কষ্ট, মুনিরা চৌধুরীর গোপন নাম!
জাহানারা পারভীনপ্রকাশিত : নভেম্বর ২৩, ২০১৯
সিলভিয়া প্লাথ পড়তে গিয়ে মনে পড়ে তার আত্মহত্যা; দীর্ঘ মনস্তাত্তিক সংকট ও আত্মহত্যাপ্রবণ মানসিকতার কথা। এরিয়েলের কবিতা, মাকে লেখা চিঠি, আত্মজৈবনিক উপন্যাস বেলজার পড়তে গিয়েও খুঁজেছি বিষণ্ণতার সূত্র। কেন তিনি মনের মতো একটা পদ্ধতি খুঁজতে চেয়েছেন বারবার? আত্মহত্যার? স্লিপিং পিল, ব্লেড, শেষ পর্যন্ত সাফল্য আসে গ্যাসের চুলায়। অথচ তখন বাড়িতে দুই শিশু সন্তান। মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতার অসহায়ত্ব, বধূ ছিল শিশুটিও ছিল, তবু মরিবার হলো তার স্বাধ। এই মরবার স্বাধ নিয়েই জীবন কাটিয়েছেন সিলভিয়া। তার জীবন তাই বলে। আত্মঘাতি লেখকদের পড়তে গিয়ে, তাদের জীবনীর সঙ্গে সংযোগ খুঁজেছি, কিছু একটা বোঝার ইচ্ছে, কোনও একটা সূত্র খোঁজার চেষ্টা। রিভলভারের গুলিতে আত্মহত্যা করা মায়কোভস্কি, হেমিংওয়ে, ওভারকোটে ভারি পাথর নিয়ে নদীতে ডুবে যাওয়া ভার্জিনিয়া উলফ, মানসিক বিষণ্ণতা থেকে আত্মহত্যা করা এডগার অ্যালান পো, গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করা কথাসাহিত্যিক ফোস্টার ওয়ালেস। এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। এই তালিকার আরেক নাম মুনীরা চৌধুরী। বাংলা ভাষার কবি। এই মৃত্যু আকস্মিক। দুঃখজনক। কার্ডিফের সমুদ্র উপকূলে পাওয়া গেছে তাকে। মৃত। সমুদ্রের ধারে পাওয়া মৃতদেহ, রহস্যজনক মৃত্যুর অভিঘাত আমাদের মনে তৈরি করেছে নানা অভিঘাত। তিনি নিজেই মৃত্যু নিয়ে বলেছেন।
কষ্ট, মৃত মুনিরা চৌধুরীর গোপন নাম! এই কষ্টই তার অবলম্বন। আশ্রয়। অথচ এই কষ্ট থেকে বাঁচতেই কি বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছামৃত্যু? প্রশ্ন ওঠে। কেন তার কবিতায় বারবার এসেছে মৃত্যুর প্রসঙ্গ। পৃথিবীর আর সব আত্মঘাতি কবিদের মতো তিনিও কি মৃত্যুর কথা ভেবেছেন বারবার? অথচ জীবনের সকল বিষাদ, অবসাদ, কষ্ট ভুলতে কবিতাতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তুমুল বাঁচার মাঝে নিজের মৃত্যুর নির্দেশনাও দিয়ে গেছেন। প্রিয় বন্ধুর সঙ্গেই মৃত্যু হবে তার। এরকম প্রস্থানের ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন বেঁচে থাকতেই। তাই তার মৃত্যু প্রস্তুতি নিয়ে বিস্মিত হওয়ার সুযোগ নেই।
কেন যে বারবার মৃত্যুর কথা বলো?
হঠাৎ মরে গিয়ে আমায় দুঃখ দিয়ো না...
ঈশ্বর দুঃখ পাবেন
হঠাৎ মরে গিয়ে আমায় দুঃখ দিয়ো না...
আমরা তো একসঙ্গেই মারা যাব
পৃথিবীর প্রাচীন কবরে যখন, দু’চোখের পাথর ছিদ্র করে গড়িয়ে পড়ে জল, আর কবি মুনিরা চৌধুরী জেনে যান বর্ষা এসেছে। বর্ষা তার কাছে বিষাদের সমার্থক। নিজে কষ্টের প্রতিনিধি। তিনি দেখতে পান আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে, বৃষ্টির মধ্যে ঘুড়ি উড়ছে, আর চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছে তার প্রিয়জন। সেই প্রিয়জনকে তিনি তুমি বলে সম্বোধন করেছেন। তখন পৃথিবীর সব চায়ের পেয়ালা ভেঙে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে। এরপরই কবির কল্পনাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। কবি দেখেন, পৃথিবীতে নতুন এক পরিবর্তন। এখানেই তার কবিতার শক্তি। তার চিন্তার নতুনত্ব।
মুনিরা চৌধুরীর সঙ্গে আমার কখনও পরিচয় হয়নি। তার কথা জেনেছি তার মৃত্যুর পর। এ এক নতুন আবিষ্কার। তার কবিতার আধুনিকতা, নতুন চিন্তা, ভাষা— পড়ে মনেই হয়নি তার জন্ম লন্ডনে। বড় হয়েছেন সেখানে। জন্মসূত্রে ব্রিটিশ বাঙালি কবি মুনিরা। জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের বাইরে। বাংলাভাষাকে জানতে তিনি দীর্ঘ দিনের জন্যে বাংলাদেশে এসে থেকেছেন। শিখেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। বাংলা কবিতা ও গদ্য রচনার কলাকৌশল। লন্ডনে ফিরেও পড়ে থেকেছেন বাংলা ভাষা নিয়ে। লন্ডনের কার্ডিফে বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলা একাডেমি ইন্টারন্যাশনাল। অনেক পরে বাংলা শেখা এই কবির ভাষা, শব্দ ব্যবহার, পরিমিতিবোধে অদ্ভুত এক ঘোর। মনে শুধুই জন্ম নেয় মুগ্ধতা। তার নিঃসঙ্গতার স্বরূপ পাওয়া যায় তার কবিতায়।
একদা জানতাম,
কার্ডিফের ওই একটা মাত্র ডানাভাঙা কালো কবুতরই আত্মীয় আমার
আত্মীয়টি উড়ে গেছে দূরে, তারপর পুড়ে গেছে
তারপর থেকে
একা বসে আছি
এক শত বছর ধরে
কবি মুনীরা চৌধুরীর সঙ্গে কখনও পরিচয় না থাকার আফসোস কাটাতে তার কবিতার কাছে আসি। তার মনোজগৎ বোঝার চেষ্টা করি। আর বিস্মিত হই। আমাদের চারপাশের সাহিত্যের কোলাহলের বাইরে দূরদেশে থেকে কবিতার কি এক আশ্বর্য, বিস্ময়কর জগৎ তৈরি করে নিয়েছিলের তিনি। যে জগতে বাস করলে আর সব কিছু তুচ্ছ করা যায়। এমনকি চারপাশের সমাজ বাস্তবতা, ঘর সংসার সন্তানকেও পেছনে ফেলে নিজের সব বিষাদ, বিষণ্ণতা নিয়ে চলে যাওয়া যায় রহস্যজনক এক জগতে। যেখানে জেগে থাকা যায় সারারাত। নিজের সব বেদনা নিয়ে। ঘুমের ঘোরেও যেখানে জেগে থাকা যায়।
আমি জেগে থাকি
কাটা হাতখানা অন্য হাতে নিয়ে সারারাত জাগি
অনন্ত ভোরের দিকে হাতের গহীনে জ্বলে ওঠে হাতের চিতা
হাড়-গলা গরম ঘন হয়ে এলে কেবল শীত শীত লাগে… ঘুম লাগে