কাজল শাহনেওয়াজের গল্প ‘রোরো চশমা’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২০

শেষপর্যন্ত চোখের ডাক্তারের কাছে গেলাম। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি সমস্যা? বললাম, আগের মতো দেখতে চাই না। লোকটা যন্ত্রপাতি লাগাতে লাগাতে বললেন, আগে কি দেখতেন বলেন তো। আমি বলি, আগের দিনগুলি দেখতে চাই না, পুরান দিন দেখলে জ্বর জ্বর লাগে, রাতে ঠিকমতো হজম হয় না। সে বলে, দূরের জিনিস ঠিক দেখেন? বয়স কত হৈল? মাথায় চোট পাইছেন কোনোদিন?

দুই চাইর বার ধমক দিয়া বললেন, আজকাল অনেকেই এই সমস্যা নিয়া আসতেছে। পরীক্ষা করে কাগজ ধরাইয়া দিয়া বললেন, আপনার তো বেশ পাওয়ার লাগবে। কাছেও ঠিকমতো দ্যাখেন না, আবার পুরান দিনের অসুখ— চোখের প্রেসারও তো হাই। সাবধানে থাইকেন, মাঝে মাঝে চশমা বদলাইতে হৈবো!

বিকালে ‘দৃষ্টিদান’ নামক চশমার দোকানে যাই। দেখি একটা লোক, খুব চিনা চিনা লাগলো। বললাম, কি ভাই, ভালো? একটা চশমা দেখান তো। এই যে কাগজ। পুরান দিন দেখতে চাই না আরকি।
পুরান দিন কি আর দেখবেন রে ভাই, পুরান মানুষরা কি আর দুনিয়ায় আছে? সেই সব চশমার ফ্রেমও নাই আজকাল, কোম্পানি সব বদলাইয়া গেছে। গোল্ড নাই, সেই দামে প্লাস্টিক খোঁজে। কী যে ভাত খাইতেছি!
কেন, বেশ তো চিকন।
আর চিকন, সব ডিটারজেন্টে ধোয়া, কোনো গন্ধ নাই, স্বাদ নাই।
লোকটাকে বেশ ভালো লাগলো। বললাম, কাক্কু, আপনার মাথায়তো দেখি টুপি লাগাইছেন, চুল নাই?
ওসমান কাক্কু একবার হতাশ ভঙ্গি করেন, পুরান দিন আর নাই, মাথায় চুল থাকলেও পইড়া যায়, খালি পাকে। দেখেন না কত কালার।

বুঝলাম, কাক্কু অনেক গল্প জানে। তার মুখের ভিতরটা খুব উথাল পাথাল করছে। দোকানে আরো ক্রেতার আগমনে আমার ধ্যান ভাঙলো। অগ্রিম কিছু টাকা দিয়ে বের হয়ে আসলাম। মনে মনে বলি, আবার আসবনে।
নতুন চশমার উত্তেজনা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আগে বুঝি নাই, দিন চারেক আগে চোখে লাগানোর পর বুঝলাম, আরে একি ব্যাপার, এতদিন তো কাছেও ঠিক মতো দেখি নাই। আমার ধারণা ছিল, সবাই শুধু দূরেই দেখে না। তার জন্যই চশমা। মনে মনে দ্বিধায় পড়ি, আমি কি শুধু আগের দিনগুলিই দেখতে চাই না? নাকি কাছের দিনগুলিও?

বেশ টলোমলো লাগতেছে হাঁটতে চলতে। আমার দাদার বাড়ি ছিল বিক্রমপুর, লৌহজং। দাদাদাদি চির বিশ্রামে যাবার আগে সেখানে যাওয়া হতো। বর্ষায় গেলে কেড়ায়া নৌকায়। ছৈএর ভিতর হাঁটাহাঁটি করলে পুরা নৌকাটাই টলটল করতো। চশমা পরার পর সেরকম লাগতেছে। মনে হচ্ছে, ঢাকা শহর ছেড়ে বহুদিন আগের ৭১ সনের গ্রামে চলে গেছি।

পাশ দিয়ে দুজন মহিলা বকবক করতে করতে যাচ্ছিল, বুঝছেন তো অরা বাইরে গেঞ্জি পরে, পায়জামা পরে, প্যান্ট পরে। আমাগে মতো শাড়ি না। হাঁটতে কুনো অসুবিধা নাই।
হ, ছিলা কলা বোঝেন? ছিলা কলা রাইখা দেন, কেউ হাত বাড়াইবে না। পর্দা করলে, বোরকা পড়লে সবার চোখ নিসপিস করবে কলাটার জন্য। এইটাই জগতের রীতি।
প্রথম জন বোরকাঅলি, দ্বিতীয় জন জামাপাজামা পরনে।

নতুন চশমায় আমার জগৎ যেন একটু দরজা ফাঁক করল। যা দেখছি তাতেই আনন্দ পাচ্ছি। ঝকঝকে মনে হচ্ছে। স্বাধীন মনে হচ্ছে। যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম বাসা থেকে, রাস্তা ভুলে অনেকদিন পরের বাড়িতে ছিলাম, ব্যাটারি ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম। সারাদিন কালো কালিতে হাতপাবুকমুখ অন্ধকার করে ঘরে ফিরে দেখতাম পানি নাই। বাড়িঅলি এক বালতি পানি ধার দিলে কয়েকজন মিলে মুখে ঝাপটা দিয়ে খেতে বসতাম। আজ বাড়ি ফিরে এলাম। ইচ্ছামত গরম পানিতে সাবান শ্যাম্পু লাগিয়ে কালি ধোবার দিন আজ। ঝকঝকে হবার দিন।

দিন পাঁচেক পর ট্রেনে চড়লাম। ট্রেন যে এত বদলে গেছে খেয়াল করি নাই। যার যার সিট নম্বর আছে, কেউ কারো সিট দখল করে না। আসার সময় বৌ বলেছিল, ট্রেনে খাবার জন্য কিছু নিবা? আমি তিন কোনা খাবারের কথা বলতেই গভীর হাসি দিল। ট্রেনে উঠে দেখি, কত রকমের খাবার! কত রকমের ব্যাগ বোচকা মানুষের হাতে। কত রকমের নজর কারা! কত চমৎকার করেই না কত রকমের জুতা, জামা, টি-সার্ট, বেল্ট, সানগ্লাস পড়েছে। মেয়েরা কত সাবলীল, ছেলেরা কত দুষ্টুই না হয়েছে। তাছাড়া ট্রেনটাও বেশ সাজানো গোছানো। এক কামরা পরিষ্কার পোষাক পরা ভ্রমণরত সমাজ। ভালোই লাগল নিজেকে নিরুপদ্রব দেখে।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, দ্রুত, প্রায় আগের মতোই বাইরের দিগন্ত ভিতরের ঘটনা দিগন্তকে কেন্দ্র করে পরিধিতে ঘুরে চলে যাচ্ছে। বাল্যকালের দৃষ্টি! দেখে মনটা আনচান করে ওঠে। চশমা পাল্টানোর মাসখানেক আগে থেকেই দিনগুলি অস্থির যাচ্ছিল মনে পড়ে। কিন্তু তাতে কি, এখন তো ভালো লাগছে!

নতুন চশমার উত্তেজনা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। চোখের শক্তি এত হারায়ে গেছিল, আগে বুঝি নাই। অনেক দিন পর একা একা ভ্রমণে। আঞ্চলিক ট্রেনের অনেকের ভাষাই একরকম। তাই ভাষাজনিত আড়ষ্ঠতা নাই। সবাই সবার সাথে বিনা ভূমিকায় কথা বলছে। একজন তালা বিক্রেতা আমার সামনের যাত্রিকে জিজ্ঞেস করল, আপনেরার বাড়িত এবার গরম কেমন?
তোমরার মতোই। তা এত গরমের খবর ক্যান? বোরোর ধানের খবর নিতে পারো না?
না, গরমে তো মাইনষে ঘর খোলা রাইহা ঘুমায়, এই সময় তালার বেচা বিক্রি বালা থাহে না...
লোকটার প্রতিভায় আমি মুগ্ধ। আমাকে একজন চিনে ফেলল। মনে হল আমিও তার মুখ চিনি।
ভাইজান বালা আছুইননি?
হ্যাঞ ভালা, ঈশ কত দিন পর দ্যাখা, ভালা তো? আমি অকৃত্রিম বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠতে চাই।
না না, গত ঈদেই তো দেখা হৈলো, মনে নাই, ঐ যে ভাভিদের নিয়া ট্রেনে বৈসা ছিলেন! ভাভি ভালা তো? এখন মনে হয়, নাহ, এ লোকটাকে তো কখনো দেখি নাই। ‘ওহ না, এইতো...’ বলে মিনমিন করে কিছু একটা বলে কিছু একটা বোঝাতে চাই। পুরানো দিনগুলি সত্যি কেমন অস্পষ্ট ছিল, কাউকেই আলাদা করে দেখতাম না, কারো মুখই স্পষ্ট মনে নাই।

ট্রেন বেশ আরামদায়কই লাগছে। বাসের মতো কোনো চাপ লাগছে না। সন্ধ্যা নামলো। রাত নামছে। দিনের অনেক তাপের বাতাস কমে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। বাইরের মানুষের চেহারাগুলি আর দেখা যাচ্ছে না। বাইরে হঠাৎ দেখি পূর্ণিমার দুতিন দিনের পরের চাঁদ মিটির মিটির করে উঠছে। একেবারে উঠে গেলে কামরার ভিতরকার আলো অসহ্য লাগবে। প্রায় নিখুঁত এই চাঁদটা আজকে রাতটা জ্বালাবে বোঝাই যাচ্ছে। এখনই মনে হচ্ছে যাচ্ছি তা কোথায় জাচ্ছি, অন্তস্থ ‘য’ থেকে বর্গীয় ‘জ’ য়ে জাচ্ছি, মাঠের বুকের ভিতর দিয়ে, পুরাতন ব্রক্ষ্মপুত্রের পেটের ওপর দিয়ে... কতদিন পরে যাচ্ছি... আমার চশমার ভিতর দিয়ে... আমার চোখের মন খুলে... আমার কতদিনকার বিগত অন্ধত্বের বাইরে...

কোনো এক স্টেশনের কাছে এসে একটু থামতে গেছিল আমাদের ট্রেনটা, হঠাৎ মনে হলো, চাকাগুলির মধ্যে যেন একটা গোলযোগ লেগে যাচ্ছে। কে কার আগে যাবে সেই রকম হুড়াহুড়ির শব্দ। কামরাদের মধ্যেও ভারি একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। কে যেন যতজোরে সামনে টানছে তো আবার পরক্ষণেই হরাশ করে পিছনে ধাক্কিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এরকম কিছুক্ষণ চলতে থাকার পর ব্যাপারটা ভয়ংকর হয়ে পড়ল। আমাদের বগীর ভিতরে একটা বড় ধরনের ওলট পালট হয়ে গেল। কে কোথায় গেল তার কোনো ঠিকঠিকানা রইল না। ব্যাগ বোচকা ফেলে মানুষগুলি আতংকে ও আঘাতে মৃত্যুকে যেন আশপাশেই দেখছে। চিৎকার করলো এবং যে যেভাবে শুরু করেছিল সে ভাবেই চালিয়ে গেল। যদিও হঠাৎ করেই ট্রেনটা আবার ঠিকমতো চলতে থাকল। রেল লাইনের ওপর শৃঙ্খলা ফিরে এলো।

আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম মেঝেতে। আমার নতুন চশমাটাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ট্রেনের বাতিটা নিবে গেছিল। প্রায় সবাই বিধ্বস, বিহবল, পাগল পাগল ভাব নিয়ে উলটা পালটা ডাকাডাকি করছিল আর বাচ্চারা কাঁদছিল আর বড়রা রেল কোম্পানিকে ক্রোধের আগুনে পুড়ছিল। আল্লাকে ডাকছিল বারবার। আমি কোনোমতে হাতড়াতে হাতড়াতে সিটে উঠে বসি। কয়েকবারের চেষ্টায় একসময় চশমাটাকে অক্ষতই পাই। বাইরে মানুষের কোলাহল। এই সময় চাঁদটা বেশ উঠে গেছে। লোকেরা বলছিল, ‘ভীষণ বাঁচাইয়া দিছে ড্রাইভার, এইরকম ব্রেক না করলে সামনে মাল গাড়িটার সাথে এতক্ষণ যে কী হৈত!’ আমরা আবার শিউরে উঠি! হুঁশিয়ার ট্রেন ড্রাইভারের জন্য দোয়া করি ও নিজেদের জানের জন্য ছদগা মানত করি!

হঠাৎ মাথায় একটা চকিত চিরকুট ভেসে উঠল, তুমি আমার রোমান্স আর আমি একটা চ্যালেঞ্জ নিতে চাই। যত দিন আমার জীবন আছে ততদিন পর্যন্ত তোমাকে ভালবেসে যেতে চাই, তোমার কাছে বিশ্বাসী হয়ে। তুমি কি আমাকে একটু প্রতিশ্রুতি দেবে না?

গতকালই কেউ একজন অচেনা সেলফোন ব্যবহারকারী আমাকে এই কথাটা লিখে পাঠিয়েছে। আজ কিছু একটা হয়ে গেলে প্রতিশ্রুতিটার কি হতো? ভাবতেই ভীষণ চাঙা হয়ে গেলাম। নাহ, সামলে নিতে হবে! ব্যাগ ট্যাগ কোথায়?

চশমাটার আগে বুঝতে পারি নাই এত সুন্দর ফল, সুন্দর ফুলগুলা পৃথিবীর পথে পথে ছড়ানো। খালি পুরান দিন দেখতে দেখতে সব সাদা কালো ফ্রেম... কেবল বিগত লালের ইশারা ছিল আমার প্রাণে! আজ একবার বেঁচে গেলাম বলে, মনে হচ্ছে আরেকটা মৃত্যুকে পার হয়ে আসিলাম। মধ্যরাতে শেষ স্টেশনে নামার সময় দেখি মাথার উপর মফস্বল শহরের চাঁদটা সব কিছু দখল করে নিতে চাইছে।

গত বেশ কিছু দিন ধরেই আমার বৌকে দেখছিলাম খানিকটা করে অন্যমনস্ক। শে তো এরকম থাকে না! কি হয়েছে তার? সরাসরি জিজ্ঞেসও করা যায় না। মানে তার আর কোনোখানে সেই ছাপ পড়ে নাই। ঠিকমত খাচ্ছে দাচ্ছে, অফিস যাচ্ছে। রান্না করছে। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছে, অভ্যাগতদের সমাদর করছে। কোথাও কোনো ছন্দপতন নাই। কিন্তু টুকটাক অন্যমনষ্কতা টের পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ আমাকে আদর কর্তে চাচ্ছে, যা আমরা সাধারণত করি না। মানে দম্পতিদের আবার রকম সকম করে ভাব বিনিময়ের তেমন দরকার পড়ে নাকি? কিন্ত ও যেন ভালবাসা শিখছে। আমরা কেউ কারো মোবাইল ফোন ধরি না। নিতান্ত ব্যালেন্স ঘাটতি বা কারো নম্বর দেখতে না হলে। একদিন ওর মোবাইলে একটা ফোন কর্তে গিয়ে, ও তখন বাথরুমে না কোথায়, দেখি কে যেন খুব একটা একান্ত ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়েছে ওকে, তবে ভাষাটা কেমন যেন শক্ত, নিষ্ঠুর। মনে হচ্ছে আরেকটা বার্তার উত্তর। কৌতূহল হলো, আগের বার্তাটা কি? পাঠানো তালিকা থেকে সেটা বের করে দেখি বেশ স্যাঁতস্যাঁতে একটা বার্তা। কান্না কান্না অভিযোগ, কেন ভুলে যাচ্ছে? খানিকটা থমকে গেলাম। ব্যাপারটা কি? এত ভুলে যাওয়ার কথা উঠলো কেন? তার পা আবার এত দাবি? গত কয়েকদিনের চিরকুটগুলি তখনো ছিল! অন্যায় হলো যদিও, তবু পড়ে দেখলাম। একটা সম্পর্ক ছিন্ন হবার গল্প বেশ বোঝা যায়।

আমি খানিকটা বিমুঢ় হয়ে পড়ি। আরে ব্যাপারটা কি? আচ্ছা এখন যদি ওকে জিজ্ঞাস করি এসব কি, ও কি কিছু বলবে? কিন্তু কেমন বাঁধো বাঁধো লাগে। আমাদের এত দিনের সংসার, কাউকে সন্দেহ করার ভাষা তো কখনো দরকার হয় নাই। তাহলে কিভাবে কথা বলি? অভিযোগ করবো? এহ একদম সম্ভব না। এই মধ্যবয়সে কেউ কি অভিযোগ করে? না কি ঝগড়া করব? বাসায় ছেলেমেয়েরা রয়েছে, ওরা তো শুনবে। ওদের মায়ের সাথে কি ঝগড়া করা উচিত? তার আগে তো আমাদের নিজের নিজের হিসাব করা দরকার।

একদিন যায়। দুইদিন যায়। দেখি আমার চির স্বাভাবিক বৌ সত্যি সত্যি হতাশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। একটা ম্লানতা ওকে খেয়ে ফেলছে। ওতো নিশ্চয়ই জানে না আমি কিছু একটা আঁচ করতে পারছি। মনে হচ্ছে তো ও ওর জীবনের প্রথম বিরহে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এভাবে কত দিন যাবে? একবার ভাবি, ওকে কিছু একটা জিজ্ঞাস করেই ফেলি। আবার একটু হোচট খাই। ব্যাপারটা কি এরকম, যে, আমাদের একটা শূন্যতা ছিল। যদি তাই হয় তাহলে আমি কি এর সাথে জড়িত হয়ে পড়ছি না? আমি কি নিজেকে এর মধ্যে জড়াবো? ওকে কিছু বলা হয় না। আবার সন্ধ্যার দিকে ও যখন অফিস থেকে ফিরে এসে প্রতিদিনের মতো রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ক্লান্তি নিয়েই, আর ওকে দেখাচ্ছে হতভাগিনীর মতো, আমার ভিতরে ভ্রাতৃভাব তৈরি হলো। মনে হলো আমি ওর বড় ভাই, ওর ব্যথা আমাকে কাবু করছে। কিন্তু তাও কিছু বলা হলো না।

এ সবই আমার চশমা নেবার আগে। আমার তো আমার মতোই চলছে। কিন্তু কি যে ঝামেলা হলো। আস্তে আস্তে আমি একদিন দেখলাম আমার রাগ হচ্ছে। এটা তিন কি চার দিনের দিন। ও পাইছে কি? এই বুড়া বয়সে প্রেম করছে মাইনা নিলাম, তারপর ছ্যাঁক খাইছে তাও মাইনা নিলাম কিন্তু এই রকম বিরহ বেদনা যে আর সহ্য হয় না। বাসাটারে কি রকম বিচ্ছেদ গানের আসর বানাইয়া ফালাইছে। যখন তখন নতুন নতুন খাবার দাবার নাই। সারাদিন ওর অফিসে কি হৈল সে গল্প নাই। অফিসের ফোনে দুনিয়ার মানুষকে বিনা পয়সায় ফোন করা নাই। তাই বিকাল থেইকা ঘাড় গরম কইরা বইসা থাকি। রাত্রে ভাত খাই না। কথার জবাবে কথা কই না। খালি হা হু করি। রাত যখন একটা, সব কিছু অতিষ্ঠ, ও এমনিতেই শুকাইয়া ছিল, এতক্ষণে একেবারে জেলিফিস!
বলে, কি হৈছে তোমার?
আমি কই, তোমার কি হৈছে? এই কথা ২০-৩০ বার বলার পর ঝরঝর কৈরা ভাইঙ্গা পড়ে। আমিও বড় ভাইয়ের মত সব শুনি ও এমন ভাব করি যে একটা বিরাট ঘটনা হৈছে।
ও বলে: এখন কি হৈবো? বলো কিছু।
আমি বলি, বলবা তো তুমি। বলো কি করতে চাও। এমন ভাবে বলি যে ওর অন্তরাত্মা কাঁপে। ও বলে আমি ভুল করছি। আর কান্দে!

যাই হোক এর পর কয়দিন আবার ধুমধাম কৈরা আমরা প্রেম করি। বুড়া বয়সে যেমন হয় আর কি। খানাদানা, বেড়ানো। বাচ্চাদের জামাকাপড় কেনা। টিভিতে নাটক দেইখা হাসা। কিন্তু আমার যে ভিতরে ভিতরে গলা শুকাইয়া যায় এইটা টের পাইলাম চশমাটা নিবার পর। পুরান জিনিস মনে করতে চাই না ঠিকই, কিন` কি যেন কি হয়। বুক জ্বলে, পেট ফাঁপে। মুখে বলি এসিডিটি। গ্যাসের প্রকোপ। আসলে যে কি তাকি জানি না! বারে বারে মনে হয় কোথায় একটা শূন্যস্থান তৈরি হৈছে! আমার অজান্তে এটা কি ভাবে হৈল? এতো হাসি খুশির ভিতর কবে হৈল? যখন হৈল টের পাইলাম না কেন? তাইলে কি ও বেশ অভিনয়ও শুরু করছে?

মফস্বল শহরের সাথে চাঁদের সম্পর্কটা ভাইবোনের মতো। আমার এসিডিটি ফেসিডিটি শুরু হইবার পর হঠাৎই একদিন বুক ব্যথা হয়, তীব্র। আমি জানি এটা তেমন কিছু না। তবে সবাই বললো ছুটি নাও, বিশ্রামে থাক। বললাম, ঠিক আছে, বিশ্রাম নিব, তবে ঢাকা থাকব না। যদিও ছেলেমেয়ে তিনটাকে স্কুলে আনা নেয়ার ঝামেলা হবে, বাজার করা ইত্যাদি ইত্যাদির রুটিন ওলট পালট হবে; কিচ্ছু করার নাই। আর কোথাও গেলে একা যাব। তাই যাচ্ছি। যেখানে রাত আটটা নয়টা বাজত কিশোরগঞ্জ পৌঁছতে, সেখানে এখন মধ্যরাত।

শহর ঘুমিয়ে গেছে। রিকসাচালকেরা শেষ যাত্রি নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। আমি ঠিক করতে পারছি না কোন রাস্তা দিয়ে যাব। স্টেশনের সামনে রাস্তাটা বেশ নতুন করে বানানো হয়েছে, দুদিকেই যাওয়া যায়। বাম দিক দিয়ে গেলে মনিপুরঘাটের ব্রীজ দিয়ে যেতে হবে। ডান দিক দিয়ে গেলে নিউটাউন হয়ে বড় বাজারের ব্রীজ। এই শহরের যে কোন দিকে যেতে হলে নদী পার হতে হয়, ব্রীজে উঠতে হয়। মৃত নদী, নরসুন্দা। আচ্ছা এত রাতে কি বাসায় গিয়ে ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে?

একটা তরুণ আমাকে রিকসা করে নিয়ে যাচ্ছে। খুব জোরে চালাচ্ছিল, বললাম আস্তে যেতে। সোজা পথে চালাচ্ছিল, বললাম ঘুরপথে যেতে। কিছুক্ষণ গিয়ে গন্তব্য বদল হল। ছেলেটা কিছু বলছিল না, তারপর বলল: কই যাইতে চান? আমার মাথায় নানা বন্য পরিকল্পনা কাজ করতে চাইছে। ওকে প্রস্তাব দিলাম: চালাইতে থাকো না! বেশ আমুদে ছেলে। আমার দিকে না তাকাইয়া সে একটা কাঁধ ঝাকানি দিল: আইচ্ছা চলেন!

আমরা এদিক সেদিক চললাম। এ মাথা থেকে ও মাথা। উত্তর থেকে দক্ষিণ। নদী ধরে ধরে, অলিতে গলিতে, পুকুর পাড় ধরে, বদ্ধ দোকানপাট, রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড পাশে রেখে ঘুরপাক খেতে লাগলাম। চশমাটা পরীক্ষা করতে শুরু করলাম, দেখি পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে কিনা! চশমাটা কতটা নতুন? দোকানের লোকটা বলেছিল, শুধু চশমাটা কিন্তু কিছু পারবে না। আপনাকে নতুন নতুন মানুষের কাছে জাইতে হবে। অচেনা কিছুর সামনে পড়তে হবে। তাইলেই দেখবেন এর কেরামতি। আর আমি কিনা পুরানো জায়গায় এসে পরীক্ষা করছি!

এক সময় দেখি শহরটা প্রায় আগের মতই আছে। তেমন বদলায় নাই। তাহলে কি এতএত কালো টাকার ছিটে ফোঁটা এই শহরের গায়ে লাগে নাই? এক দিকে তা ভালই হৈছে। চাঁদটা বেশ পশ্চিম দিকে নামছে। বাড়ি ঘরের ছায়া লম্বা হচ্ছে, সামনের উঠান আরো রহস্যময় করে ফেলছে। তার মধ্যেই দেখি প্রায় প্রতিটা বাড়ির সামনে নতুন নতুন কবর জায়গা করে নিয়েছে। এসব তো আগে দেখি নাই? শোলাকিয়া দিয়ে যাবার সময় মনে হল এইটা আমার বন্ধু সৈয়দের কবর। নিউটাউনে যেন দেখা হল আবিদের কবর। আরেকটা কবর যেন মুস্তফার। আরেকটা যেন নাসিমের। সারা শহর যেন এই প্রতিপদের চাঁদের রাতে পসরা সাজিয়ে বসেছে প্রিয় মানুষদের শেষ শয্যা নিয়ে। শহরের এক প্রান্তে এসে দেখি আমার পুরানো দিনের প্রাণের সখা, শুয়ে আছে শিউলি ফুলের বিছানায়। আমাকে দেখে শে একটা কপট রাগ দেখিয়ে বলে, আমাকে দেখতে এলে! আমি লজ্জায় এতটুকু হয়ে যাই। কই আমি কখন তো আসতে চাই নাই তোমাকে শুয়ে থাকতে দেখতে! তোমার এই ব্যক্তিগত জায়গায় জানি যে, কারো কোন জায়গা নেই আর। কিন` আমার বুক ক্ষয় হয়ে যেতে থাকে, আমি থমকে যাই। একটু দাঁড়াই।

রিকসার ছেলেটা আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। শেষ রাতের একটা ট্রেন হু হু করে চলে যায়। আমি কবরটার পাশে গিয়ে একটু দাঁড়াই। হাত দিয়ে চারপাশটা পরিষ্কার করতে চাই। ও খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলে: কি, উঠে আসবো নাকি? একবার মনে হয় বলি: ঠিক আছে চলো রিকসায় ঘুরি! ছেলেটা খুব ভাল, দেখো না কেমন ঝাকড়া চুল ওর। ও তৈরি হয়ে এলে একটা সুফিলাল রঙের বিড়াল আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। চল। আমরা চলতে শুরু করি। শহরের আরেক প্রান্তে শ্মশানের কাছে গিয়ে দেখি খুব সুন্দর করে দেয়াল হয়েছে, তবে অনেকটাই ছোট। পাশে একটা চিকন নদী মতো ছিল, তা প্রায় অদৃশ্য। আমার খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছা করে। কতকাল আগের সিগারেট খাওয়ার কথা মনে হয়। শ্মশান বন্ধুদের ছাউনিতে বসে ভাবি আজ কি গোস্বামি এখানে আছে? আমি বিড়ালিনীকে বলি: তোমার পাখিটা আমি বহুদিন হল খুঁজে পাই না। তুমি কি জান ও কোথায়? ও বেশ বিড়ালদের কায়দায় হেসে হেসে আমার সাথে ফাজলামি করতে লাগল। আমি বললাম: দেখ আমি নতুন চশমা লাগাইছি। ও বলে তোমার সব চশমাই নতুন, এ আর নতুন কি? কত ঢং দেখাইবা। আমি বলি এইটা আমার বৌ বলছে লাগাইতে, ভাল হৈছে না? আর পুরান দিন দেখতে হবে না। ও হি হি করে হেসে আমাকে খামচাতে চায় ওর আলোর মতো নরম নখগুলি দিয়া। কত দিন পর ওর স্পর্শ! আমি তাকাইয়াও দেখিনা ওর চোখগুলি জ্বলে উঠল কিনা। চোখ বুঁজে ওর গরগর শব্দশুনি। মনে হয় আমার পার্থিব কানে ওর অপার্থিব থাবার গান বেজে উঠছে।

পুরানো জায়গায় এসে সবার সাথে দেখা হল। আর সকাল থেকেই আমার মোবাইল বন্ধু চিরকুট পাঠাতে লাগল, ‘প্রজাপতি জানে না তার পাখনাগুলি কেমন রঙিন, কেবল মানুষ জানে শে কতো মনোহর। তুমিও জানো না বন্ধু তুমি কেমন, ... কেবল আমিই জানি তুমি স্পেশাল।’ আমি হো হো করে হাসতে হাসতে গরম খিচুরী খেতে থাকি। এই অজানা মহিলাটি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে আমাকে আনন্দ দেবার। কারণ তার ধারণা ফোনে আমার কথা বলার ভঙ্গি কোন খবর পড়ুয়ার মতো। তারপর শে বলে শে এখন ঘরে থাকতে থাকতে মোটা হয়ে যাচ্ছে, তাই কথা বলে ব্যস্ত থাকতে চায়। গত কয়েক দিনে শে আমাকে ফোন করে শ’পাচেক টাকা খরচ করেছে, কিন্তু বুঝতে পারছি না আমার নম্বরটা কোথায় পেল? আমার বৌ কি তার কোন চেনা মানুষকে দিয়ে দুষ্টামি করাচ্ছে? যাই হোক একেবারে খারাপও লাগছে না। কারো না কারো সাথে তো একেবারে বানানো কথা বলতে ইচ্ছা করে, নাকি? একেবারে অর্থহীন কথা, অদরকারী কথা! সেই ১৮/১৯ বছরের মত? বানিয়ে বানিয়ে নীল ধানখেতের পাশে বসে গেরুয়া রঙের আকাশে পাখিদের জেটপ্লেন ওড়াতে? আমার সদ্য বান্ধবী আবার একটা বড়দের খুচরা জোক পাঠাল। আমি পুরানো জায়গায় এসে এই নতুনের কথা ভাবছি, তখন সেই বিড়ালিনী এলো।

ওর চোখদুটি অপরাজিতা ফুলের মত নীল আর বাইরে ঠিকরে আসা। আমার মুখোমুখি তাকালো। এই প্রথম। একটা লাল রঙের রোয়া রোয়া দেহের ভিতর থেকে একজোড়া লেজার জ্বলজ্বলে চোখ। সোজা আমার চোখে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে একটু থতমত খাই। তরিঘরি করে বৌকে ফোন দেবার চেষ্টা করি। কিন্তু ওর ফোন বারবারই ব্যস্ততা দেখায়। আবার কি কাউকে ফোনে পেয়েছে? বেড়ালটা আমাকে কামড়ায় না। আদর ও করে না। কেবল সামনে বসে তাকিয়ে থাকে আর নি:শব্দে গরগর করে। আমি নতুন পাওয়া নম্বরটাতে চেষ্টা করি। একবারেই পেয়ে যাই। যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। আমি যাই বলিনা না কেন দেখি শে গোগ্রাসে আমার কথা খেতে থাকে। যেন তার খুব খিদা পেয়েছে। আমি যা বলি তাই যেন তার কাছে বিরিয়ানি। তাকে কি বলব আমার বিড়ালটার কথা? শে কি বুঝতে পারবে! একটু দ্বিধা হয়।

সেই সকালগুলি আমার মনে হল, মনে পড়লো সেই দুপুর ও বিকালগুলির কথাও। যখন একটা পাখি আমাকে একদল পাখির ভিতর থেকে আলাদা হয়ে দেখিয়ে ছিল তার পেখম তোলা দুপুর ও বিকাল। আজ সেই পেখমটার কথা খুব মনে পড়লো।