ক্যামেলিয়া আলম

ক্যামেলিয়া আলম

ক্যামেলিয়া আলমের গল্প ‘বর্শা’

প্রকাশিত : অক্টোবর ১১, ২০১৯

ছোট এক ঢিবি থেকে গড়াতে থাকে রেজা আর সুজা। দুজনের কাঁধের মাংস নখের আচঁড়ে ছিঁড়েখুড়ে যাচ্ছে। তবু মারামারি থামছে না। গড়িয়ে পড়ায় রেজা এবার পড়ল বেগতিক হালে। সুজা পেটের উপর চড়ে বসতে পেরেছে। রেজা পা সামনে আনার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না।

আল্লারে, মাইরা ফ্যালাইবো রে। খুন কইরা জেল খাটবো... বলতে বলতে জীবন নাহার ছুটে আসে। দুই ভাইকে সমস্ত শক্তি দিয়ে সরায়। হাত ধরে দুমদাম দুইটা কিল বসায় পিঠে দুজনের। লালমুখে রেজা উঠে দাঁড়ায়। গলায়, বুকে সরু লাল রেখচিত্র দু’ভাইয়ের। তিন বছরের ছোট ভাইয়ের সাথে কখনোই পারে না রেজা। বরাবর মার খায় সুজার এবড়ো থেবড়ো হাত চালাচালিতে। আর সুজার গায়ে যতনা আঘাত লাগে তার চেয়েও বিকট চিৎকারে বিদীর্ণ হয় আকাশ। সেই চিৎকারে সামনে বুড়ো বটগাছটার পাখিগুলো ডানা ঝাপটে ওঠে। একপাল ঘুঘু উড়ে, গোলাকার ঘুরে আবার এসে বসে।

দুই ভাইকে দুহাতে নিয়ে সোজা ঘাটের জলে নামায়। পানিতে ছেড়ে হাত দিয়ে ডলে ডলে ধুলাবালি সরায়। মাথাভর্তি কিচকিচে বালি জীবন নাহারের নখের আচঁড়ে নরম কাদার মতো কপাল বেয়ে নামতে থাকে। জীবনে আর সুক পাইলাম না, বান্দরের ছাও জন্ম দিছি, লেহা নাই পড়া নাই, সারাদিন খেলন আর খেলন। তা খেলবি খ্যাল, মাইরপিট করতে হইবো?

দুই ভাই স্তিমিত হয়ে আছে কিছুটা। বরাবরই মারামারিতে ক্লান্ত হয়ে এভাবেই চুপ মেরে যায় তারা। ছোট বুকটা ওঠানামার শব্দ আর মায়ের বকুনি ছাড়া কোনও টুশব্দ থাকে না। গা ঘষে পানিতে ডুব দিতে বলে জীবন নাহার ঘাটপাড়ে বসে সারা শরীর ঘষতে থাকে। দুই ভাইয়ের ডুবাডুবি শেষ হলে ঘাটপাড়ে ভেজা শরীরে এসে দাঁড়ায়। বলে, খবরদার, এক পাও নইড়লে কঞ্চি দিয়া পিডাইয়া মাইরা ফেলুম...

দুই ভাই হাত জড়োসড়ো করে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায় হেলেপড়া সূর্যের শেষ তাপেও কেমন শীত শীত লাগে। শিরশির করে কাঁপতে থাকে দুইভাই। ঘাটের পানিতে দূরে বুদবুদ ওঠে। রেজার চোখ যায় প্রথম, সুজা সুজা দ্যাখ দ্যাখ, মাছ মাছ...। চমকে সুজা পেছনে তাকায়। মাছের গতিবিধি বুঝতে চেষ্টা করে। কই কই? দ্যাখতে তো পারি না।

ওই যে, আমার আঙুল বরাবর চা।
হ হ দেখছি, কত বড় বুদবুদ, হাঙর হইবো।
ধ্যাত! কী কস, হাঙর থাকে সমুদ্রে। আমার স্কুলে দেখাইছে, এই এত বড়। হাত যতটা পারে প্রসারিত করে সে বুঝাবার চেষ্টা করে।

জীবন নাহার ডুব দিয়ে মুখ তুলে দেখে, দুই ভাইয়ের ইশারা আর ঠোঁটের নাচন। আবার এক ডুব দেয় চোখবুজে। সারা দিনের শ্রান্তিক্লান্তি ঘাটের তলটায় ফেলে আসে।

দুই.
জীবন নাহারের স্বামী আবু বকর প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করে। প্রতি ৪০ মিনিট পর ঘণ্টা বাজানো যার কাজ। এছাড়া প্রিন্সিপ্যাল স্যারের ফাইফরমাস খাটা থেকে বাড়ির বাজার করে দেয়ার দায়িত্বও খুব অনুগত হয়ে পালন করে। বাড়িতে ফেরে বেশ রাতে। বাবা ফিরলেই দুই ভাইয়ের মুখরতায় ছোট টিনের ঘরখানায় সুখ নেমে আসে।

বাজান আইছে, বাজান আইছে... ছাদমুখো বইয়ের পাতাগুলো হা করে পড়ে থাকে এলোমেলো হয়ে। রেজা সুজার প্রতিযোগিতা চলে বাবাকে আগে ছোঁয়ার। প্রতিরাতে খাবার শেষে দুই ভাইরে দুই পাশে নিয়ে আবু বকর শোনায় নানান গল্প। স্কুলে ঘণ্টা পিটানোর ফাঁকে লাইব্রেরি থেকে বই পড়া আবু বকরের দশ বছরের পুরনো অভ্যাস। বাচ্চাদের জন্য রাখা বইগুলো বারেবারে পড়ে। গ্রামের এক স্কুল লাইব্রেরিতে কয়টাইবা বই থাকে? একই বই বহুবার পড়ার পরেও তার ভালো লাগে। বাচ্চাগুলোরে তাই শোনাতে পারে গড়গড়িয়ে। আজ শুরু করেছে সোহরাব রুস্তমের কাহিনি।

জাবুলিস্তানের এক রাজা ছিল রুস্তম নামে। অনেক বড় বীর ছিল। একদিন শিকারে গিয়া ঘুমাইয়া গেলে তার ঘোড়ারে সমাঙ্গন রাজ্যের সৈন্যরা ঘুরতে আইসা না বুইঝা নিয়া চলে যায় রাজার কাছ থিকা বখশিসের আশায়। এদিকে রুস্তম উইঠা তো খুঁজতে থাকে। দেহে একখানে ধস্তাধস্তির দাগ আর এর পরে লাম্বা হইয়া ঘোড়ার ক্ষুর আর মাইনষের পায়ের দাগ। ওই চিহ্ন ধইরা যাইতে যাইতে যায় রাজপ্রাসাদে। রাজা তো এই বীরেরে পাইয়া মহাখুশি। বিরাট ভোজের আয়োজন কইরা ফেলে। পরের দিন সেই সান্ঝা বেলায় রাজার মাইয়া তার ঘরে আসে তারে দেখতে। দুজনই দুজনরে ভালোবাইসা ফালায়। রাজাও মহাখুশি। বহুত ধুমধাম কইরা দিয়া দেয় বিয়া। এদিকে রুস্তম তো মহাবীর। যুদ্ধ ছাড়া কী আর বীর মরদ বাঁচে? তাহমিনারে খুইলা কয়, অনুমতি চায় দ্যাশে ফিরবো বইলা। এদিকে তাহমিনার বাচ্চা হইবো। হ্যায় তো আর যাইবো না। তহন রুস্তমে একখান দামি পাথর তাহমিনার হাতে দিয়া কয়, মাইয়া হইলে পাথরখান বানবা চুলের বেণীতে আর পোলা হইলে হাতে তাবিজ কইরা পরাইয়া দিও।

রুস্তম চইলা গেলে তাহমিনার হয় এক ফুটফুটা পোলা। সোহরাব তার নাম। এদিকে সোহরাব বড় হইয়া বাপের কথা জিগাইলে মা মুচড়াইয়া মাচড়াইয়া শেষতক বাপের পরিচয় দেয়। পোলার তো ভারী গোস্বা। কয়, এতদিনে ক্যান জানলাম না আমি এত বড় বীরের পোলা। মায় কয়, তোর বাপ নাই, তুইও চইলা গেলে আমি বাঁচুম? কিন্তু সোহরাবের মনে তখন অনেক বড় খায়েশ। ইরানের সম্রাট রেহারাইবো। মাত্র চৌদ্দ বছরেই তুরানের সম্রাটের লগে মিলা বিশাল এক বাহিনী নিয়া যায় যুদ্ধ করতে ইরানের লগে। রুস্তমের রক্ত আছে না পোলার গায়ে? রুস্তমও বিশাল বীর। ইরানের সীমান্তের দুর্গ এক্কেরে শুরুতেই দখল করলো। বেগতিক দেইখা দুর্গ থিকা ইরানের রাজারে খবর দিলো, এক বিশাল বীর আইতাছে রাজ্য দখলের লাইগা। না সামলাইলে সব মরতে হইবো। এও কইয়া দিলো, নেতাখান দ্যাখতে এক্কেরে তো মগো বীর রুস্তমের লাহান। ইরানের সম্রাট রুস্তমরে সাথে সাথেই খবর দিলো রাজ্যে আসতে। এই নিয়া রুস্তমের লগে ইরানের সম্রাটের বাধলো এক ঝগড়া। কারণ খবর শুইনাই সে রওনা না দিয়া দেরি কইরা আসছে।

রাজায় তার গর্দান কাটতে কইলো। এই শুইনা রাজার আরেক বীর সৈন্য যেই না তারে ধরতে আইছে, এক নিমিষে সে রাজার সেনারে উড়ায়ে দিয়া বাইর হইয়া যাইতে যাইতেই রাজা ভুল বুঝলো। ফিরায়ে আনলো। সোহরাবরে ঠেকানোর মতো বীর আর কেউ নাই তা এই রাজ্যের কে না জানে! বাপ পুতের যুদ্ধের খবর তাহমিনার কানে যাইতেই, তাহমিনা তাড়াতাড়ি তার ভাইরে পাঠাইলো। এদিকে সোহরাবের মামু পলাইয়া দেখা করতে গিয়া পড়লো ধরা। অন্ধকারে কিছু বোঝার আগেই রুস্তমে এক কোপে মাথা দিলো কাইটা। বাপ পুতেরে চিনানোর আর কেউ থাকলো না। এদিকে যুদ্ধের দিন মুখোমুখি হইছে পরেই সোহরাব মুখের দিকে চাইয়া রইলো। কইলো, আপনে কেডা? মহাবীর রুস্তম? রুস্তম ভাবলো শত্রুর লগে খাতির জমানোর চক্রান্ত করতে আইছে। কিছুই না কইয়া কইলো, যুদ্ধ করতে আইয়া অত কথার কাম কী? এরপরে হইলো দুইজনের মারপিট। একবার এরে ফেলে, আরেক বার ওরে। মারামারি চলতে চলতে চলতে চলতে আচমকা সোহরাব বাপ রুস্তমের বুকের উপরে উইঠা গেল। রুস্তমে করলো চালাকি, কইলো, মাটিতে পইড়া গেলে ইরানে যোদ্ধারে মারনের নীতি নাই। তাইলে তারে বীর কওয়া যায় না। সোহরাব নাইমা গেলে সেদিনে রযুদ্ধ থাইমা গেল। পরের দিন আবারো লাগলো যুদ্ধ। রুস্তম আরও শক্তি নিয়া লড়াই করতে আইছে ডরে। এক সুমায় সোহরাবরে যুতমতো ফালাইয়া সোজা বুকের উপর চইড়া বসলো। নিজের কওয়া নীতি ভাইঙ্গা দিলো পোলার বুকে কোপ। আহারে! রক্তে ভাইসা গেল সোহরাবের বুক। রাগে আর কষ্টে সোহরাব কইলো, আমারে মারলে কী হইবো? আমি বীররুস্তমের পোলা। বাপ খবর পাইলে সেইদিনই আপনের শেষদিন। চমকায় ওঠে রুস্তম। কয়, তুমি রুস্তমের ছেলে প্রমাণ দেখাও। সোহরাব বর্ম ছিড়া হাতের বাহু থিকা দেখায় বাপের দেয়া পাথরখানা। মইরা যায় সোহরাব। সেই সোহরাবরে কোলে নিয়া ছিঁড়া পোশাকে কানতে কানতে ফিরে তাহমিনার প্রাসাদে। এদিকে রুস্তমের ফেরার কথা শুইনা খুশিতে ছুইটা আইসা দেখে, বাপের কোলে পোলার লাশ। মাটির উপর লুটায় পড়ে তাহমিনা।

গল্প শেষ করতেই আবু বকর দেখে, রেজা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আর সুজা শরীরের উপর ন্যাতানো, অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আলতো হাতে সুজাকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে রেজারে বুকে জড়িয়ে ধরে। কোনকালে লিখে যাওয়া এক মহাকাব্যের বয়ানে ছোট বুকটার তোলপাড় আবু বকর বুকে জড়িয়ে শুনতে পায়।

তিন.
জীবন নাহার মাটির উনানের গোল ফোকড়ার কাছে লম্বা চোঙামুখে ঠেকিয়ে ফুঁ দেয়। আগুনের তাপে তার মুখ লালচে আভায় ধিকধিক করে। শুকনা পাতা আর খড়ির পটপট শব্দ ভাসতে থাকে চারপাশে। ভষ্ম হওয়া ধোঁয়ায় জীবন নাহার ক্ষণে ক্ষণে লাল চোখ মোছে আঁচল তুলে। সামনের এক চিলতে উঠানটায় মুরগির খোঁপটার কাছে ডালিমগাছের নিচে দুই ভাইকে পা ছড়িয়ে বসে খেলতে দেখে মুখ তুলে।

ঝিঁও ঝিঁও মাগো
প্যায়লা খাইতে গেছিলাম
কাডা ছুড়ে মারছিলাম
কাডায় কয় বিষ বিষ
ছেপলি পাতা বাইটে দিস
দারোগা আইলে ধরায় দিস
বলেই সুজা নিজের শেষ আঙুল বন্ধ করে, আমি জিতছি, আমি জিতছি... তোরে এইবার কিলামু...

খেলার নিয়ম অনুযায়ী যে জিতবে পরাজিতের হাতে কিল খেতে হবেই। কিন্তু বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের কাছে কিল খেতে মন তো সায় দেয়ার কথা না। খেলার নিয়মে চালাকি আনতে চেষ্টা করে। ছোট ভাই হলেও রেজার চেয়ে দ্বিগুণ বুদ্ধি রাখে সুজা। এক নিমিষেই রেজার হাবাহাবা চালাকি বুঝে ফেলে। বলে, ও রুস্তাম হইছো? চালকি কইরা জিততে চাও?

নিয়মের যাঁতাকলে পড়ে সুযোগ হারাবার ভয়ে সুজা সমস্ত শক্তি দিয়ে দেয় রেজার পিঠে ঘুষি। রেজার পিঠ বেঁকে আসে। দুই ভাইয়ের শুরু হয় কুস্তাকুস্তি। রৌদ্র তপ্ত দুপুরে আগুনের তাপে জীবন নাহারের মাথা গনগনিয়ে ছিল এমনিতেই। সুযোগ পেয়েই তার হাতে উঠে আসে চ্যালাকাঠ। চিৎকার করতে করতে ওদের দিকে যেতেই দুই ভাই নিমিষে দৌড়। বাড়ির ভাঙা গেট দিয়ে ছুটে যাওয়া দেখে জীবন নাহার আর বাধা দেয় না। ঘরের অনেক কাজ বাকি। কেবল সামনের মাঠ পেরিয়ে বাঁক পার হওয়ার মুখে দুই ভাইয়ের দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া এক নজরে চোখে পড়ে আবার। দুই ভাই খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে এবার পাল্লা দিয়ে ছুটছে। না বলা প্রতিযোগিতা চলে, কে আগে ছুঁতে পারে ঘাটপাড়ের বটগাছটার গোড়া।

সেইরাতে রেজার গাঁয়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। আবু বকর অনেক রাতে ফেরায় ডাক্তার পথ্য কিছুই যোগাড় করতে পারে না। সারা রাত জীবন নাহার কপালের উপর পানিপট্টি দিতে থাকে অবিরত। পরদিন সকালে আবু বকর স্কুলের প্রথম ঘণ্টা দিয়েই যায় ডাক্তার বাড়ি, ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে দেখে তখনও গাঁয়ে জ্বর। কিছুতেই ছাড়ছে না। জীবন নাহারের দূর্গারূপ হিমশিম খাচ্ছে সব একা সামলাতে। সুজার আজ খেলায় মন নাই। ক্ষণে ক্ষণে ভাইয়ের লাল হয়ে যাওয়া আধবোজা চোখের মুখটা দেখতে থাকে অসহায় হয়ে। ধক ধক করতে থাকে তার ছোট বুকটা। আবু বকর ওষুধ জীবন নাহারের হাতে দিয়েই চলে যায় স্কুলে। জীবন নাহার একরকম জবরদস্তি করে গরম ভাত লবণ দিয়ে মাখিয়ে ডলে এক লোকমা মুখে তুলে দেয় রেজার। সুজার দিকে তাকাবার ফুরসতও পায় না। হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট ছেলের দিকে। দেখে আবু বকরের টুপি একখানা পরে জায়নামাজ বিছিয়ে হাফপ্যান্ট পরে সুজা মোনাজাতরত। ছোট মাথায় বেঢপ টুপিটা পেছনে হেলে পরা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ এবার কানে আসে জীবন নাহারের।

হে আল্লাহ, আমার ভাইজানরে তুমি ভালো কইরা দাও। এই জায়নামাজে বইসা কিড়া কাডলাম, এই জীবনে ভাইজানরে আর মারুমনা। হে আল্লাহ, আমার ভাইজানরে তুমি ভিক্ষা দাও, তুমি তো দয়াময়, হে আল্লাহ...

সুজার চোখের পানি তার ছোট গাল বেয়ে অঝোরে পড়তে থাকে। ওর ছোট বুকের তোলপাড়ের সাথে সাথে জীবন নাহারের বুকটাও দুমড়ে মুচড়ে ওঠে।

চার.
প্রায় সাতদিন পরে জ্বর নামে রেজার শরীর ছেড়ে। শিংমাছের ঝোল আর কাঁচাকলা দিয়ে নরম জাউভাত আজ চেটেপুটে পুরোটা শেষ করায় কালসিটে হওয়া মুখটা উদ্ভাসিত হয় জীবন নাহারের। বোঝে বিপদ নেমেছে মাথা থেকে। সাতদিনে ভাইয়ের সাথে কথা না বলতে পারায় বুকের ভেতরের জমাট কথাগুলো ফোয়ারা ছোটায় সুজার মুখে। দুই ভাইয়ের চিহ্ন দেয়া জায়গা বাবুল কিভাবে গায়ের জোরে দখল করে রেজা পাশে না থাকায়, জসিমের দেয়া চড় কী করে হজম করে একা বলে, বটগাছটার যে ডালায় ঘুঘুর বাসা আবারও দুই ঘুঘুর উড়াউড়ি দেখা, ডিম পাড়ার সম্ভাবনার কথাও জানায়। ডালিমগাছে দুটা ফুল দেখা যাবার কথাও জানায়, জানায় আল্লাহর কাছে মানতের কথা, প্রথম ডালিম রেজা সুস্থ হলে তারেই খাওয়াবে, তবু যেন রেজাকে তাড়াতাড়ি ভালো করে আল্লাহ।

বিকেলের মাঝেই রেজাকে ঘরের মাঝে ছুটাছুটি করতে দেখে। বাইরে আপাতত যাওয়ায় বারণ থাকায় খাটের উপর বসে স্কুল স্কুল খেলা জুড়ে দেয়। প্রথম ঘণ্টাখানেক শিক্ষক সাজে রেজার স্বেচ্ছাচারী স্কেলের বাড়ি হজম করলেও তিন নাম্বারের বাড়ির সময় কানের পর্দা কাঁপানো চিৎকার দিয়ে হামলে পড়ে ভাইয়ের উপর। ক্যাঁচক্যাচে শব্দ আর ধস্তাধস্তিতে কাঁপতে থাকে খাট।

স্কুলে যাওয়া শুরু হয় আবার দুই ভাইয়ের। সময় গড়ায়। শীতের শুরুতে পরীক্ষা শেষে স্কুল যায় বন্ধ হয়ে। সারাদিন পড়া নাই, বন্দিজীবন ছেড়ে আবারও মাঠের ধূলাবালিতে গড়ায় দুই ভাই সারাবেলা। এমন একদিনে মায়ের শরীর ভালো না থাকায় বেলা পড়ে যাওয়ায় মা ঘরের কাজে থাকে ব্যতিব্যস্ত। দুই ভাই সেই সকাল থেকে নাওয়া খাওয়া না নিয়েই বাইরে বাইরে। মা ডাকে না বলে সূর্যের গতিবিধির খেয়ালও থাকে না দুই ভাইয়ের। মুচড়ে ওঠা পেট জানান দেয়, বাড়ি ফেরায়। রেজা আর সুজা মাঠ দিয়ে দৌড়ে ফিরতে থাকে। মাটিতে খেলায় বাঁধানা থাকলেও বাড়িতে মাটিসমেত ঢোকায় আছে জীবন নাহারের কড়া নিষেধাজ্ঞা। আজ মা আসেইনি, এখনও খড়ির চুলার সামনে বসা। অগত্যা নিজেদের গা ধোয়ার দায়িত্ব নিজেদের নিতেই হয়। আগেপিছুর প্রতিযোগিতায় দুই ভাই কখনোই পাশাপাশি থাকে না। বাঁক পেরিয়ে ঘাটপাড়ে আসতে আসতে সুজাকে হারিয়ে ফেলে রেজা। আশপাশে না দেখে নিজেই ঘাটপাড়ে নামে। ভাবে, ঘরে ভুলে চলে গেছে। সুজার পিঠে মায়ের কিল খাওয়ার দৃশ্য আসায় মনের আনন্দে হেসে ফেলে রেজা।

ঘাটে এসে কোমর পানিতে নেমে গলা, হাত, মুখ ডলতে থাকে। হঠাৎ চোখে পড়ে বুদবুদ। শীতের আমেজে নাকি বড়মাছ দেখতে পাওয়ার আনন্দে রেজার ঢেঙা শরীরটা কাঁপতে থাকে থমকে থমকে। শীতে পানি অনেক কমে যায়। বড়মাছ অনেক ভেসে ওঠে জলের উপরে। ঘাটপাড়ে রাখা বর্শা আনতে আনতে আফসোস করে সুজাকে এই বীরোচিত শিকার দেখাতে না পারায়। বর্শা হাতে নিয়ে পানিতে আলোড়ন না ফেলে সন্তর্পণে নামে রেজা। নিঃশব্দে পা টিপে টিপে যায় বুদবুদের কাছাকাছি। হ্যাঁ, পরিষ্কার এক কালো অবয়ব, বিরাট কোনো মাছ, রুই কাতলাও হতে পারে। হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুড়ে দেয় বর্শা। গ্রামীণ লতাপাতা খাওয়া শীর্ণ হাতগুলো থাকে বরাবরই শক্তিতে ঠাঁসা। মাছের বিদীর্ণ চিৎকারে প্রকম্পিত হয় ঘাটপাড়। অলৌকিক আওয়াজের মতো শোনায়।

শীতের শেষ সূর্যের লালচে আলোয় ঘাটের বুদবুদ লাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পানিতে। গোলাকার হয়ে ছড়াতে ছড়াতে রেজার হাতের বর্শা উঠে আসে। ওজনের ভারে বর্শা থেকে ধপ করে পানির মাঝে পড়ে সুজার ধনুস্টারের মতো বেঁকে যাওয়া শরীরটা। বড় ভাইকে ভয় দেখাবার বাসনায় যে বহুকষ্টে দম আটকে ডুব দিয়ে ছিল পানির তলাটায়।