ক্যামেলিয়া আলমের গল্প ‘ব্রুনফেলসিয়া’

প্রকাশিত : অক্টোবর ২০, ২০১৯

ঝিমধরা মাথা নিয়ে বাসায় যখন ফিরি তখন প্রায় মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। বাসার কাছাকাছি আসতেই চেনা বাসা অচেনা লাগা শুরু হয় আমার। চারপাশে এত কেন আলো? রাতে ফেরা বাসাটার দরজার রঙ কি এমন ক্যাটক্যাটে ধূসরই? প্রতিদিন হালকা আলোয় জোছনার রঙ কেন দেখাতো তবে? নাহ, এ বাড়ি তো না! সরাইখানার মতো চারপাশে কেবল মানুষ আর মানুষ! তীব্র নেশায় আচ্ছন্ন মাথা নিয়ে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে আলোকপর্ণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সারি সারি আলোকিত দালানগুলোর দিকে। যে দালানগুলোর সামনে এক প্রকাণ্ড গাড়ি আর মানুষের স্রোত।

ব্রুনফেলসিয়ার সাথে প্রথম দেখা তিনতলা সিঁড়ির মধ্যখানটায়। বেগুনি রঙা ফ্রকে ওকে দেখে ব্রুনফেলসিয়া নামটাই মাথায় গেড়ে বসলো। আমার দু’হাত ভরা মালপত্রে ঠাঁসা। চটচটে কপাল খানিকটা কোচকানো ছিল সুড়সুড়ি দিয়ে বেয়ে পড়া ঘামের জন্য। ঠিক সেই সময়েই ওর সাথে আমার দেখা। মাদকবুনো গন্ধ আর ফুটে থাকা বেগুনি আভায় ওকে আমার ব্রুনফেলসিয়াই ভাবতে হলো। ঘাড় ছড়ানো চুলগুলো আছড়ে পড়ছিল পিঠে। হাতে ক্রিকেট ব্যাট আর বল নিয়ে লাফিয়ে নামতে নামতে হাতের বাক্সে ধাক্কা খেয়ে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আবার উঠে গিয়ে সিঁড়ি গোড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আমায় উপরে উঠবার জায়গা করে দিলো। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে খুটে খুটে আমায় এমনভাবে দেখতে লাগলো যে, আমার মুখ চাপা হাসিতে ভরে গেল। ব্রুনফেলসিয়াকে ছেড়ে উঠতে উঠতে ওর আলতো হাসি ছড়িয়ে পড়া মুখটা কেমন যেন মনকে চনমনে করে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, বাহ! এই তো জীবন!
 
ব্রুনফেলসিয়ার সাথে এরপর দেখা চিলেকোঠার ঘরটায় ওঠার দিন তিনেক পরে। এক বিকেলে। ঘরের পাশেই আমার উঠানের মতো ছাদ। ছাদের স্টোর রুমটিই সাঈদ সাহেব আমায় পরিচ্ছন্ন করে ভাড়া দিয়েছেন। পুরনোকে ছাড়ার বেদনায় জমিয়ে রাখার অভ্যাসে স্টোর রুমের জন্ম হয় কী নাগরিক সমাজে? আমায় ভাড়া দেয়ায় স্টোর রুমের সেই মালপত্র রাখা হয়েছে আমার ঘরের পেছনে। মূল্য দিয়ে গড়া বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি থেকে মূল্য তোলার চেয়ে কিছু পুরনো বস্তুকে আঁকড়ে রাখার মনস্তাত্ত্বিক মূল্য কম হবারই কথা। পেছনের দিকটায় যাওয়া হবে না বলে, স্টোরের স্তূপ করে রাখা মালপত্র আমার বিরক্তি ঘটায়নি। কেবল ছাদের শেষ সীমানা ঘেঁষে রাস্তা দেখতে দাঁড়ালে ডানপাশে তাকালেই চোখে পড়ে ভাঙা খাট, ফোমের জাজিম, ভাঙা ফ্যান, খুচরো কতগুলো কাঠ বা ভাঙা চেয়ারের হাতল। দেখতে দেখতে আলোকপর্ণ সিগারেটে ধোঁয়া ছেড়ে পাশ ফিরে তাকায়। পুরনো বড়ই অনাদরের, ভাঙচুর, ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে অবাক বিষণ্ণ হাসি!

হঠাৎ এক হাসি আর থপথপে শব্দে পেছনে তাকাতেই ব্রুনফেলসিয়াকে দেখি আমি। ছাদে ওঠার শেষ দরজায় থমকে তাকানো আমার দিকে। আমি এক চিলতে হাসি হেসে পাশ ফিরি। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট দ্রুত ফেলে পায়ে পিষে আকাশের দিকে তাকাই। প্রথম দিনের মতো ওদের বাসার সহযোগী মেয়েটাকে নিয়ে আসা। আজ হাতে বল। আড়চোখে আমায় দেখে পায়ে পায়ে খেলতে থাকে আড়ষ্ট হয়ে। ওর সংকোচ দেখে ঘরে ফিরি। বিছানায় আলতো শুয়ে কেনিজির মিউজিক শুনতে থাকি। একসময় হুল্লোড় আর ধবধব শব্দ শুনতে শুনতে ঘোর লাগে আমার। দরজার এক চিলতে ফাঁক দিয়ে ওকে সন্তর্পণে দেখি। আজও বেগুনি জামা। ফোলা গালগুলো খেলার উচ্ছ্বাসে দুলছে, সামনে চলে আসার চুলগুলো ক্লান্তিহীন হাতে সরাচ্ছে। কী ভালোই না লাগলো আমার!

ব্রুনফেলসিয়ার সাথে কথা শুরু হলো এর কিছুদিন পরেই। প্রতিদিন ছাদে এসেই আমার সাথে দেখা হতে হতে কথা না বলেও আমাদের এক কমিউনিকেশন হয়ে গেছিল। ওর আসা, এরপরই আমার ঘরে ফেরা, মিউজিক ছাড়া আর চুপচাপ ওর উচ্ছ্বাস দেখা আমার নৈমিত্তিক অভ্যাসে পরিণত হলো। তেমনই একদিন ব্রুনফেলসিয়া দরজার কাছে এসে চুপিচুপি চোখ রাখলো আবছা ভেড়ানো ফাঁকটুকু দিয়ে ঠিক আমারই মতোন। চোখাচোখি হতেই সরে গেল পাশে। আবার পাশ দিয়ে উঁকিঝুকি দিলো। যতবার চোখাচোখি হয়, ততবার সরে যায়। দুজনের এই লুকোচুরির সাথে যোগ হলো আমার স্মিত হাসি আর ওর খিলখিল হাসির শব্দ। এরপরে বেশ কয়দিন দেখা নাই। অফিস থেকে ফিরতে দেরি হওয়ায় ব্রুনফেলসিয়ার খেলার সময়টা মিস করতে থাকি। অফিসেও ওর কথা মনে পড়ে। পেডোফ্যালিয়াক কিনা, নিজের মনস্তত্ত্বে প্রশ্ন রাখি। আতিপাতি খুঁজে কিছুই পাই না। কেবল বুঝি, মিস করছি বাসন্তি বিকেল, যে জগৎ ব্রুনফেলসিয়া আর আমার।

প্রায় সপ্তাহখানেক পরে বিকেলে বাসায়, বেলা পড়ে যাওয়া খেয়াল করিনি। চোখ বুজে থাকলেও হঠাৎ টের পাই ছায়ার, সাথে মিষ্টি বুনো গন্ধ।

তুমি কোথায় ছিলে?
চোখ থেকে হাত সরাই,কাজে ব্যস্ত ছিলাম।
কেন এত কাজ করবে?
আমি হাসি। ব্রুনফেলসিয়া কৌতূহল নিয়ে ঘরে ঢুকে চারপাশে দেখতে থাকে। বসে না কোথাও। এক চেয়ারের কাছে হ্যালান দিয়ে দাঁড়ায়। প্রথমদিনের সিঁড়িকোঠায় দাঁড়াবার মতো করে।
তোমার নাম কী?
আলোকপর্ণ।
ও মাই গড! এ আবার কী নাম? আ লো ক প র ণ... মানে কি?
মানে নাই কোনও। তোমার নাম কী?
মিমো।
মি মো? মানে কী?
ও চুপ করে চিন্তা করে কিছুক্ষণ। মানে নাই কোনও... সপ্রতিভ হয়ে বলে।
আমি হেসে ফেলি। বলি, আমার যে তোমায় ব্রুনফেলসিয়া বলতে ইচ্ছে হয়।
মিমো হা করে তাকিয়ে শুনে বলে, এরও কী মানে নাই?
হুম, আছে তো। ফুলের নাম।
কি বললে যে ব্রুন ব্রুন...
ব্রুনফেলসিয়া।
বাবা! কী কঠিন ফুলের নাম, ক্যাকটাসের ফুল?
আমি হেসে ফেলি, উঁহু, বসন্তের ফুল।
কী রঙের?
সাদা, হালকা বেগুনি, গাঢ় বেগুনি... এক গাছেই তিন রঙ।
তাই নাকি? আমায় দেবে এই ফুল এনে?
হুম, তবে কবে দেব জানি না। আমার যখন ইচ্ছে হয়, তখন দেব।
ওকে, তবে আমিও তোমায় এক নাম দেই, সালমান।
আমার উচ্চশব্দে হাসি দেখে ও দমে যায়। উঠেই ছুট লাগায়। আমি হাসতে থাকি একলা।

পরদিন আবার আসে। ওর আসার আগেই আমি এক মাদক গন্ধ পাই। সারা বিকেল ছাদে ঘুরে ঘুরে ওর আর আমার কথা হয় এরপর থেকে প্রায় রোজই। ব্রুনফেলসিয়ার বাসার বাবা মায়ের ঝগড়া থেকে স্কুলের সুমি টিচারের বলা গল্পগুলো সব জানা হয়ে যায় আমার। একদিন আমার কাছে জানতে চায়, বিশ্বাস কী? মা বলেছে, কখনও কাউকে বিশ্বাস করো না। মিথ্যে বলে মানুষ। মানুষ কী মিথ্যে বলে?
আমি চুপ থেকে বলি, এতগুলো একবারে প্রশ্ন করলে তো মুশকিল। বিশ্বাস আসলে কম জানাদের আশ্রয়ের জায়গা। বিশ্বাস বলে কিছু নাই।

আমি তোমায় বিশ্বাস করতে চাই। মা মানা করে যে।
আমি থমকে যাই। আস্তে করে বলি, মায়ের কথা শুনতে হয়। ওরা বড় বলে না, ওরা তোমার চেয়ে বেশি মানুষের সাথে মিশেছে বলে। ওদের জানায় ভুল কম হয়।
আমার ভুল হয় না। আমি তোমায় বিশ্বাস করতে চাই। কারণ আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই, গল্প করতে চাই। কথা বলতে চাওয়া মানুষকে মিথ্যা ভাবলে কথা আমি বলবো কী করে?
আমি চুপ হয়ে যাই। সেই রাতে আমার ঘুম হয় না। বিশ্বাস আমার মগজে ঘুরপাক খেতে থাকে। একটা সমাধান আসতে থাকে, কারো প্রতি কারো বিশ্বাস মানেই অনেকগুলো ফাঁক ফোকরকে ইগনোর করা আসলে। বিশ্বাস মানেই যাকে ভালো লাগে তার প্রতি নিজের মনমতো বানানো এক আস্থার জায়গা।

ব্রনফেলসিয়ার সাথে আমার রাজ্যের কথা চলে। ও আমায় যখন ঈশপের গল্পগুলো বলে আমি তখন প্রতিটা গল্পকে আবার উল্টো করে বলি। যেমন, ও রাখাল আর বাঘের গল্প বলে আমায় বলে, কাজেই মিথ্যা বললে তার সত্যকে তো কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। তখন আমি বলি, রাখাল আসলে দেখতে চেয়েছিল মানুষ কতবার সাহায্য করতে ছুটে আসে, কতটুকু পরে তাদের ক্লান্তি আসে। ও অবাক হয়ে মাথা নাড়ায়, উহু, এ তো ঠিক না। মিথ্যা বলে মজা করতে নেই।

হুম, তা এক সত্য। আবার আরেক সত্য, রাখালের একা আর ভালো লাগে না গরু চড়াতে। সেও চায় কেউ তাকে এটেনশন দিক। সেও চায় কেউ তার জন্য ছুটে আসুক।
ব্রনফেলসিয়া কিছুক্ষণ ভাবে। এরপর বলে, হুম সেও তো কথা। রাখালের জন্য এখন আমার খারাপ লাগছে।
আমিহাসতে থাকি। বলি, কিন্তু তাই বলে মিথ্যা এটেনশন নেয়ার কিছুই তো নাই। মিথ্যা মিথ্যাই। মিথ্যা দিয়ে এটেনশন ধরে রাখা সবচেয়ে দুর্বল মানুষের কাজ। এবার সত্যিই ঝামেলায় পড়ে সে। কোন কথা নেবে বুঝতে পারে না। কেবল হা করে শোনে। আর ভালো মন্দের দোদুল্যমানতায় দুলতে থাকে। কনফিউশনে যেমন ফেলি, তেমন ওর ভেতর বুনতে থাকি একটু একটু করে পাখি হবার বীজ। পল গগার ইনটিমেইট জার্নাল থেকে একদিন শোনাই।
এই কি পুরো গল্প, নাকি আরও আছে?
আই ক্যান নট কনকের এভরিথিং। বাট আই উইল ডু সো। লেট মি গেট।
মাই ব্রিদ এন্ড ক্রাই ওয়ানস মোর: স্পেন্ড ইওরসেল্ফ স্পেন্ড ইওর সেলফ...

ব্রনফেলসিয়া এর কিছুই বোঝে না। তবু চুপ করে থাকে। ওর চোখে অপার বিস্ময়। আর আমার চোখে ওকে দেখার বিস্ময়। কত সহজে বিশ্বাস রাখা, আস্থা রাখা, ভালোবাসা। আয়নায় ঘুরে নিজের চোখ দেখি কেবল। খুঁজে বেড়াই আরেকটা মানুষ যার কাছে ব্রনফেলসিয়াকে আমি দিতে পারি অনায়াসে। আমার ভয় ধরে যায় একসময়। চারপাশে ঘটতে থাকা সব কালো ধোঁয়ার আঁচ বাঁচিয়ে মেয়েটার সরলতা ধরে রাখবার কল্পনা আমায় অসুস্থ করে তোলে। গড়াতে থাকে দিন। কতশত গল্প আমাদের। একেকদিন একেক বিষয় নিয়ে আমাদের কথা চলতেই থাকে। কোনও অজানা বিষয়ের উত্তর না জানলে আমরা ল্যাপটপে হুমড়ি খেয়ে পড়ি। সারাবিকেল আমার গায়ে হেলান দিয়ে থুতনিতে দুইহাত চেপে দুইজনে উপুড় হয়ে খুঁজতে থাকি আমাদের আটকে যাওয়া কথার উত্তরগুলো।

একদিন ব্রনফেলসিয়াকে আমি বলি, তোমার সালমান নামটা আমি চাই না। আমায় তুমি অন্য নাম দেবে? ও চিন্তায় পড়ে যায়। ভেবে পায় না। বলে, আমি খুঁজে পাচ্ছি না, যা বলবো তাতে তুমি হাসবে, বাপু, তুমিই তোমার নাম দাও।
সেতু, আমি বলি।
ব্রনফেলসিয়া ঘাড় কাত করে আমায় দেখে। আমি মুগ্ধ হয়ে থাকি ওর এই ভংগিমাতে।
সেতু মানে কী ?
ব্রিজ।
ব্রিজ?
হুম।
সেতু নামটা সুন্দর?
নামটা সুন্দর কিনা জানি না। কিন্তু মিনিংফুল।
কেমন?
একটা কানেকশন, পারাপারের এক জায়গা।
কানেকশন? পারাপার?
হুম, এই যেমন আগে তুমি আকাশ দেখতে পেলেও আকাশের মাঝে হাজারে হাজারে ভেসে বেড়ানো মেঘগুলোর হাতি, ঘোড়া বা বুড়ো হয়ে যাওয়াকে দেখতে পেতে না। প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে আকাশের একের পর এক কালার দেখতে পেতেনা। এখন পাও। যেমন ওই যে সামান্য কাঠের চেয়ারটা তা নিয়েও তুমি সেদিন কত সুন্দর গল্প বললে আমায়। একটা গাছ কী করে চেয়ার হয়ে গেল! বললে না?

কী বুঝলো কে জানে? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, তোমায় আমি সেতুই বলবো।
হয়তো আমায় খুশি করতে, না-হয় তার ছোট মনটার অজানা গভীর কোনও জীবনবোধ থেকে। শিশু মনের গভীরতা কতটা তা আমার পরিপক্ক মাথা ধরতে পারে না। ব্রনফেলসিয়ার কাছে একদিন জানতে চাই, ব্রনফেলসিয়া, বলতো তোমার কোন পাখি ভালো লাগে? আর যা ভালো লাগে তা কেন ভালো লাগে? তাও বলতে হবে।
ও অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলে, পেঙ্গুইন।
আমি চমকাই। এর আগের রাতে পেঙ্গুইন নিয়ে কিউরিয়াস হয়ে পড়েছিলাম। একে কী ট্যালিপ্যাথিক বলে? অন্তরের কানেক্টিভিটির কোন অজানা সত্য কী আছে জগতে?  মুখে কেবল বললাম, বাহ! কেন লাগে বলতো?
দেখতে সুন্দর, ইনোসেন্ট লুক।
দুইটা প্রায় এক হয়ে গেল তো।
আরে না, একটাতো বাইরের কালার বললাম, আরেকটা তো ক্যারেক্টারের কালার।
আমি বিস্মিত হই। সূক্ষ্ম এই এনালিসিসটা আমি ভাবিই তো নাই।
আর পেঙ্গুইন বরফের দেশে থাকে, বলতে থাকে সে, আচ্ছা ও কী বরফ খেয়েই থাকে? বরফে তো আর কিছু পাওয়া যায় না।  
কে বলে পাওয়া যায় না? বরফের রাজ্যে কত যে প্রাণ আছে। মনে পড়ে আমার, আমি পেঙ্গুইনের গল্প শোনাই সেদিন ওকে। ওর বাড়ির সহযোগী মেয়েটা ঘরে বসে বসে ঝিমোতে থাকে। পেঙ্গুইন আদিম পাখিদের একজন। ক্রিল মানে এক ধরণের চিংড়ি ওদের প্রিয় খাবার। পাকা সাঁতারু। একশ ফুট পর্যন্ত ডাইভ দিতে পারে সা সা করে। তবে এক মজার কাজ কী করে ওরা জানো? পানি থেকে এক লাফে সাত ফুঁট উঁচু ডাঙায় লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। শুনে ব্রনফেলসিয়া খিলখিল করে হাসে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখি। আমার কথা চলতে থাকে, ওরা তোমার মতোন খুব কিউরিয়াস, নতুন কিছু দেখলেই এক সাথে ঝাপিয়ে দেখতে চেষ্টা করে। আর খুব ঝগড়াটে। দল বেঁধে চলে আর একটু পরপরই থেমে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে গলাবাজি করার ভঙ্গি করে শব্দ করতে থাকে। ওদের আরেক মজার কাহিনি আছে, অনেক কৌতূহলী হলেও পানিতে নামার আগে তাদের রীতিমতো সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে সভা করতে দেখা যায়। কারণ সমুদ্রে থাকে নানা হিংস্র শিকারি। কে আগে জীবন দিয়ে পরীক্ষা করবে এখানে বিপদ আছে কিনা, এ নিয়ে চলে তাদের বিস্তর কথা কাটাকাটি। এ ওকে ঠেলতে থাকে ঝাপ দেবার জন্য। কেউ রাজি না হলে যে কোনও দুর্বল একজনকে বেছে বাকিরা ঠেলে জলে ফেলে দেয়।

আশ্চর্য! ভারি দুষ্ট তো, ছিঃ আর ভালোবাসবো না ওদের। দুর্বল বলেই তাকে মারতে হবে?
হুম, হয় তো। আমি বলি। দুনিয়াটা সারভাইভের। যে সারভাইভ করতে পারবে না, সে বেঁচেও থাকবে না। দুর্বলদের উপর অধিকার খাটিয়েই তো টিকে থাকতে হয়। এই যে আমরা চিকেন খাই, বিফ খাই, ওরা আমাদের সাথে পেরে ওঠে না বলেই তো। ওরা পারলে কী আমরা ওদের খেতে পারতাম? আর ধর, যদি না খেতাম তাহলে আমরাই বা বাঁচতাম কী করে? ব্রনফেলসিয়া, এ জগতে তুমি বাঁচতে পারবে কেবল অন্যের সাথে লড়াইয়ে জিতলে। না-হয় কেউ তোমায় বেঁচে থাকতে দেবে না। ব্রনফেলসিয়া কাতর মুখে সেদিনের মতোন চলে যায়। ওর চপলতার থমকে যাওয়া আমাকে থমকে দেয়। তীব্র আক্রোশ হয় নিজের উপরে। দশ বছরের শিশু মনকে পরিণত বানাবার অপরিণত কাজের জন্য নিজেকে অভিশাপ দিতে থাকি।

এরপর কিছুদিন সত্যিই ব্রনফেলসিয়ার আসা বন্ধ হয়ে যায় আমার কাছে। একদিন নিজেই যেচে পড়ে ওর বাসায় যাই। ওর মা বাবা চমৎকার মানুষ। দীর্ঘ সময় গল্পে জানতে পারি, ব্রনফেলসিয়া মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে রীতিমতো ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়েছে। পরে জানতে পেরেছি, আমার ক্রিমিনালগিরির জন্যই এ কাজ। ফলে মগজ ধোলাইয়ের হাত থেকে সন্তর্পণে রাখার চেষ্টায় আছে। সেদিন আমায় হাসতে হাসতে ওর মা কথাগুলো জানিয়ে বলে, আপনার সাথে পরিচয় না হলে, সত্যিই একদিন আপনাকে ধমকে আসতাম আমি। আমিও হাসতে থাকি। এরপর থেকে আবারও নিয়মিত আমার চিলেকোঠায় ব্রনফেলসিয়া আসতে থাকে।

কতদিন পরে অফিস থেকে ফেরার পথে একদিন প্লান্টহাউজে হুট করে পেয়ে যাই ব্রনফেলসিয়ার গাছ। সেদিন ফিরতে ফিরতে বেশ সন্ধ্যা  হয়ে যায় আমার। ছাদে গাছটা তুলে রাখি ওকে সারপ্রাইজড করবো বলে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ও ছাদে না ওঠাতে আবার ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে জানিয়ে আসি, ওর গাছটির কথা। ওর গাছ দেখবার অস্থিরতা টের পেলেও কিছু করার নেই। বাড়িতে কাজের সহযোগী মেয়েটি বাড়িতে গেছে বেড়াতে। ফলে ওর একলা যে কোন জায়গায় ঘোরা আপাতত বন্ধ। সেদিন ওর বাসায় নবাগত এক অতিথিকেও চোখে পড়ে। ওর মা জানায়, ওর বাবার কাজিনের ছেলে, ঢাকায় এসেছে এডমিশন টেস্ট দিতে। আমি ফিরে এসে অপেক্ষা করি ওর। প্রতিদিন যত্ন নিতে থাকি গাছটা চরম মমতায়।

এমন এক একাকী সময়ে হুট করে ফোন দেয় অলক। জানায়, রেডবাটনে আজ সবাই একসাথে আড্ডা দেবে। চনমনে হয়ে ওঠে মন। তৃষ্ণার্ত বুক মদের নেশায় ঠাণ্ডা করতে যাই। ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয় আমার সেদিন। বাড়ির সামনে এলে সব অচেনা লাগে নেশার ঘোরে। রোজকার মতোন অন্ধকারে ফেরা বাড়ি আজ উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। অচেনা আলোয় চেনা বাড়িগুলোর সামনে আমি ব্রনফেলসিয়ার মতোন হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি উল্টো পাশের ল্যাম্পপোস্টটায়।  

সেদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে ওর মা রেস্ট নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই সূযোগে ব্রনফেলসিয়া চুপিচুপি ছাদে চলে আসে একা। হয়তো ওর ফুলগাছটা দেখবে বলে। ফিরে যাবার পথে সিঁড়িতে দেখা হয় ওর কাজিনের সাথে। ফুলের গল্প বললে ওর কাজিনের আগ্রহে ছাদে আবার ফিরে আসে। ব্রনফেলসিয়া যখন মুগ্ধ হয়ে মাথা নাচিয়ে, ঘাড় দুলিয়ে ফুলের গল্পটা শোনাতে থাকে, ওর কাজিনের ঘোর জাগে ভিন্ন জায়গায়। জগতের মন্দ জানবার আগেই ওর মুখ চাপা পড়ে, ওর কোমল শরীরটা ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে ছাদের অমসৃণ মেঝের ঘষায়। ওর মায়ের ঘুম ভাঙে কাজিনের ডাকে। ওর বাড়ি থেকে খবর এসেছে, তাই দ্রুত বাড়ি যাবে বলে বিদায় নিয়ে চলে যায়। ব্রনফেলসিয়া পাশের ঘরে খেলছে ভেবে ওর মা ঘুম থেকে জেগেও আড়মোড়া ভাঙতে থাকে। অনেকক্ষণ সাড়া না পেয়ে পাশের ফাঁকা ঘর দেখে ধরাস করে মায়ের বুক। ওর বাবাকে ফোন দিতে দিতেই ছুটতে থাকে ছাদে। পুরো ফাঁকা ছাদ, চিলেকোঠার একমাত্র দরজাও তালাবন্ধ। দৌড়ে নিচে গেলে দারোয়ান জানায়, আমি সকালে গিয়ে ফিরিনি এখনো। মিমোর কথা জানতে চাইলে সেও উঠে খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে চিলেকোঠার পেছনে আবর্জনা স্তূপের কাছে পলিথিনে মোড়ানো মুখের নির্বাক ব্রনফেলসিয়াকে।