কাউসার পলাশের ভ্রমণগদ্য ‘শাদা পাহাড় অভিযান’
পর্ব ৪
প্রকাশিত : জুন ১০, ২০২২
এদিকে আমার ফোনের ক্যামেরা চলমান। যদিও আমি ফোনের ক্যামেরার ওপর চরম লেভেলের বিরক্ত। বারবার বলছিলাম যদি জানতাম যে, এতটা ভয়ংকর সুন্দর হবে তাহলে আমি হয়তো আগে ভালো একটা মোবাইল বা ক্যামেরা কিনতাম, তারপর এখানে আসতাম। নেক্সট টাইম আগে এটাই করতে হবে।
অনেকক্ষণ রেস্ট করার পরে আমি উঠে দাঁড়ালাম, এবং কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। এরই মধ্যে আমাদের সামনে একটা ব্লাক পিক করে আসা ফিরতি টিমের ক্যাম্প দেখা গেল। আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরে তাদের টিম মেম্বারদের একেকজনের চেহারার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বরফের অত্যাচারের ভয়ংকর ছাপ স্পষ্ট হতে লাগলো।
তাদের থেকে আমাদের গাইড জেনে নিলেন, ওপরের আবহাওয়ার অবস্থা খুব একটা ভালো না। তবে আশা করা যায়, যে কোনো মুহূর্তেই ভালো হতে পারে। আমরা হাঁটতে লাগলাম, গাইড দ্রুত সবার সামনে চলে গেলেন। তিনি একটা জায়গায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমি ছবি তুলতে তুলতে সামনের দিকে যাচ্ছিলাম।
বাম পাশে অনেক দূরের পাহাড়ের বুক ট্রেইল ধরে হারকিদুন যাওয়ার মুসাফিরদেরকে দেখা যাচ্ছিল। মানুষ ও গাদাগুলাকে পিঁপড়ার মনে হতে লাগলো। দূর পাহাড় থেকে এরকম দৃশ্য বেশ উপভোগ করার মতো ছিল। গাইড আমাকে নিচের দিকের জংগলের ভিতর দিয়ে নদীর পাশঘেঁষে এগিয়ে যাওয়া একটা রাস্তার দিকে ইংগিত করে সে পথে এগিয়ে যেতে বললেন।
তার কথামতো আমি দ্রুত নেমে যেতে লাগলাম। এখানে নামতে গিয়ে খেয়াল করলাম, এই প্রথম কোনো একটা পথ পেলাম যেটা আমাদের বান্দরবানের রাস্তার মতো কোনো পাথুরে ভাঁজের মতো সিড়ি করা নাই। এখানের প্রতিটি উঁচু নিচু পথেই ছোট ছোট পাথর দিয়ে ভাঁজ করে সিঁড়ি করে রাখা, যাতে করে কারো ওঠানামায় কোনো কষ্ট না হয়। সিঁড়িগুলা এমনভাবে করা যেগুলো আমাদের দেশের বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির তুলনায় হাঁটা অনেক সহজ।
দেখেই বুঝা যাচ্ছিল, এরকম গহীন পাহাড়ের মাঝেও তারা যেহেতু ট্রেকারদের জন্য এত দারুণ ব্যবস্থা করে রাখছে পারছে, তাতে করে এটা স্পষ্ট যে, তাদের সরকার টুরিস্টদের নিয়ে কতটা চিন্তা করে। অন্যদিকে আমাদের দেশের অবস্থা কতটা ভয়ংকর! এমনকি তাদের ট্রেইলগুলা এতটা চমৎকার ভাবে বানানো যেখানে নতুন কেউ কখনো হারাবে না।
আমি নামতে নামতে নদীর দিকে এগিয়ে গেলাম। সামনে গিয়ে আরো অবাক হলাম, নদী পার হওয়ার জন্যও সেখানে কাঠ দিয়ে দারুণ ব্রীজ করে দেওয়া। অথচ তাদের পাহাড়ের ট্রেইলে সবুজ ঘন জংগল থেকে একটা গাছও তারা কাটে না। তারা কেবলমাত্র সেই গাছটা কাটে যেটা মরে গেছে বা বাতাসে পড়ে গেছে। টুরিস্টদের জন্য তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম আর আমাদের নিজেদের সাথে তুলনা করছিলাম।
ট্রেইলের কোনো জায়গায় কোনো প্লাস্টিকের বর্জ্য নাই। আহা, কী দারুণ সচেতন এই প্রদেশের মানুষ। আমি ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে কুকার অংকিত ভাইকে দিয়ে আমার কিছু ছবি তুলে নিলাম। এর মধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে অংকিত ভাই দ্রুত সামনের দিকে চাইলেন। আমি বললাম, আপনি যান। আমি এখানে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় একটা পাথরের নিচে আশ্রয় নেব।
উনি দ্রুত চলে গেলেন। আমি পাথরের নিচে গিয়ে ব্যাগ রেখে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। নিয়ত করছিলাম, ট্রেইলে আমি এই পঞ্চ ছাড়াই শেষ করবো। যখন একদম না ব্যবহার করলেই না তখন ছাড়া এই পঞ্চ ব্যবহার করতে আমি আগ্রহী না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি থেমে গেলে আমি আবার দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলাম। সম্ভবত ১০-১৫ মিনিট হাঁটার পরেই আমাদের এজেন্সি কর্তৃপক্ষকে দেখা গেল।
তারা গাদার মালামাল নামাচ্ছে এবং আমাকে দেখে বল্লো, আজকে এখানেই আমাদের ট্রেকিং শেষ। আমি অবাক হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, বেলা ১২টা বেজে ৪৫ মিনিট। নিজেকে বিশ্বাস হচ্ছিলো না। মাত্র ১২টা বাজে আর তারা বলছে এখানেই নাকি ট্রেকিং শেষ। অথচ আমরা আমাদের দেশে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা ট্রেকিং করে অভ্যস্ত।
আমি ব্যাগ নামিয়ে একটা নদীর পাশে একটা ঘরে বসলাম। ২০-২৫ মিনিট পরেই টিমের বাকি সবাই চলে আসলো। তাদেরকে আমি জানালাম, আজকের জন্য এখানেই ট্রেকিং শেষ। এটা শুনে কেউ বিশ্বাস করছিলো না। আমরা ব্যাগ রেখে সবাই গল্প করা শুরু করে দিলাম। অল্প কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম, আমাদের জন্য খাবারও প্রস্তুত। এখানে প্রচুর বাতাস। ফলে ভয়ংকর ঠাণ্ডা লাগছিল। সবাই দ্রুত আমাদের জন্য নির্ধারিত টেন্টে গিয়ে ঢুকলাম।
আমি কিছুক্ষণ পরে আবার বের হয়ে অজু করে নামাজ আদায় করে নিলাম। তারপর আবারো ছবি চারদিকের মায়াবি রূপ সৌন্দর্যকে ক্যামেরায় বন্দি করতে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। গাইডকে জিগ্যেস করলাম, এই জায়গার নাম কি? উনি জানালেন, এটা ওয়াটার ফলস এরিয়া, সামনে ওয়াটার ফলস। চলবে