অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

ক্যামেলিয়া আলমের গল্প ‘লফোটেন: পোষ না মানা দ্বীপ’

প্রকাশিত : আগস্ট ১৯, ২০২০

লালচে সরু সোনালি কাটাকুটি আকাশজুড়ে। এক সাদা আশটে আলোয় ল্যান্ডিংয়ের সরু শেষ মাথার ঘাস সবে উঁকি দিচ্ছে। কাচের এই প্রান্তের এয়ার টাইট ইমিগ্রেশন কম্পাউন্ডেও একের পর এক প্লেনের ঘর্ঘর আওয়াজ। কানে তালা না লাগলেও তীক্ষ্ণ শব্দে প্লেনের হুইসেল শিষ কেটে যাচ্ছে মেলিয়াস, ইনকাস আর স্টেপিসে। মধ্যকর্ণের তিন অস্থি। যাদের কাজ হলো, শব্দতরঙ্গকে কর্ণপটহ থেকে অন্তকর্ণে প্রবাহিত করা। আলোকপর্ণর সিগারেটের তৃষ্ণা পায়। পকেট থেকে এক পোলো বের করে মুখে রাখে। এক ভুলতে আরেক! ঠিক এই সময়েই মনে পড়ে ওর শবনমের কথা।

সেদিনের শবনম— শ্যামলা, নাকের পাশে এক জরুল, কোকড়া ছোট করে ছাটা পনিটেইল বাধা চুল নিয়ে মিষ্টি মুখের এক মেয়ে হাইহিল পায়ে খটখট করে কলা ভবনের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাবার এক ছন্দময় শব্দে বাকি সবার মতোই আলোকপর্ণ ঘুরে তাকিয়েছিল। শবনমকে প্রথম দেখাটা বেশ জোড়ালো ভাবেই মনে আছে ওর। অথচ মামুলি এক পরিচয়ের সম্পর্ক। মনে রাখার মতো কেউ না কারো। তবু বেশ মনে আছে। জগতে কিছু মুখ হয়তো এমনই যে কোন সম্পর্ক ছাড়াই মনে থেকে যায়।

স্বাধীন হয়েছে দেশ তখন দশ বছর। শৈশব না পেরুতেই দেশের একের পর এক বিপর্যয়। থমথমে পরিস্থিতিতেও ক্যাম্পাসের জটলাগুলোর মুখরতা মাঠ, ক্যাফেটেরিয়ার সিড়ি, মধুর ক্যান্টিনজুড়ে। হুট করেই সমাজতন্ত্রকে কী করে পাশ কাটিয়ে কালো থাবার মতো ঘিরে ধরেছে পুঁজিবাদ। তা নিয়ে ক্ষণে ক্ষণে ঝাঝালো, ধারালো, ক্ষীণস্বরের গুরুগম্ভীর চপল আলাপ। মধুর ক্যান্টিনের পাশে নাটঘরটায় নাটকের রিহার্সেল চলে বহু রাত অবধি। ‘এবার রাজার পালা’ নাটকের রিহার্সেলে অবনীর সাথে শবনম আসে একদিন। টিকালো নাকের উপরে কালো ভাসা ভাসা চোখ চঞ্চল হয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে রুমের। অল্প আলাপেই আড়ষ্টতা ভেঙে রীতিমতো বন্ধু হয়ে যায় সবার। আর দিন ঘুরতেই ক্যাম্পাসে সেলিব্রিটি। সাংস্কৃতিক জগতে নাম লেখাবার জন্য না। শবনম জনপ্রিয় হয়ে উঠে খরচের পাবলিক হিসেবে। দেদারসে পয়সা খরচ করে মেয়েটা। দশ মিনিটের পরিচয়ের সূত্র ধরে দঙ্গলের সাথে তুংকিং এ গিয়ে শবনমের খরচে খেয়ে আসার অভিজ্ঞতা আছে ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র জুনিয়র অনেকের।
শবনম সাজতো বেশ সুন্দর। শাড়ি পরতো প্রায় সময়ই। পাতলা জর্জেটে ঢাকা নাভির বিন্দু হা করে দেখতো সবাই। স্লিভলেস পরে ক্যাম্পাসে এসে তাক লাগাতো। চলনে বলনে মুগ্ধ হবার মতোন এক মেয়ে ছিল সে। ওর পয়সার স্রোতে রোজই ভেসে আসতো নতুন নতুন মুখ।

কিছুদিনের মাঝে আলোকপর্ণ ব্যস্ত হয়ে গেল পরীক্ষা নিয়ে। পরীক্ষা শেষেও তারুণ্যের স্বপ্নচ্ছটা হারালো না। চাকরি খুঁজতে খুঁজতে মঞ্চ নাটকে নির্দেশনা-লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত জীবন আসায় শবনমের পাশের পতঙ্গসমেত জীবনের রাশ টানলো। একসময় ক্যাম্পাসে আস্তে আস্তে আসাও কমে গেল আলোকপর্ণর। ফুলকির মতো এসে দপ করে নিভে গেল শবনম আলোকপর্ণর জীবন থেকে। আজকের শবনম— দীর্ঘদিন আলোকপর্ণ ফ্রান্সে। ফরাসি বউ কাতেরিনা আর মেয়ে হেযেলকে নিয়ে ফরাসি জীবন। ফরাসি টিভির জন্য ডকুমেন্টারি বানায়। ২০ বছর পরে দেশে এসেছিল দিন পনেরোর জন্য। ধানমন্ডি ২৭ এ বন্ধু জামানের বাসায় ক’টা দিন কাটাতে। যদিও পরের সিনেমার জন্য কিছু বিষয় শুট করা ছিল মূল উদ্দেশ্য। বহুদিন পর আয়নায় দেখা মুখটা যেমন অচেনা, তেমনই অচেনা লাগে ঢাকা শহর আলোকপর্ণর কাছে। ৩২ নাম্বারের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির মন বিষণ্ণ করা চেহারা আর নাই। ভেহিক্যাল এন্ট্রি রেসট্রিকটেড বলে মিনি পার্কের ‌আড্ডায় মাতে মানু্ষ বাড়ির সামনের চত্ত্বরটায়।

ছাইরঙা প্লায়ার মতো হালকা পায়ের এক বিষণ্ণ সন্ধ্যা হবো হবো কালে সেই বাড়ির সামনের রাস্তায় শবনমের সাথে দেখা— ৩৫ বছর পর। অনাকাঙ্ক্ষিত চেহারা নিয়ে হেঁটে আসছিল। প্লায়া আলোকপর্ণর ফরাসি শান্ত বিড়াল। ধূসর গায়ের রঙের সাথে সবুজ নীলে মেশানো জ্বলন্ত চোখ। হেযেলের সঙ্গতার জন্য নিয়ে আসা। ফরাসি নাম না রেখে ওর স্প্যানিস নাম রেখেছে কাতেরিনা। প্লায়া শব্দের অর্থ সমুদ্রতীর। প্লায়াকে দেখলে ওর এই নামের স্বার্থকতা বুঝতে সমস্যা হয় না কারও। আজকাল প্লায়া আলোকপর্ণর চিন্তা জুড়ে এত বেশি থাকে যে, যে কোনও অবসরে ওর নরম থাবা আঁচড় কাটে মগজের ভেতরে।

দেশে আসার দিন দুয়েক পর এক গরমের বিকেলে আলোকপর্ণ বসেছিল ভেহিক্যাল এন্ট্রি রেসট্রিকটেড এরিয়ায়। কারণ ছাড়াই। এক নারী হেঁটে আসছিল বাকি পথচারীদের মতো। কাজের তাড়া না থাকা ছন্দে। আলোকপর্ণর চোখ অভ্যাসবশে দেখে। উজ্জ্বলহীন অবয়ব এক। পথের স্থানান্তরিত দৃশ্যের মতো নারীটির থেকে দৃষ্টি সরে যাবার মুহূর্তে চোখাচোখি হয়। নারীটির চোখ জ্বলে ওঠে। শিকারির ধূর্ততায় চোখের পাতা পড়ে। পিগালীর রাস্তায় বহুবার এই চোখের দেখা পেয়েছে আলোকপর্ণ। তখনও অচেনা নারী। আর চোখের ইশারা আলোকপর্ণকে কিছুটা বিস্মিত করেছিল। কারণ নারীর বয়স আর পোষাক দুইয়ের সাথে অভিজ্ঞতার হারলটের বয়স পোশাকের পার্থক্য। এদেশের বিবেচনায়। বয়স ধরতে না পারলেও ৫০ এর নিচে না তা শুকিয়ে ঝুলে যাওয়া গলার ফুলে ওঠা শিরা থেকে বোঝা যাচ্ছে। রঙ ফিকে হওয়া সুতির নীল ফুলের ছাপা পরিষ্কার এক কামিজ পরা। মাথায় সুতির ঘোমটা আধখানা করে তোলা। নিজের মন না চোখ কার প্রতি আস্থা রাখবে ভাবতে থাকে। খানিকটা কুণ্ঠা নিয়ে চোখ সরিয়ে ফেলে। বয়স আজকাল স্বাভাবিক চিন্তা করতে অক্ষম কেন সেই ভাবনায় ডুবতে না ডুবতে আলোকপর্ণর কাছাকাছি চলে আসে নারীটি। চারপাশে তাকাবার ছুতো করে আলোকপর্ণকে বলে, সরে বসেন প্লিজ।

আলোকপর্ণ কৌতূহলী হয়ে ওঠে। এদেশে এতদিন পরে আসা। মাত্র দুদিনে আন্তরিকতায় ভেসে দেশের মানুষের বদলে যাওয়া চেহারাকে এখনও তেমন ধরতে পারেনি। দেশে ধর্মান্ধতা, খুন, ছিনতাই, গরম, যানজট, স্বার্থপরতা বেড়েছে শুনে এসে আপাতত যানজট আর নারীদের সজ্জার কিছু পার্থক্য ছাড়া বাকিগুলোর মুখে পড়েনি এখনও। আলোকপর্ণ সরে বসে অন্য দিকে তাকায়। পাশে বসা নারীর অস্তিত্ব এমনভাবে মনে গেড়ে বসে যে সরানো চোখখানায় রাস্তা, গাছ আর বাকিরা অস্তিত্বহীন হয়ে কেবল চোখে ঝুলে থাকে। আর চোখ ফিরিয়ে রাখা পাশের নারীটির অস্তিত্ব কৌতূহলী মনে ঘাপটি মেরে বসে থাকে।
‘আজ খুব গরম।’

অস্তিত্বটি শব্দ করে এবার। আলোকপর্ণর কৌতূহল বাড়লেও মুখ ফেরায় না। পাশে বসা নারীটি ঠিক কী চাইছে তা উপলব্ধির চেষ্টা করে। স্নায়বিক উত্তেজনা সেখানে নাই। কেবল জানার এক আগ্রহ। বলার সাবজেক্ট হিসেবে। ভদকা বা টাকিলায় চুমুক দিতে দিতে দেশ নিয়ে ফিরে যাওয়া প্রবাসীর আড্ডার উপকরণ হয়ে। বেশ সময় চুপচাপ। বাদামের খোসা ভাঙা শব্দ, পায়ের শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা হর্ণ আর মানু্ষের ছাড়া ছাড়া টুকরো কথার শব্দ ভাসতে থাকে দুইজনের নিঃশব্দ জুড়ে। পাশাপাশি বসা দুই অস্তিত্ব কেবল সঙ্গতা দিতে থাকে। কারণ বুঝবার অপারগতা নিয়ে। পা টান টান করে ঘাড় নাড়ায় আলোকপর্ণ। পকেট থেকে এক সিগারেট বের করে ধরাতেই, মুখের সামনে বসে সিগারেট ধরালেন যে, সিগারেট খেলে দূরে বসে খান।

আলোকপর্ণর হাসি পায়। এই নারী নিজের ইচ্ছাতেই তার পাশে বসেছে। আশেপাশে অনেকেই সিগারেট টানছে। আলোকপর্ণর তাই বাধা নাই কোন। অন্যের খারাপ লাগলে তার নিজেরই জায়গা ছেড়ে ওঠার কথা। আলোকপর্ণই এখানে বসেছে আগে। সে আগে বসলেও কথা হতো। তবু আলোকপর্ণ আস্ত সিগারেটের আগুন নিভিয়ে চোখ মেলে ডাস্টবিন খুঁজতে থাকে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে। নারীটি এবার কিছুটা নমনীয় হয়, ডাস্টবিন খুঁজছেন? আশপাশে পাবেন না।

আলোকপর্ণ সিগারেট পায়ের কাছে ফেলে কপালের বিন্দু ঘাম মুছতে থাকে পকেট টিস্যু বের করে। নারীটি আলোকপর্ণর কোনও সাড়া না পেয়ে কিছুক্ষণ পর গলাখাকারী দিয়ে বলে, আসলে আমার এজমাটিক সমস্যা আছে বলেই সিগারেটের গন্ধে দম আটকে আসে। মাইন্ড করেননি তো?

নাহ, আলোকপর্ণ স্মিত গাম্ভীর্য নিয়ে বলে। মৃদু হাসি মুখে লেগে থাকে।
আপনার বাসা আশপাশেই?
হ্যা, একটু থেমে থেমে বলে আলোকপর্ণ। সত্য আর মিথ্যার মাঝে কিছু বিষয় থাকে। অপ্রয়োজনীয়তা।
কম কথা বলেন আপনি?
এবার আলোকপর্ণ ঘুরে বসে, না, ঠিক তা না। তবে বলার মতো আসলে কিছু তো নেই। আপনি থাকেন কই? আশেপাশে?
শংকরে। আশপাশে ঠিক না। কী করেন আপনি? ব্যবসা?
না। সিনেমা বানাই।
নারীটি ঘুরে তাকিয়ে আলোকপর্ণকে দেখে, আমার এক বান্ধবীর বরও পরিচালক। সানাউল হক। মারা গেছে অবশ্য। আপনার নাম কী?
আলোকপর্ণ।
নারীটি কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে চুপ করে। স্বগতোক্তির মতো দূর থেকে ভেসে আসা ধ্বনির শব্দ ভেসে আসে আ্লোকপর্ণর কানে, আলোকপর্ণ বলে একজনকে চিনতাম যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। অবনী আপার বয়ফ্রেন্ড ছিল।

আলোকপর্ণ চমকে তাকায়, আপনার নাম কী?
নারীটি ইতস্তত হয়ে বলে. নাসিমা।
আলোকপর্ণ চুপ হয়ে যায়। মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, আপনি সত্য এড়িয়ে গেলেন কোন কারণে?
এরপর আবারও নিঃশব্দ সময়ের গুমোট বাতাস হালকা হয়ে ঝিরঝিরে স্পর্শ দিতে থাকে পরস্পরকে।
আপনার কন্ঠ কেমন যেন চিনি মনে হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই নামটা মাথায় আসছে না, আলোকপর্ণ যেন নিজেকেই প্রশ্ন করে।
নারীটি আর কিছু না বলে আচমকা উঠে দাঁড়ায়, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। আসি আমি।

হনহন করে হাঁটা শুরু করতেই নামটা বিদ্যুতের মতো মাথায় এলো। ঘুরে থাকা অবয়বকে চিনতে আর কষ্ট হলো না। মুখ অচেনায় অস্পষ্ট হয়ে গেলেও ঘুরে থাকা মানুষটির অবয়ব একদম স্পষ্ট। মুখ থেকে তাই বেরিয়ে এলো, শবনম!

নারীটি পিছলে ঝাকুনি খেল। চমকে তাকাতেই আলোকপর্ণ আর দেরি না করে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
তুমি শবনম! এত বদলে গেছ?
মাথায় ঘোমটা টানা, মুখের বয়সের ভাঁজের বাইরেও কেমন যেন এক কালো ছোপে ঢাকা মুখাবয়ব। লাবণ্যহীন মুখের কপালটা আলাদা করে চোখে পড়ে। মনে হয় ঠেলে বেরিয়ে আসছে। আধা ঘোমটার ফাঁকে পাতলা চুলগুলোর চাইতে সাদা ত্বক বেশি চোখে পড়ে। নাকের পাশে বড় তিলটা কেবল আগের মতোই আছে।

আলোকপর্ণ শবনমকে নিয়ে কাছাকাছি এক রেস্টুরেন্টে বসে। কাচের দেয়ালের পাশে মুখোমুখি বসে সহজ হতে গিয়ে বলে, কী করছো তুমি?
আলোকপর্ণর মনে হয়, প্রশ্নটা বোকার মতো হয়ে গেল। এখন রিটায়ার্ডের বয়সে পৌঁছে গেছে। এই সময় এসব প্রশ্ন করা রীতিমতো অভব্যতা। তাড়াহুড়া করে প্রসঙ্গ পাল্টাতে ভাবতে থাকে কী বলা যায়। এসময় শবনম তড়িঘড়ি করে বলে, এই তো স্কুল করছি। ইংলিশ মিডিয়ামের।
বাহ, ভালো তো। বাংলা মিডিয়াম কী চলে না এখন আর?
তা চলে। কিন্তু বাংলা আর কে পড়ে! ফকিরা টাইপ লোক ছাড়া। সারা পৃথিবীর কথা বাদই দিলাম, পিয়ন ছাড়া দেশের কোথাও ইংলিশ জানা ছাড়া কাজই তো পাবে না কেউ।

আলোকপর্ণ বিস্মিত হয় ওর ভাষা শুনে। কেমন মেলাতে পারে না। এই সেই শবনম? যাকে ঘিরে থাকতো কত ছেলে। যার চলন বলন রপ্ত করতে রীতিমতো তপস্যা চলতো মেয়েদের।
কেন? তুমি আমি তো বাংলাতেই পড়েছি। আমরা কী অনারারি কাজ করছি না?
আমাদের যুগ আর এই যুগ এক কথা না। এখন কম্পিটিশন চারপাশে। আপনার বাচ্চাকে কী আপনি বাংলা মিডিয়ামে পড়ান?
শবনম এমন কণ্ঠে বলছিল মনে হচ্ছিল সে ঝগড়া করতে চাইছে।
আমি ফ্রান্সে থাকি। এদেশে থাকি না।
ও আচ্ছা। এদেশে থাকলেও পড়াতেন না। এদেশ এখন ফকিরনির দেশ হয়ে গেছে।

বেশ জোরের সাথে বলে নিজের কথাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলো যেন। ফকির শব্দটার প্রতি শবনমের বেশ দুর্বলতা আছে বলে মনে হলো আলোকপর্ণর। শবনমের লাউড আর এরোগেন্ট শব্দধ্বনি আর সেই শব্দে ঘুরে ঘুরে দেখা পাশের টেবিলের উৎসুক চোখ আলোকপর্ণকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলো।
বাই দ্য ওয়ে, বিয়ে করেছো? আলোকপর্ণ প্রসঙ্গ পাল্টে শব্দটাকে কমাতে চায়।
না। সংকোচ চোখেমুখে।
সংকোচের কী আছে? বিয়ে না-ই করতে পারে মানুষ।
এরমাঝে খাবার নিয়ে ওয়েটারকে শবনম ধমকাতে শুরু করে হঠাৎ। আলোকপর্ণ হতভম্ব হয়ে শবনমের দিকে তাকিয়ে থাকে। শবনম ভ্রুক্ষেপ না করে গলা আরও চড়ালে আলোকপর্ণ আড়ষ্টতা অনুভব করতে থাকে। এক পর্যায়ে আলোকপর্ণর থামাতে হয় ওকে। খাওয়া খুব একটা মন্দ না লাগলেও শবনমের কুচকে যাওয়া মুখের নাক সিটকে থাকা বিষয়টা খাবারকে বিস্বাদ করে দেয়। খাওয়ার গুণাগুণ নিয়ে শবনমের মনোযোগ অন্যদিকে নিতে আলোকপর্ণ যেচে একের পর এক গল্প করতে থাকে। আলোকপর্ণর বিয়ে, অবনীর সাথে ব্রেক আপের কারণ থেকে মাতিস এর শৈল্পিক অভিব্যক্তি পিকাসোর চেয়ে কেন ভালো মনে হয় তা এতোটা সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করা শুরু করলো যেন খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত শবনমের বলার কিছু আর না থাকে।

বহুক্ষণ চেচিয়ে কথা বলার জন্যই কিনা!নাকি শিল্প, সাহিত্য আর টানে না শবনমকে।  মুড অফ করা গলায় শুধু বললো, অবনী আপা আপনাকে বেশ ভালোবাসতো।
তা বাসতো। কিন্তু করার কিছুই ছিলো না। ওর বাবার অমতে বিয়ে করতে রাজি না। খানিকটা অভিমানেই তখন দেশ ছাড়লাম। কাজ করতে গিয়ে কাতেরিনার সাথে দেখা। বিয়ে। কাতেরিনা খুব বোঝে আমায়।
অবনী আ্পাকে মিস করেন না?
মিস করি না, তবে মনে পড়ে হুটহাট।
ভালোবাসেন কাকে? কাতেরিনা নাকি অবনী আপাকে?

এ প্রশ্নে হাসে আলোকপর্ণ। জিগেশ করে, তুমি বিয়ে করনি কেন? থাকো কোথায়? বাবার বাড়িতেই? রাজারবাগ ছিলো না বাসা?
বাবার বাড়িতে থাকি না। ফ্যামিলি নাই আমার। এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না।
লফোটেন?
কী?
লফোটেন, আরেক নাম পোষ না মানা দ্বীপ।
ফ্রান্সের?
না, নরওয়ের। পাহাড় আর সমুদ্রে ঘেরা নিঃসঙ্গ এক দ্বীপ। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট গ্রাম। দূর থেকে পাহাড়গুলোকে চার্চের গম্বুজের মতো দেখায়। শিল্পীদের এক প্রিয় দ্বীপ। পাহাড়ে উঠলে এক সরু সবুজ রেখা কাগজের বাক্সের মতো বাড়িগুলোর সাথে মিশে যেতে দেখা যায়। লোকালয়ের সাথে এই একটাই সরু পথ।

শবনমের পেলিকানের ঠোটের মতোন গলা খানিকটা নুয়ে থাকে। জম ধরা চোখের মনিটা পানিতে চিকচিক করে। লফোটেনের সাদা বালুর সৈকতের কথা মনে হয় আলোকপর্ণর সেই চোখ দেখে। কিছু বলে না। আসলে কথা বলতে ভালো লাগছে না আর। শবনমের সামনে বসে থাকতে দম কেন যেন আটকে আসছে। স্লিভলেস আর কড়া ভাজের শাড়ির মিষ্টি মুখ আর কথার মেয়েটার লেশমাত্র নাই সামনে বসা নারীর। হাত ঢাকা রঙ জ্বলে যাওয়া জামা পরা মেয়েটার বড় লাল টিপের কপালটায় বলিরেখা। মাথায় ঘোমটা টেনে বসা জবুথবু নারীর সাথে ডাকসাইটে শবনমের কোন মিলই নাই।

বেসিনের কাছে হাত ধুলে চলে গেলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আলোকপর্ণ। দ্রুত বিল মিটাতে মিটাতে শবনমের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ভেসে আসে আলোকপর্ণর কানে। আবারও দুই তিনজন ওয়েটারের সাথে কী এক বিষয় নিয়ে ঝগড়া করছে। ভারী এক নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। ওকে উঠতে দেখে ওয়েটারদের ধমকাতে ধমকাতে আলোকপর্ণর কাছে আসে। আলোকপর্ণ নিশ্চুপ হেঁটে বেরিয়ে পড়ে।

রাস্তায় নেমে বিদায় দেবার আগ মুহূর্তে দ্বিধা ছেড়ে শবনম কিছু টাকা ধার চায়। আলোকপর্ণ কথা না বাড়িয়ে হাজার পাঁচেক টাকা বের করে দিলে শবনমের চোখে বিস্ময় আর লোভ চকচক করে। তড়িঘড়ি করে টাকাটা ব্যাগে ভরে। ব্যাগটা হাত দিয়ে ঠেসে ওর বুকে ধরে রাখে। বলে, আপনাকে দুইদিনের মাঝেই দিয়ে দিব। আপনি ফ্রান্সে যাবার আগেই।

আলোকপর্ণর ফোন নাম্বার যেচে নেয় নিজেই। এরপর বিদায় নিয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে হনহন করে হাটতে থাকে। সাময়িক স্থবিরতা গ্রাস করে আলোকপর্ণকে। শবনমের সরু হয়ে মিশে যাওয়া বিন্দুটি যতক্ষণ মিশে না যায় ততক্ষণ তাকিয়ে থাকে। বাসায় ফিরে জামানের সাথে কথায় কথায় শবনমের কথা মনে আছে কিনা প্রশ্ন করলে যা যা শোনে—
হুম। আরে দুনিয়ার বাটপার। আমার অফিসে এসে ভীষণ বিরক্ত করতো। প্রায় হাজার দশেক টাকা পাই। দুইদিন পরপরই ফোন নাম্বার পালটায়’
থাকে কই জানিস? বিশাল বড়লোক ছিল না ওর বাবা?
বাসা চিনলে তো টাকাই আনতে পারতাম। ফ্যামিলি মেম্বাররা তো আরেক কাঠি সরেস। তাদের সাথে নাকি যোগাযোগ নেই। উল্টো বলে, আমাদের কাছে জিজ্ঞাসা করে টাকা দিয়েছেন? বাটপারের ফ্যামিলি।

আলোকপর্ণ আহত হয় জামানের কথায়। শবনমের প্রতারণার সাথে ফ্যামিলি যে জড়িত না তা জামান নিশ্চয়ই বোঝে। তবু প্রতারিতর ঝাঁজ থাকা মনের কথাকে এড়াতে বলে, আমাদের প্রায়ই খাওয়াতো, মনে পড়ে? আমরা ২০০ টাকায় মাস চালাতাম। আর ও একেকবার বিলই দিতো দুই তিনশো টাকা।
হুম, মনে আছে। একসেস করতো্। ওর এই বড়লোকি ভাবই ওকে ডুবিয়েছে।
কী সুন্দর যে ছিল! বারান্দা দিয়ে হেটে যেত আর আমরা ক্লাস ফেলে হা করে দেখতাম।
তুই তো পুরোই রোমান্টিসিজমে ভুগছিস ওরে নিয়ে। এখন দেখলে তোর এই ঘোর পুরো কেটে যেত।
কী করে সে?
তা জানি না। বশির তো বলে রেড লাইট এরিয়াতে নাকি দুয়েকদিন দেখেছে। তবে টাকা পয়সা নিয়েছে চেনাজানা আমাদের প্রায় সবার থেকেই। কেন রে? হঠাৎ শবনমকে নিয়ে পড়লি কেন?’
নাহ, এমনিই।
বোর্ডিংয়ের ডিক্লেয়ারেশনে চিন্তার সূত্র ছুটে যায়। কড়া রোদ চোখে লাগে আলোকপর্ণর। বোর্ডিং ব্রিজ পেরিয়ে প্লেনের সিটে বসে ফোনের সুইচ অফ করার আগে শেষবার চোখ পড়ে ফোনের স্ক্রিনে। জানে শবনমের কল কখনও আসবে না। তবু অপেক্ষার চোখে তাকায়। টাকা পাওয়ার জন্য না। একবার জানতে চাইতো, শবনম কী করে বদলে গেল? কেন বদলালো? কী চেয়েছে সে জীবনের কাছে? শবনম কী ভালোবাসতো কাউকে? প্রতারিত হয়েই কী বেছে নিয়েছে প্রতারণার জীবন? জগতে প্রতারিত কতজনাই তো হয়। নাকি স্বপ্নাচারী মন জীবনের বাস্তবতাকে বোঝেনি বলেই জীবন পথ বদলে গেছে ওর। শবনম ও হয়তো মেলাতে পারে না হিসাব। জীবনের কাছেই জীবনের হেরে যাওয়াকে টের পাওয়া যায় অনেক পথ পাড়ি দেবার পর। ফেলে আসা জীবনে যে আর ফেরা যায় না তা ভুলে বসে থাকে মন। ক্ষয়ে যাওয়া সময়কে কেবলই পুরনো এলবামের পাতায় যখন দেখা মেলে, তখন হয়তো না দেখার ভান করে তাকাই, অজান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলি একান্তে আর বাতাস এতো ঝাঝালো যে চোখ জ্বলে যায় বলে চোখের কোণা রগড়ে পানির বিন্দুর অস্তিত্ব বিরান করে দেই।

মেঘের কাছে যেতে যেতে শেষবার আলোকপর্ণ দেখে ঘিঞ্জি দালানগুলো। পুতুলের বাড়ির মতো লাগে। চিকন সরু হতে থাকা পথ একবার নজরে আসে। হয়তো সেই পথের কোন না কোন বাকে শবনম তাড়া না করা ছন্দে চলছে। জমজমাট জীবন থেকে ছিটকে পড়া এক নিঃসঙ্গ দ্বীপ জীবন নিয়ে।
বাতিল– বিড়ম্বনার– অনাকাঙ্ক্ষিত এক শবনম। আহারে!