গোপন সত্যি

পর্ব ৫

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৫, ২০১৯

আশ্চর্যের বলেন আর যাই যাই বলেন, এটাই আমার জীবনের সবচে বড় সত্যি। এ ঘটনাই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আপনি হয়তো বিশ্বাস নাও করতে পারেন। বিশ্বাস না করলেও ঘটনা মিথ্যে হয়ে যাবে না। যা সত্যি তা চিরকালই সত্যি।
আপনি বলেন, আপনার গল্প আমি বিশ্বাস করব।
জোর করে বিশ্বাস করার দরকার নেই। মন চাইলে করবেন, না চাইলে করবেন না।
আমার ধারণা, আমার মন চাইবে, আপনি বলেন।
তাহলে বলা যায়।

বদরুল আলম এবার বেশ আয়েশ করে বসলেন। এ বিষয়ে আমার কোনো রকম সন্দেহ নেই, ভদ্রলোক বেশ বড় ধরনের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের বিশাল আয়তন নিয়ে একটা গল্প বলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কী এমন গল্প যা বলার জন্যে মানুষটার এত আগ্রহ? আচ্ছা, শোনাই যাক না। ইচ্ছে না থাকলেও তো মানুষকে অনেক সময় অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। তাতে বড় ধরনের কোনো ক্ষতি তো হয় না মানুষের।
আমি ভাইজান বিয়ে করেছি পাঁচ বছর আগে। বছর কয়েক জাপানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি। আপনি তো জানেন, আমাদের দেশে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারÑ এ জাতীয় পেশার ছেলেরা রীতিমতো হাঁকডাক ফেলে দ্যায় বিয়ের বাজারে। দেশে ফিরে ভালো মাইনের লোভনীয় একটা চাকরিও জুটিয়ে ফেললাম। সরকারি চাকরি। তা বেজায় হইচই করে বিয়ে করলাম ভাইজান। আমার স্ত্রীর নাম আসমা। ঝিনাইদহ জেলার ডিসি মখসেদ উল্লাহর কনিষ্ঠ কন্যা। দেখতে খুবই রূপবতী। বাসর রাতেই হরিণীর মতো টানা টানা চোখের ওই রূপবতী মেয়েটার চোখের দিকে চেয়ে আমার মনে হলো, অসাধারণ। একে ছাড়া আমার চলবে না। কিছুতেই চলবে না। সত্যি বলতে কি, আসমাকে সাঙ্ঘাতিক ভালোবেসে ফেললাম। ঝোঁকের মাথায় অফিস থেকে মাসখানেকের দীর্ঘ ছুটিও নিয়ে নিলাম। কী যে এক ভালো লাগায় জড়িয়ে পড়লাম। আপনি গুণী মানুষ, শুনে থাকবেন হয়তো, যাকে বেশি ভালোবাসা যায়, সে-ই বেশি যন্ত্রণা দ্যায়। এই সহজ অথচ চরম সত্যিটা নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করলাম।
শোনেন বদরুল সাহেব, গল্পটা সংক্ষেপ করেন।
জি আচ্ছা। সংক্ষেপ করেই বলছি।

কিন্তু সংক্ষেপ করার কোনো লক্ষণ তার গল্পে টের পাওয়া গেল না। বরং বরাবরের মতো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগল। ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কী যেন সব বলে আসমা। মাঝরাতের দিকে হঠাৎ হঠাৎ উঠে বসে বিছানায়। মুখের ওপর দু’হাত দিয়ে কাঁদতে থাকে। কিছু জিগেশ করলে জবাব দ্যায় না। বড় দীঘল দুটো চোখ তুলে চেয়ে থাকে, যেন আমি অতি কুৎসিত কোনো প্রাণী। গিরগিটি কিম্বা টিকটিকি জাতীয় কিছু। একদিন শুনতে পেলাম, বাথরুমে নিচু গলায় কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। দরজায় কান পাতলাম। কান পাতার স্বভাব যদিও আমার না, তবুও পাতলাম। ছাড়া ছাড়া ভবে যা শুনলাম, তা হচ্ছে, তোমার কী লাজলজ্জা কিছুই নাই। উনি ভালো মানুষ। যারা ভালো তারা ভালো। আমারে মরতে কও তুমি? সে যেন টের না পায়। হঠাৎ থেমে গেল বাথরুমের ভেতরের কথা। কিছুক্ষণ পর অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে গলায় আসমা বলল, কান পাইতে অন্যের কথা শোনে শয়তানে। তুই শয়তানের চ্যালা। কানে তোর বিষ হবে, মরণ বিষ। জমে গেলাম আমি। একি বলছে আসমা? আমার বিবাহিত স্ত্রী? আমার বুদ্ধি বিবেচনা অকেজো হয়ে গেল। আমি যে কান পেতে আছি এ তো জানার কথা না বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে। সরে এলাম আমি। মাথার ভেতর বিঁধে রইল কাঁটা। এরকম আরো অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটতে লাগল, যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে অনেক খোঁজখবর করে যা জানতে পারলাম, তা হচ্ছে, ছেলেবেলায় এক সন্ধের দিকে তাদের বাড়ির পাশের পুকুরটায় সে গোছল করতে নামে। তার সঙ্গে তখন কেউ ছিল না। কিন্তু অনেকেই তাকে নামতে দ্যাখে। তারপরেই নাকি তাকে আর পাওয়া যায় না। সন্ধের পরপরই তার খোঁজ পড়ে গেল। জাল ফেলে, লোক নামিয়ে খোঁজাখুঁজি চলল সারা রাত। সমস্ত পুকুর তন্ন তন্ন করে চষে ফেললেও কোনো লাশ পাওয়া গেল না। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার হরো, ওই দিনই সন্ধেয় ঠিক একই সময়ে আসমাকে গোছল করতে দেখা গেল ওই পুকুরে। তাদের বাড়ির রাখাল ইউনুস গোয়ালঘরে গরু বাঁধতে এসে তাকে দ্যাখে। একটা আকাশ ফাটানো চিৎকার দিয়ে সে ছুটে যায় ভেতর বাড়ি। এ ঘটনায় সবাই ভয় পেয়ে যায়। এ চারদিন কোথায় ছিল জানতে চাইলে চোখ বড় করে আসমা খালি চেয়ে থাকে। তাদের কথাবার্তা যেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না। অনেক জেরা করার পর তার কাছ থেকে যা জানা গেল, তা হচ্ছে, সে তো পুকুরে গোছল করছিল। তবে চারদিন তো নয়। এই খানিক আগেই তো সে নামল।
তারপর থেকেই নাকি তার আচার-আচরণে অদ্ভুত সব কাণ্ড ধরা পড়ে। বিয়ের আগে আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। মেয়ে গছিয়ে দিয়েই তারা হাঁপ ছেড়েছেন। আমিও এরপর ব্যাপারটা তেমন আমল দেইনি। আস্তে আস্তে ভুলে যাওযার চেষ্টা করেছি। যা হয়, তা হয়। তার পাগলামি দেখেও চোখ বুজে থেকেছি। কিন্তু আমার ভবিতব্যে যে এরচেয়েও বড় বিপদ ওৎ পেতে থাকবে, তা কে জানত!

থামলেন বদরুল আলম। মাথা নিচু করে গম্ভীর মুখে একটুক্ষণ চেয়ে রইলেন নিচের দিকে। মাথা নিচু অবস্থাতেই বললেন, এভাবে বিযের দেড় বছরের মাথায় আমাদের প্রথম সন্তান এলো পৃথিবীতে। কন্যা সন্তান। মেয়েটা হুবহু তার মাযের মতো দেখতে। সেই রকম টিকালো নাক। টানা টানা চোখ। কপালটাও একই। মুখের আদলেরও কোনো ভিন্নতা আমার চোখে পড়ল না। তার মায়ের মতোই গায়ের রঙ। দুধে আলতায়। এও কি কখনো সম্ভব? কিন্তু সম্ভব তো হলো। প্রকৃতির বিচিত্র সব খেলার কতটুকুই বা আমরা জানি! কী বলব ভাইজান, আনন্দে আমি প্রায় কেঁদেই ফেললাম। এত সুখও লেখা ছিল আমার কপালে! সুখের দিন খুব বেশি স্থায়ী হয় না কারো। আমারও হলো না। মাস তিনেক পরেই মারা গেল মেয়েটা। খুবই স্বাভাবিক মৃত্যু। কোনো কারণ নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, মরে শক্ত হয়ে রয়েছে বিছানায়। নাকের ভেতর সার বেঁধে পিঁপড়ে ঢুকছে।