গণপরিবহন ব্যবস্থার চেহারা পাল্টানোর সময় এসেছে

শিমুল বাশার

প্রকাশিত : আগস্ট ০১, ২০১৮

পাওয়ার বয়েজ, ডার্ক শ্যাডো, নাইন স্টার, ডিস্কো বয়েজ, সেভেন স্টার, দ্য বিগ বস, ছোটন গ্রুপ, ছোটডার্ক শ্যাডো, রেড লাইট, দাদা বয়েজ, চকচকে আত্মা, ডিএসবি এফসি, আর ডট টিআর, ফিফটিন ক্লাব, নাফিজ ডন, পিএল রাকিব, সাইকো হৃদয়, অন্তর্ভুক্ত, শয়তানের দার, গনজিলা, এইচএসওয়াই এবং ডার্ক শোলস— এসব নাম নিশ্চয়ই আপনার পরিচিত। এরা আমাদের দেশেরই বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের গ্যাং।

১৯৮০ সালে মধ্য আমেরিকায় গৃহ যুদ্ধের সময় ‘এম এস ১৩’ (মারা সালভাট্রুচা থারটিন) নামে লস এঞ্জেলসে একটি কিশোর গ্যাং গঠিত হয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। যারা খুন, ধর্ষণ, মাদক পাচার ও মানব পাচারসহ নানারকম ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। ওই গ্যাংয়ে অন্তর্ভুক্ত কিশোরেরা মেক্সিকো, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্য আমেরিকার বিরাট এলাকার নিয়ন্ত্রণ করছে। যাদেরকে প্রতিরোধ করা এখন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বড় মাথা ব্যথার কারণ।

লন্ডনের ওয়ার্ল্ড ভিশনের এক জরিপ বলছে, মেক্সিকোর প্রতি দশজন কিশোরের সাতজনই বিভিন্ন গ্যাংয়ে নাম লিখিয়ে সংগঠিত অপরাধ কর্মে জড়িয়ে যেতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করে না। এসব গ্যাংয়ে জড়িত হবার কারণ নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে তার বেশিরভাগেরই ফলাফল পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন।

তিনদিন ধরে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পথে নেমে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও রাস্তা অবরোধ করে রাখছে। রাষ্ট্রের কাছে সুনির্দিষ্ট দাবি তাদের আছে। তার মানে, এ রাষ্ট্রের ওপর তাদের এখনো কিছু আস্থা অবশিষ্ট আছে। আগের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, যখনই কেউ দাবি দাওয়া নিয়ে পথে নামে তখন তাদেরকে রাজনৈতিক দলের গুটি মনে করে প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে অস্ত্রধারী পুলিশ দিয়ে দমন-পীড়নের নানারকম চেষ্টা করা হয়। সবশেষ কোটা আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতারণার শিকার হয়েছে।

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতায় নানারকম প্রবঞ্চনার শিকার হচ্ছে। বিচার চাইবে কার কাছে? বাসে চলাচল করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ছোট ছোট মেয়েরা। খুন হচ্ছে। রাস্তার পাশে নিরপরাধ দাঁড়িয়ে থেকেও প্রাণ দিতে হচ্ছে তাদের। এটা সত্য যে, আমি মনে করি না এক শাজাহান খান পদত্যাগ করলে সড়কের দুর্ঘটনা কমবে। কারণ এ রাষ্ট্রে অনেক শাজাহান খান আছেন। তবে হ্যাঁ, শিক্ষার্থীদের এবারের মতো ঘরে ফেরানো সম্ভব হবে। যারা পথে নেমেছে তারা পরিচয় গোপন করে আসেনি স্কুল-কলেজের ড্রেস জড়িয়েই এসেছে।

বহু বছর আগে এদেশে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের গণপরিবহনে হাফ পাশের একটা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তুলে নেয়া হয়েছে। সে প্রক্রিয়াটাও আমাদের অনেকেরই জানা। গণপরিবহন সংশ্লিষ্টরা আমাদের এসব ভবিষ্যতের সাথে যে দুরাচারের রীতি জারি রেখেছে, তা কারো অজানা নয়। অনেক অভিভাবক জানেনই না, তার সন্তান গতকাল রাজপথে নেমেছিল। অনেক অভিভাবক তার সন্তানের খোঁজ নিতে গিয়ে গতকাল হিমশিম খেয়েছেন। কিছু কিশোর-কিশোরীর ব্যক্তিগত কেস স্ট্যাডি থেকে বলছি, যাদের বাবা-মা জানেন না তার মেয়েটা বা ছেলেটা রাজধানীর সব কিছু সম্পর্কে খোঁজ রাখে।

স্কুলে যাবার বদলে দূর-দূরান্তে কখনো একা, কখনো আবার বন্ধুদের সাথে নিয়ে ঘুরতে চলে যায়। তারা যে একসময় সংগঠিত অপরাধের সাথে জড়াবে না, তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? এ শহরে চারদেয়ালে একলা বড় হওয়া এসব শিশু কিশোরের মনস্তত্ত্ব রহস্যঘেরা। যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক ট্রানজিশানের মধ্যদিয়ে তারা বেড়ে ওঠছে, তাদেরকে প্রচলিত শৃংখলার হিসাবে নিয়ন্ত্রণ করা আগামীতে কতটা সম্ভব, সে নিয়ে আমার সংশয় আছে। তারা এ সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক নগ্নতা এরইমধ্যে দেখে ফেলেছে তাদেরই চোখে। আজ যখন এ লেখাটা শুরু করলাম তখন পরপর দুটি খবরে শেষরাতের ঘুম একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল।

গাবতলীতে ট্রাক উল্টে চারজন আহত এবং কেরানীগঞ্জের আটি ভাওয়াল এলাকায় র‍্যাবের ক্রস ফায়ারে এক ব্যাক্তি মারা গেছে। এমনিতে গল্প ও কবিতা ছাড়া অন্যকিছু না লেখার একটা সিদ্ধান্ত আমার ছিল। কেন এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তাও একটু বিচার করলেই আপনারা সবাই বুঝতে পারবেন। সড়কে কেন দুর্ঘটনা ঘটছে? কারা এজন্য কে বা কারা দায়ী? কারা পরিবহন শ্রমিক? একজন চালক বড় হয়ে কি হন? বিআরটিসির এমনও চালক দেখেছি যার বেতন একজন পরিচালকের চেয়েও বেশি। বেসরকারি গণপরিবহন খাতের একজন চালক বড় হয়ে কি হন? তার কি বেতন বাড়ে? সরকারি কর্তাদের বেতন যে যুক্তিতে বাড়ানো হয় সে যুক্তি কি বেসরকারি খাতে অচল?

যে মেয়েটা প্রাণ দিয়েছে তার বাবাও কিন্তু একজন বাসচালক ছিলেন। তিনি তার ভালো ছাত্রী মেয়েটাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতেন, তার হিসাব কি এ রাষ্ট্রের কাছে আছে? একজন চালকও কি খুঁজে বের করতে পারবেন যিনি তার এ পেশাকে সম্মান করেন? যিনি মনে করেন, তার সন্তানও একদিন মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন চালক হয়ে? পেশাগত এত অমর্যাদা আর বৈষম্য সমাজে জারি রেখে আপনার সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে শ্রমের মর্যাদা রচনা পড়ান—  লজ্জা লাগে না? কত মিথ্যুক আর ধোঁকাবাজ বানাচ্ছেন ভবিষ্যত প্রজন্মকে, এ বোধ আপনাদের নাই?

যাত্রী চাহিদার কথা বিবেচনা করলে রাজধানীতে গণপরিবহন উপেক্ষা করার সুযোগ আমাদের নাই। তবে কি গণপরিবহন ব্যবস্থার চেহারা পাল্টানোর সময় এসেছে?

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী