সংগৃহিত
কোটা ও সাংবাদিকতা
নাদিম মাহমুদপ্রকাশিত : এপ্রিল ১১, ২০১৮
২০১৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্স বিরোধী আন্দোলনের দিন আমি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের রাজশাহীর আলোকচিত্রী Gulbar Ali Juwel জুয়েল ভাইকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারের পাঠিয়েছিলাম। তিনি যখন ছবি তুলছিলেন, তখন কিছু অতি উৎসাহী আন্দোলনকারী তার পা ভেঙে দিয়েছিল। এরপর রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসা চলাকালীন জুয়েল ভাইকে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা বিভিন্নভাবে হেনেস্তা করেছিল। আমরা কিন্তু সেই সময় সংবাদ প্রচার থেকে পিছিয়ে আসিনি। আমরা তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম।
সাংবাদিকদের সাথে চিকিৎসকদের একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। ফলে বছরের বিভিন্ন সময় তাদের কাছে সাংবাদিকরা হেনস্তা হয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, এ দেশের মানুষ মনে করে, সাংবাদিক মানে হলো নিম্ন প্রজাতির কোনও প্রাণী আর নিম্নশ্রেণির পেশা। তারা মনে করে, সাংবাদিকদের মারলে কিছু হয় না। তাই বছরজুড়ে সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় সাংবাদিকরা মার খেয়েও নিজেদের পেশাদারিত্ব বজায় রেখেছে। কখনো কখনো ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ে আমরা নিজেদের মূল্যবান অনেককিছু হারিয়ে ফেলি। আমরা মনে করি, এই পেশা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। সব ঝুঁকি মাথায় নিয়ে শত শত সাংবাদিক আপনাদের কাছে তথ্য সেবা দিয়ে আসছে। খেয়ে না খেয়ে সারাদিন ঘর্মাক্ত শরীরে আপনাদের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করছে। কিন্তু আপনারা কি করছেন? সাংবাদিকদের গালি দিচ্ছেন। তাদের নিয়ে ট্রল করছেন, তাদের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধারে নেমে গেছেন। কিন্তু কেন?
কোটা বিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিকরা কি আপনাদের সংবাদ প্রকাশ করছিল না? নাকি সংবাদের জন্য আপনাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছিল না? একজন স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থী হিসেবে আপনি যে ব্যবহার করছেন, তা আপনাদের সাথে যায় না। আগে মানবিক, তারপর প্রতিবাদী হোন। কোটা বিরোধী আন্দোলনে দেশের সিংহভাগ সাংবাদিক আপনাদের সাথে লড়ছে, ফেসবুকে যৌক্তিক আলোচনা করছে, পত্রিকায় লিখছে। এরপরও কেন আপনারা খুশি নন? প্রতিটি পত্রিকা কিছু নির্দিষ্ট সম্পাদকীয় নীতিমালায় চলে। তাদের নিজস্ব কিছু চিন্তা-ভাবনাও থাকে। আর তার প্রতিফলন তাদের প্রচারিত সংবাদে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে আপনারা সব সাংবাদিকদের চোখরাঙানি দেবেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়। মনে রাখবেন, সাংবাদিকরাও মানুষ। তাদেরও রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকে। আর সেই অনুযায়ী আপনাদের কোটা বিরোধী আন্দোলনে কেউ সমর্থন করতেও পারে আবার নাও করতে পারে। এটা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এটাই গণতান্ত্রিক সৃষ্টিশীলতা। সব ছাপিয়ে আপনাদের দাবির প্রচারণা কেউ বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে না।
২০১৩ সালে Nadia আপু কিন্তু হেফাজতের উগ্রতার শিকার হয়েছিল। ওই সময় সাংবাদিকরা কিন্তু খবর প্রচার বন্ধ করেনি। কারণ, সাংবাদিকতায় আবেগের চেয়ে পেশাদারিত্বের মূল্য বেশি। তাই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর আগে নিজেদের একটু সামলে নেবেন। আমাদের সহকর্মীরা যে অবস্থায় সংবাদ প্রচার থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সংবাদ প্রচার থেকে বিরত থাকা মানে প্রতিবাদ নয়, বরং সেটাতে পেশাদারিত্ব ক্ষুণ্ন হয়। প্রতিবাদের ভাষা বিভিন্ন ধরনের থাকতে পারে, তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যখন পাঠক-দর্শকদের আগ্রহ থাকে তখন তা থেকে তাদের বঞ্চিত করা সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। আপনাদের এই সিদ্ধান্তের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে গুজব ছড়ানোর মতো ঘটনা ঘটছে। মিথ্যা সংবাদ ও তথ্যে আন্দোলনকারীরাও বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। মনে রাখবেন, হাজার হাজার শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তখন আমাদের উচিত তাদের ভাষাগুলো সঠিকভাবে রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরা। গুজবগুলো রুখতে আপনাদের সংবাদ প্রচারের যথার্থ গুরুত্ব সবার রয়েছে।
নিজেদের সামন্য ভুল সিদ্ধান্তের কারণে, এই পেশাটিকে তরুণদের কাছে খারাপভাবে উপস্থাপন করার প্রয়োজন নেই। তরুণরা জানুক, সাংবাদিকতা একটা সাহসিকতার পেশা। নির্যাতিতদের পাশে থাকার পেশা। নিজেরা হাজারও লাঞ্ছিতে হলেও এই সংবাদ সংগ্রহে পেশাদারিত্বের পরিচয় দেয়া সাংবাদিকতার শিক্ষা। আশা করি, আন্দোলনকারীরা নিজেদের ভুলগুলো বুঝতে পারবে। সেই সাথে সাংবাদিকদের সাথে সহযোগিতামূলক আচরণ করবে।