কাজল শাহনেওয়াজ
কাজল শাহনেওয়াজের স্মৃতিগদ্য ‘কদম পাগলা’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
পাগলা কদমশাহের প্রেমে মাতোয়ারা দিঘলী বাজারের মানুষ। নদীর পারে ঘুরে বেড়ায় নেংটা মহাজন কদম আলী মাস্তান। বর্ষাকালে লঞ্চ থেকে নাইমা কেড়ায় নৌকায় বাড়িতে ফেরে নাইয়রী। শক্ত ছইয়ের ওপর উঠে পা ভাঁজ করে বসে থাকি চঞ্চল বালক। একজনের বেশি ওপরে ওঠা সম্ভব নয়। বাকি ভাইয়েরা নিচে থেকে হাউকাউ করে। লম্বা লগ্গি মাইরা স্রোতের বিপরীতে চলার সময় চিকন খালে সামান্য ঢেউ প্যাকে গিয়া বাড়ি খায়। বৈঠা বাওয়ার ছপছপ শব্দে ছন্দের দোলা। মনে হয়, হাঁসের দল কোঁৎ-কোঁৎ করে পানি গিলতেছে।
সৃষ্টিকর্তা দেখতে কেমন? খোয়াজ খিজির দেখতে কেমন? লোকে ভাবে, কদম পাগলার সাথে খিজিরের যোগাযোগ আছে। ওনারা একই ফ্যামিলির। উনি গাঙের ঢেউরে নাচাইতে পারেন আবার শান্তও করতে পারেন। নদীতে যখন দুইশো মনি গস্তিনৌকা ঝড়ে পড়ে, বাতাসে তার মাস্তুল ভাঙে, খিজির খিজির বলে ডাকে মাঝি-মাল্লারা, তখন তাদের চোখে ভাসে কদম পাগলের রূপ। সমুদ্রের ঢেউকে যেমন পাতিলে মাপা যায় না, সূর্যের আলোরে যায় না চুলার আগুনে দেখা— সৃষ্টিকর্তার লীলা তেমন বুঝা যায় না।
পাগল বুঝা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। উনি সারাদিন থাকেন চুপচাপ। কাছে গেলে চেইতা যান— সেই মানুষের গায়ে তাজা গু লাগায়ে দেন। এইজন্য হঠাৎ কেউ কাছে যায় না। তার কেরামতি নদীর দুইপার ধরে ছড়ায়ে পড়ছে। এই তারে দেখা গেল গোয়ালন্দে আবার একই সাথে চানপুরে। সদরঘাটে লঞ্চ থেকে নামতে দেখা যায় তো আবার তারে দেখো ভাগ্যকুলে স্টিমারে উঠতেছেন। তুমি বোয়াল মাছের সাধ মনে নিয়া বললা, ‘বাবা কই বোয়াল পামু?’ বাবার মেজাজ ভালো থাকলে বলবেন, ‘যা খালপাড়ে’। সেখানে গিয়া দেখা যাবে জাউল্যা এইমাত্র বড়শি উঠাইছে বোয়াল নিয়া। বাবায় চাইলে চাকরি হয়, বাজা মেয়ের পেটে খোকা আসে।
আব্বা ও মা দুজনেই তার ভক্ত। দিঘলী আসলে খোঁজেন তারে। উনি খুব তাসের কার্ড পছন্দ করেন। কেউ পুরা প্যাকেট দিলে শিশুর মতো খুশি হন। একটা দুইটা ফিরায়ে দেন। এইগুলি তার ইশারা তাস। একটা দিলে ‘হবে না’, দুইটা মানে ‘হবে’। বাকিগুলি নিয়া খেলেন। নিজে-নিজে একা -একা কথা বলেন আর দান ফেলেন। তাসের রঙেও তার ইশারা থাকে। একবার আব্বার এক বন্ধু বিলাত যাবার আগে আব্বার মারফত এক প্যাকেট তাস পাঠান। সেই চাচা অনেকদিন চেষ্টা করেও যাইতে পারতেছিল না। কিন্তু তাস দেবার পর চাচার কপাল বদলায়।
রং মিলায়ে দুইটা তাসে ঠিকঠাকই বিলেত যাইতে পারেন উনি। পাগলরে নিয়া লোকে আজগুবি গল্প ছড়ানো শুরু করে। মার সম্পর্কে এক মামার বাড়িতে তার জন্য খানকা খোলা হয়। দিঘলী আসলে সেই বাড়িতে উনি নাকি ঘুমান। দিনে-দিনে সেই বাড়ির বাড়বাড়ন্ত! মাঘ মাসে বিরাট আয়োজন, রাতদিন গানবাজনা, খানাখাদ্দি। মানতের খাসি, গরু, মুরগি, মিষ্টি। পাতিল পাতিল খিচুরি রান্না হতে থাকে। দিনের পর দিন। জিকির আজকারে বাড়ি ভরে ওঠে। মাঘের আগেই মা চঞ্চল হয়ে যান কদম পাগলের মেলায় আসার জন্য। যে কোনোভাবেই দিঘলী আসা চাই।
মৃত্যুর পর তার ওফাতের দিন ওরশ শুরু হয়। যদিও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারতো না, কবে কোথায় মারা গেছেন। সবাই দাবি করতো, স্বপ্নে নাকি দেখেছে তার মৃত্যু। একদিন উনি হাঁটতে-হাঁটতে পদ্মার ভিতরে চলে যান। দেখা গেল, পানি দুই ফাঁক হয়ে গেল ধীরে-ধীরে, আর উনি সেখানে ঢুকে গেলেন। পাগল যেন নদীতে হারায়ে যেতে-যেতে গান গাইতেছিলেন, ‘পদ্মার ঢেউরে মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়া যা-আ-রে…’ আর নাচতেছিলেন।
বিভিন্ন খানে তার গায়েবি মাজারের ওরশ। সবাই যেন জানতো, একদিন কদম আলী মাস্তান ফেমাস হবে। মৃত্যুর পর তার আদি মাজার পদ্মায় ভেসে যাবে। তারপর হবে অনেক অনেক মাজার। সারা বিক্রমপুর জুড়িয়া। কদম পাগলা যদি কামেল হবে তবে তার কবর নদীতে ভাইঙা গেল ক্যান? একথার কোনো উত্তর কারো জানা নাই।