ক্রীড়নক
নাঈমুল হাসান হিমেলপ্রকাশিত : মে ০৭, ২০২০
দিব্য হাঁটছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে সে। ভূপৃষ্টের এই যে রূপ তার পুরোটা আসে মেঘ থেকে। মেঘ বৃষ্টি না ঝরালে সব মরুভূমি। দিব্য মেঘের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। যাযাবর মেঘগুলোকে কী অপরূপ শক্তিই না দান করেছেন বিধাতা। এই মেঘ দেখেই মানুষ পুলকিত হয়। আবার এই মেঘ দেখেই মানুষ আতঙ্কিত হয়। শরৎতের ঝলমলে সকালে দুরন্ত মেঘের ব্যস্ততা দেখে মন প্রফুল্ল হয় দিব্যর। দিব্য গুনগুন করে গান ধরে, রঙ্গিয়া রঙ্গে আমি মজিয়াছি রে/মজিয়াছি রে, আমি ডুবিয়াছি রে...
দিব্য খুব ধীরে হাঁটছে। ব্যস্ত শহরের ফুটপাতগুলো খুব ধীর হয়। দেশের সমস্ত ব্যস্ত মানুষ জড়ো হয়ে ফুটপাতটাকে ধীর করে তুলেছে। এর ওর গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে। সবাই প্রথম হতে নেমেছে এই ট্র্যাকে, জীবন পণ লড়াই। বেশ বিরক্ত লাগছে দিব্যর। তার উপর জ্যোতিটা তার হাত ধরে আছে বেশ শক্ত করে। ঘামে ভেজা ব্যস্ত লোকগুলোর স্পর্শ বাঁচিয়ে চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে জ্যোতির। বেশ খুতখুতে মেয়েটা। বিধাতা সৃষ্টির সময় এই মহান মানবীর প্রতিটা কোষে কিঞ্চিৎ বিরক্তি মিশ্রিত করে দেন। সেই বিরক্তি তার সর্বাঙ্গে। সেই বিরক্তি বেশ ভালোই টের পাচ্ছে দিব্য।
দিব্যর হাতে জ্যোতির বজ্রমুষ্টি আরও শক্ত হচ্ছে ক্রমশ। দিব্যর শক্তি নেই এই হাত সরানোর, এমন কী শিথিল করার। অনুরোধটুকু করাও তার পক্ষে অসম্ভব। জ্যোতির সাথে দিব্যর প্রথম দেখা হয় তার মেসে। মাঝদুপুরে হঠাৎ ভাতঘুম ভেঙে ঢুলুঢুলু চোখে দিব্য তাকিয়েছিল এক জোড়া চোখের দিকে। চোখ বললে ভুল হবে, যেন এক জোড়া স্ফুলিঙ্গ। স্থির চোখে আগুন ঝরছে। মানুষের চোখ এতটা ভয়ংকর হতে পারে! দিব্য ভয় পায়। মেয়েটা পাশের চেয়ারটাতে বসে। মেয়েটা কাঁদছে, দুহাতে মুখ ডেকে কাঁদছে। কাঁদুক, মেয়েদের কাঁদতে কোনও বিশেষ কারণের দরকার হয় না। দিব্য আবার শুয়ে পড়ে। ক্রন্দন সঙ্গীতে তার ঘুম আরও গাঢ় হয়, এই অবস্থায় কোনও প্রশ্ন করা বা কিছু জানতে চাওয়া বৃথা। যাকনা কিছুটা সময়, শীতল হোক ধরিত্রী, এত তাড়া কিসের!
দিব্যর ঘুম ভাঙ্গে সন্ধ্যায়, আলস্য দেহটাকে পাশ ফেরায়। হঠাৎ মনে পড়তেই ধরফর করে উঠে বসে, তাকায় চেয়ারের দিকে মেয়েটা বসে আছে আগের মতই। তবে স্ফূলিঙ্গের স্থলে একটা স্নিগ্ধ আলো ছড়াচ্ছে এখন। ঝড় যখন বৃষ্টি সমেত আসে পৃথিবী তখন পুনর্জন্ম লাভ করে। সেই রুপ যে এত অপরূপ হতে পারে দিব্যর ধারণাও ছিল না। মেয়েটা চোখ তুলে তাকায়। দিব্য বিস্মিত হয়, যেন প্রথম তুলি হাতে কোনও শিশুর আঁকা অগোছালো ছবি।
চুলগুলো কিছুটা উসকোখুসকো, কালি লেপটে রয়েছে চোখের কোন জুড়ে, সরল স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে ঘরময়। নারীর সাথে চাঁদের তুলনা বুঝি এখানেই, জোছনা।
কিছু বলবেন? জানতে চায় দিব্য। মেয়েটা চোখ মোছে। তার ঠোঁট কাঁপছে। এই কম্পন শিহরণ জাগানীয়া, দোলে ওঠে ধরণী। তোলপাড় তোলে শান্ত পুকুরে। মেয়েটা ইতস্ততবোধ করে ক্লান্ত চোখে কিছুটা লজ্জা খেলে যায়। পরিস্থিতি সামলে নেয়ার এক অপূর্ব ক্ষমতা থাকে মেয়েদের। খালি গ্লাসের দিকে তাকায় মেয়েটি। দিব্য খেয়াল করে, জগেও পানি নেই তৃষ্ণা মেটানোর। দিব্য বিছানা ছেড়ে উঠে জগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
বেশ খানিকক্ষণ ধরে মাথায় পানি ঢালে দিব্য। দিনের ঘুম তার মাথা ভার করে দেয়, আলস্য বাড়ায়। আলস্য দূর করতেই এই পানি, শীতল পানি গড়িয়ে পরছে মাথার চার পাশে চোখ বন্ধ করে চিন্তা করে দিব্য। পানির শব্দ তার চিন্তার গতি কে ধীর করে, পানির শীতলতা স্পষ্ট করে কল্পনা। চোখ বন্ধ করে দিব্য, আজ আকাশে মেঘ নেই,
গুটি কয়েক তারা জ্বলছে, চোখ ঝলসে যায় সে আলোয়, বিষণ্ণ বোধ করে দিব্য। কলের শেষ ফোঁটা পানিটা কাঁধ বেয়ে গড়িয়ে পরে। টকটকে চোখ নিয়ে বের হয় দিব্য। কাধটা বেশ ভার লাগছে, চোখ বন্ধ করে হাঁটতে গিয়ে ঠুকা খায় দরজায়। কপালে হাত দিতে ইচ্ছে করে না তার, দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়।
তৃষ্ণার্ত রমণী মাথা তুলে তাকায়। মেয়েটা কি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে? চকচক করে উঠে দিব্যর চোখ, শিরশির করে রক্ত বেয়ে উঠে কানের পাশের শিরা বেয়ে। চোখ বন্ধ করে দিব্য, নিজেকে শান্তনা দিতে চায়, ক্ষণিক আনন্দ, রাত যে পুরোটাই বাকি। মেয়েটার থেকে একটু দূরে গিয়ে খাটের কোনে বসে দিব্য। কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ নেই উত্তর আসবে না। এই পৃথিবী নির্বাক মানুষদের খুব পছন্দ করে, কোন আবদার নেই, ভাল মন্দের বাছবিচার নেই, প্রশংসা বা তিরষ্কারের ভয় নেই ধরণের মানুষ গুলোই বেশ। দেখছে যা জুটছে খাচ্ছে। ভাল খেলো না মন্দ খেলো এ নিয়ে কেউ চিন্তিত হবে না। আলোটা চোখে লাগছে দিব্যর, বেড সুইচটা টিটে লাইট বন্ধ করে দেয় সে।
একটা মৃদু শব্দ হয় ঘরে। দিব্যর শিরদাঁড়া বেয়ে স্রোত নামে। সোজা হয়ে বসে দিব্য। লম্বা দমনেয়, বেশ কয়েকটা ইন্দ্রিয় সচল হয়ে যায়, এইত আসছে। মৃদু হাসিতে বাঁকা হয় দিব্যর ঠোঁট। শীরার ব্যাথাটা ক্রমশ্য পরিবর্তণ হচ্ছে, ভো ভো করে ঘুরছে চার পাশ, টেবিলের পাশ থেকে আওয়াজটা আরও বাড়ছে, একটা ঝড় শুরু হয়েছে যেন দিক বিদিক চুরমার হয়ে যাচ্ছে। চেয়ারটা বেশ জোরে নড়ছে। দিব্য কাঁপছে থরথর করে কাঁপছে। উঠে দাঁড়ায় দিব্য একটানে চেয়ারটাকে পেছন থেকে আছড়ে ফেলে মাটিতে। একটা ভোতা গুঙ্গানির শব্দ হয়। দিব্য বসে পরে, আঙ্গুলগুলো শক্ত হয়ে খুঁজতে থাকে আওয়াজের উৎস। সহসাই খুজে পায় লক্ষ্য। ঝড় বেড়ে চলছে প্রবল বেগে, ঝাপটানো, ঘর ঘর শব্দের ঘর ভরে উঠে। এক ফোঁটা উষ্ণ ঘাম নেমে আসে গাল বেয়ে দিব্য শিহরিত হয় শক্ত হয় হাতের জোর। ঝড় বেড়েই চলেছে। দিব্য উত্তেজিত হয়। উত্তেজনায় টানটান হয় প্রতিটি কোষ প্রতি অস্থি। হঠাৎই থেমে যায় সব। দিব্যর হাত শিথিল হয়, এক পাশে ধুপ করে পরে যায় দিব্য। ক্লান্ত সে মুচকি হাসিতে এক প্রশান্তি অনুভব করে সে। ইচ্ছে করে চিৎকার করে উল্লাস করে। ক্লান্ত সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে কাঁপছে সে ধড়ফড় করে কাঁপছে।
দরজায় ধুম ধুম শব্দে ঘুম ভাঙ্গে দিব্যর। উঠতে গিয়ে টের পায় সারা গায়ে ব্যাথা। অসহ্য ব্যাথা। কোন মতে নিজেকে টেনে তুলে দরজা খুলে দেয় দিব্য। জ্যোতি হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে। দিব্য জ্যোতির দিকে তাকায় আতকে উঠে দিব্য, টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পরে যায়,জ্ঞান হারায়।
দিব্যর জ্ঞান ফিরে হাসপাতালের বেডে। কপালে কোমল শীতল স্পর্শ টের পায় দিব্য তার সকল ইন্দ্রীয় মূহুর্তেই জাগ্রত হয়। চোখ মেলে তাকায় সে।
এক মাঝ বয়সি নার্স তার দিকে ঝুকে রয়েছে। মৃত্য হাসিতে ঠোঁট নাড়ছে মহিলাম। দিব্য তাকিয়ে থাকে। নার্স উত্তর না পেয়ে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে চলে যায়। দিব্য উঠে বসে হাতের স্যালাইনের সিরিঞ্জটা খুলে বের হয়ে আসে হাসপাতাল থেকে। রোদে চোখ ঝলসে যায়। শরৎতের ঝকঝকে রোদ। রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে উঠে আসে। টের পায় হাতে কোমল স্পর্শ। জ্যোতি তার হাত ধরে হাটছে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে ফুটপাত ধরে তাকে ফিরতে হবে সেই অন্ধকার ঘরে। এক রহস্য ময় খেলার অপেক্ষায় হাটছে তারা।।।