কূটনৈতিক তৎপরতা: পুতিনের সাথে আলোচনার পর কিয়েভে ম্যাক্রোঁ

হাসান আজারকাত

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২২

ইউক্রেন ঘিরে উত্তেজনা প্রশমিত করার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে মস্কোতে রুশ নেতা পুতিনের সাথে কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা আলোচনার পরদিন মঙ্গলবার ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ কিয়েভে পৌঁছান। রাশিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় ম্যাক্রোঁ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করেন। মস্কো ইউক্রেনের সীমান্তের কাছে এক লাখ সৈন্য সংগ্রহ করেছে, কিন্তু জোর দিয়ে বলেছে ইউক্রেনে আক্রমণ করার কোনো পরিকল্পনা নেই। ক্রেমলিন পশ্চিমের কাছ থেকে ইউক্রেন এবং অন্যান্য প্রাক্তন সোভিয়েত দেশগুলিকে ন্যাটোর সদস্য হিসাবে গ্রহণ না করার, সেখানে অস্ত্র মোতায়েন বন্ধ করার এবং পূর্ব ইউরোপ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের নিশ্চয়তা দাবি করেছে।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে পশ্চিমা নেতারা উত্তেজনা হ্রাস এবং আক্রমণ প্রতিরোধের আশায় কয়েক দফা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। রাশিয়ায় চলমান এবং বেলারুশে শুরু হতে চলা সামরিক মহড়ার প্রেক্ষাপটে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। মঙ্গলবার, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, মহড়ায় অংশ নিতে ছয়টি বড় অবতরণকারী জাহাজ ভূমধ্যসাগর থেকে এরই মধ্যে কৃষ্ণ সাগরে চলে গেছে। ম্যাক্রোঁ সোমবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আলোচনা করেন। পুতিনের সাথে আলোচনার পর ম্যাক্রোঁ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের নিশ্চিত করে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কোনো অবনতি ও উত্তেজনা বৃদ্ধি হবে না। পুতিন কোনো প্রস্তাব দেবেন বলে তিনি আশা করেননি। তার উদ্দেশ্য ছিল উত্তেজনা বৃদ্ধি রোধ করা এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মুক্ত করা... যে উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে।

ম্যাক্রোঁ পুতিনের সাথে তার আলোচনাকে ‘পর্যাপ্ত’ ও ‘গভীর’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, সংকট নিরসনে আগামী দিনগুলি গুরুত্বপূর্ণ হবে এবং একসাথে গভীর আলোচনার প্রয়োজন হবে।

ম্যাক্রোঁর সাথে বৈঠকের পর পুতিন উল্লেখ করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মস্কোর দাবি উপেক্ষা করেছে, তবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পুতিন প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করেন, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান রাশিয়া এবং জোটের মধ্যে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাতে পারে, কিয়েভ যদি ক্রিমিয়ার সংযুক্ত উপদ্বীপ পুনরুদ্ধার করতে চলে যায। সেক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাশিয়ার সাথে একটি সামরিক সংঘাতে জড়াবে। পুতিন আরো যোগ করে বলেন, কেউই বিজয়ী হবে না।

সোমবার ম্যাক্রোঁর সাথে বৈঠকের পর পুতিন বিশদ বিবরণ ছাড়াই বলেন, ফরাসি রাষ্ট্রপতির কিছু প্রস্তাব পূর্ব ইউক্রেনের সংঘাতের মীমাংসার ভিত্তি হিসাবে কাজ করতে পারে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, কিয়েভ মস্কো থেকে ম্যাক্রোঁর নিয়ে আসা সংকেতগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখছে। কুলেবা বলেন, আমরা সংলাপের জন্য উন্মুক্ত, আমরা একটি গঠনমূলক মেজাজে আছি, আমরা একটি কূটনৈতিক সমাধান খুঁজছি, কিন্তু আমরা আমাদের লাল রেখা অতিক্রম করব না।

এদিকে ওয়াশিংটনে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বিডেনের সাথে দেখা করেছেন। স্কোলজ ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি কিয়েভ ও মস্কোতেও যাবেন। স্কোলজের সাথে বৈঠককালে বাইডেন হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, যদি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে তাহলে নর্ড স্ট্রিম ২ রাশিয়া-টু-জার্মানি গ্যাস পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়া হবে। তবে এমন পদক্ষেপ নেয়া হলে সেটি রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করার পাশাপাশি জার্মানির জন্যও গ্যাস সরবরাহ সমস্যা সৃষ্টি করবে।

স্কোলজ আক্রমণের ব্যাপারে মস্কোকে সতর্ক করে বলেন, রাশিয়া আক্রমণ করে বসলে তাদের নিজেদের হিসাবের বাইরেও অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। মঙ্গলবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন রাশিয়াকে সতর্ক করে বলেন, ইউক্রেন আক্রমণ করা কেবল ন্যাটোকে শক্তিশালী করবে, তবে তিনি এখনও বিশ্বাস করেন যে নীতিগত এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কূটনীতি এই সংকটকে প্রশমিত করতে পারে।

টাইমস অফ লন্ডনে প্রকাশিত একটি লেখায় জনসন মিত্রদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন যে, রাশিয়া যদি সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেনে প্রবেশ করে তাহলে রাশিয়ার উপর কার্যকর ভারী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে। তিনি আরো বলেন, যুক্তরাজ্য লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়ায় ন্যাটো বাহিনীকে শক্তিশালী করতে তিনি মঙ্গলবার লন্ডনে লিথুয়ানিয়ান প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাল্টিক দেশগুলির সমর্থন আদায়ের জন্য সাক্ষাত করতে প্রস্তুত।

জনসন বলেন, তিনি দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে আরএএফ টাইফুন ফাইটার এবং রয়্যাল নেভির যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর কথা বিবেচনা করছেন। ব্রিটেন সোমবার বলেছে যে তারা পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো বাহিনীকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে পোল্যান্ডে ৩৫০ সৈন্য পাঠাচ্ছে এবং ইতিমধ্যেই ইউক্রেনে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠিয়েছে। ন্যাটো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় নেতারা ন্যাটোর মূল নীতিগুলি চ্যালেঞ্জ করার অভিযোগ এনে স্পষ্টভাবে পুতিনের দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করেন, যার মধ্যে রয়েছে ন্যাটো প্রতিরক্ষা জোট ইউক্রেনকে যেন সদস্য পদ না দেয়া এবং পূর্ব ইউরোপে সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে দেয়া।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোতে প্রবেশের কোনও সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে খুব বেশি সম্ভব নয়। তবে তিনি এবং অন্যান্য ন্যাটো সদস্য দেশ এবং ন্যাটো নিজেই ভবিষ্যতে জোটে ইউক্রেনের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করতে অস্বীকার করেছেন।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট