কাজী জহিরুল ইসলাম

কাজী জহিরুল ইসলাম

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা ‘শাড়ির আলমারি’

প্রকাশিত : জুলাই ১১, ২০২৪

আমার বঙ্গীয় স্ত্রীর কাঠের আলমারিতে ছ`টি তাক,
মাঝে মাঝে দেখে ভীষণ অবাক
হই এ-কারণে, ওখানে বাহিত হচ্ছে ছয় রকমের ঢেউ,
এরকম দেখেছেন কেউ
একটাই নদী, অথচ তরঙ্গে ছ`টি ভিন্ন রঙ?

সবচেয়ে ওপরের তাকে ভাঁজ করা আছে বৈশাখি তুফান এবং
সুদৃশ্য আঁচল থেকে
একঝাঁক কাঁচামিঠা আমের কিশোরী বোল ডেকে
ওঠে মাঝরাতে; উঠোনের প্রকাণ্ড ঝাকড়া ভূতিজাম গাছটিও,
যেটি আজ আমার ভীষণ প্রিয়,
রাখা আছে সবুজ পাতার আচ্ছাদনসহ এই তাকে,
যত্নে, অন্য পোশাকের ফাঁকে।

এবার দ্বিতীয় তাকে চোখ রাখা যাক,
এখানে বৃষ্টির তুমুল ক্রন্দন দেখে আবারও অবাক,
এত জল, অবিরল, ছলছল কী প্রবল বহে।
চারখানা চোখের নদীতে দোঁহে
এতকাল ভাসিয়েছি তিতাস-কীর্তনখোলা,
সাসান্দ্রা-মুরভি হয়ে টেমসের ঢেউ তোলা
বুক দূরে ঠেলে,
প্রুশিয়ান, শোনব্রুন দম্ভের বিম্বিত দানিয়ুব ফেলে,
হাডসন নদীর প্রমত্ত বুকে, একসাথে,
যৌবনের যুথবদ্ধ সংঘাতে;
সেই জল সকল স্রোতের যৌথ তরঙ্গে একত্রে একাকিত্বের ক্রন্দনবাহে
কী এক প্রবল উৎসাহে
বয়ে চলে আজ এই বিশুষ্ক কাঠের পাটাতনে।

এখানে রয়েছে ভাঁজে ভাঁজে প্রিয়তমা স্ত্রীর হাতের যতনে
কৃষ্ণচূড়ার সুরেলা সন্ধ্যা, কদমগুচ্ছের ইতস্তত চুম্বন-প্রত্যাশা,
সদ্য বিবাহিতা গ্রাম্যবালার রক্তিম ভালোবাসা।

তৃতীয় যে তাক, আলো-আঁধারির ফাঁদে দৃশ্যত খানিক অকিঞ্চন,
সেখানে নিয়ত বয়ে চলে শ্রাবণের ধারা, মাধবকুণ্ডের প্রস্রবণ।
সিরামিকের ধবল পেয়ালার মতো শারদীয় চাঁদ
হয়তো কোথাও পেতেছে গভীর কোনো জ্যোৎস্নার ফাঁদ
মধ্য তাকে, দেহের রোয়াকে, ভাঁজের গোপন বাঁকে নিজেরই নির্মিত রাতে;
আলোর মায়াবী দাগ, প্রেম অনুরাগ,
বিলেতি ফগের নিচে ঢেকে রাখা দূরের সোহাগ,
অনিচ্ছায়, অবজ্ঞায়, মুছে যায় প্রতিদিন মার্কিনি প্রভাতে।

এখানে রয়েছে আরও গুটি ধরা শেষ বর্ষার প্রস্থানোদ্যত
জলে দুলে দুলে জলকরলার সংযত
সবুজ সঘন প্রতিবাদ,
শাপলার অবারিত ভেসে থাকা জলের আবাদ,
শুভ্র শিউলির প্রস্ফুটিত নাভি থেকে কমলা-বৃত্তের চুমু তুলে
এনে ভাঁজ করে রেখেছেন এই তাকে জারুল রমণী, যাকে আমি খুলে
দেখি কোনো এক নিবিড় রাত্রির অবসরে,
তখন বোধের করমচা ফুল থোকা থোকা জ্বলে ওঠে নিশুতি অম্বরে।

চতুর্থ তাকের মসৃণ সেগুন পাটাতনে
সযতনে
জামদানি ঘুঘু বিরহের সুরমাদান ছড়িয়ে বসে আছে একা
ওর সঙ্গে ঘটে কদাচিৎ দেখা,
যদি পেয়ে যাই একসঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে বেড়াবার বৈকালিক অবসর,
যখন উজ্জ্বল উৎসব রঙে সাজে এই জুনের শহর।
ঝমঝম বেজে ওঠে সোনানি ধানের হৈমন্তী কাঞ্চিভরম,
ধানের হিঞ্জার ভাঁজে পোয়াতি কিষাণী বধু লুকোয় শরম,
এইখানে, এই সেগুন মসৃণ কাঠের আড়ালে
ধরা আছে বধুটির ধানভানা পরিশ্রান্ত বুকের লাজুক ওঠানামা, সময়ের মিহিজালে।

জবুথুবু জমে আছে শীত টিস্যুসিল্কের নরোম কুয়াশার ভেতরে পঞ্চম তাকে,
এই ফাঁকে
বলে রাখি আমি তাকে
গতকাল দিয়েছি উপাধি এক, আধুনিকা বলে,
শাড়িস্রোতের সঘন এই নিবিড় অঞ্চলে
তিনি এক বিশ্বকর্মা, সে-কথা ভাবিনি একটুও,
পঞ্চম তাকের শৈত্যপ্রবাহে সে-কথা তবুও
বিস্মৃত হইনি আমি,
কাশফুলগুচ্ছে শোভিত বেশ কিছু দামি
গাদোয়াল,
মঙ্গলগিরিও হেসে হেসে দুলছিল গোদাভরী-চম্পাবতী যুগল গাঙের সুবিশাল
তরঙ্গের তালে দুলে দুলে।

শেষ তাকে কোন ঢেউ নিয়ত আছড়ে পড়ে সেকথা বলছি খুলে,
এখানে হলুদ বউ-কথা-কও পাখনা মেলেছে কাতানের রঙে,
কত না বিচিত্র ঢঙে
পলাশের লাল, উত্তপ্ত শিমুল বর্ণমালা ছড়িয়ে দিয়েছে গল্পের সন্ধ্যায়,
সাদাকালো তাঁতের গভীরে আহা কী পরম মমতায়,
গাঁদার ইচ্ছেরা মনিপুরী বিভায় উজ্জ্বল,
বাসন্তিকা শাখে বালুচরী শিখা মেলেছে হলুদ পুষ্পদল।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৮ জুলাই ২০২৪