সংগৃহিত
কুক্কুর
শাহরুখ পিকলুপ্রকাশিত : নভেম্বর ০৩, ২০১৮
সমিরুদ্দিনের বয়স সত্তর ছাড়িয়েছে। সেই যে গন্ডগোল হলো, পিরোজপুরের অজপাড়াগাঁয়ের তাদের গ্রামটা যখন পাঞ্জাবিরা পুড়িয়ে দিলো, সমিরুদ্দিনের কচি বউটাকে লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে সেই অদ্ভুত অচেনা ভাষা-বলা লোকগুলো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো, গ্রামের কদু মাতব্বর তাদের সাহায্য করলো শিয়ালের মত খ্যাক খ্যাক হেসে, সমিরের বয়স তখন পঁচিশ কি ছাব্বিশ। সে যুদ্ধে গেলো, ভারতের এক ক্যাম্পে প্রথম বন্দুক ধরলো, তা চালাতে শিখলো, যুদ্ধ করলো নির্ভয়ে, আর যুদ্ধ জয়ের পরে নিজ গ্রামে ফিরেই কদু মাতব্বরের পেটে ঢুকিয়ে দিলো মনের সব ক্ষোভ ভরা বেয়োনেট, বউটাকে আর কোনদিন খুঁজে পাই নি সে, কিন্তু কদু মাতব্বরের ছোট ভাই-ই তাকে একদিন গ্রাম ছাড়া করলো। সেই থেকে সে তাদের গ্রামেরই অবস্থাপন্ন ফকির বাড়ির ছেলে রজব ফকিরের গুলশানের আলিশান বাড়িতে আশ্রিত। রজব ফকির লোক ভালো, সমিরকে নামকা ওয়াস্তে কাজ দিলো কিন্তু মূলত দিলো আশ্রয়। সেই থেকে সে রয়ে গেছে গুলশানের অভিজাত এলাকায়- বড়লোকদের মাঝে এক গরীব কিন্তু সৎ ও কৃতজ্ঞ রক্ষক। মূর্খ সমির আজ চল্লিশ বছর ধরে আল্লাহকে ডাকে আর রজবের জন্য দোয়া করে। কচি বউটা পোয়াতি ছিলো, সেই অজানা (বা মৃত)বাচ্চাটার জন্যও কাঁদে সে।
এক দিন সে রাস্তায় অসহায় এক কুকুরের ছানাকে কুঁই কুঁই করতে শুনে তার সহজাত ভালোমানুষিতে কোলে তুলে নিলো, তাকে বাড়ির বেগম সাহেবের অনুমুতিক্রমে দুধ দিলো, কুকুর ছানাটা আগাছার মত বড় হয়ে উঠলো ‘সালাউদ্দিন’- সমিরের দেওয়া নাম, তার সেই হারানো ছেলে যেন সে।
সেই ঘরে নিয়মিত আসে রাজ্জাক হুজুর, ভেক ধরেছে আল রাজ্জাক গোপালগঞ্জপুরি, ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে তার দেশের বাড়ি, তার থেকে এই নামের আবিষ্কার।
‘না-পাক কুত্তা লইয়া কীসব করেন, সমির মিয়া!’
‘ক্যাঁ, আপনের কি গোয়ায় খাউজায়?’ সমিরের থেকে বছর তিরিশেকের ছোট নব্য গজিয়ে ওঠা এই প্যাঁদা হুজুর।
‘কুত্তা শয়তানের দোস্ত, আপনি কি জানেন?’
‘ক্যাঁ, তোরে গুতাইসে না তোর পাতে হাগসে?’ হঠাৎ সম্মানসূচক সম্বোধনের পতন, রাগে।
‘আপনি বুঝতাসেন না, কী পাপে আপনি পাপিষ্ঠ!’
‘আরে মোর খোদা, তোর থনে ধর্ম শেখতে হপে নি মোর? বাল হালা গিয়া। মুই তোর বাপের বয়স, মোরে হিগাইতে আহিস না কলোম।‘
গোপাল্গঞ্জপুরি সেদিনের মত চলে গেলেন কিন্তু ক’দিন পরেই সাগরেদ জমরুদকে পাঠালেন।
জমরুদ ঢাকাইয়া, সে এসে সমিরকে বললো, ‘এই যে বুইড়া মিয়া, কুত্তা পালেন ঠিক আছে মাগার এই মহল্লার বাইরে গিয়া এই সব নফরমানি করেন গিয়া।‘ মুক্তিযুদ্ধ করা সমির একটুও না ভড়কে, ‘ঐ তুই জন্মাইসো কবে, হালার ভাই হালা? তুই মোরে কি গেয়ান দিবি রে হমন্দির পুত?’
‘কল্লা ফালাইয়া দিমু তোর বরিশাইল্যা মান্দের পো!’
‘দে, তোর বাজানের মায়ের ওলান থাকলে দে। হুকনা ওলানে আর কয় সের দুধ ধরে রে, বেডা। তোর গুষ্ঠির’
সপাং করে রাম-দা পড়লো সমিরের গর্দানে, পরেরটা তার বুকে, ক্রমে পিঠে, ঘাড়ে, পাঁজরে। ধপাস করে সমির জমিনে পড়ে শুধু কলেমার ‘লা ইলাহা’ বলেই দেহত্যাগ করলো। সেই কুকুরছানাটা তার কাছে এসে কিছুক্ষণ কুঁই কুঁই করে, চেটে চেটে তারই রক্ত খেতে মত্ত হলো, মাতাল এক শিশু প্রাণী। মৃত্যু সবারই অনিবার্য, একের মৃত্যু অপরের খাদ্য, জীবন। কুত্তার বাচ্চা, জীবন দর্শনের কীই-বা বোঝে, তবে বোঝে জীবন ধারণের প্রয়োজনীয়তা। কুত্তা, মানুষ, দেবতা............সবই যে একই পাল্লায়। কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে.........
এর দু দিন পর জমরুদ কোপালো রজবকে, কেউ কিছু বললো না। মনিবভক্ত, অনেকটা কুকুরের মতোই সমিরকে আগেই সরিয়েছে গোপালগঞ্জপুরী এই উদ্দেশ্য হাসিলের কারণেই।
নিরুপায় রজবের ছেলেপুলে-পরিবার পালিয়ে বাঁচলো। গোপালগঞ্জপুরি ক’দিন পরে রজবের বাড়িতে আস্তানা স্থাপন করলো। মুরিদের শেষ নেই সে স্থানে। সবাই যে হরিণ চায়- সোনায় মোড়া।
সমিরুদ্দিনের মরদেহ যে কোথায় গেলো তা কেউ জানে না তবে তাকে নিয়ে একটা স্মরণসভা হয়েছিলো বটে, পয়সা দিয়েছলো গোপালগঞ্জপুরি, সার্বিক তত্বাবধানে জমরুদ। জমরুদ মরেছে আজ বেশ কিছু দিন কিন্তু কেউ তার আসল নাম জানে না। পোষা কুকুরের নাম দিয়ে আর কী এসে যায়, কাম দিয়ে কথা। লোকে জানে না যে, সে ঠাঠারি বাজারের কসাই চান্দুর ছেলে কুদ্দুস। পুলিশের গুলিতে কারো নাম লেখা থাকে না।
ঢাকা ২৬শে অক্টোবর ২০১৬