কলকাতার মানুষ কৃপণ নয়, সাশ্রয়ী

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৬, ২০১৮

সেদিন কথাসাহিত্যিক অমর মিত্রের সঙ্গে ইনবক্সে আলাপ হচ্ছিল। তিনি তখন ইউটিইউবে বাংলাদেশের টিভি নাটক দেখছিলেন। চঞ্চল চৌধুরী অভিনীত একটি নাটক। অমরদা প্রায়ই বাংলাদেশের নাটকগুলো দেখেন। তার মতো পশ্চিমবঙ্গের অসংখ্য দর্শক দেখেন। ইউটিইউবে। তারা বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো দেখতে পান না। এতদিন আমি জানতাম, বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো না দেখানোর পেছনে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমার জানাটা ভুল ছিল। এবার কলকাতায় এসে ভারতের এক যুগ্মসচিবের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, এ ব্যাপার সরকারি কোনা বিধি-নিষেধ নেই। মূলত ক্যাবল অপারেটর ও টিভি মিডিয়া মালিক চক্র বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো ব্লক করে রেখেছে। তাদের ভয়, বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো ওপেন করে দেয়া হলে তাদের চ্যানেলগুলো দর্শক হারাবে। দর্শক ভাগ হয়ে যাবে।

শুধু সেই সচিব নন, অনেকের সাথে আলাপ করেও একই তথ্য পাওয়া গেল। তথ্যটা সঠিক। কারণ, সরকারি অফিসগুলোতে যে ডিশলাইন চলে সেই লাইনে সার্চ করলেই বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো দেখা যায়। যদি সরকারি বিধি-নিষেধ থাকত তাহলে সরকারি অফিসের ডিশলাইনে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো দেখা যেত না।

দুই.
কলকাতার মানুষ সম্পর্কে ঢাকায় অনেক গল্পকথা চালু আছে। যেমন, কলকাতার মানুষেরা কৃপণ, অতিথিপরায়ণ নয়; কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে বলে `খেয়ে এসেছেন, না গিয়ে খাবেন?` অতিথিকে অর্ধেক মিষ্টি খেতে দিয়ে বলে, `অর্ধেকটার পুরোটা খাবেন কিন্তু দাদা!` দুপুরে কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে খেতে না দিয়ে উল্টো বলে, আবার এলে কিন্তু খেয়ে যাবেন দাদা!` কলকাতার মানুষের কৃপণতার এমন অনেক গল্পকথা চালু আছে বাংলাদেশে।

আমি অনেক বার কলকাতায় এসেছি। তবে এবারের মতো এত দীর্ঘ সময় কখনো থাকিনি। এবার কিংবা অতীতেও আমি কলকাতার মানুষদের উপরোক্ত ধরনের কৃপণতার মুখোমুখি হইনি। উল্টো বরং তাদের অতিরিক্ত আপ্যায়নকে কখনো কখনো বিরক্তিকর মনে হয়েছে। কলকাতার বাইরে নদীয়া-মুর্শদাবাদ এলাকার মানুষদের আপ্যায়নে, আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছি।

কে জানে, হয়ত আমি যাদের সঙ্গে মিশি তারা কৃপণ নন। কৃপণদের সাথে আমার দেখা হয় না। গত ক‘দিনে কলকাতার জীবনচিত্রকে খুব গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। আমার কাছে মনে হলো না এখানকার মানুষরা ততটা কৃপণ, যতটা ঢাকায় শুনে থাকি। হ্যাঁ, তারা সাশ্রয়ী, অপচয় খুব একটা করে না, এটা বলা যায়।

ঢাকার কেউ এসে কলকাতাবাসীর জীবনযাত্রা দেখলে প্রথমে এখানকার মানুষকে কৃপণ বলেই মনে করবে। যেমন, এখানকার মধ্যবিত্তরা একসঙ্গে এক কেজি মিষ্টি কিনবে না, ঢাকাবাসীর মতো একসঙ্গে পাঁচ কেজি মাছ বা মাংস কিনবে না। না কেনার পেছনে কারণ আছে। এই প্রসঙ্গে সংস্কৃতিজন সন্দ্বীপন ধর বললেন, `আমার বাসায় প্রতিদিন যদি চারটা মিষ্টির প্রয়োজন হয় আমি কেন দশটা কিনব? আগামীকাল দরকার হলে আমি তো আবার তাজা মিষ্টি কিনতে পারছি, তাজা মাছটা বা তাজা মাংসটা কিনতে পারছি। ফ্রিজে রেখে বাসি জিনিস কেন খাব?` সন্দ্বীপনদার যুক্তিটা পছন্দ হলো।

তিন.
এবারের কলকাতায় এসে একটা জিনিস খুব ভালো করে জানলাম। বাংলাদেশের অনেক প্রকাশকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, লেখকদের সম্মানীর ব্যাপারে তারা নয়-ছয় করে থাকেন, ঠিকমতো সম্মানী দেন না, বই কত কপি ছাপেন তার সঠিক অঙ্কটি লেখককে জানান না, লেখকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই ছাপেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অভিযোগগুলো মিথ্যে নয়। অধিকাংশ প্রকাশকের মধ্যে শুদ্ধতা নেই। যদিও আমি কখনো (মাত্র একজন ছাড়া) কোনো অশুদ্ধ প্রকাশকের পাল্লায় পড়িনি। সাম্প্রতিককালে শুদ্ধ প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে। ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। কলকাতার প্রকাশকদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো বেশি। কবি জয় গোস্বামীর সঙ্গে আলাপকালে একবার তিনি অভিযোগটি করেছিলেন। গতকাল গল্পকার স্বপ্নময় চক্রবর্তী এবং অনুবাদক অভিজিৎ মুখার্জিও একই অভিযোগ করলেন। এসব ব্যাপারে কলকাতার তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালোই বলতে হচ্ছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশের অনেক লেখক কলকাতার প্রকাশকদের টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করেন। কয়েকজনের নামও জানতে পারলাম। কেন যে তারা এসব করে! এভাবে কি বড় লেখক হওয়া যায়? পাঠকের কাছে পৌঁছা যায়?

টুকে রাখা কথামালা
কলকাতা, ৫ নভেম্বর ২০১৮