ক্যামেলিয়া আলমের গল্প ‘গ্লেসিয়ার জীবন’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ৩১, ২০১৯
জারালার সনের ওয়ান মিসিসিপি গানটা হঠাৎ বেজে উঠলো:
ওয়ান মিসিসিপি, ইউ’র হিয়ার
লাভিং মি উইদ ইওর হোলহার্ট
এ্যান্ড টু মিসিসিপি, উই স্ক্রিম
টু ওয়াচ ইচ আদার ফল এ্যাপার্ট
থ্রি মিসিসিপি, ইউ আর গন
সেয়িং দ্যাট ইউ আরডান,
ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট ইট নো মোর
এ্যান্ড ফোর মিসিসিপি, ইউ আর হোম
লাইক নাথিংএভার হ্যাপেনড এ্যাটঅল
হুট করে থেমে গিয়ে গানটা আবার শুরু হলো। চারুলতা কোনোরকমে মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে ব্রা আর শর্ট পরেই বেরিয়ে এলো। হাতের হলুদ টিশার্ট গলা দিয়ে নামাতে নামাতে বারান্দার জানালায় একবার দৃষ্টি রেখে বিছানার ওপর থেকে মোবাইল ফোনটা হাতে নিতেই গানটা বন্ধ হয়ে গেল। এর মানেই অপর প্রান্তের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। জারালার সনের গানটা চারুলতার নিত্যদিনের সাথী। কিছু মানুষ যেমন শরীর ভেদ করে আত্মায় গিয়ে বাসা বাঁধে, কিছু গানও তেমন হুড়মুড়িয়ে আত্মার অলিন্দে শিরশিরিয়ে বেড়ায়। আশপাশের কত শত ভালোও যে জায়গায় পৌঁছুতে পারে না। এই গানটা তাই চারুলতার দীর্ঘদিনের রিং টোন। এর মাঝে কয়েক বারই মোবাইল বদলেছে, গানটা বারেবারেই ফিরে এসেছে। স্ক্রিনে এক অচেনা নাম্বার দেখে কল করবার ইচ্ছেটা উবে যায়।
প্রয়োজন হলে যেচে পড়ে ফোন করবেই... মাথার এই ভাবনাটা দুই ভ্রুর মাঝের কপালটায় সামান্য আলোড়নের মাঝেই থেমে যায়। আবার চোখ আটকায় বারান্দার জানালায়। মৃদুল ডাক্তারের বাড়ির জানালা তার বারান্দা আর বেডরুম বরাবর। নতুন ফ্ল্যাট কেনার পর কিছুদিন উঁচু জানালার পর্দা টেনেটুনে রেডি হবার অভ্যাস ছিল। পুরনো হবার পরে অভ্যাসটা মরে গেছে। এর পেছনে চারুলতার যুক্তি হচ্ছে, এই সাতসকালে কেউ অপর প্রান্তের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে ওর উদাম শরীর দেখবার চেষ্টা করবে না। আর আরেকটা যুক্তি হচ্ছে, নগরের এই ব্যস্তসমস্ত জীবনে কর্মজীবিকার ও অন্তত আনুবীক্ষণিক মন তৈরি হবে না অপরকে দেখবার। ফলে সেই চোখঢাকা খরগোশের থিউরি চারুলতার মনের মাঝে থাকে, আমি দেখি না তাই তারাও নিশ্চয়ই কেউ দেখতে পায় না আমায়।
আয়েশ করে বডি লোশন নিয়ে আলতো হাতে মাখতে থাকে সারা শরীরে। আঙুলের মৃদু চাপ সারা শরীরজুড়ে ছুটতে থাকে, ব্লাড সার্কুলেশনের সঠিক চলাচলে চর্বি আর বাসা বাধতে পারে না। তাই এই অভ্যাসটা এখন চারুলতার প্রাত্যহিক। এক টিভি চ্যানেলে কাজ করে, নিজেও টুকটাক অভিনয় করে সিভিসিতে। তবে একটিংয়ের চেয়ে ডিরেকশনেই চারুলতা আনন্দ পায় বেশি। নিজের ইমারত নিজের মতোনই গড়া যায় তাতে।
আবারও বেজে ওঠে মোবাইল। একটু আগের সেই অচেনা নাম্বারই ভেসে আসছে স্ক্রিনজুড়ে। দেরি না করে এবার তাৎক্ষণিক তোলে ফোনটা। অপর প্রান্তের ঠাণ্ডা এক গলার আওয়াজ যত বাক্য বলতে থাকে, ঠিক ততটাই পাংশু হতে থাকে চারুকলার মুখ। ফোনটা করেছে গীতালী আপা। পুরনো থিয়েটারের সিনিয়র আপা। কিছুক্ষণ পরে ফ্যাকাশে মুখটায় আবারও রক্তকণিকা চলাচলের ছাপ ভেসে আসে। চোয়ালের শক্ত বাঁধুনি এবার নরম হতে দেখা যায়।
কখন মারা গেছে? ও আচ্ছা।
আবারও অপর প্রান্তের আওয়াজ।
সামলে নেয়া চারুলতা বেশ স্বাভাবিক গলায় বলে, না গীতালী আপা, আমি যাব না। থাকুক।
এরপরই ফোনটা ছুড়ে বিছানার ওপর রাখে। চারুলতা বিপ্লবী ছিল না। দুইদিন পরপরই ভালোলাগাকে পাল্টাতেও শেখেনি কোনোকালে। তবু চলে আসতে হয়েছিল। চলে আসবার পরের কিছুদিন কতটা প্যারালাইজড মন নিয়ে কাটিয়েছিল তার পুরো স্মৃতিজীবন রিলের মধ্যি খানটায় আটকে আছে। রঞ্জনের আগে যে তার জীবনজুড়ে ছিল, সে ছিল মুকুল, যাকে এই শেষ তিনবছরে একেবারেই ভুলে গেছিল। স্বার্থপরতা? এক ভার দলা পাকিয়ে পুরনো কিছু মানুষের চোখগুলো ঘুরপাক খায় মনের ভেতরে। দম আটকে আসে খানিকটা। সদ্য ইস্ত্রি করা ফতুয়াটা হাতে তুলে নিয়ে পরতে গিয়েও নামিয়ে রাখে নিঃশব্দে। দমকা হাওয়ার মতোন এক কান্না এবার সদ্য জেগেওঠা ঝরণা ধারার মতোন বেরিয়ে আসে পাথর মোড়া অলিন্দ থেকে, তীব্র বেগে নামে দুই চোখজুড়ে। সশব্দের কান্নার দমক পেরুলেই মোবাইল টেনে নিয়ে সময় দেখে। মিটিঙের আর মিনিট পাঁচেক বাকি। প্রতিদিন কাজের শুরুতে ঘণ্টাখানেকের এই মিটিঙে উপস্থিতি জরুরি। দ্রুত কললিস্ট চেপেই সাদীভাইকে ফোন দিয়ে অসুস্থতার কথা বলে ফোনটা বন্ধ করে দেয়। পুরনো থিয়েটারকর্মীদের একের পর এক ফোন থেকে পালিয়ে বেড়ানোই এখন প্রথম প্রধান কাজ।
হঠাৎ শীত লাগে চারুলতার। বিছানার উপর মুড়ি দিয়ে কুঁকড়ে শুয়ে পড়ে। ইস্কাটনে ছিল তখন তাদের বাসা। বাড়িতে নিত্য অশান্তি। মায়ের একার আয়ে সংসার খুড়ে খুড়ে চলে। বাবা যা আয় করে, তার পুরোটাই ব্যয় হয় নেশায়। বাবার এলকোহলের এডিকশন বাড়ির ভেতরটাকে ভয়ংকর শীতল করে রাখতো। বাড়ির ভেতরটা সবুজ রাখতো মা সবসময়। সারা বাড়িময় নানা প্ল্যান্টের ছড়াছড়ি, একটু ওমের আশায় সারা বাড়িজুড়ে সাজিয়ে রাখতো নানারঙা লাইট। ড্রইংরুমের কর্ণার, বিছানার পাশে রাখা চেস্ট ড্রয়ারের উপরে, এমনকি চারুলতার ঘরের দেয়ালের এপাশ ওপাশ ধরে রাখা লম্বা তারে ছোট ছোট মরিচবাতি। তারের সাথে ক্লিপ সেটে লাগানো চারুলতার হরেক রঙা ছবি। এত আলোর উত্তাপে ভরা সাজানো বাড়িটাতে ঢুকলে চারুলতার তবু শীত শীত করতো। গ্লেসিয়ারের চলমান জীবনের শীতল ফোমগুলো থেকে বের হবার সুতীব্র ইচ্ছায় একের পর এক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো বহুরাত অবধি। তবু সেই মন্থর গতিতে এগিয়ে যাওয়া গ্লেসিয়ারের জীবন, যেখানটায় আছে সূঁচ বেধা শীতলতার নিঃসীম শূন্যতার গা কেপে ওঠা হাওয়া।
থিয়েটারে সেজন্যই যোগ দেয়া। অভিনয় দিয়ে অভিনয়ের জীবন আর ঘর থেকে পালিয়ে বেড়াবার এক অদম্য চেষ্টা। মানব প্রকৃতিতে আনন্দিত হবার শক্তিময়তা বিবর্ণ বিষাদের থেকে বেশি থাকে বলেই গ্লেসিয়ার জীবনকে তপ্তসমুদ্রে নিক্ষেপ করতে পেরেছিল চারুলতা থিয়েটারে এসে। রঙ্গমঞ্চে কখনও ডোরা, কখনও কুসুম আর কখনও তারা নেল জনসন হয়ে বেশ একটা কাটিয়ে দেয়া সময়। কেবল ঘরের চৌকাঠ মাড়ালেই আবার গ্লেসিয়ার জীবন।
মুকুলের সাথে দেখা হয় থিয়েটারে এসে। চমৎকার প্রাণখোলা হাসিখুশি এক মানুষ। গভীর সংবেদনশীল। অসম্ভব সৃজনী ক্ষমতা। তার নির্দেশিত নাটকগুলোয় ২০ বছরের চারুলতা ১৭ বয়সী কিশোরী থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা হবার অ্যাক্টিং অবলীলায় করে যেত। রিহার্সেল শেষ হতে হতে প্রায়ই রাত হয়ে যেত। জাহাঙ্গীর, সুমনভাই, তপনভাই ছাড়াও মুকুলভাইও মাঝে মাঝে পৌঁছে দিতো বাড়ি। বইতে থাকা বাতাসের মাঝে হুট করেই বসন্তের বাতাসের মতো মুকুলভাই হুড়মুড়িয়ে জায়গা করে নিলো মনের শেষ কুঠুরিতে। মনে আছে, চারুলতার সেই রাতটির কথা, যেদিন প্রথম প্রেমেপড়া। কারণ সেই দিনটিই প্রথম বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়েও শীত লাগলো না আর। চারপাশে সবই ভালো লাগা। পরম দূরে সরে যাওয়া বাবার নেশাতুর চোখখানাকেও বড় মায়ার মনে হয়েছিল সেদিন। পাশ ফিরিয়ে মায়ের শুয়ে থাকাকে দেখে পোশাক না ছেড়েই মাকে জাপটে ধরে শুয়ে পড়েছিল।
আহা, কতদিন এই নারীকে কেউ আলিঙ্গন করেনি... মা চমকে পাশ ফিরে শুতে চাইলেও চেপে ধরে রাখলো চারুলতা। অলীক ভালোবাসার উষ্ণতাটুকু ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হলো কাঠজীবনের এক নারীকে। মা বাধা দিলো না। হাতটুকু চেপে ধরে পড়েই রইলো ওপাশে মুখ রেখে। কতক্ষণ এভাবে ছিল, জানে না চারুলতা। মায়ের পিঠে মাথা রাখা চারুলতা কেবল টের পেলো মায়ের ফুলে ফুলে কান্নার রেশটুকু। মা অপর প্রান্ত থেকে চোখ বুজেও দিব্যি টের পেল তার ব্লাউজের পিঠের একটু একটু ভিজে আসা মেয়ের চোখের কান্না।
এভাবেই শুরু হলো। গড়াতে থাকলো সময়। চারুলতার পড়া আর কাজের ফাঁকে চাকরিও হয়ে গেল এক টিভি চ্যানেলে। মুকুল ভাই সার্বক্ষণিক সঙ্গী। প্রেমের শুরুটায় তার সংবেদনশীলতা, অকপটে নিজের জীবনের গল্পগুলো বলে হালকা হতে থাকা চারুলতা আচমকাই আবিষ্কার করলো, মুকুল ভাই কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে। সারাক্ষণই নাক টানে আর এটাসেটা বলে ইদানীং যে কোনোভাবে টাকা নিচ্ছে। উপার্জনক্ষম হওয়ায় টাকা-পয়সা দিতে দ্বিধা ছিল না শুরুতে। থিয়েটার করা মানুষ হওয়ায় সিগারেট, গাঁজা বা একটু আধটু অ্যালকোহলকে মন্দ চোখে দেখেওনি কোনোকালে। আর তাছাড়া অন্ধভাবে আস্থা রাখা মুকুল ভাই একদিন যুক্তি দিয়ে যখন বোঝালো, দেশে করা এইসব কোক, ফান্টার চাইতে অ্যালকোহল কেন শরীর উপযোগী, সেই সময় দ্বিধা আর থাকলো না মুকুল ভাইয়ের দৈনন্দিন অ্যালকোহল পানে। দেশীয় সব মিষ্টি পানীয়তে পেস্টি সাইড মেশানো হয় পোকামাকড় থেকে দূরে রাখতে। কী ভয়ংকর বিষ প্রতিনিয়ত মানব শরীরে যাচ্ছে। চারুলতাও বেশ যুক্তি খাটিয়ে মেনে নিলো পানীয় হিসেবে সাধারণ কোক, ফান্টার চাইতে অ্যালকোহলের উপযোগিতাকে। কিন্তু তার এই নেশায় সামাল দিতে গিয়ে চারুলতার হিমশিম খাওয়া জীবন ক্রমাগত বিরক্তিকর লাগতে শুরু করে।
চাকরি পাবার আগে প্রায়ই চারুলতার টাকা-পয়সার ক্রাইসিস মোকাবেলা করতে হতো। বাড়ি থেকে পয়সা পাওয়া যেত ন্যুনতম প্রয়োজন মেটাবার। প্রেমের বাহুল্যতায় লাগে কত কত টাকা। এছাড়া বাড়ি ফিরতে গেলেও কখনও টাকা যেত ফুরিয়ে। প্রথম প্রথম মুকুল ভাই দিতোও। এক সময় যখন দুজনের কারও কাছেই পয়সা থাকতো না, সেইসময় হেঁটেও ফিরতো বাড়ি। রাত্রির ল্যাম্পপোস্টগুলো চারুলতা আর মুকুলের কতদিনের কত ফেলে যাওয়া টুকরো শব্দের ঝাপি! চারুলতার গেট খুললেই মুকুলের ফিরে যাওয়া। দৌড়ে চারুলতা দোতলায় নিজ ঘরটার জানালায় চলে যেত। হালকা আলো-আঁধারির বাঁকের শেষ মাথায় মন্থর পায়ের এক দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া অবয়বকে দেখবার এক উত্তাল চাওয়া থেকে। চারুলতার চাকরির পর থেকে মুকুল পুরোই বদলে যেতে শুরু করলো। বিষয়টা বিস্ময়ের চেয়েও ভয় দেখাতে শুরু করলো চারুলতাকে।
চারুলতার খুব কঠিন সময়ে মুকুল ভাইকে কাছে পাওয়া। অন্তরের অন্তর হয়ে যাওয়া মানুষটির প্রতি তবু ক্ষোভ জমতে থাকে এবার। চারুলতার দিকে কোনো নজর নাই, নির্দেশনা দিয়ে যা আয় করে তার প্রায় পুরোই ব্যয় করে নেশায়, সামান্য কোন অনুভূতিও আর আগের মতো কাজ করে না মুকুলের। অভিমানী চারুলতা একদিন পয়সার বিষয়টা তুললে মুকুল বিস্ময়ের চোখে চারুলতাকে দেখে।
এর মানে, তোমার আমার প্রেম টাকা-পয়সার?
আমি তা বলেছি? ঝাঁঝের সাথে বলে চারুলতা।
তুমি তো তাই বলছো। টাকার হিসাব চাইছো, আমি আগে দিয়েছি, এখন দেই না কেন তার ফিরিস্তি শুনতে চাইছো ইতরের মতো।
মোটেই তা শুনতে চাইনি। আমি কেবল জানতে চাইছি তোমার ইনকামের টাকা তুমি কী করো। সারা বছরে আমায় একদিন খাওয়াতে এখন কেন তোমার দ্বিধা এত? আমার জন্মদিনটাও বেমালুম ভুলে বসে আছো। আমি বলার পর বহুদিন পরে একবেলা খাওয়ালা। বললা, ভুল হয়ে গেছে। পরের টাকাটা পেলেই গিফট কিনে দিবা। সেও আজ মাস তিনেক হলো।
ও আচ্ছা, গিফট দিতে না পারার জন্য বলতে চাইছো, ভালোবাসা যাবে না? প্রেম করা যাবে না?
চারুলতা আর মুকুল সেদিন বসেছিল ফুটপাতের উপর। চারুলতার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। উত্তর দিতে ইচ্ছে হয় না আর। হাঁটুর উপর মাথা গুজে রাখে নীচু হয়ে।
রাস্তার উপর এসব অভিনয় করবা না। মহিলা সমিতি বা গাইড হাউজ পাও নাই। তোলো মুখ।
প্রচণ্ড ধমক কষে হ্যাচকা টানে হাত ধরে টেনে তোলে চারুলতাকে। চারুলতা হতবিহবল হয়ে তাকিয়ে থাকে মুকুলের দিকে। কিছুই বলতে পারে না। বুকভাঙা কান্নাকে চেপে রাখে ভয়ে। পাংশু মুখে মুকুলের টানে হাঁটতে থাকে এবড়ো থেবড়ো ভঙ্গিতে। রিকশায় উঠে বসার খানিক ক্ষণ পরে মুকুল কোমরের পাশটায় জড়িয়ে ধরে চারুলতার। চারুলতা মুখ গুজে দেয় মুকুলের বুকে, হু হু করে কাঁদতে থাকে।
সরি আমি।
চারুলতার মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায় আবার।
আসলে চারপাশের এত অস্থিরতা। একদিকে দেশের যা কনডিশন, অন্যদিকে প্রোডিওসারগুলোও দিনের পর দিন বিল্ আটকে রাখে।
চারুলতা সরল ভাবে বলে, তুমি চ্যানেলে জয়েন্ট কেন করো না? অন্তত মাসকাবারি বেতনটা তো হতো।
আরে ধুর! চ্যানেল কি কোনও ক্রিয়েটিভিটির জায়গা? সেখানে তো বিক্রি হতে হবে, শিল্পের আছে নাকি কিছু সেখানে। একজন প্রকৃত শিল্পী স্বাধীনতা ছাড়া কোনও সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারে? ঋত্বিক ঘটক কি টিভি চ্যানেলে কাজ করলে এই শিল্পের জন্ম দিতে পারতো?
চারুলতা মেনে নিতো। কারণ কথাগুলোয় কোনও ভুলই নাই। তবে এই টাকা কেন্দ্রিক জটিলতা আরও শুরু হলো। আগে তবু ভদ্রোচিত চাওয়া ছিল, বাড়তে বাড়তে তা জবরদস্তির পর্যায়ে যখন পৌঁছে গেল তখন ভয় পেতে শুরু করলো মুকুলকে। কেবল তাই নয়, বন্ধুবান্ধববিহীন এক জীবনও চারুলতার শুরু হলো। কেবল মুকুলের সন্তুষ্টির জন্য। কখনও বন্ধুবান্ধবের একান্ত অনুরোধে কোথাও গিয়ে আড্ডায় বসতে না বসতে মুকুলের পথমধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিভীষিকার জীবন এনে দিলো ওর। জীবন আরও দুর্বিষহ হলো যেদিন হুট করে প্রেগনেন্সি ধরা পড়লো। দুজনেই অপ্রস্তুত। অ্যাবরশনের মতো অমানবিক সিদ্ধান্ত নিতে হলো। অ্যাবরশনের দিন সারা দিন হাসপাতালে থাকলো ঘোরের মাঝে। চারুলতার নিজেকে মনে হলো জমাট বরফে আটকা পড়া ডানাভাঙা এক সীগাল। পরদিনই নাটকের পূর্ব নির্ধারিত শো, বাতিল করবার কোনও সুযোগ না থাকায় মঞ্চে যখন দাঁড়ালো, দৃশ্য থেকে দৃশ্যায়নের বুলিগুলো তোতাপাখির মতো আউড়ে গেল। প্রায় ঘণ্টাখানেকের এক নাচের দৃশ্যে অভিনয়ের সময় চারুলতার হঠাৎই কান্না পেল মঞ্চজুড়ে লালনীল বাতিগুলোর দপদপানিতে। ওর মনে হল, এই স্টেজের প্রতিটি আলো ওকে নিয়ে অট্টহাসি হাসছে। দুলুনির তালে চাপা পড়ে থাকলো মাথার তীব্র দুলুনি। জীবন কেবল গ্লেসিয়ারে বয়েই চলা!
দুই.
সুপার ন্যাচারাল বলে কিছু কী আছে?
স্বর্ণালীর কথাগুলো ভোতা মন নিয়ে কোনও রকমে কানে গেল চারুলতার। ইদানীং ভয়ংকর বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকলে স্বর্ণালী জোর করে তুলে নিয়ে আসে চারুলতাকে। ওর ফোন বন্ধ করে চুপচাপ কয়েক দিন কাটাতে বলে। তুই মুকুলকে নিয়ে অতিরিক্ত বাড়া বাড়ি করছিস? আমার আর রাহির কী প্রেম নাই? কই আমরা তো দিব্যি বন্ধু, আড্ডা সবই দিচ্ছি। আমাদের মাঝে তো এ নিয়ে বিন্দুমাত্র ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। মুকুল অবশ্যই সাইকো। কেন সে তোকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে?
না ঠিক তা না, আমায় ভালোও তো বাসে। আমার মনোবলহীন জীবনে সে আমার পাশে ছায়ার মতো ছিল। আমি অভিনয় যা শিখেছি, হাতে ধরে সে আমায় শিখিয়েছে।
খুব ভালো কথা। সেজন্য গ্রেটফুল থাক। কিন্তু ক্রীতদাসী হচ্ছিস কেন? আর সে চাকরি-বাকরি করে না কেন?
স্বর্ণালী, সে সত্যিই ক্রিয়েটিভ এক পার্সন। হ্যাঁ, এও ঠিক, ইদানীং ওর টানাটানিটা খুব বেশি বেড়েছে। আমার বেতনের সময়টায় মরিয়া হয়ে টাকা নেয়।
হোয়াট? কতদিন ধরে দিচ্ছিস?
প্রায় বছরখানেক।
তোদের শিল্পীরা তো নেশা করা ছাড়া শিল্প রচনা করতে পারিস না। এইসবের অভ্যাস আছে?
চারুলতার চুপ করা থেকে স্বর্ণালী বুঝে নেয়। হঠাৎ কী মনে করে স্বর্ণালীর এক বন্ধুকে কল দিয়ে কথা বলে টুকটাক। এরপর চারুলতার দিকে তাকায়।
চারু, মুকুল ভাই ড্রাগস এডিকটেড, তুই কী জানিস?
হ্যাঁ, আন্দাজ করতে পেরেছি কিছু দিন পরেই। ওকে ছাড়াবার সাধ্যমতো চেষ্টাও করেছি। সাইকোলজিস্ট দেখাবার চেষ্টা করেছি, রাজি হচ্ছে না।
উফফ। মাথায় হাত রাখে স্বর্ণালী।
চারু, সে হেরোইন নেয়, তুই কী করে তাকে বদলাবি? তোর ফ্যামিলি কী তোর প্রতি এতটা সাপোরটিভ?
হেরোইনের কথা জানি না। গাঁজা খায় জানি আর...
তুই বুঝছিস, তুই কী করছিস? তোর ফ্যামিলিতে তুই ছাড়া তোর মায়ের কেউ নাই, কিছুই নাই। তোর বাবাকে নিয়ে যে অসুস্থতা দিনের পর দিন দেখেছিস, তা তুইও জীবনে নিবি? তুই কী ভালোবাসতে পারছিস আগের মতো?
কিন্তু ওকে ছাড়ার কথাও তো ভাবতে পারছি না, বিরক্ত হচ্ছি আবার ওর কাছে গিয়েই শান্তি পাচ্ছি।
এ কেবল মাত্র অভ্যস্ততা। তুই অভ্যস্ত হয়ে গেছিস ওরে ভালোবাসতে। তুই অভ্যস্ততা বন্ধ কর, আবার ঠিক হবে, কী যেন ওই ছেলেটা, রঞ্জন, হ্যাঁ, রঞ্জনের সাথে বন্ধুতা গাঢ় কর। প্রেম করতে হবে না।
স্বর্ণালী, তুই আসলে বুঝবি না। ওর ভেতরে এক সুপার ন্যাচারাল বিষয় আছে। আমি নিজেও খেয়াল করেছি। সে অনেক বড় হবে।
ওহ ড্যাম ন্যাচারাল! সুপার ন্যাচারাল বলতে কী বুঝিস রে? গাঁজা খেয়ে, এলকোহলে ডুবে থেকে দুই ছত্র কবিতা লেখা আর শিল্প রচনা?
সুপার ন্যাচারাল কল্কিতে দম দিয়ে সন্ন্যাসগিরি বা গাঁজার নেশায় ডুবে সংবেদনশীল কথার মায়াজাল সৃষ্টি করা না। কোনো মিথ্যাকে সুন্দর মিথ্যা, আনন্দের জন্য মিথ্যা বললেই তা সত্য হয়ে যায় না। সত্যকে সত্য বলে প্রকাশ করার টিমটিমে বাতির সৌন্দর্য হাজার সুন্দর মিথ্যার আতশবাতির চেয়েও মহান। কারণ ওইটুকুই দিনশেষে থাকে। বাকিগুলো ভেলকি। সুপার ন্যাচারাল মানুষ কী করে হতে পারা যায়, জানিস? ভোর চারটায় উঠে ২০ মিনিটের কঠিন একসারসাইজ করে সারাদিনের জন্য শরীরমনকে ফিট করে নিজ লক্ষ্যে অটল থেকে কাজ করে যাওয়া। মানুষের উপকার করতে অবলীলায় ঝাপিয়ে পড়া। অসুন্দর, মিথ্যা আর স্বেচ্ছাচারীতাকে সুপার ন্যাচারাল বলিস কোন যুক্তিতে? সুপার ন্যাচারাল যদি কেউ থাকে সে তোরমা, আজ তুই কই থাকতি উনি যদি এই লোডটা না নিয়ে চলতো। তোর মা অসুস্থ সংসারের জন্য বহু চারুলতার উপকার করতে পারেনি, একজন চারুলতাকে তো গড়েছেন, তার মেয়ে হয়ে তুই আরও অসংখ্য চারুলতার পাশে থাকতে চাস নাকি তোর মায়ের জীবনের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাস, দ্যাটস আপটু ইউ।
স্বর্ণালীর সাথে কথা বলবার পরেও বেশ কিছুদিন খুড়ে খুড়ে চলছিল প্রেম। এর মাঝে রঞ্জনের সাথে হঠাৎই একদিন রাস্তায় দেখা। কাছাকাছি এক রেস্টুরেন্টে দীর্ঘ সময় একটানা কাটালো। রিলিফ বোধ করলো কিছুটা। লজিক্যাল লাগলো ওর কথাগুলো। কোনও ডমিনেইট না, কেবল বিষয়গুলোকে থার্ড আই দিয়ে বিশ্লেষণ। মুকুলকে সরাসরি বলেই কেবল হলো না, ওর থেকে পালিয়ে বেড়াতে হলো দীর্ঘ সময়, নিজের জন্য, ওর জন্য। মানসিকভাবে যেদিন বুঝতে পারা গেল, মুকুলের প্রতি করুণা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নাই, তখনই রঞ্জনকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলো।
থিয়েটারের অনেকে ভুল বুঝলো। চারুলতার বদনাম হলো ভারি। সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী, যে অসহায় মুকুলের পাশে প্রেমময় অবস্থান না রেখে নিজের জীবন গড়তে চলে গেছে! কেবল চারুই উপলব্ধি করে যে, সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়া মানুষকে কখনই বাঁচিয়ে তোলা যায় না। এ তার নিয়তি!
চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে। আলোর তীব্রতায় ফেটে পড়া শহরও কী বিচ্ছিরি রকমের কালো, বিবর্ণ। দীর্ঘদিন পরে চারুলতার ভীষণ শীত লাগতে থাকে। মুকুল আর কোনোদিন এই আলো-অন্ধকারের পৃথিবী দেখবে না। এক ভয়ংকর শূন্যতায় ডুবে যেতে থাকে চারুলতা। গ্লেসিয়ার জীবনে ভাসতে ভাসতে যখন কুঁকড়ে ছোট হতে থাকে ঠিক সেই সময়েই রঞ্জন ঘরে এসে বাতিটা জ্বালায়। চারুলতার চোখ কুচকে ওঠে আলোর বন্যায়। রঞ্জন চারুলতার পাশে শুয়ে ওকে প্রবল আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখে কেবল। মুকুলের মৃত্যুর খবরটা ওর কানেও গেছে।
একটু একটু করে ফোমের বরফগুলোয় উত্তাপ ছড়ায়। গলতে গলতে সমুদ্রের বিশালতায় পরিণত হয়। যার মাথার উপর এক উদীয়মান স্বর্ণজ্বলা আকাশ এই রাতের শহরেও চারুলতা দেখতে পায়।