দুইবার, তিনবার। আমি ফোন ধরি নাই। মরেক গা তুই! আমার কী!
তারপর?
তার কিছুক্ষণ পর আবার এসএমএস পাঠাইছে, `চলে যাচ্ছি...।` আমি মনে মনে কইলাম, গো টু দ্যা হেল!
হা হা হা।
হা হা হা...। ওই কাপড়ের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, চোখ মুছতে মুছতে হাঁইটা যাইতেছে। ওই সময় আমার অবশ্য একটা কবিতা মনে পড়ছিল। ওইই শুনাইছিল একদিন:
ঐ যে দেখ দুঃখি প্রেমিক
যাচ্ছে পুড়ে রোদের ভিতর
ভিক্ষে দিলে ভিক্ষে নেবে
ছিন্ন বাসে শীর্ন দেহে
যাচ্ছে পুড়ে রোদের ভিতর...
হা হা হা। তোর ভিক্ষেই করা উচিত। ফকিন্নির ঘরের ফকিন্নি।
আহারে! বেচারা মজনু!
হা হা হা...।
চলছে খুনসুটি। সেঁজুতি ও শাকিলের মধ্যে। ওরা বন্ধু বান্ধবী। একই ক্লাসে পড়ে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফার্স্ট ইয়ার মাত্র। ওদের মধ্যে হয়ত একটু একটু করে প্রেম জন্ম নিচ্ছে। সম্পর্কের মাত্রাটা জ্বরাক্রান্ত থার্মোমিটারের পারদের মতো একটু একটু করে বাড়ছে। সেটা বোঝা যায় সেঁজুতি যখন মাঝে মাঝে শাকিলকে নাম ধরে না ডেকে ‘বাবু’ বলে ডাকে; আর শাকিল সেঁজুতিকে ‘বেবি’ বলে ডাকে। ওরা এখন একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের পুকুরে গোসল করে, সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে যায়, কস্তুরি হোটেল ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করে, মোটর সাইকেল নিয়ে লংড্রাইভে যায়...আরো কতো কি! একজনের জন্মদিনে আরেকজন রাতজেগে কার্ড বানায়, টি-শার্ট উপহার দেয়। যতক্ষণ ক্যাম্পাসে থাকে ততক্ষণ একসঙ্গে থাকে। ছায়া হয়ে মায়া হয়ে। ক্যাম্পাস থেকে যে যার বাসায় ফিরে গেলে ফোনে ফোনে লেগে থাকে। আঠার মতো। আংটার মতো। ওরা নানা বিষয় নিয়ে মজা করে, আড্ডা দেয়। আজ ওদের মজা করার বিষয় সেঁজুতির সাবেক প্রেমিক। আঁতেল কবি।
আচ্ছা বাদ দে তো বলদাটার কথা। বিকালে কি একটু বের হবি? বসুন্ধরা সিটিতে যেতাম। কসমেটিকস কিনি না কতো দিন! আদুরে গলায় বলে সেঁজুতি।
হোয়াই নট বেইবি? অফকোর্স যাব।
তারপর বিকেল নামে এ শহরে। মধ্য বিকেলের সিঁদুররঙা আলোকে পেছনে ফেলে একটা রিকশা এসে দাঁড়ায় বসুন্ধরা সিটির সামনে। একটা মোটর সাইকেলও এসে দাঁড়ায় ঠিক একই সময়। ‘কি টাইমিং মাইরি!’ হাসতে হাসতে বলে শাকিল। সেঁজুতিও নকুল দানার মতো হাসি ছড়িয়ে বলে, তুমি দেখি কলকাতার দাদাদের মতো কথা বলছ গো!
একটা নীল-সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পড়েছে সেঁজুতি। শাকিলের মনে হলো, একখণ্ড শরতের আকাশ যেন শরীরে জড়িয়ে রেখেছে মেয়েটা। খোলা চুল এলিয়ে পড়েছে ফর্সা কাঁধের ওপর। কানের দুপাশ থেকে কয়েকটা চুল উড়ছে এলোমেলো। লম্বা একজোড়া সাদা রঙের দুল বটের ঝুড়ির মতো ঝুলে আছে কানের লতি থেকে। কপালে নীল রঙের ছোট্ট একটা টিপ। কি যে অপার্থিব সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! এমন সৌন্দর্যের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে শাকিলের।
শাকিলের নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা দেখে লাজনম্র হয় সেঁজুতি। ‘কী দেখিস ওমন করে?’ শাকিল বলে, শরতের আকাশ দেখি। সেঁজুতি আবার নকুল দানা ছড়িয়ে দেয়। তুই একটা কী যে! তারপর হঠাত কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলে, আচ্ছা, এখন কী শরত কাল?
হ্যাঁ। তুই জানিস না? ওই যে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ, নীল আসমানে সাদা মেঘের ভেলা।
শরতে নাকি কাশফুল ফোটে। সেঁজুতি অভিমানভরা গলায় বলে, জানিস বাবু, আমি কোনোদিন কাশফুল দেখি নাই।
বলিস কি! আশ্চর্য হয় শাকিল। আজই তোকে দেখাব, চল। কসমেটিকস আরেকদিন কিনে দেব।
খুশিতে ডগমগ করে ওঠে সেঁজুতি। লাফ দিয়ে শাকিলের মোটরবাইকের পেছনে উঠে বসে। শাকিল আর কথা না বাড়িয়ে মোটরসাইকেল স্টার্ট দেয়। তারপর প্রায় চল্লিশ মিনিট পর দিয়াবাড়ি গিয়ে পৌঁছায়। এত কাশফুল! এত কাশফুল! খুশিতে লাফিয়ে ওঠে সেঁজুতি। দুপাশে বিস্তীর্ণ কাশফুল, মাঝখানে একচিলতে পথ; সেই পথ ধরে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে শুরু করে শাকিলের ‘বেইবি’। পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে সেঁজুতির ওড়াওড়ি দেখতে দেখতে শাকিলের মনে পড়ে, শিশুর মতো উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত এই মেয়েটাও কিনা অতীতে একটা প্রেম করেছে! একজন কবিকে ভালোবাসত সে। বছর চারেকের সম্পর্ক ছিল তাদের। তারপর কী কারণে কবির সঙ্গে স্পর্কের ইতি টেনেছে সেঁজুতি, তা পরিস্কার জানে না শাকিল। ভাসা ভাসা কথায় যতটুকু জেনেছে, তাতে মনে হয়েছে আপাদমস্তক আনস্মার্ট, অসামাজিক এবং অতিমাত্রায় অরোম্যান্টিক একজন কবিকে শেষঅব্দি মেনে নিতে পারেনি সেঁজুতি। সেঁজুতির ভাষায়, ‘রোম্যান্টিকতা শুধু তার কবিতাতেই পাওয়া যায়, জীবনাচরণে ছিটেফোঁটাও নেই’। এসব ছাড়াও বোঝার উপর শাকের আঁটি হিসেবে ছিল দারিদ্র। প্রথম প্রথম কবির ওইসব দারিদ্রক্লিষ্ট জীবনের গল্প শুনতে ভালোই লাগত সেঁজুতির। কেমন সিনেমা সিনেমা লাগত। কিন্তু শেষের দিকে এসে আর ভালো লাগত না। এক সিনেমা আর কত দেখা যায়! তারপরও সেঁজুতি চার বছর ধরে ক্রমাগত চেষ্টা করে গেছে কবিকে তার নিজের মতো করে গড়েপিটে মানুষ করে নিতে। কিন্তু পারেনি।
জীবন! কী বিচিত্ররূপেই না ধরাধামে প্রবহমান। একেক জনের জীবন একেকভাবে বয়ে যাচ্ছে। কারো সাথে কারো চাওয়া মেলে না। যদিওবা কিয়দংশ মেলে, বাকি রয়ে যায় সিংহভাগ। সেই সিংহভাগের হিসেব মিলাতেই পার হয়ে যায় গোটা একটা জীবন। শাকিলের এখন মনে পড়ছে তার বাবার কথা। মায়ের কথা। নিজের কথা। ধনাঢ্য বাবা তার। শহরের অভিজাত এলাকায় আলিশান বাড়ি তাদের। অথচ বাড়িতে একদানা সুখ নেই। মা নেই যে ঘরে, সে ঘরজুড়ে হাহাকার ছড়িয়ে থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু কী কারণে মা ছেড়ে গেছে বাবাকে, নাকি বাবাই তাড়িয়ে দিয়েছে মাকে, জানে না শাকিল। শুধু জানে, দু’চারদিন পর পর নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে বাড়ি আসে বাবা। মদ খেয়ে সারারাত চিৎকার করে। আর শেষরাতে বমি করে ঘর ভাসিয়ে দেয়। শাকিলের এসব ভালো লাগে না। সে পালিয়ে যেতে চায় দূরে কোথাও। বাবাকে বলেছিলও একবার, ‘বিদেশ পাঠিয়ে দাও আমাকে’। উত্তরে বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তার পেছনে একটি পয়সাও খরচ করতে রাজি নন তিনি। কেনইবা করবেন? শাকিলের বুকের ভেতরটা বলকওঠা ভাতের মতো গুমরে ওঠে, সে তো তার বাবার ঔরসজাত সন্তান নয়। তার মায়ের প্রেমিকের অবৈধ সন্তান!
বেলা পড়ে আসে। হলুদ আলোয় ম্লান হয়ে গেছে আকাশ। ধেয়ে আসা সন্ধ্যার আগমুহূর্তের সোনারোদ গায়ে মাখতে মাখতে কাশবনের ভিতর থেকে হাঁক ছাড়ে সেঁজুতি--‘ছবি তুলবি না? সানলাইট চইলা যাইতেছে তো!’
ক্যামেরার লেন্স ঠিক করে নেয় শাকিল। শাটারে চোখ রাখে। ‘চুল খুলে দে। হাওয়ায় উড়ুক। মুখটা আর একটু উঁচু হবে। হ্যাঁ, হ্যাঁ... পারফেক্ট। কোমরে হাত...। ওকে।’
ক্লিক ক্লিক। ছবি উঠতে থাকে একের পর এক। সেঁজুতি কাশবন মাড়িয়ে ছুটে আসে শাকিলের কাছে। ‘দেখি দেখি কেমন হলো ছবিগুলো।’ এভাবে আরো কিছু ছবি তুলতে তুলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। দূরে জ্বলে উঠেছে সড়কবাতিগুলো। এখানে, এই কাশবনের ছায়ায় শুধু ঘন সরের মতো জমে উঠছে অন্ধকার। সেঁজুতি তাড়া দেয়, ‘রাত হয়ে যাচ্ছে। আমাকে বাসায় রেখে আয়।’ শাকিল বলে, ‘হ্যাঁ, যাব। আর একটুক্ষণ থাকি না! দেখবি, একটু পর কি বিরাট একটা চাঁদ উঠবে আকাশে। এমন চাঁদের আলোয় প্রিয়মানুষের হাত ধরে হেঁটে বেড়ানোর বড় সাধ আমার।’
সেঁজুতির অন্তরে এক লহমায় খুশির ঝালর দুলে ওঠে। এমন রোম্যান্টিকতাই সে সারা জীবন প্রত্যাশা করেছিল কবির কাছে। পায়নি। কি ভুল মানুষের সঙ্গেই না চারটা বছর ব্যয় করেছে সে! কিন্তু বাসায় ফেরার তাড়া তার খুশির ঝালর ধরে টান দেয়। রাত হয়ে গেলে সেঁজুতির মাতৃজননী চিৎকার করে বাসা মাথায় তুলে ফেলবে যে!
সেঁজুতি উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে দেখে, শাকিল ফোনে কার সঙ্গে জানি কথা বলতে বলতে কাশবনের জঙ্গলের দিকে নেমে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে স্ট্যান্ড করে রাখা শাকিলের মোটর বাইকের ওপর বসতে বসতে সেঁজুতি আবছা আবছা শুনতে পায় শাকিলের কণ্ঠ, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ দিয়াবাড়ির শেষ মাথায়। রাস্তার বাঁ পাশ দিয়ে নেমে ডানে মোচড় নিলেই...। মজনু, তারেক, বল্টু, পলাশ, ওরা কই? তাড়াতাড়ি...।’ সেঁজুতি আর শুনতে পায় না। শুধু নিবিড় অন্ধকারে ছায়া ছায়া অবয়ব দেখতে পায়, কাশবনের ভেতর উবু হয়ে বসে পড়ল শাকিল। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বসল নাকি ছেলেটা? ভাবে সেঁজুতি। ছেলেরা পারেও! একটুও লাজ-শরম নাই! যেখানে সেখানে জিপার খুলে...। ফিক করে হেঁসে ফেলে সে।
খানিকবাদে, মিনিট দশেক হবে হয়ত, চারটি মোটরবাইক এসে ঘিরে ধরে সেঁজুতিকে।
২.
উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলছে।
টেবিলে সজোরে চাপড় দিয়ে চিৎকার করে ওঠে শাকিল, ‘আমি এক পয়সাও কম নেব না।’ চাপড়ের চোটে টেবিলের নড়বড়ে পায়া থেকে ঝুরঝুর করে ঘুণ খসে পড়ে। কবিও নাছোড়। টেবিলে পাল্টা আঘাত করে, ‘আপনাকে তো একেবারে মেরে ফেলতে বলি নাই। বলেছিলাম একটু ভয় দেখাতে। আর আপনি বন্ধুবান্ধব লইয়া মেয়েটারে ছিড়াখুইড়া খাইছেন!’
‘অতশত বুঝি না। এক লাখ টাকার চুক্তি হইছিল, এক লাখ টাকাই চাই।’ গর্জে ওঠে শাকিল। সে বাপের ড্রয়ার থেকে চুরি করে, এখান সেখান থেকে ধানাইপানাই করে লাখ দুয়েক টাকা জোগাড় করেছে। আর লাখ খানেক হলেই ফুরুৎ করে উড়াল দিতে পারে বিদেশে।এই সময় কিনা শুয়রের বাচ্চা কবি টালবাহানা শুরু করেছে!
কবি গাঁইগুঁই করেই যাচ্ছে, ‘আপনি মাইরা ফেললেন কেন মাইয়াডারে? হ্যাঁ, মাইরা ফেললেন ক্যান?’ তার উদ্দেশ্য গাঁইগুঁই করে যদি কিছু টাকা কম দেয়া যায়। এই প্রথম একজন প্রকাশক তার বইয়ের রয়্যালিটি দিয়েছে এক লাখ টাকা। এখন পুরো টাকাটাই গচ্চা যেতে বসেছে। আরে বাবা, ঝোঁকের মাথায় না হয় বলেছিল সেঁজুতিকে শায়েস্তা করতে। তাই বলে মেরে ফেলবে? সে তো সেঁজুতিকে ভালোইবাসত। চারটা বছর... আহারে, সোনায় মোড়ানো চারটা বছর। অথচ রাগের মাথায় কী একটা কথা বলেছিল শাকিলকে, সেটাই শাকিল বাস্তবায়ন করে ফেলবে, কে জানত!
উফ, জীবন! শুধুই গড়মিল।