ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ডের গল্প ‘সান এন্ড মুন’

অনুবাদ - লুনা রাহনুমা

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৫, ২০২০

ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড বেউচ্যাম্প, ১৮৮৮ সালে নিউজিল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী এই লেখিকা তাঁর সময়কালের অন্যতম প্রধান শক্তিশালী লেখিকা ছিলেন। স্কুলে থাকাকালীন সময় থেকেই ক্যাথরিন সাহিত্য রচনায় শুরু করেন। পড়ালেখার শেষ ধাপে তিনি লন্ডনে যান, সেখানে মাত্র একবছর থেকে ১৯০৬সালে আবার নিউজিল্যান্ডে ফিরে আসেন। তখন থেকে নিয়মিত লেখা আরম্ভ করেন ক্যাথরিন। কিন্তু তাঁর লেখক জীবনের ভীত পোক্ত হয় ১৯০৮সালে, যখন তিনি আবার লন্ডনে চলে যান। সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন ও বিয়ে করেন। 

 

তিনি তাঁর সময়ের অন্যতম সেরা লেখক হিসাবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন। ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ডকে ছোটগল্পের মাস্টার বলা হতো। ১৯১৭সালে ক্যাথরিনের শরীরে এক্সপ্রেমুলামারী টিউবকোলোসিস রোগের লক্ষণ দেখা যায়। মানব শরীরে রোগ প্রতিরোধের অসামান্য ক্ষমতা থাকলেও প্রতিভাধর লেখিকা ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড এই রোগে মারা যান যখন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৫। 

 

ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ডের ছোটগল্পগুলোর ভেতর জনপ্রিয় হিসেবে,‘The Garden Party’, ‘The Daughters of the Late Colonel’, ‘Bliss’, ‘Prelude’, ইত্যাদি নাম উল্লেখ করা যায়। 

আমি ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ডের ‘Sun and Moon’ গল্পটি অনুবাদ করেছি।  

 

সূর্য আর চন্দ্র

 

বিকেলে চেয়ার এলো। মালবাহী একটি গাড়ি ভর্তি হয়ে সোনালী রঙা পায়ের চেয়ারগুলো আকাশের দিকে চারটি করে পা উঁচু করে বাড়িতে এসে হাজির হলো। চেয়ারের পর এলো ফুল। কয়েকটি লোক গাড়ি থেকে একের পর এক মোটা ফুলের আঁটিগুলো দুইহাতে উঁচু করে ঘরের ভেতর আনছিল। বেলকনি থেকে দেখতে মনে হচ্ছিলো হাস্যকর কিছু ফুলের মুকুট মাথা নেড়ে নেড়ে কালো রাস্তাটাকে অভিবাদন করে হেঁটে চলেছে।

 

চন্দ্র ভেবেছিলো, ওগুলো মানুষের টুপি পরা মাথা। বললো, "দেখো। একটা লোক মাথায় খেজুরের গোছা লাগিয়েছে।" অবশ্য চন্দ্র কখনোই আসল আর নকল জিনিসের পার্থক্য বুঝতে পারে না।

 

বাড়িতে আজ সূর্য আর চন্দ্রকে দেখাশোনা করার কেউ নেই। নার্স মেয়েটি এখন সেলাই দিদিমনি অ্যানিকে সাহায্য করছে ওদের মায়ের ড্রেস ঠিকঠাক করতে। ড্রেসটি বেশি লম্বা হয়ে গিয়েছে। আর বগলের নিচটা মায়ের গায়ে খুব টাইট হচ্ছে। ড্রেস অল্টারেশনের ভেতরেই মা কিছুক্ষণ পরপর ওদের বাবাকে টেলিফোন করছে, পার্টির জন্য কোন জরুরি জিনিস আনতে যেন ভুলে না যায় তাই। এই মুহূর্তে মায়ের হাতে ওদের সাথে কথা বলার মতো সময় বলতে শুধু এটুকুই ছিল: "বাচ্চারা, সামনে থেকে সরে যাও।"

 

এরপর ওরা আর মায়ের সামনে যায়নি - অন্তত সূর্য যায়নি একেবারেই। সূর্য মাকে ক্ষেপিয়ে নার্সারির কামরায় বন্দি থাকার কথা চিন্তা করতেও ভয় পায়। যদিও চন্দ্রকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। কারণ ওকে কখনো নার্সারিতে বন্দি থাকতে হয়নি। চন্দ্র যদি আজ সন্ধ্যায় বাড়ির অতিথিদের কারো পা জড়িয়ে ধরে বানরের মতো ঝুলতে থাকে, তাহলে বাবা ও মা বড়জোর চন্দ্রকে দুই হাতের দুই আঙুলে শক্ত করে তুলে ধরে বাতাসে ছুড়ে মারবে, তারপর খুব করে ঝাঁকাবে বাচ্চা মেয়েটাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ভয়ে ও ব্যাথায় চিৎকার করে কেঁদে উঠে। সূর্য অবশ্য চন্দ্রের এই শাস্তি পাবার জন্য একটু বেশি ভারী। সে এখন এতই ভারী যে রবিবারে মোটা লোকটি বেড়াতে আসলে সূর্যকে দেখে বলে: "এই যে বাবু, আসো তোমাকে একটু কোলে নিতে পারি কিনা দেখি!" তারপর লোকটি তার দুই হাতের দুই বুড়ো আঙ্গুল সূর্যের দুই বগলের নিচে ঢুকিয়ে দেবে আর কঁকিয়ে উঠার ভান করে বলবে: "ঠিক এক মণ ইটের সমান ওজন এই ছেলের!"

 

সন্ধ্যার পার্টি উপলক্ষ্যে আজ ওদের বসার ঘরের প্রায় সব আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বড় পিয়ানোটি ঘরের এক কোনায় নিয়ে রেখেছে। আর পিয়ানোর জায়গায় এসেছে অনেকগুলো সুবিশাল ফুলের তোড়া আর সোনালী পা-ওয়ালা চেয়ারগুলো। ঘরের একপাশে এই চেয়ারগুলোকে সাজানো হয়েছে কনসার্ট দেখার মতো করে। সূর্য দেখলো একটি সাদা মুখের লোক পিয়ানোর সামনে বসে আছে। তবে সে পিয়ানো বাজাচ্ছিল না। একটু পরপর পিয়ানোতে টুংটাং শব্দ করছে আর তারপর পিয়ানোর পেটের ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। লোকটির পায়ের কাছে একটি ব্যাগ নানারকম যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ পিয়ানো বাজাচ্ছে তারপর জলদি করে আবার মাথা ঢুকিয়ে দিচ্ছে পিয়ানোর খোলা পেটের ভিতর। সূর্য মনে মনে ভাবলো, এটা নিশ্চয়ই পার্টির আসল কনসার্ট না!

 

আজ অবশ্য এই বাড়িতে দেখার আসল স্থান হচ্ছে রান্নাঘর। সূর্য ও চন্দ্র রান্নাঘরে উঁকি দিলো। ওদের রান্নার বাবুর্চি মিনিকে সাহায্য করার জন্য আরেকটি লোক ডাকা হয়েছে। মিনির মুখ টকটকে লাল হয়ে আছে, কিন্তু তার মেজাজ ভালো আছে কারণ মিনি খুব হাসছে। সে দুই ভাই বোনের হাতে দুই টুকরো আলমন্ড ফিঙ্গার দিলো। তারপর মিনি সূর্য আর চন্দ্রকে আলতো করে তুলে ময়দার ড্রামের উপর বসিয়ে দিলো যাতে ওরা ভালো করে দেখতে পায় মিনি আর নতুন লোকটি রাতের পার্টির জন্য কী কী খাবার রান্না করেছে।

 

মিনি একটি একটি করে খাবারের ডিস্ আনছে রান্নাঘরের শেল্ফের ভেতর থেকে আর লোকটি সেগুলোকে টেবিলে সাজাচ্ছে খুব যত্ন করে। বড় থালায় করে আস্ত কিছু মাছ এলো, মাছেদের গায়ে তখনো মাথা, চোখ আর লেজ লাগানো আছে। তারপর লোকটি দ্রুত হাতে জেলির বাটিতে এঁকেবেঁকে কিছু দাগ কেটে তার উপরে ক্রিম ঢেলে দিলো। মাংসের বড় ডিসের পাশে খুব চিকন একটি কাঁটা চামচ রাখলো। একের পর এক আরো অনেক খাবার আনতে লাগলো মিনি।

 

"ওহ, তোমরা তো আইস পুডিংটি দেখোনি।" মিনি বলে উঠে, "এসো।" মিনি নিজের দুই হাতে দুই ভাই বোনকে ধরে ফ্রিজের কাছে নিয়ে যায়। সূর্য ভাবছে, মহিলা আজ এতো দরদ দেখাচ্ছে কেন ওদেরকে!

ও! ও! ওহ! চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো বাচ্চা দুটির। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে আইসক্রিম দিয়ে বানানো ঘরটির দিকে। একটা ছোট্ট ঘর। একটা ছোট্ট গোলাপি ঘর, তার উপরে সাদা তুষারের ছাদ। সবুজ জানালা। বাদামি দরজা আর দরজার গায়ে হাতল হিসেবে লাগানো হয়েছে একটি বাদাম!

 

বাদামটি দেখে সূর্য কেন যেন খুব ক্লান্ত বোধ করতে লাগলো। সে মিনির গায়ে হেলান দিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ চুপচাপ।

 

"আমি একটু ছুঁই? আমি এই একটি আঙ্গুল দিবো শুধু একবার ওই ছাদটিতে", বলে নাচতে থাকে চন্দ্র। সব খাবারেই আঙ্গুল দিতে চায় ও। সূর্য চায় না।

 

মিনি এবার ব্যস্তস্বরে কাজের বুয়াদের লক্ষ্য করে বলে, "খুব ভালো করে টেবিলের সবকিছু চেক করো। কোনকিছু এলোমেলো থাকলে এক্ষুনি ঠিক করে ফেলতে হবে।"

 

কাজের বুয়ারা সবাই টেবিলের কাছে ছুঁটে যায়। ঝুঁকে পড়ে বারবার চেক করেছে খুব সতর্ক চোখে। সূর্য আর চন্দ্র একটু ভড়কে গেলো। টেবিলের কাছাকাছি যাওয়ার অনুমতি নেই ওদের। তাই ওরা দরোজায় কাছে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে টেবিলের খাবারগুলোর দিকে।

 

বাইরে এখনো পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। তবুও বাড়ির সব জানালার ব্লাইন্ড ফেলে দেয়া হয়েছে। বাতি জ্বলছে ঘরে। লাল রঙের বাতিগুলো একেকটা লাল গোলাপের আকৃতির। টেবিলের কোনায় লাল ফিতা আর গোলাপের তোড়া বাঁধা। টেবিলের মাঝখানে নানা রঙের গোলাপ পাপড়ি দিয়ে একটি ছোট্ট হ্রদের মতন বানানো হয়েছে। সেদিকে আঙ্গুল দিয়ে বাবুর্চি মিনি বুয়াদেরকে বললো, "ঐখানে আইস পুডিংটা বসানো হবে।"

 

টেবিলের দুই কোনায় দুইটি রুপার সিংহ বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পিঠে অনেক রকমের আকর্ষণীয় ফল।

 

সূর্য আর চন্দ্র অবাক হয়ে দেখতে থাকে চোখ ধাঁধানো পানির গ্লাসগুলো আর চকচকে খাবার প্লেটগুলো আর ঝলকানি দেয়া ছুরি-কাঁটাচামচগুলো - আর লোভনীয় সব খাবারগুলোকে। আর … ঐযে লাল রঙের ন্যাপকিনগুলোকে কেমন করে যেন গোলাপ বানিয়ে রাখা হয়েছে………

 

"সবাই কি আজ আমাদের বাড়িতে ডিনার করবে?" সূর্য জানতে চায়।

 

"আমার তো তাই মনে হচ্ছে," মিনি হাসে। বুয়ারা হাসে। চন্দ্র হাসে। চন্দ্র সবসময় ওর আশেপাশে অন্যরা যা করে তাই করে। কিন্তু সূর্যের হাসি আসে না। সূর্য দুইহাত পেছনে রেখে গম্ভীর মুখে টেবিলের চারপাশে কয়েকবার ঘুরলো। হয়তো তার এই ঘুরতে থাকা কখনোই থামতো না যদি নার্স এসে হঠাৎ চিৎকার করে বলে না উঠতো, "ঠিক আছে তাহলে, বাচ্চারা, তোমাদেরকে এখন হাত মুখ ধুয়ে কাপড় পরে তৈরি হয়ে নিতে হবে।"

 

বাচ্চা দুটি ধীর পায়ে তাদের ঘরের দিকে চলে গেলো।

 

বাচ্চারা যখন কাপড় বদলাচ্ছিলো ওদের মা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় একবার ওদের দিকে। তিনি তখন নিজের মুখে কিছু একটা ঘষছিলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে বললেন, "আমি যখন বেল বাজাবো তখন তুমি ওদেরকে নিচে পাঠাবে নার্স, ওরা শুধু কিছুক্ষণের জন্য নিচে গিয়ে অতিথিদের সাথে দেখা করে আবার চলে আসবে।

 

"সূর্য ওর গায়ের সব কাপড় খুলে ফেলেছে। প্রায় উলঙ্গ। তারপর আবার কাপড় পড়লো। একটি সাদা শার্ট যার উপরে লাল আর সাদা ফুলের প্রিন্ট করা।

 

"তুমি আজ রাশিয়ান পোশাক পরেছ," সূর্যের চুলে টোকা দিয়ে বলে নার্স।

 

"তাই নাকি?" সূর্য উত্তর করে।

 

"হুম, এখন এই চেয়ারে চুপচাপ বসে তোমার ছোটবোনকে দেখো।"

 

চন্দ্রের তৈরি হতে অনেক সময় লাগলো। নার্স যখন ওর পায়ে মোজা পরাচ্ছিলো, চন্দ্র তখন খিলখিল হেসে গড়িয়ে পড়ছিলো। বারবার খাটে হেলান দিয়ে পরে যাচ্ছিলো, সব সময় যেমন করে আর কি। চুল বাঁধার সময় সে নার্সকে নানারকম প্রশ্ন করতে থাকলো তাই বারবার ওর চুল খুলে যাচ্ছিলো। অবশেষে চন্দ্রও তৈরি হলো। চন্দ্রর সাদা ড্রেসটির নিচে লম্বা সাদা পশমের ঝালর দেয়া। পায়ের জুতো জোড়াও ধবধবে সাদা, তাতে বড় সাদা পমপম বল লাগানো।

 

"এই তো আমার শুভ্র সাদা ভেড়ার বাচ্চাটা।" বলেই এক দৌড় দিলো নার্স দরজার দিকে। "ম্যাম, এক মিনিট।"

 

তাদের মা আবার আসলো ওদের ঘরে। মায়ের চুলে অর্ধেক খোঁপা তখনো লম্বা হয়ে ঝুলছে।

 

" ও মা! কী মিষ্টি!" মা চিৎকার করে উঠে।

 

"সত্যি," নার্স গলা মেলায় মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে।

 

চন্দ্র তার জামার এক প্রান্ত উঁচু করে দুই হাঁটু হালকা বাঁকা করে অভ্যর্থনা জানায় মাকে।

সূর্য অবশ্য কিছু মনে করে না কেউ ওকে লক্ষ্য না করলেও - ততটা মন খারাপ করে না সে এতে।

 

মা চলে যাবার পর ওরা খুব লক্ষী বাচ্চার মতো কিছুক্ষণ টেবিলে খেললো। আর নার্সটি ঘরের দরোজায় দাঁড়িয়ে নিচে কী হচ্ছে সেসব বোঝার চেষ্টা করছে। এক এক করে গাড়ি আসার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অতিথিরা সবাই পৌঁছে গিয়েছে। নিচতলায় তাদের কথা, হাসি, কৌতুকের শব্দ শোনা যেতে থাকে।

 

অনেকক্ষণ পর অবশেষে বেল বাজলো। নার্স দ্রুত চিরুনি দিয়ে চন্দ্রের চুল ঠিক করে দিলো। সূর্যের শার্টের কলার সোজা করে দিলো। ভাই-বোন দুজনের হাত ধরিয়ে দিলো একসাথে।

"এবার তোমরা নিচে যাও।"

 

ওরা একটি দুটি করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে আরম্ভ করলো। সূর্য একটু বিরক্ত হচ্ছিলো অমন করে বোনের হাত ধরে হাঁটতে। কিন্তু হাত ধরার বিষয়টি মনে হলো চন্দ্রের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। সে ভাইয়ের হাত ধরে দোলাতে থাকে আর তার গলার মালাটি ঝুমঝুম করে বাজতে লাগলো।

 

ওদের মা বসার ঘরের দরোজায় বসে আছে। একটি কালো পাখা দিয়ে নিজেকে বাতাস করছে। ড্রয়িংরুম ভেসে যাচ্ছে খুব মিষ্টি চকোলেটের গন্ধে। মহিলারা ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। ছেলেরা সবাই কালো পোশাক পড়েছে সাথে হাস্যকর ঝুলানো লেজওয়ালা কোট তাদের গায়ে। লোকগুলোকে দেখতে গুবরে পোকার মতো লাগছে। সূর্যের বাবাও আছেন এদের ভেতর। অনেক শব্দ করে হাসছে, কথা বলছে আর প্যান্টের পকেটের ভেতর কিছু একটা নাড়ছে শব্দ করে।

 

"ওহ কী চমৎকার দেখতে বাচ্চা দুটি!" মহিলারা চিৎকার করে উঠে। "ঠিক, একটা হাঁসের ছানা। আর একটা ভেড়ার বাচ্চা! মাগো, কী দারুণ! বাড়িতে রেখে আসা আমার বিড়ালের কথা মনে পড়ছে ওদেরকে দেখে।"

 

অতিথিদের ভেতর যারা চন্দ্রকে ছুঁতে পারলো না তারা সবাই সূর্যকে চুমু খেলো। শুকনো খটখটে শরীরের একটা মহিলা দাঁত কেলিয়ে বললো, "এই ছেলেটি কী সাংঘাতিক সিরিয়াস পাপেটরে বাবা!"

 

সূর্য মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো দুপুরের সেই পিয়ানো বাদকটি আছে কিনা। না, লোকটি নেই। এখন মোটা আরেকটি লোক পিয়ানোর সামনে বসে পাশে একটি মেয়ের সাথে কথা বলছে। মেয়েটির কানের কাছে একটি বেহালা ধরা।

 

পুরো পার্টিতে মাত্র একটি লোককে ভালো লাগলো সূর্যের। গায়ের রং ফ্যাকাসে লোকটি সূর্যের খুব কাছে এসে সুন্দর একটি চাহনি দিয়ে মৃদু স্বরে বললো, "কী খবর বেটা!" তারপর কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে বললো, "তুমি কুকুর পছন্দ করো!" সূর্য বললো, "হ্যাঁ।" তারপর লোকটি আবার হাওয়া হয়ে গেলো। সূর্য লোকটিকে সবখানে খুঁজলো। কিন্তু কোথাও পেলো না। ওর মনে হলো লোকটি হয়তো কুকুর আনতে বাড়ির বাইরে গিয়েছে।

 

"গুডনাইট, আমার পাখি বাচ্চারা," ওদের দুইজনের হাত ধরে মা বললেন, "এবার তোমরা তোমাদের ছোট্ট খাঁচায় চলে যাও আবার।"

 

সেই মুহূর্তে চন্দ্র আবার বোকামি করে বসলো। সে তার দুই হাত উঁচু করে জেদ করে বসলো, "ড্যাডি আমাকে কোলে করে নিয়ে যাবে।"

 

কিন্তু অতিথিরা সবাই মনে হলো মজা পেয়েছে ওর কথাতে। শব্দ করে হেসে উঠলো অনেকে। বাবা এসে পাঁজাকোলা করে চন্দ্রকে ওর ঘরে নিয়ে গেলো অন্যসব দিনের মতো।

 

নিজের রুমে ফিরতেই নার্সটি আজ খুব তাড়াহুড়ো করছিলো ওদেরকে বিছানায় পাঠানোর জন্য। সূর্য রাতে ঘুমানোর আগে মোনাজাত করে প্রতিদিন অনেকটা সময় নিয়ে। আজ নার্স সূর্যকে তাড়া দিয়ে বললো, "খাটে যাও। খাটে বসে মোনাজাত করো।"  

 

ওরা দুইজন খাটে শোয়া মাত্র নার্স লাইট বন্ধ করে দিলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেলো ঘরটি

হঠাৎ করে। কেবল ডিম্ লাইটের হালকা আলো ধীরে ধীরে সয়ে আসে ওদের ছোট্ট চারটি চোখে।

 

"তুমি কি ঘুম?", চন্দ্র প্রশ্ন করে।

"না," সূর্য বলে, "তুমি?"

"না," চন্দ্র জানায়।

 

অনেক্ষন পর আবার ঘুম ভাঙলো সূর্যের। নিচতলা থেকে তখন তুমুল হাততালির শব্দ আসছিলো উপরে। জোর বৃষ্টির শব্দের মতো। সূর্য টের পেলো চন্দ্র ওর খাটে নড়ছে।

 

"চন্দ্র, তুমি কি জেগে আছো?"

"হুম। তুমি?"

"আমিও। চলো আমরা সিঁড়ির ফাক দিয়ে দেখি নিচে কি হচ্ছে।"

 

সিঁড়ির প্রথম ধাপে বসে ওরা নিচের ড্রয়িংরুমের দরোজার দিকে তাকিয়ে থাকে। দরজাটি খুলে গেলো। ভেতর থেকে তীব্র হাসির শব্দ আর তীক্ষ্ণ সংগীতের আওয়াজ ভেসে আসছে। অতিথিরা সবাই টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে ঘুরছে। ঠিক যেভাবে সূর্য ঘুরছিলো আজ বিকেলে। আইস পুডিংটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছে ফ্যাকাশে চামড়ার লোকটি। দরোজায় বাদামের হাতলটি দেখিয়ে লোকটা যেন ঠিক সূর্যের গলায় বলে উঠলো, "বাদামটা দেখেছো?"

 

"তুমি এতো মাথা নেড়ো না, চন্দ্র। "

"আমি মাথা নাড়ছি না। তুমি নাড়ছো। "

"না আমি না। আমি কখনো মাথা নাড়ি না। "

"ও-ওহ তুমি নাড়ো। তুমি এখনো মাথা নাড়ছো।"

"আমি নাড়ছি না। আমি শুধু তোমাকে দেখাচ্ছি কিভাবে মাথা না নাড়তে হয়। "

 

তারপর যখন আবার ওদের ঘুম ভাঙলো, ওরা শুনতে পেলো ওদের ঘরের দরজা খুলে বাবা খুব চিৎকার করে কথা বলছে। নিচতলার ঘর থেকে আসছে মায়ের খিলখিল হাসির শব্দ। বাবা একেবারে ওদের গায়ের উপরে পড়ে গেলো প্রায়। নিচে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বললো, "উপরে এসো, দেখে যাও।"

 

মা উপরে আসে। দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে বলে, "ওরে দুষ্ট বাচ্চারা! এখনো জেগে আছো তোমরা!"

 

"ওদেরকে নিচে নিয়ে যাই। দুটিকে দুটো হাড্ডি খেতে দিই, কি বলো?" বাবাকে কোনদিন এতো আনন্দিত হতে দেখেনি আগে সূর্য।

 

"না, দরকার নেই এখন আর ওদের নিচে যাবার। ঘুমিয়ে পড়ুক," মা বলে।

 

"এখন ওরা নিচে গিয়ে কিছু না খেলে আমার ফাঁসি হবে এখনই," বাবা বললো, "আর এখন ওদেরকে নিচে নিলে কেউ আমাকে শাসন করবে জানি, তবুও ওরা যাবে!", বলে দুই সন্তানের দুইটি হাত টেনে তোলে ওদের বাবা।      

 

সূর্য ভেবেছিলো বাবার উপর মা সাংঘাতিক ক্ষেপে যাবে। কিন্তু না। মা ওদের বাবার দিকে তাকিয়ে হাসছে শুধু।

 

"বাচ্চারা এসো, কিছু খেয়ে নাও," ওদের খুব খুশি বাবা ডাকলো।

 

চন্দ্র একটু থমকে গেলো। বললো, "মা, তোমার ড্রেস একপাশে পুরোটা ছিঁড়ে গিয়েছে।"

 

"তাই নাকি?", মা বলে। আর বাবা বললো, "হুম," বলে মায়ের খোলা কাঁধে কামড় দেয়ার ভঙ্গি করে। মা বাবাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়।

 

কিন্তু - আঃ! আহা! এগুলো সব কিভাবে এসব এমন হলো! লাল ফিতা আর লাল গোলাপগুলো সব খুলে পড়ে আছে মেঝেতে। চোখ ধাঁধানো পানির গ্লাস আর চকচকে খাবার প্লেটগুলো সব কী নোংরা হয়ে আছে! চমৎকার লোভনীয় যে খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়েছিল লোকটা সন্ধ্যাবেলায়, সেইসব খাবারগুলো এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। মাংসের হাড়, ফলের খোসা, প্লেটের আধা খাওয়া খাবার পড়ে আছে সবখানে। টেবিলের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটি বোতল যার মুখ খোলা আর সেখান থেকে গড়িয়ে পড়েছে ভেতরের পানীয়। ভিজে যাচ্ছে টেবিলের কাপড়। কেউ বোতলটি সোজা করে রাখেনি।

 

আর সেই আইসক্রিমের ছোট্ট গোলাপি ঘরটি, যার ছাদ ছিল সাদা তুষারের তৈরি, তার সবুজ জানালাগুলো এখন ভাঙা - ঘরটি ভাঙা - বরফ গলে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পুরো ঘরটি টেবিলের মাঝখানে।

 

"সূর্য, এদিকে এসো," ছেলের চোখের বিস্ময় আর কষ্টকে উপেক্ষা করে বাবা স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে কথা বলতে চেষ্টা করে।

 

চন্দ্র পায়জামার পা দুটি উঁচু করে ধরে একটি চেয়ারের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে রিনরিনে সুরে অনেক কথা বলতে থাকে।

 

বাবা টেবিলের উপর পড়ে থাকা আইসক্রিমের বাড়িটির একটা অংশ চামচে তুলে বললো, "এটা একটুখানি খেয়ে দেখো….."

 

ওদের মা জলদি করে একটি ছোট প্লেট নিয়ে আসে সূর্যের জন্য। মায়ের এক হাত সূর্যের গলা পেঁচিয়ে রেখেছে।

 

"ড্যাডি, ড্যাডি," খুব আশ্চর্য হয়েছে চন্দ্র। "দেখো। আইসক্রিম ঘরের ছোট্ট দরজাটি এখনো আছে! কেউ খেয়ে ফেলেনি! আর বাদামটিও আছে এখনো! আমি খাই বাদামটা?" হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের উপর এগিয়ে যায় চন্দ্র। ছোট্ট আঙুলে তুলে আনে আইস ঘরের দরজা থেকে বাদামটি। তারপর সেটাকে নিজের মুখে পুরে শব্দ করে কামড়াতে থাকে। বুঁজে থাকা চোখের পাতায় খুশির উচ্ছাস উথলে উঠে।        

 

"এই যে নাও সূর্য," প্লেটে আইসক্রিম একটুকরো তুলে নিয়ে বাবা ডাকে সূর্যকে।

 

কিন্তু সূর্য দরজা থেকে নড়ে না। আচমকা মাথা উঁচু করে হাহাকারের মতো চিৎকার করে উঠলো। বিলাপের মতো বলতে থেকে, "আমার কাছে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটি খুব নোংরা - বিকট - ভীষণ জঘন্য!" ফোঁপাতে থাকে সূর্য।

 

"এইতো, দেখলে!" মা বলে, "দেখো এবার!"

 

"ব্যাস, অনেক হয়েছে," বাবা বলে, হাসিখুশি মুখটি আর নেই এখন। "এক্ষুনি। এই মুহূর্তে তুমি চলে যাও নার্সারিতে।"

 

বুকভাঙা কান্না নিয়ে সূর্য আবার চলে যায় ওর নার্সারির ঘরে।