কাউসার পলাশের ভ্রমণগদ্য ‘শাদা পাহাড় অভিযান’
পর্ব ১
প্রকাশিত : জুন ০৫, ২০২২
অনেকদিন আগে থেকেই আমাকে হাই অল্টিচুট টানছিল। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ এক হাজার মিটারের পাহাড় থেকেই আমার পাহাড় সম্পর্কে সকল শিক্ষাদীক্ষা পাওয়া হয়। তবে অতি উচ্চতার সাদা পাহাড়ে কিভাবে কি করতে হবে বা কিভাবে হাঁটতে হবে, সে সম্পর্কে আমার জ্ঞান শূন্যই বলা যায়। এমনকি দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য সকল প্রকার পেপার প্রস্তুত করে ভিসা আবেদনের ব্যাপারটাও ছিল আমার কাছে আতংকের। চিন্তা করে দেখলাম, ঘরে বসে থাকলে কাজ হবে না। মাঠে নামলেই ব্যবস্থা হবে।
করোনার থাবায় জর্জরিত হবার দীর্ঘদিন পরে ভারতীয় স্থল বর্ডারগুলা খুলছে, এই সংবাদ আসতে শুরু করলো। ভিসার জন্য যে সকল পেপাল প্রয়োজন ছিল তা আমার কাছে পরিপূর্ণ ছিল না। এই পেপারগুলা প্রস্তুত করাই যেন আমার জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো। তবে শেষেমেশ ভিসা প্রসেসিংয়ের কাজ শুরু করলাম। এরপর অপেক্ষা করতে লাগলাম। শেষপর্যন্ত আমি ভিসাটা পেয়ে গেলাম। ভিসা হাতে পাওয়ার পরপরই আমার জন্য দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ আসলো আমি কোথায় যাব সেটা নির্বাচন করা। যেহেতু আমার শাদা পাহাড়ের কোনো অভিজ্ঞতা নাই, তাই এক্ষেত্রে আমাকে খুবই চিন্তা-ভাবনা করেই কোথায় যাব সেই স্থান নির্বাচন করতে হবে। শরিফ ভাই আর আমি একের পর এক রুট এই ট্রেইলে দেখা নিয়ে ব্যস্ত। কাজটা ছিল আমার, কিন্তু চিন্তার রেখাটা ছিল বেশি উনার। আমার অভিযান শতভাগ নিরাপদ ও সফল করার জন্য উনিই আমার থেকে বেশি জোড়ালো ভূমিকা পালন করেন। আমার কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে তা নিয়েও যেন উনার চিন্তার শেষ নাই।
প্রস্তুতির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ সালাউদ্দিন ভাই ও তানভীর ভাইকে নিয়ে যাবতীয় প্রয়োজনীয় যা যা দরকার রোজার শুরুতেই তা কেনাকাটা করে ফেললাম। তব কিছু বাকি ছিল যা কিনা পরবর্তীতে ওমর মোস্তাফিজ ভাই নেপাল থেকে এনে দিয়ে আমার কাজকে অনেক সহজ করে দিছিলেন। ভিসা পাইলাম, অতি উচ্চতার শাদা পাহাড়ের জন্য সকল প্রকার প্রস্তুতি নেওয়া প্রায় শেষ। অথচ তখনো আমি জানি না আমি কোথায় যাব। ভারতীয় ট্রেইলগুলা নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা ও বিশ্লেষণের পরে শরিফ ভাই বললেন, শুরুতেই ৪ হাজার মিটারের রুপিন পাস আমার জন্য নাকি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। আমি বললাম, ভাই আল্লাহ ভরসা। এটাতেই যাই, যা হবার হবে। তবে আমার মনে হয়, আমি পারবো ইনশাল্লাহ।
তারপর শরিফ ভাই রুপিন পাস নিয়ে ইউটিউব দেখে দেখে পূর্ব প্রস্তুতি সম্পর্কে আমাকে একে একে কি করণীয় সব দেওয়া শুরু করলেন। শরিফ ভাই শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি খবর নিতে শুরু করলেন ঈদের পরে বাংলাদেশ থেকে রুপিন পাস যাওয়ার মতো আর কেউ আছে কিনা তা জানার জন্য। শেষ পর্যন্ত এই মানুষটার কষ্ট সার্থক হলো। আমাদের পূর্ব পরিচিত থেকেই উনি কয়েকজনকে খুঁজে পাইলেন যারা কিনা রুপিন পাস যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। কুয়েটের কয়েকজন ছাত্র রুপিন পাসের পরিকল্পনা করছিল। শরিফ ভাই আমাকে তাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। অবশ্য এদের সাথে আমার অনেক আগে দলিয়ান পাড়ায় সাক্ষাৎ হয়েছিল। এদের থেকে সুরেশ দেবের আমার কথা হলো। তিনি খুবই আন্তরিকতার সাথে আমাকে উনাদের পরিকল্পনার কথা জানালেন। উনার পরিকল্পনা শুনে আমার খুবই ভালো লাগলো। উনারাও একে একে সকল প্রকার প্রস্তুতি মূলক কার্যক্রম শুরু করে দিলেন। পূর্বেই উনাদের ইন্ডিয়াতে যাওয়ার অনেক অভিজ্ঞতা ছিল। তাই আমার ওপর প্রেশার অনেকটা কমে আসে। আমি তখন থেকে অধীর আগ্রহে কখন যাব সেই কাঙ্ক্ষিত সময়ের অপেক্ষায়।
আমাদের সিদ্ধান্ত হলো, ঈদের দিন রাতেই আমরা বেনাপোল দিয়ে কলকাতায় যাব। অবশেষে দিনটি এলো। আমি বাসা থেকে সবকিছু নিয়ে সালাউদ্দিন ভাইয়ের বাসায় গেলাম। সেখানে মাহবুবুর রহমান ও মোহিদুল ইসলাম মিলন বাসা থেকে আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসলেন। তারপর তানভির আলম দোয়েল ও সালাউদ্দিন ভাইসহ আমরা একসাথে রাতের খাওয়া শেষ করলাম। খাবার শেষ হলে তানভীর ভাই আমাকে উনার বাইক করে শ্যামলী পর্যন্ত দিয়ে আসলেন। আমি কল্যাণপুর চলে গেলাম। সেখানে বাসের জন্য কাউন্টারে অপেক্ষা করতে থাকলাম। রাত ১০টা ৩০ মিনিটে বাস আসলে আমি বাসে উঠে বসলাম। বাস চলতে শুরু করলো। পরের দিন সকালে বেনাপোল গিয়ে নামার কয়েক মিনিটের পরেই আমার টিমের বাকি ৫ জনের সাথে দেখা। উনারা সবাই খুলনা থেকে একটা প্রাইভেট কারে সরাসরি বেনাপোল গিয়ে সিরিয়াল ধরে আমার জন্য অপেক্ষায় আছে।
সুরেশ আমাকে রিসিভ করেন এবং সবার সবার সাথে পরিচিয় করিয়ে দিলেন। তারপর একে একে পর্যায়ক্রমে আমরা একজন করে সিরিয়াল ধরে রেখে দীর্ঘ ৫-৬ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে দুই দেশের ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করলাম। এর ফাঁকে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করেই কয়েকটা গ্রুপ ছবিও তুলে নিলাম। ভারতে প্রবেশ করেই শুরুতেই একটা মসজিদে গিয়ে যোহরের নামাজ শেষ করলাম। তারপর আমরা রাহুল সাহার পরিচিত একজনের মাধ্যমে আমাদের টাকাকে রুপিতে কনভার্ট করে নিলাম। একটা অটো রিক্সায় করে আমরা বনগাঁয় গেলাম। সেখানে একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া শেষ করে কলকাতার লোকাল ট্রেনে উঠে বসলাম। ট্রেনে উঠে বুঝতে পারলাম, কলকাতার মানুষের ধৈর্য আমাদের দেশের মানুষের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। আর না হয় ট্রেনে এভাবে জার্নি করা অসম্ভব! একটা সময় আমরা কলকাতায় গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল রাইটার্স বিল্ডিং থেকে পরের দিন দেরাদুন যাওয়ার টিকেট কাটা।
আমরা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গেলে আমাদেরকে সেখান থেকে টিকেট না দিয়ে বলল, দুটো টিকিট আছে। আপনারা জলদি পরের ভবনে চলে যান। নেক্সট ভবনে গেলেও আমাদের সেইম কথা বললে আমরা আবার তাড়াহুড়ো করে পরের ভবনে যাই। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা টিকিট পাই। সবাই খুশিতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাহুলের মারফতে আমাদের জন্য নিউমার্কেট এরিয়াতে কেউ একজন হোটেলের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আমরা নিউমার্কেট এরিয়াতে গিয়ে প্রথমেই দেশে যোগাযোগ করার জন্য সীম কার্ড নিলাম। তারপর সবাই রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করে খাওয়া দাওয়া ও কেনাকাটার জন্য বের হলাম। সেদিন রাতেই ছিল রিয়াল মাদ্রিদ ও ম্যানচেস্টার সিটির সেমি ফাইনালের ম্যাচ। সারারাত আমি খেলা দেখলাম। এই খেলাটা না দেখলে হয়তো আমাকে সারাজীবন আফসোস করা লাগতো। পরের দিন বিকাল ৫টার সময় হাওড়া রেল স্টেশন থেকে দেরাদুন যাওয়ার ট্রেন ছিল। আমরা যথাসময়ে গিয়ে ট্রেনে উঠলাম।
ট্রেনও যথাসময়ে ছাড়লো। আমি জানালার পাশে বসে প্রকৃতি উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ করেই সাংক্রির এজেন্সি থেকে আমার ফোনে একটা মেসেজ আসলো। যেটাতে লিখা ছিল, বড় প্রব্লেম হয়ে গেছে। স্থানীয় সরকার ট্রেকারদের জন্য রুপিন পাস বন্ধ করে দিছে, সুতরাং রুপিন পাস যাওয়া যাবে না। চলবে