ক্রিস্টিয়ান কার্লসসন
ক্রিস্টিয়ান কার্লসসনের গুচ্ছকবিতা
ভাষান্তর: মাসুদ খানপ্রকাশিত : নভেম্বর ২৭, ২০২৪
কেপলিন মাছ
বড় মনোহর এই কেপলিন মাছ
ছোট-ছোট শরীর তাদের দেয় না উসকিয়ে
কোনোই সমস্যা, সমুদ্রের।
একযোগে নয়, বরং একে একে এসে
ঝাঁক বেঁধে ঘনীভূত হয় কেপলিনকুল
আর যেই ঘনিয়ে আসবে রাত্রি
অমনি উঠে আসবে কেপলিন ঝাঁক
মিলিত হবার জন্যে, হাওয়াদের সাথে
উঁচু-উঁচু মেঘেদের রুপালিধূসর কিংবা
নীল-নীল প্রতিফলন-শোভিত হাওয়াদের সাথে
ওইদিকে ফের
দিনের আলোর সাথে সাথে
কেপলিন-ঝাঁক নামতে থাকবে নিচে, আরো নিচে,
খুঁজে পেতে রঙের ঐকতান,
আর নিরাপত্তার খাতিরে
একশো পঞ্চাশ গজ অব্দি
মৃদু-মৃদু ছায়া, অগণিত সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম সুঁইয়ের মতন।
এইবার যে-কোনো শিকারি
যে নয় ত্রিকোণাকার, যে নয় মানুষের মতো;
বরং যে ডিম্বাকার, মাছের আকৃতি,
এবং বিমূর্ত ওই সোনালি-রুপালি ঝালরের পিছে-পিছে
আবছা ভেসে বেড়াচ্ছে যে
খুঁজে পাবে এইখানে তার দুপুরের ভোজ,
আর
রাতের কাজটা তো বরাদ্দ আছে মানুষেরই জন্যে
সেই সে-শিকারি
ভুলিয়ে-ভালিয়ে যাকে রাখা হয়েছে
সংখ্যাগুরুত্বের এক ভুয়া নিরাপত্তাবোধে।
ঝাঁক তো সুরক্ষা নয় কোনো
ঝাঁক শুধু সহজ করে দেয়
ছোট-ছোট মাছেদের বিনাশের পথ।
সত্যিকারের জীবন আমি করেছি অনুভব
বহুবার উপলব্ধি করেছি আমি
গোলাপ ফুলেদের জীবন
তাদের হাসিখুশি অন্তরঙ্গতা; আর মৃত্যুর যে দুর্দান্ত ঘ্রাণ,
তারও অধিক যে সৌন্দর্য,
তার এক চমৎকার নিদর্শন ওই গোলাপদের জীবন।
পাহাড়ি পথের ধারে,
একদা বাস করতো এক নারী,
নিচ থেকে উঠে-আসা ঠাণ্ডা হাওয়ার সঙ্গে
যে মিশিয়ে দিত সূর্যালোক
সোনালি-সোনালি কেশ আর দীর্ঘ ফর্সা দেহখানি তার
দোলায়িত হতো
পাহাড়ের যত খাড়া আর উঁচু-নিচু ধার বরাবর,
আর রোয়াকের চারধারে
হেলানো জংলি জায়গাটুকুতে
জন্মাত যে-ঘাস, সেই ঘাসেদের ওপর।
অন্যদের কাছে
সে ছিল একটি লিলিফুল, তবে
আমার কাছে সে একটি গোলাপ, তার ছিল
গোলাপের খোলামেলা অন্তরঙ্গ ভাব
যা কিনা
বাস্তব জীবন আর সেইসঙ্গে
সৌন্দর্যেরও এক সামান্য স্বভাব।
রেকর্ডের অপর পিঠ
ভাবছি আমি বসন্তের কথা ওহায়োর।
ভাবছি আমি বসন্তের কথা ফরাসি দেশের প্যারিসের।
প্যারিসে গিয়েছি আমি,
কিন্তু কখনো যাইনি তো ওহায়োয়।
নেচেছিলাম আমি ‘বিউটিফুল ওহায়ো’র তালে তালে
একদা অনেক আগে একটি কটেজে।
মেয়েটি পড়েছিল ট্রাউজার আর ফ্রক,
এবং উলেন মোজা, পাদুকাবিহীন।
কবি আছে একজন, লিখেছে সে ওহায়োকে নিয়ে,
নাম তার জেমস রাইট, নিশ্চিত করে বলেছে সে
কোনো এক জায়গায়: আর মাত্র দু’দিন বাদেই
বসন্ত আসবে ওহায়োয়।
চলে যাব আমি ফরাসি দেশের প্যারিসে
আমার কতক বন্ধু রয়েছে ফরাসি দেশের প্যারিসে।
বসন্ত খুবই পছন্দ আমার ফরাসি দেশের প্যারিসের।
তবে আমি খুব বেশি ভালবাসি ওহায়োর স্পন্দন,
সেইসাথে সেই মেয়েটিকে, যার কাছে ওই গ্রামোফোন
ট্রাউজার যার আঁটোসাঁটো খুব টাইট।
আমাদের সেই কবিটির নাম রাইট।
মনে তো হচ্ছে মেয়েটির বাড়ি ওই দূর ওরেগন।
গুরুত্বপূর্ণ কাজকারবার
খুব করিৎকর্মা, ছারপোকার মতন
যে কিনা ঝাড়–দারনির ধূলিঝড়ের পর
গা পালিশ করবে বলে
থামে কিছুক্ষণ।
চকচকে ক্ষুর একখানি,
পড়ে আছে একটুকরা চামড়ার ওপর
বেচারা কাগুজে ছুরি, মূলত ভোঁতা, ধারহীন,
চামড়ায় বাঁধানো এক মামুলি কাব্যগ্রন্থের ওপর
নিষ্প্রভ ইস্পাত বলে না কিছুই নিজের থেকে, শুধু
পনির, চামড়া, মোম, আর গদগদ প্রশংসা
এইসব কর্তনসম্ভব সামগ্রীর পাশে
জ্বলজ্বল করতে থাকে সজীব, সপ্রাণ।
এক ছায়ামানব
ছোট্ট এই নদীর মতন বয়ে যাব আমি
উপকূলে ওই কাঁপা-কাঁপা
রূপকাহিনির যে-দরিয়া, তার দিকে।
অতীতের অতিশয় গভীরে প্রোথিত...
ভেঙেচুরে বেরিয়ে এসেছি আমি একদিন,
তেমন কিছুই নেই করার আমার,
আমি এক ছায়ার মানব
নেচে যাচ্ছি হৃদয়বিহীন
এক পাকা ক্ষিপ্র নাচিয়ের সাথে
আমার পায়ের চারপাশে যে বরফ
তা টের পেয়েছিলাম আমি বহু আগে
এবং ত্যক্তবিরক্ত হয়ে সরে চলে গেছি
উষ্ণ ও সবুজ ভূমির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে,
সময়কে বয়ে যেতে দিয়েছি তো আমি পাশ কেটে আমার,
কখনোই খুব একটা বেশি কিছু থাকে না করার:
এমনি-এমনি-বয়ে-চলে এরকম কিছুর রূপকচিত্র যদি
আঁকতে চাও মনে, তবে
ছোট্ট এই নদীটিকে পাঠ করতে পারো
এইখানটায় এসে, তিলেক দণ্ডের তরে
নদীটি হারিয়ে যায় মাটির তলায়।
আমিও করতে পারতাম তা-ই।
নদীটির অবিচল গতিধারা,
আঁকাবাঁকা, সোজা, অথবা লুকানো
ধীরে ধীরে নিষ্কাশন করে চলে অববাহিকার জল।
যুগ-যুগ ধরে আমি দেখে আসছি
রূপকের শুকিয়ে আসা
আর ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া...
জীবন তো নয় কোনো নদীর মতন
বরং, নদী নিজেই জীবন
রূপকরহিত; নেই এমন রূপক কোনো
যাতে ছায়া টেনে দেওয়া যায় নাচিয়ের ওপর
অথবা পেরিয়ে যাওয়া যায় তাকে।
খুব একটা বেশি কিছু নেই করবার।
আমি এক ছায়ার মানব
নেচে যাচ্ছি নির্ভাবন
এক জাঁদরেল ক্ষিপ্র নাচিয়ের সাথে।
ক্রিস্টিয়ান কার্লসসন (১৯২২ - ২০১৪) আইসল্যান্ডের কবি। জন্ম আইসল্যান্ডের তিয়োরনেস অঞ্চলের এইভিক গ্রামের একটি খামারে। শৈশব কাটে নিকটবর্তী ছোট্ট শহর হুসাভিকে। আকুরেইরি বন্দরনগরীর জুনিয়র কলেজের শিক্ষা শেষ করে পাড়ি জমান আমেরিকায়। পড়ালেখা করেন ইংরেজি সাহিত্যে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে বিএ পাশ করেন ১৯৪৫-এ। এরপর চলে যান নিউ ইয়র্কে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এমএ করেন ১৯৪৭-এ। আরও বছর পাঁচেক আমেরিকায় কাটিয়ে ১৯৫২-তে তিনি ফিরে যান আইসল্যান্ডে এবং সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন পুরোপুরি। আইসল্যান্ডীয় সাহিত্য পরিষদের বোর্ড-সদস্য নিযুক্ত হন ১৯৭৯-তে। দেশপ্রেমিক পর্ষদ-এ ছিলেন ১৯৮৪-৮৫ সালে। লিখেছেন কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ; করেছেন অনুবাদ। সম্পাদনাও করেছেন বেশ কিছু বই।
কবিতাসংগ্রহ বের হয় ১৯৭৬-এ। Davíðspenninn (ডেভিডের লেখনী) পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ৯১-এ, তার “কবিতাগুচ্ছ ৯০” এর জন্য। এর বছরখানেক পরে পান জাতীয় সম্প্রচার সার্ভিস লেখক পুরস্কার।