চিত্রকর্ম: মকবুর ফিদা হুসেন
গোপন সত্যি
পর্ব ৩
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৫, ২০১৮
চট করে কোনো মিথ্যে বলা যায় না। কেমন একটা বাধো বাধো ঠেকে। একটু ভেবে নিয়ে গুছিয়ে বলতে হয়। এমনভাবে বলতে হয় যাতে অন্যের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। মশলাপাতি দিয়ে পান সাজা যদি আর্ট হয় তবে সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যে বলাটাও একটা আর্ট। এ আর্টটাও অনেকেই ঠিকঠাকমতো প্রকাশ করতে পারে না, যেমন আমি। মনিরা অসুস্থ, এ ডাহা মিথ্যে বলার সময় গলার স্বর কী রকম কেঁপে গিয়েছিল। বুঝতে পারি না, মানুষ প্রতিদিন এত ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলে কেমন করে! বদরুল আলমকে এ মিথ্যে বলার দরকার ছিল। কিছু কিছু মিথ্যে আছে ঢাল-তলোয়ারের মতো আত্মরক্ষার কাজ করে। ভদ্রলোক যে টাইপের কথাবার্তা বলছেন, তা শোনার পর সারাবাড়ি মাথায় তুলবে মনিরা, এ আমি দিব্যি কেটে বলতে পারি। ভারি খুঁতখুঁতে স্বভাবের মেয়ে মনিরা। চমৎকার গোছানো প্রতিটা কাজ। কথা বলেও বেশ গুছিয়ে। অসংলগ্ন কোনো কিছু শুনতে পারে না। নিজস্ব ঢঙ ও রুচিতে চলতে ভালোবাসে। কথা যা বলার, মেপে মেপে ঠিক ততটুকুই বলবে। বেশি নয়, কমও নয়। এই মেয়েকে এখুনি ভদ্রলোকের মুখোমুখি হতে দেয়া যাবে না। তুলকালাম ঘটে যেতে পারে। তিনি চলে যাওয়া মাত্র চেপে ধরবে আমাকে, আচ্ছা, তুমি কি পাগলের ডাক্তার? এতদিন তো জানতাম তুমি ইউনিভার্সিটির টিচার।
একথার পর আমার বলার আর কিছু থাকবে না। চুপ করে চেয়ে থাকতে হবে। তোমার কাছে বুদ্ধিমান কোনো লোককে তো কখনো আসতে দেখলাম না। পাগল-ছাগলে সবসময় ভর্তি থাকে ড্রয়িংরুম। থমথমে মুখ করে বসে থাকা ছাড়া আমার কোনো পথ খোলা থাকবে না। মনিরা মুখে রক্ত এনে নিচু গলায় আরো বেশ কিছু শক্ত কথা বলবে। কিন্তু সীমা অতিক্রম করবে না কখনো। তার রাগের মাত্রা এর চেয়ে উঁচুতে উঠবে না কখনো। আমাকে অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে তার প্রতিটা কথা বুকের ভেতর লালন করতে হবে। কেননা ভবিষ্যতে একই কথা বারবার শুনতে বা বলতে কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। তাছাড়া মনিরার কণ্ঠস্বরও বেশ মিষ্টি। কেমন যেন বাঁশি বাঁশি মনে হয়।
আমাদের কোনো কাজের মেয়ে নেই। কাজের মেয়ে সম্পর্কে মনিরার একটা আতঙ্ক আছে। তার ধারণা, কাজের মেয়েগুলো চুরি করে পালিয়ে যায়। জিনিসপত্র হাতিয়ে নেয়ার অভ্যেসটা তাদের বংশগত। এ পর্যন্ত তিন-তিনটে কাজের মেয়ে এ বাড়ি থেকে মালপত্র হাপিস করে পালিয়েছে। শেষের জনের নাম ছিল রাফেজা। মহা ফাজিল মেয়ে। সবসময়ে ঠোঁটে পাঁচ টাকা দিয়ে ফুটপাথ থেকে কেনা লিপস্টিক ঘষতো। সময় নেই, অসময় নেই, এ ঘষাঘষির কাজটা খুব মনোযোগ দিয়ে সে করত। উঁচু দাঁতের ওপর কায়দা করে লেপটানো ওই রঙটা ভারি বিচ্ছিরি দেখাতো। ঘন ঘন ছাদে ওঠা ছিল তার প্রিয় অভ্যেস। মনিরা তার বাপের বাড়ি ফরিদপুর থেকে মাস তিনেক আগে মেয়েটাকে এনেছিল। বেশ কিছু কাপড়জামা, গয়না আরো কী কী যেন হাতিয়ে এক দুপুরে উধাও। পাশের বাড়ির কাজের ছেলেটার সঙ্গে নাকি ভাব-ভালোবাসা ছিল। সেও লাপাত্তা। রাফেজা নামের এ মেয়েটা সবচেয়ে জঘন্য যে অপরাধটা করেছে তা হচ্ছে, ক্যাসেট প্লেয়ারটা হাতিয়ে নিয়েছে। জিনিসটা মনিরা বিয়ের আগে তার জমানো নিজস্ব গোপন টাকা দিয়ে কিনেছিল। এ কারণেই হয়তো জিনিসটার প্রতি মনের একটা টান ছিল তার। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিদিন সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথের গান ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে বসে থাকা ছিল তার রুটিন। ওই সময়টায় বসার ঘরে আমি কিছু ছাত্র পড়াই। মনিরাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, মেয়েটার বাবা-মাকে ব্যাপারটা জানানো উচিত। জিনিসপত্রের দাবি-দাওয়া তো এত সহজে ছেড়ে দেয়া যায় না। গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মনিরা বলেছিল, না। সে আমার পক্ষে কোনোদিনও সম্ভব হবে না। আমি পারব না।
চলবে