গৌতম গুহ রায়

গৌতম গুহ রায়

গৌতম গুহ রায়ের গদ্য ‘আত্মমর্যাদার দ্রোহ ও সম্ভ্রম’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৪

১০ সেপ্টেম্বর। মধ্যরাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো। পথে বসে রাজ্যের ২৮টি মেডিক্যাল কলেজের আগামীকালের চিকিৎসকেরা, কাঁধে কাঁধ দিয়ে তারা, প্রতিবাদে অকুতোভয়, গানে শ্লোগানে প্রকৃতিও সম্ভ্রমে লুটায়ে পড়ে। তোমাদের এই লড়াইকে কুর্ণিশ। ‘অভয়া’ বিচার পাবে এই বিশ্বাস বুকে নিয়ে বাংলার মানুষ পথে নেমেছে, দ্রোহের হুংকারে। এই দ্রোহ ফিরিয়ে দিয়েছে বাঙালির  আত্মমর্যাদাবোধ । একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে ধ্বংস করতে হয় তার অর্থনীতিকে। অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে হলে ধ্বংস করতে হয় তার সংস্কৃতিকে। সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হলে ধ্বংস করতে হয় তার শিক্ষাকে। শিক্ষা ধ্বংস হলে ধ্বংস হয় তার আত্মমর্যাদাবোধ।

দেড় দশক ধরে একে একে শিক্ষা থেকে অর্থনীতিকে একে একে ধ্বংস করার কাজ শুরু হয়েছিল। আজ কিছুটা আশা জাগছে মানুষের গণজাগরণের স্ফুলিঙ্গে। আজকের দ্রোহ সেই আত্মমর্যাদা বোধের জাগরণ ঘটাচ্ছে, এটাই সবচেয়ে বড় সুসংবাদ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে হুংকার দেওয়ার, গত দেড় দশকের ‘থ্রেট কালচার’ আজ চুপসে গেছে জাগ্রত জনতার এই হুংকারের সামনে। বাঙালি ভেতো কিন্তু ভীতু নয় । ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির চরিত্র সমালোচনা করিলে, কথাটা কতকটা সত্য বলিয়া বোধহয়, তবে বলা যাইতে পারে, বাঙালির এ দুর্দ্দশা হইবার অনেক কারণ আছে । মানুষকে মারিয়া ফেলিয়া তাহাকে মরা বলিলে মিথ্যা কথা বলা হয় না । কিন্তু যে বলে বাঙ্গালী চিরকাল দুর্ব্বল, চিরকাল ভীরু, স্ত্রীস্বভাব, তাহার মাথায় বজ্রাঘাত হউক, তাহার কথা মিথ্যা । ‘বাঙালার কলঙ্ক’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন।

কয়েকদিন ধরে বাংলার মেডিক্যাল কলেজগুলোর জুনিয়র ডাক্তারদের তেজ দেখে এই কথাগুলো বারেবারে মনে পড়ছিল। যে দীর্ঘ প্রস্তুতি, কঠিন শ্রম ও অধ্যাবসায় লাগে ডাক্তারিতে সুযোগ পাওয়া ও পড়ার জন্য তা অনেকেই জানেন, সেই কঠিন যাত্রার শেষ পর্বে এসে গোটা যাত্রা পথটাকেই বাজী ধরে সত্যের জন্য যুদ্ধে নামা প্রবল এক মানসিক শক্তির পরিচয় দেয়,  সেলাম তোমাদের, বাংলার জুনিয়র ডাক্তারদের। বৈপরীত্য বাঙালির এক স্বভাব চরিত্র। একদিকে সত্যের পক্ষে মাটি কামড়ে কঠিন লড়াইতে থাকা মানুষেরা, এর বিপরীতে বিশ্বাসঘাতকতা, কাপুরুষতা ও হীনতায় আত্মবিক্রিত কিছু মানুষ। এরা কেউ সরকার পোষ্য গায়ক, কবি, নাট্যকার বা আরও কিছু। আবার বঙ্কিম– বাঙালি ভেতো কিন্তু ভীতু ছিল না, কোনো কালে।

আলেকজান্ডার ‘বাংলা’ আক্রমণ করতে সাহস করেননি গঙ্গারিডি জাতির পরাক্রমের জন্য, উগ্রসেনের প্রতাপের কথা জেনেছিলেন তিনি। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখেছেন, বাঙালিরা অস্ত্রবহন করতেন। রবার্ট ক্লাইভ তথাকথিত যুদ্ধ বা ১৭৫৭-র শেষে ইউরোপিয় সৈন্যদের বিদ্রোহ দমন করেছিলেন বাঙালি আধ্যুষিত লাল পল্টনের সাহায্যে। ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহ তথা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের পর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয় ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শাসক। বাঙালি সৈন্যদের নিয়ে সিরাজ কলকাতা দখল করেছিলেন খাঁটি ইংরেজ সৈন্যদের পরাজিত করে। আরও পেছনের পাতা উলটে বাঙালির মুছে দেওয়া ইতিহাস, যেখানে সমুদ্রযাত্রায় অসামান্য পারদর্শী এক জাতি, বৌদ্ধ ‘মহাবংশ’এ আছে বাংলার সিংহগড়ের সন্তান বিজয় সিংহ সিংহল বিজয় করেছিলেন। শুশুনিয়া লিপিতে পাওয়া যায়। বঙ্গ সন্তান মহাপদ্মনন্দর ক্ষত্রিয় নিধন ও শৈর্য-র সাক্ষ্যবাহী ইতিহাস।

বীরত্বের পাশাপাশি অত্যাচারও কম হয়নি বাঙালিদের ওপর। ১৬৬৩ সালে শিহাবুদ্দিন লিখেছিলেন, আরাকানের মগ জলদস্যুরা জলপথে এসে বাঙলা দেশ লুট করতো। হাতের কাছে যাদেরই পেত, ধরে নিয়ে যেত। তাদের হাতের চেটোতে ফুঁটো করে তার মধ্যে সরু বেত ঢুকিয়ে বেঁধে এনে নৌকার পাটাতনের নিচে ফেলে বন্দি করে নিয়ে যেত। সকালের দিকে সেখানে কয়েক মুঠো চাল ফেলে দিতো, যেন হাস মুরগিকে খাওয়াচ্ছে। এছাড়াও বর্গী থেকে নীলকর... অত্যাচারের অনেক ক্ষত বাঙালির দেহে লেগে আছে। কিন্তু অত্যাচারের কাছে সে পরাভূত হয়নি কোনো দিন।

বাংলার দীর্ঘ এই সৌর্যের ইতিহাসের আড়ালে রয়ে গেছে কিছু কালো অন্ধকারের মানুষ। এই ক্রান্তিকালে মুখোশ খুলে আজ প্রকাশ্যে এই অন্ধকারের মুখগুলোর কেউ কেউ নাট্যকার, গায়ক, লেখক।  ১৬২৯ বা তার সমকালে বাংলায় এসেছিলেন সুইডিস মিশনারি সেবেষ্টিয়ান মানরিক। মনরিক লিখেছিলেন, এজন্যই এরা কর সবসময় আগাম আদায় করে। কখনো কখনো এরা জোর করে কর আদায় করে। আর যেসব হতভাগ্যের কর দেবার উপায় নেই তাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে দাস করে নিলামে বেচে দেয়। এত অত্যাচার সত্ত্বেও বাঙালিরা সহজে কর দিতে চায় না। এদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা ভাবে, যতক্ষণ না তাদের ভালো করে মার দেওয়া হচ্ছে ততক্ষণ কর দেওয়া ভীষণ অপমানজনক। ভালো করে মার না খেয়েই যদি এরা কর দিয়ে ফেলে তাহলে এদের স্ত্রীরা এদের অবজ্ঞা করে। বলে যে, এত কষ্ট করে জড়ো করা টাকা যারা এত সহজে দিয়ে দেয় তারা অপদার্থ আর কাপুরুষ।

সেবেস্টিয়ান পরের পরিচ্ছেদে লিখেছেন, বাঙালিরা খুব অলস আর দুর্বল চিত্ত। এশিয়ার অন্য জাতির মতো এরাও স্বার্থ নিয়ে মেতে আছে। বাঙালিরা তাই ভীতু ও কাপুরুষ। হুকুম দেওয়ার চেয়ে তামিল করতেই বেশি পারে। তাই এরা এত সহজে বন্দিদশা মেনে নেয়। এদের কাছ থেকে ভালো কাজ পেতে হলে এদের সঙ্গে মৃদু ব্যবহার না করে  কর্কশ ব্যবহার করলেই ভালো ফল পাওয়া যায়। একটা প্রবাদ আছে এখানে, মারে ঠাকুর, না মারে কুকুর।

যখন গোটা বাংলার মানুষ তার সৌর্যের দাপট ফিরিয়ে এনে শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহ ঘোষণা করছে, দিনরাত এক করে পথে নেমেছে তখন এই ‘ভীতু ও কাপুরুষেরা’ স্বর্থের লোভে অন্ধকারের সাধনায় লিপ্ত রয়ে যাচ্ছে। শাসকের প্রসাদ, দানাপানি তাদের অবলম্বন। সরকারি খেতাব, মঞ্চ, অর্থের প্রতি এদের টান সেই কুকুরের মতো যে জলে মাংসমুখি কুকুরের থেকেও মাংস কেড়ে খেতে জলে ঝাপ দিতেও কুণ্ঠা করে না।

আজ আমাদের সামনে সেই ক্রান্তিকাল এসেছে যখন সাদাকে সাদা বলার কালোকে কালো বলার আত্মমর্যাদা উদ্ধার করতে হবে। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, অন্ধকারকে অভিশাপ দেওয়ার চেয়ে একটা প্রদীপ জ্বালা ভালো। অন্ধকার তো বিরাট, বিশাল ব্যাপার। সূর্য ডোবার পর আস্তে আস্তে নেমে আসে, সব একেকার হয়ে যায়, কোনো রঙ-রূপ আলাদা করা যায় না। মানুষের গড়া তখন যেন থেকেও নেই। খুবই বিপন্ন লাগে। এক পা এগোতে ভরসা হয় না। জানি না সামনে কী আছে।

তবু অন্ধকার তো সত্যিকারের কোনো জিনিস নয়। সে তো শুধু আলোর অভাব। যতই গাঢ় হোক, একটা জোনাকি উড়লেই ভয় কেটে যায়। জানালা দিয়ে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা গেলেই বুকে বল আসে। সেই দিকেই এগিয়ে চলার ইচ্ছা জাগে। আলো যখন আছে তখন মানুষ আছে। আজ সেই প্রত্যয় জেগে উঠছে,আলো যখন আছে, মানূষ আছে, ভয় কাটছে...

লেখক: কবি