ফাইল ছবি
কৃত্রিম মানুষের কৃত্রিম সৌখিনতা
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : নভেম্বর ০৮, ২০১৮
এ কথা এখন নতুন নয় যে, ঢাকাবাসীর জীবনযাপন প্রকৃতিবিরুদ্ধ। যান্ত্রিক। নানা দূষণে দূষিত। কত কত উপায়ে যে এ শহরে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। প্রত্যেকের ধান্দা, কীভাবে আরো একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারব। জীবন এখানে বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতা। কেউ ফুটপাথে শুয়ে রাত কাটিয়ে দিচ্ছে, আবার কেউ সুদৃশ্য বেডরুমে নরম বিছানায়। যে মানুষটা ফুটপাথে ঘুমোচ্ছে তার সারাদিনের চেষ্টা থাকে যে কোনোপ্রকারে খাবারের সংস্থান করা। আর যে মানুষটা দুধেল ফেনায়িত বিছানায় দেহ রেখে ঘুমিয়ে পড়ছে তার চেষ্টা থাকে আরো আরো ভোগের দিকে।
শারীরিক চাহিদা ছাড়াও যে আত্মার কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকে, ঢাকাবাসী তা বিস্মৃত। অবশ্যি বিস্মৃত না হয়েও উপায় নেই। এখানকার জীবনযাপনের ছকই তাকে বিস্মৃত হতে বাধ্য করে। ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা কারা? এ হিসেব করলে পুরো ঢাকাই দেখা যাবে, জনশূন্য। মূলত সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষই একটু ভালোভাবে খেয়েপরে বেঁচে থাকার ধান্দায় (অনেকে একে বলবেন ক্যারিয়ার) এ শহরে এসে শেকড় গাড়ে। না গেড়ে উপায়ও নেই। রাজধানী তো। আর এখানেই সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা। আমাদের পাঠ্যপুস্তক এমনই এক কারিকুলামে তৈরি যে, স্কুল-কলেজে পড়তে পড়তেই গ্রাম কিম্বা মফস্বলের ছেলেমেয়েদের লক্ষ্য থাকে, ঢাকায় গিয়ে চাকরি নেয়া। এ শিক্ষা ব্যবস্থা যান্ত্রিক ও ভোগবাদী জীবনের দিকে শিক্ষার্থীকে চালিত করে। প্রকৃতির নিবিড়তায় ভেতর যে শান্তি, তা যে ভাবালুতা, এ শিক্ষা ব্যবস্থা কৌশলে তাকে এটাও বুঝিয়ে দ্যায়।
বলা হয়, আমাদের প্রধান পেশা কৃষি। কিন্তু গ্রামগুলোতে জরিপ করলে দেখা যাবে যে, তিরিশটি বাড়ি পরে গিয়ে একটি বাড়ি মিলবে যে বাড়ির লোকজন কৃষির ওপর নির্ভরশীল। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ এখন বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে (গ্রামাঞ্চলে কম্পানির চাকরি কথাটা খুব চালু) চাকরি করছে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছে। তবু গ্রামে ফিরে গিয়ে লাঙল ধরছে না। কেন ধরছে না? ধরবে কেন? সে যে শিক্ষিত এই অহংকারটুকু সে ভুলতে পারে না। আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা তাকে তা ভুলতে দ্যায়ও না। এইসব শেকড়ছেঁড়া প্রজন্মই আজকের ঢাকা শহরের নাগরিক। কেউ বিশিষ্ট। কেউ অবিশিষ্ট। আব্দুল করিম সারা জীবন ক্ষেতে সোনার ফসল ফলিয়েছেন, তার ছেলে আব্দুল মতিন এখন বহুজাতিক কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক। কিন্তু শেকড়ের প্রতি, প্রকৃতির নিবিড়তার প্রতি কখনো কখনো এই মতিন সাহেবরাও এক ধরনের টান অনুভব করেন।
পয়লা বৈশাখের রমনার অনুষ্ঠানের কথা ধরা যাক। বিশেষ এ দিনে ঢাকার রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। বিশেষ করে শাহবাগ অঞ্চল পুরোপুরি ব্লক হয়ে যায়। এ দিনকে উপলক্ষ্য করে বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের বাহারি বিজ্ঞাপন আগে থেকেই প্রচার করতে থাকে। আর বিশেষ দিনটাতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে নামিয়ে দ্যায় পণ্যভর্তি ছোট যানবাহন। দেদারসে বিক্রি হতে থাকে কোমল পানীয়। মাথার ওপর প্রখর সূর্য, তবু সাধারণ মানুষের উৎসাহের কোনো খামতি নেই। তারা সার বেঁধে চলেছে রমনায়। আহা, প্রাণের উৎসব যে! এই যে প্রাণের উৎসব কথাটা, এটাও একটা চালাকি। বহুজাতিক কোম্পানির সুচতুর ক্রিয়েটিভ সেলের আবিষ্কার। এই ফাঁদে পড়ে সাধারণ মানুষ পকেটের স্বাস্থ্য হানি করছে। আর লাভবান হচ্ছে পুঁজির লগ্নিকারক। পাঠক, চলুন একটা ছড়া পড়ে নেয়া যাক:
সংস্কৃতির ধরণ
এই শহরে সংস্কৃতির বিচিত্র এক ধরণ
পান্তা-ইলিশ ঢেঁকুর তুলে বর্ষ করে বরণ।
বছরজুড়ে সবক’টা দিন জিন্স-ফতুয়ার চল
ওই দিনই সব পাঞ্জাবি আর হলুদ শাড়ির দল।
রমনা বটমূলের মেলায় উচ্ছ্বসিত প্রাণ
রঙ ধাঁধানো জেনারেশন গাইছে রিমিক্স গান।
শেকড় ছেঁড়া প্রজন্ম এই ঢাকায় করে বাস
এদের সংস্কৃতি দেখেই কাটছে বারো মাস।
মফস্বলে আটপৌরে জীবন যাদের কাটে
আগ্রহ নেই যে মেলাটা হচ্ছে গ্রামের মাঠে।
ডাকছে তারা, রমনা বটমূলের মেলায় যাবি?
এই আমাদের গ্রামের মেলা বিচ্ছিরি হাবিজাবি।
গ্রামের নাকি ইটদালানের বর্ষবরণ খাঁটি
এই কথাটা বুঝতে চলো, গ্রামের পথে হাঁটি।
কিন্তু গ্রামের পথে হাঁটি বললেই তো আর হাঁটা সম্ভব নয়। গ্রামে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। এছাড়া আমাদের ভেতর তো শিক্ষিত হওয়ার অহংটাও স্থায়ী হয়ে গেছে। ফলে দুধের স্বাদ আমরা ঘোলে মিটিয়েই ভাবি, যাক, খাওয়া তো হলো! গ্রামের জীর্ণ কুটিরের উঠোনে যে ঘাসবন ছড়িয়ে থাকে, এ শহরে তার প্লাস্টিক ভার্সন কিনতে পাওয়া যায়। এলিটদের বসার ঘরের মেঝেয় তা চোখেও পড়ে। অনাদরে যে লতাফুল গ্রামের পথেঘাটে ফোটে তার প্লাস্টিক ভার্সন এ শহরে এলিটদের বসার ঘর সাজানোর উপকরণ। গ্রামে যা প্রাকৃতিক এখানে তা কৃত্রিম। কৃত্রিম মানুষের কৃত্রিম সৌখিনতা।
শীত এলেই দেশের প্রতিটি স্থানে নানা উৎসবের আমেজ লাগে। গ্রামে প্রায় রাতেই বসে গাজির গানের আসর। বাউল গানের আসর। আর আছে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন। সারা বছর এসব হুজুরেরা যেন ঘুমিয়ে থাকেন। ইসলাম প্রচারের দরকার তাদের পড়ে না। যেই না শীত এলো, অমনি কোত্থেকে যেন এরা আবির্ভূত হন। এরপর গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে তারা ছড়িয়ে পড়েন ওয়াজ মাহফিলের আসর বসাতে। শীতঋতু যেন উৎসবের মাস। এসময়ে গ্রামে গ্রামে যখন চলে নানা আয়োজন, তখন রাজধানীর এলিটরাই বা বসে থাকবে কেন? তারাও তাদের মতো করে আয়োজন করে উৎসবের। কেউ সাহিত্য নিয়ে, কেউ সংগীত নিয়ে, এরকম নানা কিছু নিয়ে। ঢাকা ফোক ফেস্টিভ্যালের কথাই ধরা যাক। লোকজ নাম দিয়ে সেখানে যা পরিবেশন করা হয়, তা যে কতটা কৃত্রিম এটা তারাই জানেন যারা এ উৎসবে গেছেন। যার ভেতর গ্রামের মাটির সোঁদা গন্ধ এখনো হারিয়ে যায়নি, এ উৎসব দেখে ফিরতে ফিরতে তার মনে পড়বে, গ্রামে বুড়ো বটগাছটার নিচে যে বেদি আছে, সেখানে মাঝরাতে চাঁদের আলোয় থই থই করছে। এ বেদিতে বসে সন্ধে থেকে সোহরাব ফকির তার একতারা নিয়ে লালনের গান গায়। প্রতি রাতেই দু’চার জন দর্শক তার জুটে যায়। দর্শক না হলেই বা তার কী? সে তো মনের সুখেই গানটান গায়।
ঢাকা লিট ফেস্টও এলিটদের এরকম একটি সৌখিন আয়োজন। যেখানে প্রচুর ইংরেজি বইটই থাকবে, থাকবে গণমাধ্যমের চোখ। দেশি-বিদেশি সাহিত্যিকরা চিবিয়ে চিবিয়ে সাহিত্যের গুণাগুণ বর্ণনা করবেন। আর সাধারণ পাঠক মনে করবে, আহা, সাহিত্যর প্রভূত উন্নয়ন ঘটে যাচ্ছে। বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় সাহিত্যের মিলনমেলা এই লিট ফেস্ট। সত্যিই কি তাই? সাহিত্যের প্রতি উৎসুখ যে কেউ কি এখানে ঢুকতে পারবে? না হে পাঠক, তা পারবে না। কেননা, এখানে ঢুকতে হলে আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন করে রাখতে হয়। এর মানে, এখানে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। তাহলে সাহিত্যের মিলনমেলা এটাকে কী আক্কেলে বলি?
আমরা জানি, সাহিত্য ধারণ করে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিম্বা চেতনা (যাই বলি)। কিন্তু ঢাকা লিট ফেস্ট ধারণ করে এলিটদের আশা-আকাঙ্ক্ষা। গণমানুষের রুচির কোনো ছাপ এ উৎসবে আমরা দেখতে পাই না।
অষ্টম বারের মতো এ আয়োজন শুরু হলো আজ বাংলা একাডেমি চত্বরে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘ঢাকা লিট ফেস্ট-২০১৮’ এর উদ্বোধন ঘোষণা করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ, সাদাফ সায্ সিদ্দিকী ও আহসান আকবার।
জানা গেছে, এবার এ উৎসবে ১৫ দেশের দুই শতাধিক সাহিত্যিক, অভিনেতা, রাজনীতিক, গবেষক, সাংবাদিক অংশ নেবেন। এবারের লিট ফেস্টে আলোচনা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ শতাধিক সেশন থাকছে। আরও আছে আনপ্লাগড মিউজিক কনসার্ট। লিট ফেস্টের শেষ দিনে যোগ দেবেন ভারতীয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বিদেশি অতিথিদের মধ্যে এবার অংশ নেবেন পুলিৎজারজয়ী মার্কিন সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অ্যাডাম জনসন, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক ও কলামিস্ট মোহাম্মদ হানিফ, ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ফিলিপ হেনশের, বুকারজয়ী ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জেমস মিক, ভারতীয় জনপ্রিয় লেখিকা জয়শ্রী মিশরা, লন্ডন ন্যাশনাল একাডেমি অব রাইটিংয়ের পরিচালক ও কথাসাহিত্যিক রিচার্ড বেয়ার্ড, ভারতীয় লেখিকা হিমাঞ্জলি শংকর, শিশুতোষ লেখিকা মিতালি বোস পারকিন্স, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এশিয়ার প্রধান হুগো রেস্টল, মার্কিন সাংবাদিক প্যাট্রিক উইন, লেখক ও সাংবাদিক নিশিদ হাজারি। তারকাদের তালিকায় এবার যুক্ত হচ্ছেন বলিউড কাঁপানো অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা। তিনি আসছেন আত্মজীবনী নিয়ে কথা বলতে। আসছেন অভিনেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট নন্দিতা দাস। কথা বলবেন নারী অধিকার, অভিনয় জীবন ও বহুল আলোচিত হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন নিয়ে।
এত যে আয়োজন তা কাদের মনোরঞ্জনের জন্যে? পাঠক, একটু ভাবুন তো।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক