কাউসার পলাশের ভ্রমণগদ্য ‘শাদা পাহাড় অভিযান’
পর্ব ২
প্রকাশিত : জুন ০৮, ২০২২
স্থানীয় এজেন্সির মেসেজ পেয়ে আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নিমিষেই যেন সবাই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গেল! আমরা সবাই দ্রুত আলোচনা করতে লাগলাম বিকপ্ল ট্রেইলের খোঁজে। আমাদের কথা হলো, যেহেতু আমরা ট্রেনে উঠেই গেছি সুতরাং আমরা যে কোনো একটা ট্রেইলে যাবই। আমাদের পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ এজেন্সির নির্ধারিত ইভেন্ট ফি আমরা কলকাতা থেকেই তাদের একাউন্টে ট্রান্সফার করে দিছি।
সুরেশ দেব এজেন্সিকে কল দিলেন এবং সেখানে রুপিন পাস ছাড়া অন্যান্য আর কি ট্রেইলে যাওয়ার অনুমতি আছে তা জানতে চাইলেন। তারা আমাদেরকে বালি পাস এবং আরো কয়েকটা ট্রেইলের কথা জানালে আমরা বালি পাস যাব বলেই সাহস করে তাদেরকে জানিয়ে দিলাম। এর মধ্যেই আমি দেশে শরিফ ভাইকে মেসেজ করে এগুলো জানালে উনিও এটা নিয়ে চিন্তায় পরে গেলেন। শরিফ ভাইও বিভিন্ন ট্রেইলের সম্পর্কে বিস্তারিত খবরাখবর নিয়ে আমাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। এদিকে আমরা লোকাল এজেন্সির থেকে বালি পাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে তারা এটার উচ্চতা ও কঠিনত্ব সম্পর্কে আমাদেরকে জানান।
তারা এটাও জানান যে, বালি পাসের তুলনায় রূপ সৌন্দর্য এবং কঠিন ট্রেইল বিবেচনায় রুপিন পাস কিছুই না। এগুলো শুনে আমি মনে মনে খুশি হতে লাগলাম। এদিকে বালি পাস যাব এই সিদ্ধান্ত নিয়ে টিমের একজন শুরু থেকেই নাখোশ ছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন কোনো সহজ ট্রেইলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু টিমের অধিকাংশ সদস্যদের মতের সাথে তার মতের মিল না ঘটায় সে মন খারাপ করে সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন। এভাবেই গল্প, বিভিন্ন আলাপ এবং শুয়ে-বসে আমাদের দীর্ঘ ৩০ ঘণ্টার জার্নি শেষ হলো।
রাত ১০ টা নাগাদ উত্তরাখণ্ডের রাজধানী দেরাদুন শহরে গিয়ে আমরা নামলাম। সবাই চরম ক্ষুধার্ত ছিলাম। সিদ্ধান্ত হলো, ট্রেন থেকে নেমেই সবার আগে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে তারপর আমরা যা করার করবো। আমরা অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে একটা রেস্টুরেন্ট খুঁজে সেখানে গিয়ে রুটি ও ভাত খেয়ে নিলাম। সুরেশ জানালেন, আজকেই আমাদের শেষ গোস্ত খাওয়া। এরপর আবার ট্রেইল থেকে ফিরে দেরাদূনে এসে আমরা গোস্ত পাব। আপাতত এখান থেকেই আগামী দিনগুলোর জন্য সবাইকে স্থানীয় নিয়মে সবজি খাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে।
এর মধ্যেই লোকাল এজেন্সির প্রতিনিধি এসে আমাদের সাথে দেখা করলেন এবং সবার সাথে পরিচিত হয়ে পরবর্তী দিনের দিকনির্দেশনা দিলেন। উনার সহযোগিতায় রাতে থাকার জন্য আমরা একটা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। হোটেলে ঢুকতেই সবার শুরুতেই আমি ব্যাগ থেকে গোসল করার সামগ্রী বের করে গোসলে চলে গেলাম। তারপর একে একে সবাই ফ্রেশ হয়ে আমরা ঘুম দিলাম।
পরের দিন খুব সকাল সকাল আমাদের সাংক্রি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা গাড়ির ড্রাইভারের কলে ঘুম শেষ হলো। উনি আমাদেরকে জানালেন সাতটা তিরিশ মিনিটের মধ্যে বের হতে না পারলে ঝামেলা হয়ে যাবে। আমরা সবাই খুব দ্রুত উঠে ফ্রেশ হয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি দেরাদুনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলো। আস্তে-ধীরে গাড়ি শহর ছেড়ে পাহাড়ের গা ধরে ওপরে উঠতে শুরু করলো। গাড়ির গতির সাথে মনের আনন্দের পরিবর্তন হতে শুরু করলো। যতই সময় যাচ্ছিল ততই যেন আমি গাড়ির জানলা দিয়ে এদিক সেদিক হয়ে মোবাইলে ভিডিও বা ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম।
আস্তে-ধীরে আমরা বিখ্যাত পাহাড়ি মৌশরি শহরে ঢুকলাম। দুর্গম এই কঠিন পাহাড়ি পরিবেশের মধ্যে এতটা সুন্দর একটা আধুনিক শহর কল্পনা করাও যেন আমার জন্য কঠিন ছিল। যতই সামনে আগাচ্ছিলাম ততই যেন বিস্ময়কর দৃষ্টিতে চারপাশ নিয়ে আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। বিশাল বড় বড় পাহাড় কেটে পাথরের গায়ের সাথে কোনো রকমের হেলান দিয়ে তারপর এই রাস্তা তৈরি করা। দেখে মনে হচ্ছিল যেন পাথরের সাথে কোনো রশি দিয়ে ওপর থেকে ঝুলিয়ে রাখা হইছে। যে কোনো মুহূর্তে একটু ভুল করা মানেই যমদূতের সাক্ষাৎ! টিমের কেউ সকালের নাস্তা করি নাই। সবাই ক্ষুধার্ত ছিলাম। ড্রাইভার সাহেবকে বলা হলো তার জানাশোনা ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট দেখে নাস্তার ব্যবস্থা করার জন্য।
আমরা একটা রেস্টুরেন্টে থামলাম। যার যার পছন্দ অনুযায়ী নাস্তার অর্ডার করে সবাই গল্প করছিল আর আমি এই সুযোগে আশপাশের জায়গাটা ঘুরে দেখার জন্য বের হয়ে গেলাম। মিনিট দশেক পরে নাস্তা চলে আসলো সবাই দ্রুত খেয়ে আবার গাড়িতে। গাড়ি পাহাড়ের বুকে আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু কঠিন দুর্গম পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই আমাদের টিমের প্রান্ত ভাই কিছুটা অসুস্থ হয়ে গেলে আমরা গাড়ি থামিয়ে কিছুটা সময় প্রকৃতির মাঝে বিশ্রাম নিলাম।
আমরা সবাই আবারও গাড়িতে উঠে বসলাম। ২০ মিনিট যাওয়ার পরেই দেখলাম, বিশাল এক অপরূপ মায়াবী ঝর্ণা। ঝর্ণার পাশে আবার কয়েকটা দোকানও ছিল। ঝর্ণাটার চারদিকের সংরক্ষণ ব্যবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম, এ দেশের সরকার প্রকৃতি ও প্রকৃতি প্রেমি মানুষ নিয়ে কতটা গভীরভাবে চিন্তা করে। আমাদের দেশের সাথে তুলনা করতে গেলে আফসোস কেবলমাত্র আফসোস করতে হয়। আমরা সেখানে নেমে ঝর্ণা থেকে পানি নিলাম এবং দোকানে গিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করে নিলাম। সেখানে আরো একটা দারুণ ব্যাপার ছিল যে, এত্ত দুর্গম পাহাড়ের দোকানগুলাতে যে কোনো পণ্যের দাম অতিরিক্ত এক টাকাও বেশি না। শহরের মতো পাহাড়ের দোকানেও সেইম দাম।
আমরা আবারো গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি কয়েক হাজার ফুট উচ্চতার পাহাড়ের গা ঘেঁষে রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল। উত্তরখণ্ডের পাহাড়ের যতই গহীনে যাচ্ছিলাম আমিও যেন ততই অবাক চোখে চারদিকে তাকিয়ে মুগ্ধতায় ডুবে যাচ্ছি। নতুন পাহাড়ের নতুন পরিবেশে নতুন নতুন মানুষের বৈচিত্র্যময় কালচার এবং জীবনযাপনের নতুন চিত্রের আগমন আমার কাছে দারুণ লাগছিল। ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে আমরা আরো একটা নতুন পাহাড়ি শহরে ঢুকলাম। সেখানে আমাদের দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবারো যাত্রা শুরু করলাম। এইবার কিছুদূর সামনে যাওয়ার পরে এমন একটা এলাকায় ঢুকলাম যার চারপাশের রাস্তাটা আমার কাছে মনে হলো আমি কল্পনার কোনো দেশে আছি, যা কিনা আমার কাছে কখনো কাশ্মীর আবার কখনো সুইজারল্যান্ডের কোনো রাস্তা মনে হচ্ছিল।
মাঝে মধ্যে বিশাল বড় বড় মহিষের পাল দেখা যাচ্ছিল। সবকিছু মিলিয়ে যা দেখছি সবই জীবনের প্রথম দেখছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। এইভাবে করেই আমরা বিকাল ৫টা নাগাদ সাংক্রি শহরে গিয়ে নামলাম। হঠাৎই সুরেশ আমাকে দূরের বিশাল এক সাদা চূড়ার দিকে ইংগিত করে বললেন, ওই যে দেখেন আপনার প্রথম সাদা পাহাড়ের রূপ সৌন্দর্য।
সাংক্রি ছোট এবং অত্যন্ত গোছানো একটা গ্রাম। সেখানে নেমেই দেখলাম বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রচুর ট্রেকারদের আনাগোনা। এরমধ্যেই একজন স্থানীয় এসে আমাদের সাথে করমর্দন করে আমাদের গাইড বলে পরিচয় দিলেন এবং আমাদেরকে ২টা রুমে নিয়ে গেলেন। রুমে গিয়ে আমি ব্যাগ রেখে আসরের নামাজ শেষ করে দ্রুতই বের গেলাম গ্রামের চারপাশে ঘুরে দেখার জন্য। আমি একটা রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। যতই সামনে যাচ্ছিলাম প্রকৃতি যেন আমাকে ততই লোভ দেখিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। এত সৌন্দর্য কখনোই আমি আশা করি নাই। চারদিকে সবুজের মাথায় যেন একখণ্ড বিশাল সাদা টুপি। সবুজ যেখানে সমাপ্ত সাদা সেখান থেকেই শুরু। চলবে