কিংবা অন্য পৃথিবীর দিকে ভেসে যায় আমাদের গান

রথো রাফি

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৯, ২০২০

বসে আছে সে। এক হাতের আঙুল থেকে অপর হাতের আঙুলে পিঁপড়েটিকে বারবার আসতে দিচ্ছে, যেতে দিচ্ছে। এভাবে, এভাবেই চক্রাকার ঘুরে চলেছে পিঁপড়েটি। বুঝতে পারছে না কেন সে আঙুল ছেঁড়ে দূরে কোথাও যেতে পারছে না। অন্যকোথাও যেতে চেয়েও সে সেই দুই হাতের দুই আঙুলেই রয়ে যাচ্ছে। পিঁপড়েটি অস্থির হয়ে কেবল সামনের দিকে ছুটেই চলেছে। তার ছোটার বেগ বাড়ছে, বাড়ছে না বিচরণের পরিধি।

চা খেলো ইক্ষণ। এরপর সিগারেট। নিকোটিনের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে তার ফুসফুসের অলিতে গলিতে। প্রতিটি কোষে এবং সেখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে রক্তের স্রোতে। তার স্বাভাবিক লাগছে। ‘নষ্ট দ্রাঘিমায় এসে গেছি হে দেবদূত! অস্থিতে মজ্জায় হিম জমে গেছে অজস্র কর্দম কী করতে কী করে ফেলি বুঝি না পূর্বাপর কেঁচো খুঁড়ে অজগর! বুকের ভেতর অহরহ টমটমের শব্দ শুনতে পাই। প্রাগৈতেহাসিক অন্ধকূপে পড়ে থাকি বিকল জন্তুর মতো পুঙ্গুতায়– আর স্তব্ধ পরাধীনতায় ...’

বিকেলের রোদ পড়ে গেছে। গাছের ছায়া লম্বা হয়ে পূর্ব দিগন্ত ছুঁতে চাইছে, যখন ‘চলুন সেক্স করতে যাই’ বললো মুয়ীজ। ‘সেক্স না করলে স্বাস্থ্য ভাল থাকে না। অবশ্যই যাবে।’ ‘কিন্তু আপনিও চলেন।’ ‘কবে?’ ‘আগামি কাল।’ কয়েক মিনিট নীরবতা বয়ে গেলো ইক্ষণ ও মুয়ীজের মাঝ দিয়ে।
‘বলোতো, বাতাসের চেয়ে নরোম কী?’
‘স্তন।’
‘না হলো না, মানুষের মন।’
‘না, স্তন। আগামিকাল, চলেন যাই, বোঝবেন কার কথা ঠিক।’
‘চলো।’
ক্ষণমিত্রা বসে ছিল পাশেই। শুনলো সে দুজনের কথাগুলো। মৃদু হাসলো। সে এখানে এসব সবসময়েই শুনে থাকে। এবং এসব তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয় সবসময়েই। আমি তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইলাম আসলে এ হাসির অর্থ কী। সে গতকাল অনেক ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে এখানে এসে বসেছিল। এসব কথা আজও তার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো। সারিক্তার ডাকে ওঠে সামনের বাস্তাটায় গিয়ে বসলো ক্ষণমিত্রা। আমি বসে রইলাম অমসৃণ কাঠের এই টেবিলটার ওপর। আর মাথার উপর ও তিনদিকে সামিয়ানা, পলিথিনের, হালকা নীল। মুয়িজের ধারণা এই সামিয়ানার জন্যই বাতাস আসছে না, গরমে আমরা অস্থির।

টুক। টুক। টুক টুক। টুক। টুক। ... শব্দটা বাজাতেই থাকে ইক্ষণ।
‘কে?’ এ প্রশ্নটা শ্রুতিভূত হওয়ার পরপরই দরজাটা খোলে। চৌকাঠ জুড়ে একটি মেয়ে, হাতে কচুর একটা লতি।
‘আমি কি এখানে থাকতাম না? আমাকে কি চিনতে পারছেন?’ আমি যে বাড়িতে থাকতাম, তার সিঁড়িটা কি আরেকটু মোটা ছিলো, নাকি চিকন? ঠিক বোঝতেছিনা। ‘আচ্ছা, আমি যদি এখানে থাকতাম, তাহলে তো আপনি চিনতেই পারতেন, তাই না। আপনিতো জানালেন না, আপনি আমাকে চিনতে পারলেন কিনা। আর সত্যি করে বলেন তো আপনি, এখানে কি নতুন আসছেন, তাহলে তো চেনার কথা না। আর আমি একমাস ধরে বাসাটা খুঁজতেছি। আমি কিভাবে যে ভুলে গেলাম। আমরা তো কতো কিছুই ভুলে যাই, তাই না, তাই বলে আমার মতো কি কিছু ভুলে মানুষ!’

এসব কি বলছে বুঝতে না পেরে, সে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ইক্ষণ। তাকে তো বাড়িটা খুঁজে বের করতে হবে। এবার এক মহিলা খোলা দরজার সামনে দাঁড়ানো দেখতে পায়।
‘আচ্ছা আপনি কি আমার আপা না, তাই তো বলি। দূর কী থেকে যে কী বলি। আচ্ছা আমি কি আপনার ভাই? না, তা হতে পারে না। হলে তো আপনি আমার নাম ধরেই ডাকতেন। রাগারাগি থাকলেই কেবল লোকজন একে অপরের সাথে কথা বলে না। তো আমি কি এখানে থাকতাম! আমি একটা মাস ধরে এ রাস্তায় ও রাস্তায়। আগে জানতাম মানুষ হারায়, বাসা হারায় না। এখন দেখি আমার মতো লোকের কাছ থেকে বাসাই হারাইয়া যায়। আচ্ছা, আমার না মারাত্মক পেটে খিদা লাগছে। লোকে পাগল ঠাওরায়, আমারে। বিশ্বাস করে না, আমার পেটে ক্ষুধা লাগতে পারে। পৃথিবীতে এমন আজব কথা কি শুনেছেন পাগলের ক্ষুধা লাগে না। আর আমি যদি পাগলই হতাম, তাহলে কি বাসা খুঁজে বেড়াতাম। আচ্ছা আমি কি কিছু খেতে পেতে পারি? আচ্ছা একটা লোককে যখন কেউ চেনে না, তখন কি সে পাগল হয়ে যায়? বলেন না প্লিজ, আমি কি এখানে থাকতাম?’’

‘না থাকতে না?’
‘তাহলে তো আমি আপনার অচেনা না, তাই না, তাহলে আপনি আমাকে তুমি করে বললেন কেন? বয়স্ক অপরিচিতের সাথে তো কেউ তুমি বলে শোধায় না, আচ্ছা আমি কি আপনার পরিচিত?’

এমন সময় মা ডাক দরজায় আছড়ে পড়ে। মহিলা চলে যায়। এবং দরজা লাগিয়ে দেয়। মেয়েটির হাসি আছড়ে পড়ে দরজায়। ছেলেটি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আর টেনশন ভাল লাগে না। কখন যে পাগল হয়ে যাবো?’ ইক্ষণের কানে আসে। সে এসবের অর্থ বুঝতে পারে না। কিন্তু ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো তার, মাঝরাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, অন্ধকার, আর ঘুমন্ত দালানের সারি, স্বপ্নের নির্দিষ্ট কোন মানে নেই। আর ভাবে ঘরের ভেতরের ছেলেটাতো আসলে সেই।

‘খালি চাপ আর চাপ, মাসে মাসে কিছু টাকা দিবে বলে কতো যে কথা শুনিয়ে দেয়। আবার বিভিন্ন জায়গায় ঘুষ দিতে আমাকেই যেতে হয়। আবার সবাই ঘুষ খায়। কেউ যখন খায় না, বসিয়ে বসিয়ে ঠাণ্ডা ভাষায় অপমান করে। গা জ্বলতে থাকে। লোকটাকে দেখে আমার আত্মগ্লানি হয়। লোকটা কি সৎ? আমার বিশ্বাস হয় না। হলে সে এই পদে কিভাবে বসে আছে! বাস্তবে আমার আত্মগ্লানী হয়, ভাবতে থাকি চাকরি ছেড়ে দেব আজই। অফিসে আমার ম্লাান মুখ কতজনেই না দেখে ফেলে।’
‘সহ্য করো।‘
‘এর বিকল্প কি আছে আর তোমার।’
‘কিভাবে বাঁচবে?’

আমি চাকরি ছাড়তে পারি না। বাসায় এলে তো আর চাকরি ছাড়ার কথা মনে থাকে না। তোমাদের মুখ আবার আবার আমাকে অফিসের দিকে ঠেলে দেয়। ভাল লাগে না। এভাবে কুলানো যায়? একের পর এক কাজ। এখানে যাও তো ওখানে যাও, একই কাজ নিয়ে, একঘেয়েমির মাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। কাকে বলবো এসব কথা।
‘এমন ছিলো একদিন আমারও স্মৃতি। আমারও দিন।’ কারা যেনো এসব বলাবলি করে ঘরে বাইরে মাঠে ঘাটে, তাদের মাঝেই থাকে সে, তাই অহরহ শোনে, শুনতে পায়। সকাল সন্ধ্যা রাত। ইক্ষণ এসবের অর্থ বুঝতে পারে না। ঘুম না এলে মাথা খুব গরম হয়ে এলে অপমানিতের মনোবেদনায়, মাঝরাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, অন্ধকার, এইসব অভিজ্ঞতার সমাধান নেই।

কাঠের বেঞ্চি থেকে ইক্ষণ একটা বেনসন সিগারেট চাইলো।
`বেনসন নেই’।
অগত্যা মুয়িজের কাছ থেকে গোল্ডলিফ নিলো সে।
ডাক দিলো মাঈন, গাঁজা দেখিয়ে, ‘টানবে নাকি একটু?’ সে মনে করে এ সভ্যতা কবেই একদম পচে গেছে, একে উদ্ধার করতে হলে আত্মবিনাশী হলেই চলবে না, অন্যদেরও আরও পচতে সহায়তা করতে হবে। ড্রাগ তার কাছে এ ক্ষেত্রে মহৎ অস্ত্র!
আমি বললাম, ‘টানবো না।’
এদিকে পাশেই তৈরি হচ্ছে একটা সিগারেট যার ভেতরে গাঁজার পাতাগুলো তামাক-সোগার সাথে ডাবলহেলিক্স তৈরি করে ক্রমে উঠে যাবে অগ্নিসরোবরে। অন্য একটি তামাক শলাকা মুখ থেকে মুখে ঘুরছে আর পুড়ছে। ধুঁয়ার ভেতর থেকে ভেসে আসছে গান। আমি নীরব হতে চেষ্টা করি।

‘আচ্ছা আমি এতোদিন কেন কোন ব্রথেলে যাইনি? কত কারণই তো হতে পারে! এই যেমন সেখানে আসা মেয়েরা নিজের ইচ্ছায় আসে না, আর আমি না গেলে তারা উপবাস থাকবে না। কিংবা তারা বহুব্যবহৃত হতে হতে নিজের অনিচ্ছায় অসুস্থ হয়ে গেছে। আর তাদের ব্যবহার করতে গেলে আমাকেও সিফিলিসে ধরতে পারে! আসলে কি সিফিলিসের ভয়? নাকি সিফিলিস হলে চারপাশের সবাই জেনে যাবে, ডাক্তারকে বলতে হবে, ব্রথেলে গিয়েছিলাম। আরো একবার আরো একজনের কাছে নিজেকে নগ্ন হতে হবে। নাকি অন্য কিছু? আচ্ছা সিফিলিসের হাত থেকে বাঁচতে তো কনডম আছে, তাই না? কিন্তু কনডম তো আর কিছুই নয়, আমাদের ক্ষুধার চেয়ে আমাদের যৌনতাকে বেশি স্বীকৃতি দেয়া। আমরা কি জানি না, কনডম এ শতাব্দীতে কত বড়ো বিজনেস হতে চলেছে! তাহলে কেন যাই নি? নাকি সমস্ত কিছু বিজনেস হয়ে যাওয়ার পরও কোথাও ‘যৌনতাকে বিজনেসের বাইরে পেতে চাওয়ার একটা প্লেটোনিক চাওয়া তোমাকে যেতে দিচ্ছে না, ইক্ষণ।’

এভাবে নিজের ভেতর না না হা হা না না নানা কথা আসছিলো, ভাসছিলো, যাচ্ছিলো– মেঘের মতো। আকাশ একবার মেঘলা, একবার নীল হচ্ছিলো।

For you there`ll be no crying
For you the sun will be shining
`Cause I feel that when I`m with you
It`s all right I know it`s right
And the songbirds keep singing like they
Know the score
And I love you I love you I love you
Like never before

‘আমরা যদি আকাশের মতো হতাম, গায়ে আমাদের যদি কোন দাগ না পড়তো!’ এ যে সারিক্তা ছেলেদের সফলতাকে খুব ভালবাসে, সম্ভবত নিজেরও। কিন্তু কোন সফলতা? যে সভ্যতার বিরুদ্ধে গেয়ে ওঠে, তাকে, না কি সে সভ্যতার সবচেয়ে লাভজনক বাণিজ্যকে হয়ে ওঠতে সহযোগিতা দেয়ার সুযোগ পেয়েছে বলে ভাল সামজিক মূল্য পাচ্ছে, তাকে? ইক্ষণ জানতো না, ছেলেটা একটা মোবাইল নেটওয়ার্কিংয়ের কাজ করে। গান সে যতোই সভ্যতার বিরুদ্ধে গাওয়া হোক না কেন, তা আজকাল বিক্রয় যোগ্য হয়ে ওঠে, ভালই অর্থকরি চলে আসে, যদিও সভ্যতার মুখপত্র বিভিন্ন চ্যানেল এবং এফএম রেডিওতে তেমন প্রচার মেলে না। আসলে মানুষগুলো যেহেতু অসুখী ফলে সভ্যতার স্বপ্ন নিয়ে গাইলেও বিক্রিযোগ্য হওয়া যায়, তেমনি সভ্যতাকে গালি দিলেও বিক্রি যোগ্য হওয়া যায়। আটকায় না। বিজনেস যেখানে, সফলতা কেবল সেখানেই। আর যেখানে বিজনেস নেই, সেখানে সফলতাও নেই, বা সফলতাকে ব্যঙ্গ করতে কিছু করুণাই অবশিষ্ট আছে। আমি হ্যাঁ বলেছি, বিক্রি হয়ে গেছে, আমি না বলেছি, বিক্রি হয়ে গেছে, আমি হা না কোনটাই বলবো না বলবো, হায় আমার নীরবতাও বিক্রি হয়ে গেছে, হে আমার শিং বাকানো ক্রোধ, হে আমার নিরুদ্ধ নিস্তব্ধতা, খোলা বাজারের মাঝখানে তবু তবু তোতলামি চলবে না একদম!

‘ছুরি হাতে অশ্ব ছুটে যায়। রজঃস্বলা হলো নাকি মেয়ে? এসেনিন কবিতা লিখবেন। ফিনিক্সের গান নগরের ড্রেনে ড্রেনে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যবহৃত নিরোধের সাথে। দর্পণে বিম্বিত শেষ মুখ। বাদুড়ে রূপান্তরিত ফুসফুস নগর ছাড়িয়ে উড়ে যায়। দূরে সমুদ্র গর্জায়।’ কী কারণে এসব ভাবছে সে? সে মানে ইক্ষণ নিজে। সে কি এজন্য নয় যে, মেয়েটা যেমন তার পিঠ মুয়িজের উরুতে, বুকে, তেমনি সেই ছেলেটির গলাও জড়িয়ে ধরে এবং চুমো খায়। আবার মুয়িজ যেমন এ নিয়ে কিছু মনে করে না, তেমনি ঐ ছেলেটিও। ইক্ষণ ভাবছে, তারা আসলে কিছু না মনে করলেও, মেয়েটির স্বাধীনতা কি তারা মেনে নিয়েছে? আবার এও ভাবছে, মেয়েটির যখন যাকে ইচ্ছা তাকেই ছোঁবে এটাইতো চাই। আবার ছোঁতে ইচ্ছে না করলে ছোঁবে না। কিন্তু এই ছোঁয়াছোঁয়ির ব্যপারটার একটা শ্রেণী যে আছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে, যখন সে আর কাউকে জড়িয়ে ধরছে না আড্ডায়। যাদের জড়িয়ে ধরছে না তাদেরকে, যারা সেই সফলদের দল, যাদের সফলতা আজও বিক্রি যোগ্য নয়। সে এসব ভাবছে কেন? কেন ভাবছে, ‘বাণিজ্যের ঊর্ধ্বে আর একটি চুম্বনও পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই।’ আচ্ছা, বেশ্যারা যদি নিজের অনিচ্ছায় এই ব্যবসায় এসে থাকে, তাদের কি অভিনয় চালিয়ে যেতে হয় না, তার ক্লায়েন্টদের সাথে? তাহলে আমি কেন ওখানে যাব, প্রতারিত হতে? প্রতারণাকে আমি কিনতে যাবো টাকার বিনিময়ে? তিনশ টাকার প্রতারণা কিনে আমার প্রতারিত হবার লোভ বাড়বেই বই কমবে না। তারা যতো অভিনয়ই করুক, অভিনয়ও তো মনের ব্যপার, অভিনয়কে ধারণ করা শরীর কি নিস্বাদ হয়ে পড়ে? ‘বিপন্ন পুরুষ ফিরে গিয়ে গুহার দেয়ালে বিচিত্র রঙে আঁকে ছবি অপূর্ব পশুর কল্প-শিকারীর সেই শহরের উঁচু উঁচু আশ্চর্য দালানের। চর্বির প্রদীপের আলোয় বোবা জীবনের শিল্প ফোটে শক্ত তুলির আঁচরে, নারী তার ছায়া রাত্রিভর জেগে থাকে পাশে, হাতে নিয়ে মৃত্তিকার রঙে ভরা পট। গলায় তার বাঘের দাঁতের মালা পাখির পালক কালো চুলের খোঁপায়। দৃষ্টির আঁচল তার মুছে নেয় ঘাম, দুর্বিনেয় ক্ষুধা হিমায়িত শ্বেত বর্বরতা গত বিকেলের ক্লান্তি। মনে হলো এই নারী রৌদ্রের বন্দর...’ অপরের স্বীকৃতি ছাড়া, অপরের জেগে ওঠা ছাড়া সে জাগতে পারে না, পারবে না কখনো, এমনই ভেবেছে ইক্ষণ।

প্রেমিকার স্তন থেকে হাত নেমে এসেছে, যতোবার তাকে নামাতে বলা হয়েছে, ততোবারই এক মুহূর্ত সে দেরি করেনি। ‘বহুদিন তোমাকে দেখিনি। জীবন নিঃসঙ্গ হয়ে, যেতে থাকে প্রতীকের দিকে। নোংরা রাস্তা দিয়ে দৌঁড়ে যেতে যেতে দেখেছি প্রতীক-চিহ্ন– বণিক সভ্যতা যাকে মর্যাদা দিয়েছে। কারা আজ নিসর্গে গিয়েছো ভেবে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের সিমেন্টের আগুনের পাশে গিয়ে মুখ লুকিয়েছো?...’। ‘সমস্ত অপেক্ষা তবে ব্যর্থ হয়ে এলো। নেমে এলো ছায়া। পাদ্রীর পোশাক থেকে ধর্মগ্রন্থ থেকে মেঘ থেকে স্মৃতিস্তম্ভ থেকে ক্রুশ থেকে নারী মূর্তি থেকে মুখোশ ও পতাকা থেকে মাঠ পার হয়ে অতি দীর্ঘ ছায়া নেমে এলো।’ তবে তাই হোক, যৌনতার অবসেসন সব অভিনয় হয়ে আসুক।’ অপরের জেগে উঠা ছাড়া যে আনন্দ তা মনে হয় নিজেকেই ধসিয়ে দেয়া। অপরের স্বীকৃতি ছাড়া আমরা নিজের জন্য এক নিঃসঙ্গতাকে যন্ত্রণাময় করে ফেলি আর নিজেকেই ধসিয়ে দেই, তাও তো জীবনের প্রতিকূল। ফলে তা সুখের বদলে বিষণ্ণতার ভীষণ জমি চষে দেয়। এমনই ভাবি। ‘অভিনয় বিনা কিছু নয়, নেই এই পৃথিবীতে আজ!’

ঐ যে লোকটা যে কিনা পথে পথে কেবল হাঁটে আর হাঁটে। যার অমল ধবল চাকরি ভাল লাগেনি। স্ত্রী মারা যাবার পর যে লোক নাজুক স্তব্ধ হয়ে যায়, তার কথা ভাবি। ৩৫ বছর ধরে লোকটি হাঁটছে। তার বন্ধু এক সময় তাকে পীর বানিয়ে দিয়েছে। পথের এই মোড়ে তো ঐ মোড়ে বসে থাকে যতোক্ষণ ইচ্ছে। অনেক মেয়ে ছেলে মাথা নিচু করে পেছনে পেছনে হাঁটে। তাদের মনোবেদনা নিয়ে সে কি আজ খেলে বেড়ায়, তার নীরবতার সীমানা ধরে রেখে? যাদের ঘরে শান্তি নেই, যাদের বিয়ে হচ্ছে না, যাদের সন্তান হচ্ছে না বলে শাশুড়ি ঘর থেকে বের করে দিতে চায়, স্বামীকে আরেকটা বিয়ে করতে বলে যেসব মেয়েরা, তাদের কোন কাজে লাগে এই লোকের পিছনে মুক হয়ে হাঁটা, কে জানে! সেও তো নেয়নি এসবের খবর।

তবে তাই হোক। যেখানে স্থিরতা বলে কিছু নেই, স্থির হয়ে আছে জমাট হয়ে আছে কেবল বিষাদ, সেই সময়ে সেই দেশে আমারও তবে ভিন্ন পরিণতি হবে কেন! সমস্ত অপেক্ষা তবে পরিণতিহীন হয়ে আসুক! ‘বিস্মৃতির ছায়া পড়ুক আমারই প্রাণে, আমার রক্তে মাংসে আমার অতীতে আমার ভবিষ্যতে।’ ‘মুখ ভেঙে গেছে মানুষের। হাজার হাজার মানুষ ভাঙা মুখ নিয়ে ঘোরে। খুব কাজ। গ্রাম থেকে আসা মানুষ, শহরের গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসা মানুষ, সবাই শহরের রাস্তায়। শহরের ধোঁয়ায় বিষে মলিন। যে বলেছে অবচেতনের কথা, যে এক বধির স্রোতের কথা বলেছে, যে প্রথমে চিৎকার করে উঠে ধীরে ধীরে নারীর কথা বলেছে, যে বলেছে ‘একদিন উন্মাদ হয়ে যাবো’, তাদের সকলেরই ভাঙা মুখ। যখন গাঢ় হয়ে এসেছে শীত রাত্রি তখনো দূর থেকে অস্পষ্ট কোলাহল শোনা গেছে মানুষের। মানুষের পাশেই নক্ষত্রলোক...’

কফিল ভাই দেখি পার্কের লোহার বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকলো। এগিয়ে এলো। আমার কাঁধে হাত রাখলো।
‘চা খাবেন।’
‘খাবো’।
‘তো কী অবস্থা?’
‘মানুষের নিমর্ম ভোগান্তি দরকার’
‘কেন?’
‘না হলে কিছুই হচ্ছে না। মানুষ এ না হলে এই দীর্ঘ ব্যর্থ নিস্ফলা সময়ের পরিধি ছেড়ে বাইরে আসছে না কিছুতেই।’
‘সবকিছু ভেঙে ফেলতে চাওয়া কি এতো সোজা। সোজা না।’
আমি বোঝলাম না, কোন প্রসঙ্গে এসব বলা।
‘আপনি বিয়ে করেছেন?’
‘না’
‘সিস্টেমে মাথা দেন না কেন?’ বিয়ে মানে তো এই ...’
‘আপনি নিজে মিষ্টি না খেয়ে অপরকে মিস্টি খাওয়ার উপদেশ দিচ্ছেন!’

তিনি হাসে, আমি হাসেন। হাসতে থাকি, হাসি। আমরা আর এই হাসির অর্থ বুঝি না। এই পার্ক কি এসব বোঝে, যেখানে আমরা বসে বসে কাটিয়ে দিচ্ছি আমার অমলধবল সব সোনার দিন? একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে থাকি, বসে থাকি, বসে থাকি। নীরব। আর পার্কের গাছের ছায়া এসে দুপুর গরমঘামশরীর ছুঁয়ে যায়। ‘আমাদের মহাভারত পড়া শেষ হয়নি আজও। একদিন আমার জরাগ্রস্থ পিতামহকে মহাভারত পড়তে দেখেছি, আজ আমার বালক-পুত্রকে মহাভারত পড়তে দেখলাম। পূর্ণাঙ্গ জীবন আর, পাশাপাশি, যুদ্ধের গল্প, নারীর গল্প, বীরত্ব ও ছলনার গল্প, স্বপ্ন এবং সত্যের গল্প, ধর্ম ও পাপের গল্প, সময় ও শূন্যতার গল্প। আমাদের চেতনা-প্রবাহের এইসব গল্প শেষ হবে না কোনদিন।’

মনে হলো কফিল ভাইয়ের পাশ থেকে উঠে গিয়ে এখনই বলি, ‘ক্ষণমিত্রা চলো, শিখা অনির্বানের ঐ ইতিহাস, যুদ্ধ, জয়, মিছিল, জনসভা, সূর্য নারীর ম্যুরাল আচ্ছন্ন বিষাদজয়ী দেয়ালটায় পিঠ ঠেকিয়ে বসি। ক্ষণমিত্রা, আজ আমার খুব যৌন ক্ষুধা পেয়েছে, ক্ষণমিত্রা বিকেলবন্ধু আমার, সন্ধ্যাবন্ধু আমার, আমার আজ খুব বিষাদে পেয়েছে। চলো চলো তোমার স্তনে, হাত দিয়ে এই সন্ধ্যার অন্ধকারে অনেক্ষণ বসে থাকি, আর চলো দেখি, বুড়ি চাঁদ আজও হেঁচড়ে হেঁচড়ে উঠে আসছে জীবনকে অস্বীকার করতে না পারার ব্যর্থতায়। দেখি তারাগুলো, যারা আবহমান কাল ধরে দেখে যাচ্ছে এই পৃথিবীর রণরক্তসফলতা, তবু একটা শব্দ ঝরে পড়ে না যাদের বুক থেকে। ‘হায়, লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র তবু অন্ধকার কাটেনি একফোঁটাও।’

‘ক্ষণমিত্রা চলো, আজ আমার খুব বিষাদে পেয়েছে। আজ আমার যৌন পিপাসা পেয়েছে খুব। চলো তোমার স্তন ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকি। হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ঐ যৌনবিষাদমগ্ন মাঠে।’ ‘আরো কত হিমযুগ বরফের শাদা নদী নদীতে সাঁতার কাঠের জাহাজে চড়ে দূর পাল্লাার সমুদ্রে পাড়ি সিংহকে তাড়িয়ে গুহায় রাত্রি বাস চামড়ার তাঁবু পেতে পাহাড়ে পাহাড়ে নির্জন উপত্যকায়। আগুনের চারপাশে টোটেম-উৎসব উৎসবে মৈথুন বাঁশের কাঠিতে গেঁথে শিকারের মাংস পুড়িয়ে পুড়িয়ে সমবেত ক্ষুধার সৎকার...’। ‘মনে রেখো সূর্য তার সৌন্দর্য পোড়ায় মেরুর শীতকে নয়। পোড়ামাটির পাত্রে খোদাই যতো লিপিচিত্র উন্নত ধূসর হাতিয়ার নতুন কি পুরাতন, সবই আমার আমার রক্তের, আমার ভুলের, বিশৃঙ্খল যৌনতার।’

একসময় উঠে পড়ি এগিয়ে যাই। আবার আবার সেই কলাতলি। আবার সেই মজিদ ভাই। ‘এক কাপ চা, মজিদ ভাই’, সাকুল্যে এ কয়টি শব্দই বেরিয়ে আসে ইক্ষণের কণ্ঠ থেকে, ‘ক্ষণমিত্রা, একটা বেনসন খাওয়াও না?” কাঠের চলকা ওঠা হাতুড়ে টেবিলটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার মুখ অন্ধকারে ধৌত হতে থাকে, আর অন্ধকার ধ্বনিমালায়।

Between the conception And the creation Between the emotion And the response Falls the Shadow Life is very long Between the desire And the spasm Between the potency And the existence Between the essence And the descent Falls the Shadow…

প্রতিদিন কতো যৌনতার গল্প বলি, কত তামাশা কৌতুকে স্নাত হই আমরা । তবু আমার ক্ষুধার কথা বলতে পারি না। চলো ক্ষণমিত্রা চলো ঐ মাঠে, যেখানে সন্ধ্যা সম্ভাবনা আর মাংসের তাপ নিয়ে মহাজাগতিক রূপের তলে ডুবে থাকে নক্ষত্রজুটিরা। বলতে পারি না। মজিদ ভাইয়ের দোকান ফেলে রাস্তা পেরিয়ে, নজরুলের মাজার ফেলে চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে এসে ঢুকি, এবং ছবিগুলো দেখতে থাকি, কে শিল্পী তা জানি না, জানতেও চাই না। ছবিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছি। গ্যালারিতে বাঁশি বাজছে চৌরাসিয়ার। একপাক প্রায় শেষ তখন চোখে পড়লো ছবিটা, খুবই ট্রেডিশনাল ছবি, প্রতিদিনকার জীবনের একটা সহজ দৃশ্য: মা তার শিশুকে কি যেনো বলছে। শিশুর পিঠের অংশ দেখা যাচ্ছে, মায়ের দিকে ফেরানো ন্যংটো শিশু, আর মায়ের মুখ শিশুর মুখোমুখি, মায়ের মুখ দেখতে পাচ্ছি, শিশুটি নিচের দিকে সোজা ঝোঁকে তাকানো। হাতের কব্জি মায়ের মুঠোয় আটো হয়ে আছে, মনে হচ্ছে মা কিছু বলছে, নির্দেশের মতো, নিষেধের মতো একটা কিছু, প্রশান্ত বিরক্তিহীন মুখে, যেনো তার বিহ্বল স্বপ্ন ফুটে রয়েছে শিশুর মুখে, এমনভাবে তাকানো, বড় হলে আমাকে মনে রাখবি তো? নাকি অন্য কিছু, এতো দুষ্টামি করিস কেন, শুধু ব্যথা পাস, নাকি পুকুরের পাড়ে খেলিস না, কখন যে পুকুরে পড়ে যাস। আমি তোকে সাঁতার শিখিয়ে দেবো, তখন না হয় পুকুরপাড়ে খেলিস? কারণ ছবির জানালা দিয়ে একটা পুকুর দেখা যাচ্ছে। নাকি অন্য কিছু? কালো কালিতে আঁকা এক মা, তার শাড়ির আঁচল লুটিয়ে পড়েছে বিছানা থেকে মাটিতে, তার ব্লাাউজের ডান পাশের স্তনটা দেখা যাচ্ছে, ‘কথা শোন বাবা, ওদিকে যাসনে, সাপ আছে, কামড়ে দেবে? চুপ হয়ে বস তোকে লজেন্স দেবো, শেয়ালের আর কুমিরের গল্পটা আজকে আবার বলবো, যদি এখানে বসে থাকিস!’ এসবই না কি অন্যকিছু বলছে মা? আমি ছবিটা দেখতে থাকি, সাধারণ, কিন্তু দৃষ্টি কাড়া, ছবিটা নিশ্চয় বিক্রি হয়ে যাবে, বিক্রির জন্যইতো করা, একটা সাদা পৃষ্ঠতলে অলংকারহীন ছবি। তখনই দেখি পাশে একটা ছবি দেখছে ক্ষণমিত্রা।

‘কী খবর?’
‘ছবি দেখলে?’
‘হু’
‘ছবি দেখলে যখন, বলো তোমার কোন ছবিটা পছন্দ হয়েছে? দেখি তোমার পছন্দের ছবিটা।’
‘চলেন।’

সে আমাকে আরো চারটা ছবি পেরিয়ে নিয়ে গেলে একটা ছবির পাশে। ছবিটার দিকে তাকানো যায় না। আমার মনে হলো বিভৎস। একটা গর্ভের ভেতর ভাসছে একটা শিশু, রং খুবই ফভিক, কড়া লাল, তীব্র সবুজ, এবং হাল্কা বেগুনির আবহ জরাযুর পৃথিবীর তরল আঠালো রসের আবহ ফুটিয়ে রাখছে। শিশুটি উপর হয়ে ভাসছে। আর ব্লিডিংওয়ের একটা ধারা। ক্ষণমিত্রা কয়েকদিন ধরে ঘরে ফিরছে না। তার বন্ধুটি তাকে গ্রহণ করেনি বলে। বন্ধুটি স্বীকার করলো না বলে, আরো একটি ভ্রুণের অপচয় হয়ে গেলো এ পৃথিবীতে, ক্ষমিত্রার অনিচ্ছায়। বন্ধুটি পেলো মুক্তি। সে পেলো বিষণ্ণতা। তাকে আমার পছন্দের ছবিটা দেখালাম।
‘কেমন লাগলো?”
‘ভাল।’
‘তোমার ভেতর এখন এক শিশুর কল্পনা খেলা করে।’
ক্ষণমিত্রা মৃদু হাসলো। হাসির গা থেকে যেনো বিষণœতা কখনোই মোছার নয়।

ঋণ: শোয়েব শাদাব, কালী কৃষ্ণগুহ, সৈয়দ তারিক ও টিএস এলিয়টের কবিতার টুকরা এবং ইভা ক্যাসিডির গাওয়া একটা গানের কথা