কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : আগস্ট ০৫, ২০২৩
মুসলমান ছাত্রদের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শনের নানা উদাহরণ আছে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কাশীতে যে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তার সব বিভাগে মুসলমান ছাত্রদের প্রবেশাধিকার ছিল। এমন কি, সংস্কৃত সাহিত্য, ব্যাকরণ এবং বেদসহ হিন্দুধর্ম শাস্ত্র অধ্যয়নেও তাদের বাধা ছিল না। কিন্তু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এদিক থেকে কাশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যতিক্রম ছিল। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃত নিয়ে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সংস্কৃত পড়ার জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। কিন্তু বিষয়টা অনেকে সহজভাবে নেননি।
মুসলমানের সন্তান বেদ পাঠ করবে সেটা চাইছিলেন না। ষড়যন্ত্র চলছিল। ভর্তির পর দুমাস নির্বিগ্নে কেটে গেল। সে পর্যন্ত ক্লাসে কেবল ব্যকরণ ও সাহিত্য পড়ানো হয়েছিল। দুমাস পর বেদ পড়াবার জন্য এলেন পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রম। সামশ্রম এসেই, প্রথম দিন সকল কাজের আগে রেজিস্ট্রার খুলে নাম পড়তে আরম্ভ করলেন আর শহীদুল্লাহর নাম দেখে অগ্নিশর্মা হয়ে নিজের হাতে নাম কেটে দিলেন। তাঁকে ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতে বললেন। কারণ ম্লেচ্ছ বা অনার্য জাতির লোকদের বেদ শিক্ষা দেওয়া মহাপাপ।
স্মরণ রাখতে হবে, ভারতে যখন মুসলমানরা ছিল না, তখনো সবার বেদ পাঠের অধিকার ছিল না। বেদ পাঠ বা শ্রবণ করতে পারে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য। শূদ্র ও নারীদের জন্য বেদ পাঠ নিষিদ্ধ ছিল। বুঝতে হবে হিন্দু ধর্মে সব হিন্দুদের মন্দিরে ঢুকবার অধিকার ছিল না। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় আর সাধারণ হিন্দু এক নয়। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়রা হলেন উচ্চবর্ণের হিন্দু। সাধারণ হিন্দুদের বা মুসলমানদের সেখানে জায়গা নেই। মুসলিম সম্রাট বা ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে মেলামেশায় বর্ণ হিন্দুদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু সাধারণ হিন্দুদের সঙ্গে বর্ণহিন্দুরা মেলামেশা করবে না। বর্ণহিন্দুরা নিম্নবর্ণের হিন্দু আর মুসলমানকে একই পাল্লায় দেখতেন।
স্বভাবতই মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতরা বেদ পাঠ করতে দিতে চাইলেন না। বুঝতে হবে বিশ শতকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা এটা। যাই হোক পরের ঘন্টায় ব্যাকরণের ক্লাসে বসলে সেখানেও ‘যবন’ শহীদুল্লাহর প্রবেশ নিষেধ হয়ে গেল। ব্যকরণের শিক্ষক নতুনরূপ ধারণ করে বললেন, ব্যকরণটা হচ্ছে বেদাঙ্গ। সুতরাং মুসলমানকে তা পড়ানো যেতে পারে না। পণ্ডিত মহাশয়রা সবাই একযোগে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে তাড়াবার ব্যবস্থা করলেন। ভদ্রলোকদের দ্বারা এই হলো বাংলার নবজাগরণের নমূনা, বিশ শতকের শুরুতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মুসলিম ছাত্র বেদ স্পর্শ করতে বা পড়তে পারবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ছিলেন তখন ডক্টর থিবো। তিনি কয়েকটা সহানুভূতিশীল শব্দের সদ্ব্যবহার করেই নিজের কর্তব্য শেষ করলেন। সেখানে হতাশ হয়ে তিনি শরাণাপন্ন হলেন স্যার আশুতোষের। পণ্ডিতদের গোঁড়ামির নিন্দা করলেন, কিন্তু অন্যায়ের প্রতিকারের কোনো সুবন্দোবস্ত করলেন না। তিনি পরামর্শ দিলেন, এ নিয়ে আর গোলমাল না করে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা করো। মুসলমান সমাজে এ নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারের কাছে প্রতিকার চেয়েও লাভ হলো না। বেঙ্গল কাউন্সিলে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও সরকারের পক্ষ থেকে জবাব দেওয়া হলো, তারা এ সম্পর্কে অবগত নন এবং তাদের পক্ষে প্রতিকার করাও সম্ভব নয়। আইন, বিচার, যুক্তি ও আড়াই কোটি মুসলমানের প্রতিবাদকে নিষ্ঠুরভাবে পদদলিত করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে বের করে তবে ক্ষান্ত হলেন।
বঙ্গভঙ্গ রদ হবার পরপর সময়ের ঘটনা এটা। এই ঘটনার দু-বছর পরে আবদুল আজিজ নামক নাগপুরের এক মুসলমান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন সংস্কৃতে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। সকল উচ্চশিক্ষিত হিন্দু পণ্ডিতও আজিজের অসাধারণ সংস্কৃৃত জ্ঞানের প্রশংংসা করেছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এবার আগে থেকেই সতর্ক ছিলেন, তাঁকে আদৌ ভর্তি হতেই দেওয়া হলো না। তিনি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শ নিতে গেলে তিনি পূর্বের মতোই উপদেশ দিয়েছিলেন গোলমাল করে ফল হবে না। তখন আবদুল আজিজ দু-দুবার প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়েও উত্তীর্ণ হতে পারলেন না। হিন্দু ভদ্রলোকদের চক্র এতোটাই ক্ষমতা রাখতেন। ঠিক এর পর ১৯২০ সালে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক আবদুল মজিদ সংস্কৃত সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সংস্কৃতে স্নাতকোত্তর করার জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান। গান্ধীর নেতৃত্বে তখন খিলাফত আন্দোলন চলছে।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অধ্যাপক মজিদ স্যার আশুতোশ মুখোপাধ্যায়ের মুখোমুখি হলে তিনি বললেন, দেশে একটা ভালো হাওয়া চলছে, এখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পড়তে গিয়ে একটা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ সৃষ্টি করা তোমার মতন শিক্ষিত যুবকের উচিত হবে না। তিনি অধ্যাপক মজিদকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিতেও সমর্থন করলেন না। বললেন, দিতো পারো কিন্তু উত্তীর্ণ হতে পারবে না।
কী কারণে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমানদের অধিকার রক্ষা করা যায়নি? কারণ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির বেশির ভাগ সদস্য ইংরেজ ও হিন্দু। বাংলায় তখন মুসলমান সংখ্যাগুরিষ্ঠ হলেও, কিছুতেই তাদের সমান প্রতিনিধি দেওয়া হয়নি। বর্ণহিন্দুরা অন্যত্র গণতন্ত্রের কথা বললেও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা মানতে রাজি ছিলেন না। সে-কারণে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে কোনো ব্যাপারেই মুসলমানদের অধিকার সংরক্ষিত করা হতো না। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সহ পরে দুটি ঘটনা তারই প্রমাণ। ভিন্ন দিকে মুসলমানরা যখন সংস্কৃত নিয়ে পড়াশুনার উৎসাহ দেখায় সেখানে তাঁদেরকে কূপমণ্ডুক বা সবক্ষেত্রে সংকীর্ণ ভাবার কারণ নেই। বরং বিভিন্ন দলিলপত্রে দেখা যাবে মুসলমানরা তখন অনেকবেশি উদারতার পরিচয় দিয়েছে। হিন্দু ভদ্রলোকরা মুসলমানদেরকে ‘বিশেষ’ কোনো সুবিধা দিতে না চাইলে তাঁরা নিজেদের জন্য সবসময় বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করেছেন।
বর্ণহিন্দুরা সেসব ক্ষেত্রে অনুদারতার পরিচয়ই দিয়েছেন। বহু মুসলমান ছাত্র হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের জন্য একই স্থানে ছাত্রাবাস নির্মাণ, একসঙ্গে বসবাস এবং একইসঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা রাখার কথা প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু হিন্দুগণ তা একেবারেই মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। বিশেষ সুবিধা চেয়ে নিজেদের জন্য আলাদা হোস্টেল করার জোর দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, মুসলমানদের সঙ্গে যেন তাদের খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্ত না করা হয়।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক