কামরুল আহসানের প্রবন্ধ ‘মস্তিস্কের কারসাজি’
প্রকাশিত : নভেম্বর ১১, ২০২০
মাথা জিনিশটা কী আসলে? আমরা জানি, আমাদের ঘাড়ের ওপর একটা ঠুলি আছে, ঠুলির ভিতর ঘিলু আছে, ঘিলুর ভিতর গোবর আছে, সেই গোবরে কারো কারো পদ্মফুল ফোটে।
ঘিলুর ভিতর যে গোবর আছে, সে কথা বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই সত্য। তা না-হলে দুনিয়া এমন জাহান্নাম হতো না। আসলে তো আমাদের মস্তিষ্কের ভিতর কিছু রাসায়নিক সংকেত বহমান। ওই সংকেতগুলোই আমাদের দুঃখের অনুভূতি দেয়, সুখের অনুভূতি দেয়, ক্ষমতার অনুভূতি দেয়, ইর্ষার অনুভূতি দেয়— আর আমরা মনে করি ওই অনুভূতিগুলোই আমি!
এটা ভাবলে খুব আশ্চর্য লাগে, মস্তিষ্ক কীভাবে ‘আমি’ ধারণাটার জন্ম দেয়। এই ‘আমি’টাকে নিয়েই তো যতসব গণ্ডগোল। যখন ‘আমি’ বিষয়টা আসে তখনই তো আসে ‘আমার’ বিষয়টা। যখন ‘আমার’ বিষয়টা আসে তখনই আসে দখলদারিত্বের বিষয়। যখনই দখল তখনই হামলা-মামলা-মোকদ্দমা।
যাবতীয় অরাজকতা তাহলে আমাদের মাথার ভিতরেই। আমরা যদি শ্রেণিবিপ্লব না করে শুধু আমাদের মস্তিষ্কটাকে ভালো করে বুঝতে পারতাম, তাহলে হয়তো এমনিতেই পৃথিবীতে কায়েম হয়ে যেত সাম্যবাদ।
মস্তিষ্ক সম্পর্কে মানুষের ধ্যান-ধারণা অর্জনের বয়স আসলে বেশি নয়। দেকার্তই প্রথমে মস্তিষ্কের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, মানুষের সমস্ত অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার আসল মেশিন এইটাই।
এর আগে তো মানুষ আত্মা, মন-টন ইত্যাদি কিছু বিশ্বাস করত। আত্মার কথা বলে বুকের বাম পাশে হাত দিত, যেহেতু হৃদণ্ডিটা নড়ে তাই ভাবত, এটা বোধহয় আত্মাই। আসলে আত্মা বা মন বলে যদি কিছু থাকে তাহলে তো তা মস্তিষ্কেরই কারসাজি। পরকালে শেষবিচার যদি কারো হয় তাহলে তো হবে মস্তিষ্কেরই। তবে বৈজ্ঞানিক আলোচনায় আত্মা বা মনের আলাপ টেনে আনা অবান্তর। ধর্ম বা ভাবের লোক আত্মা বা মন সম্পর্কে যত কথা বলে মাথা সম্পর্কে তত কথা বলে না। এবং হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ মাথার পরিবর্তে আত্মা বা মন নিয়ে যে ঘ্যানঘ্যান করেছে তা দার্শনিক আলাপের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে।
মানুষ মাথার ভিতরে বাস করলেও সে নিজে সচেতন সত্তা হিসেবে, জাগ্রত চৈতন্য হিসেবে নিজের মাথার ভিতরে ঢুকতে পারে বড় অল্পেই। প্রথম যে-মানুষ নিজের মস্তিষ্কের ভিতরে প্রবেশ করেছিলেন আমার মনে হয় তিনি বুদ্ধ। তাই বুদ্ধ শব্দের অর্থ জাগ্রতজন। বুদ্ধ যে নির্বাণ লাভ করেছিলেন আমার মনে হয়, তিনি মস্তিষ্কের ওই বিভ্রমটা বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি মস্তিষ্কের স্বয়ংক্রিয় রাসায়নিক সংকেতগুলো থামিয়ে দিয়েছিলেন।
কিছুক্ষণ ধ্যানে বসলেই এটা উপলব্ধি করা যায় যে, মস্তিষ্ক নিজে নিজেই সচল থাকে, এবং তার খাদ্য যোগানের জন্য অযথাই ব্যস্ত থাকে। মস্তিষ্কের ওই বৈদ্যুতিক সংকেত চালানোর জন্য তার কিছু পুষ্টি দরকার হয়, সেই পুষ্টি আমরা মানে আমাদের সারা শরীর খেটেখুটে তাকে যোগায়। খেয়াল করে দেখেন, এই যে আমরা সারা দিন-রাত পরিশ্রম করি তাতে আমরা কী পাই? সবই পায় মস্তিষ্ক। নিজের খাদ্য যোগানোর জন্য সে সারা শরীরটাকে দাসের মতো খাটিয়ে মারে। সেই খাদ্য নিয়ে সে যেসব অনুভূতি বা উপলব্দির জন্ম দেয় তা বেশির ভাগই নিরর্থক। একই চিন্তা বা অনুভূতির চক্রে সে সারাক্ষণ ঘুরপাক খায়। আর আমরা ভাবি, আহ, আমার কী দারুণ অনুভূতি হলো!
এই অনুভূতি যেমন সুখের তেমন অনেক দুঃখের, অনেক সময় প্রচণ্ড ক্ষতিকরও। কারণ, যে কোনো অনুভূতিই একটা নেশার জন্ম দেয়, এবং আমরা মানে আমাদের মস্তিষ্ক সেটা আবার পেতে চায়; ফলে ভালো মন্দ যাই হোক, নিজের অজান্তে হলেও সেই একই অনুভূতি আমরা আবার পেতে চাই। তা না-হলে কেউ বাজে নেশা করতো না। মাদকদ্রব্য ছাড়াও অনেকে অনেক অনুভূতির নেশায় আসক্ত হন। যেমন প্রেমে ছ্যাক খাওয়ার অনুভূতি অনেকে ইচ্ছে করেই নেয়, এটা সে নিজেও জানে না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক