
কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুলাই ১৬, ২০২৪
বাংলাদেশে যে কোটা সংস্কার বা বর্জনের আন্দোলন চলছে বা যারা এই আন্দোলন করছে, তাদের আন্দোলনের সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করতে পারি কিংবা আমি পুরো একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না কেন? একটি দেশের মানুষের তার দাবির পক্ষে কথা বলা বা আন্দোলন করার অধিকার না থাকার নাম কি গণতন্ত্র? স্বাধীন দেশ মানে কি এই, কতিপয় মানুষের বিশ্বাসের বিপরীতে কথা বলা যাবে না? তাহলে সেই বিশ্বাসগুলো কি একটি ধর্ম, যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না?
দার্শনিক ভলতেয়ারের চিন্তা ফরাসি বিপ্লবকে ভীষণভাবে বেশি প্রভাবিত করেছিল। তিনি চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে বলেছিলেন, আমি তোমার মতের সঙ্গে যদি একমত নাও হই, তবুও তুমি যাতে তোমার মত প্রকাশ করতে পারো সেই লড়াইয়ে আমি জান দিতে প্রস্তুত। ভলতেয়ারের কাছে মানুষের মত প্রকাশের গুরুত্ব এতাটাই ছিল। কিন্তু আমাদের দেশের বহু নাট্যকর্মী ও কয়েকজন নাট্যকারও মনে করেন, তা হতে পারে না। তিনি তাহলে তার নাটকে কী প্রকাশ করতে চান? তিনি তাহলে নাটকের ওপর ব্রিটিশদের দিয়ে যাওয়া সেন্সরশিপ প্রয়োগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন সরকারকে?
যখন কাউকে বলা হয় গোঁড়া, তার মানে কি? যে নিজের বিশ্বাসের বাইরে অন্যের বিশ্বাসকে দাঁড়াতে দেয় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখন কিছু মানুষের তেমন একটি গোঁড়া বিশ্বাস বা ধর্মে পরিণত হয়েছে। সেই বিশ্বাস আবার সুবিধা মতন ব্যাখ্যা দেয়া হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সকল রকম শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তিলাভ, সেই সঙ্গে গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে কি, সকল ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার। কিন্তু সরকার বিশেষ কোনো ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে না।
এই যে সরকারের পক্ষ থেকে সারাদেশে পাঁচশোর বেশি মসজিদ প্রতিষ্ঠা, সেটা কি ধর্মনিরপেক্ষতা হলো? যদি কেউ এ নিয়ে কথা বলতে চায়, এর বিরুদ্ধে নিজের মত জানাতে চায়, তাহলে কি তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না? মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাদ দিয়ে কি আমাদের দেশের স্বাধীনতা? রাষ্ট্রের মধ্যে কয়েকজন লোক কি ঠিক করে দেবে কোন মতটা প্রকাশ করা যাবে, কোনটা করা যাবে না? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কট্টোরপন্থী চেতনাধারীদের কাছে আমার জানার আগ্রহ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কি কোনো ধর্মীয় প্রসঙ্গ? বাংলাদেশের স্বাধীনতা কি আর সকল দেশের স্বাধীনতা থেকে আলাদা?
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা কি আমাদের দেশের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ? বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক বেশি মিল আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার। বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র তখন যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেনের মধ্যেই ছিল, কিন্তু ব্রিটেন কর বাড়িয়ে দিলে যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহ করে তারা স্বাধীন হয়ে যায়। কিন্তু সে দেশ কি তাদের পতাকা, স্বাধীনতাকে ধর্ম বানিয়ে ফেলেছে? কখনো কি বলেছে তার দেশের স্বাধীনতা এবং সরকার সম্পর্কে সমালোচনা করা যাবে না? জর্জ ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে কিচ্ছু বলা যাবে না?
যুক্তরাষ্ট্রের বহু মানুষ জানে না তাদের স্বাধীনতা দিবস কবে? সেটা জানাটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ স্বাধীনতা তাদের কাছে ধর্ম বা কুসংস্কার নয়, একটা অধিকারবোধ। সেই অধিকার সেই দেশের নাগরিকরা বহু গুণ বেশি ভোগ করে প্রাচ্য বা বাংলাদেশের তুলনায়। সেই দেশের নাগরিকরা তাই তাদের পতাকা নিয়ে আদিখ্যেতা করে না। পতাকার নকশা দিয়ে গায়ের জামা, পায়ের মোজা বানায়। তাতে তাদের স্বাধীনতা নষ্ট হয় না। কারণ প্রকৃত অর্থে তারা বাস্তবে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। স্বাধীনতা তাদের কাছে ধর্ম নয়, নাগরিক অধিকার। কিছু কথা মালা নয়, সবাই খেয়ে পরে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ সুবিধা। স্বাধীনতা শব্দটা সেখানে বিচার হয় জনগণের অধিকার রাষ্ট্র ও সরকার কতেটা রক্ষা করছে, সেই নিক্তিতে।
ফরাসি বিপ্লবের মূল কথা ছিল সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার একটি বড় প্রসঙ্গ ছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মনে রাখতে হবে, ইউরোপীয় রেনেসাঁর ভিতর দিয়ে নতুন চিন্তা ছড়িয়ে পড়লেও বারবার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছিল। ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা, গ্যালিলিওকে বিজ্ঞানের সত্য বলতে না দেয়া সেই সময়কালের ঘটনা। বহু জনকে চার্চ বা সমাজের কর্তারা তখন পুড়িয়ে হত্যা করে সত্য বলার জন্য। বড় বড় মনীষীরা তখন বুঝেছিলেন, সত্যকথা বলতে না পারলে, সকলের মত প্রকাশের অধিকার না থাকলে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা হবে না এবং মানুষের প্রকৃত মুক্তি ঘটবে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাই ছিল ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম মূলমন্ত্র।
কথাটা খুব স্পষ্ট, মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে কেবল আমার নিজের মত প্রকাশ নয়, সকলের কিংবা আমার বিরোধী পক্ষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। থাকতেই হবে। ইউরোপের গণতন্ত্র ও সাংসদীয় রাজনীতি এই মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে বলেই পশ্চিম জ্ঞানবিজ্ঞানে এতেটা এগিয়ে আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই বলেই সামগ্রিকভাবে প্রাচ্য বা বিশেষ করে আমরা এতেটা কট্টর আর ধর্মের নিগড়ে বাঁধা।
ইউরোপে বহুদিন বহু বছর ধরে এইরকম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে বলেই এবং সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চার ফলে সে দেশের সরকার সে দেশের জনগণের সঙ্গে যা খুশি করতে পারে না। সেখানকার মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীদের জীবনযাত্রা প্রাচ্যের বহু মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীদের মতন বিলাসবহুল নয়, সামন্ততান্ত্রিক নয়। পিতা প্রধানমন্ত্রী হলেই তার পুত্র কন্যারা বা সাঙ্গপাঙ্গরা যা খুশি তা করতে পারে না। রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে অফিসের পিয়ন দারোয়ানরা চারশো পাঁচশো বা পাঁচ হাজার কোটি টাকার মালিক হতে পারে না কিংবা সে টাকা বাইরে পাচার করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা কখনো বলে না `আমি` এটা করেছি, ওটা করেছি; বলে আমার রাজনৈতিক দল বা আমার দেশ।
পশ্চিমের অনেক দোষ আছে কিন্তু এসব ব্যাপারে পশ্চিমের আর পূর্বের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পার্থক্য সুস্পষ্ট। পশ্চিমের দেশ বাইরের দেশের ওপর যতেই মাস্তানি করুক, নিজের দেশের জনগণের সঙ্গে তাদের মাস্তানি চলে না। সেই কারণেই পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ মানুষ যখন গাজার হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সোচ্চার, প্রাচ্যের মুসলমানদের তখন খবর নেই। পশ্চিম যে প্রাচ্যের নানা দেশের ওপর মাস্তানি করে তার প্রধানতম একটি কারণ এসব দেশগুলোতে জনগণের বাক-স্বাধীনতা নাই। কিছু কিছু দেশে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা রাজার সমান। নামে গণতন্ত্র, চলে রাজতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রীরাই এই সকল দেশে সবকিছু করে দেন, কিন্তু জনগণের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা উল্লেখিত হয় না, জনগণের পাত্তা নেই।
প্রাচ্যের বহু প্রধানমন্ত্রী যে ভাষায় কথায় বলেন সেরকম ভঙ্গিতে কথা বলার চিন্তাই করতে পারবে না ইইরোপের একজন প্রধানমন্ত্রী। ফলে সেখানকার আমলাতন্ত্রের চরিত্র ভিন্নরকম। সেখানকার সরকারি কর্মকর্তার কাছে একজন নাগরিক কোনো দরকারে গেলে, কর্মকর্তা বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইবে আমি কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি। সাহায্য করার চেষ্টাই করবেন তারপর। প্রাচ্যের সরকারি কর্মকর্তা কাছে কোনো দরকারে কেউ গেলে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কর্মকর্তাটি উদ্ধত ভঙ্গিতে জানতে চাইবে, কি চান আপনি? যেন আপনি তার দয়া নিতে গিয়েছেন। তারপর ঘুষ দিয়ে আপনার কাজটি হতে পারে আবার নাও হতে পারে। কারণ এখানে আপনার মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। ফলে এই কর্মকর্তা বিশেষ বিশেষ সরকারের আমলে নানাভাবে চার পাঁচ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যাবে যা আপনি জানতে পারেন, কিংবা নাও জানতে পারেন। কিংবা প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলবেন আমার বাসার চাকর চারশো কোটি টাকার মালিক। ব্যস এটুকুই, আর কিছু ঘটবে না। মানুষ যখন স্বাধীনভাবে তার যেকোনো মত প্রকাশ করতে পারবে, তখনই ধীরে ধীরে এসব বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে কোটা আন্দোলনের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। কারণ এই আন্দোলন করাটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার।
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ