গণপরিবহনে নারীদের যৌন হয়রানি, দেখার কেউ নেই

আইরিন সুলতানা

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২৪

আমরা জানি সভ্যতার শুরুতে নারীরা ঘরে ঘরে নির্যাতিত হতেন। বাংলাদেশ অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। আর এখন আধুনিক সভ্যতার বিকাশের ফলে ঘরে নির্যাতিত হওয়ার পাশাপাশি নারীরা বাইরেও নির্যাতিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বর্তমানে গণপরিবহনে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানির ভয়াবহতা আমরা প্রতিদিনই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখতে পাই।

 

এই দেশ আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে বলে আমরা আশাবাদী। এজন্য দেশের জনগণ, সরকার ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আমরা সাধুবাদ জানিয়ে আসছি। কিন্তু এত উন্নয়নের মাঝে আমাদের বাঙালির মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়ন কি আদৌ উন্নত হয়েছে? পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাবে নারীর হয়রানি বন্ধ করা কী সম্ভব হবে না? যানবাহনে নারী হয়রানিতে সরকারের সজাগ দৃষ্টিপাত কেন সম্ভব হচ্ছে না?

 

আমাদের দেশে বড় বড় মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল কর্ণফুলী ট্যানেল। আরও কত কত প্রজেক্ট। কেন এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে? শুধুই কী পুরুষদের উন্নয়নের জন্য নাকি নারীদেরও অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের জন্য? যোগাযোগের এই ব্যবস্থাগুলো তৈরি করে মানুষের কর্মঘণ্টা বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এই কর্মঘণ্টা বাঁচিয়ে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে। মেট্রোরেলের কারণে আমাদের ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা যানজটের হাত থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে এবং এতগুলো কর্মঘণ্টা নষ্টের কারণে দেশের প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হতো, তা আজ অনেকটাই মুক্ত হয়েছে। কিন্তু এই উন্নয়ন কী শুধুই পুরুষকেন্দ্রিক- নাকি নারীদের জন্যও? যদি নারীদের জন্যও হয় তাহলে কেন রাজধানী শহর থেকে শুরু করে প্রত্যেক কর্মব্যস্ত শহরগুলোতে চলাচলের পথে নারীরা আজ হয়রানির শিকার হচ্ছে? কেন নারীরা আজ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হচ্ছে? কেন নারীরা এক পরোক্ষ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকছে?

 

নারীদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজে ঘরের বাইরে আসা যাওয়া করতে হয়। কিন্তু চলাচলের রাস্তা নারীদের জন্য কেন নিরাপদ হয়ে উঠছে না এখনো? কেন পুরুষদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে যানবাহনে আরোহণ করতে হয়? কেন নারীদের জন্য বরাদ্দকৃত আসন থাকা সত্বেও নারীরা ব্যর্থ হয়? কে দেবে এতগুলো প্রশ্নের উত্তর?

 

এসব দুর্ভোগের কথা বলে আর কী হবে? নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন তো দূরের কথা, নারীদের তো অনেক সময় বাসেই উঠতে দেয়া হয় না। জোর করে বাসে উঠলেও সিট না থাকলে বাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেতে হয়, নারীদের সিটে পুরুষ বসে থাকে। বললেও উঠতে চায় না অনেক সময়। উল্টো ধমক শুনতে হয় সিট ছাড়া বাসে উঠা হলো কেন?

 

অথচ, ইসলাম নারীদের যে সম্মান দিয়েছে, তাতে হওয়ার কথা ছিল নারীদের মর্যাদা সর্বোচ্চ। নারী দেখামাত্রই পুরুষ নিজের আসনটাও ছেড়ে দেবে। নিজের কাজকে প্রাধান্য না দিয়ে কষ্টে জর্জরিত নারীকে সাহায্য করবে। এটাই ছিল ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু আমরা বাঙালি জাতির মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়ন সাধন করতে পারিনি। যার ফলে আমাদের এমন কিছু অনুপাত দেখতে হচ্ছে- যা অকল্পনীয়।

 

গবেষণায় দেখা যায়, দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ হত্যার ঘটনার ৫০% মহাসড়কে, ২৫ শতাংশ আঞ্চলিক সড়কে ও ২৫ শতাংশ রাজধানীর অভ্যন্তরীণ সড়কে ঘটে। মাঝারি পালস্নার বাসে ঘটে ২৫ শতাংশ, আন্তঃশহর বাসে ৩০ শতাংশ, স্বল্প দূরত্বের বাসে ২০ শতাংশ, দূরপাল্লার সিটিং বাসে ১৫ শতাংশ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। অধিকাংশ ঘটনার সঙ্গে পরিবহণের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজার জড়িত। যাদের বয়স ৩৫- ৪০ বছরের মধ্যে।

 

আরেকটি অনুপাত যদি আমরা লক্ষ্য করি, তরুণীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব শীর্ষক সমীক্ষা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যাতে দেখা যায়, দেশে মোট তরুণীদের মধ্যে ৬৫.৫৮ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হন।

 

এছাড়া ৪৫.২৭ শতাংশ তরুণী গণপরিবহণে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। গণপরিবহণ হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত বাস বা বাসস্ট্যান্ড যৌন হয়রানির মতো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন ৮৪.১০ শতাংশ তরুণী। গণপরিবহণে হয়রানির শিকার এসব নারীদের ৬৫ শতাংশ বিভিন্ন কটূক্তির মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন।

 

আজকের দিনে এত উন্নয়ন আমাদের দেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অথচ যেখানে উন্নয়ন বেশি প্রয়োজন সেখানে কারো কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। যার ফলে শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর জায়গায় স্পর্শ করা থেকে শুরু করে, ধাক্কাধাক্কি করে ওঠানামা- উঠার সময়ে হেলপারের বিরূপ মন্তব্যের শিকার নারীদেরই হতে হচ্ছে। অথচ লোক লজ্জার ভয়ে, আত্মসম্মানের ভয়ে অনেক নারীই প্রতিবাদ করতে পারছে না। এই উন্নয়নশীল দেশে নারীদের এই হয়রানি বন্ধেও যদি উন্নয়ন ঘটানো যায় তবেই সম্ভব হবে প্রকৃত উন্নয়ন।

 

পরিশেষে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, বিরোধী দলের নেতা একজন নারী, জাতীয় সংসদের স্পীকার একজন নারী। কোথায় নেই নারীদের সুউচ্চ অবস্থান? তাই নারীদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করতে যানবাহনে নারী হয়রানী, যৌন হযরানী থেকে নারীদের রক্ষা করতে কঠোরভাবে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। তবেই সম্ভব হবে মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়ন। তবেই সম্ভব হবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য পূরণ।