কলকাতার কতো রঙ্গ এবং বাবু সংস্কৃতি
পর্ব ৩
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুন ১৬, ২০২১
বাবুদের কিছু মোসাহেব থাকেন। ক্রমে কলে কৌশলে, বেনেতি বেসাতে টাকা খাটিয়ে অতি অল্পদিন মধ্যে কলিকাতা সহরে কতকগুলি ছোটলোক বড়মানুষ হন। রামলীলে, স্নানযাত্রা, চড়ক, বেলুনওড়া, বাজি ও ঘোড়ার নাচ এরাই রেখেছেন; প্রায় অনেকেরই এক-একটি পাশবালিশ আছে; যে আজ্ঞে ও হুজুর আপনি যা বলচেন, তাই ঠিক— বলবার জন্য দুই এক গণ্ডমূর্খ বরাখুরে ভদ্রসন্তান মাইনে করা নিযুক্ত রয়েছে।
বাবুরা এইসব মোসাহেবদের কাছে নিজেদের প্রশংসা ও প্রতিদ্বন্দ্বির কুৎসা শুনে শুনে বেশ আনন্দ লাভ করতেন। প্রশংসা শোনার জন্য টাকা খরচে তাদের কোনোরকম আপত্তি ছিল না। কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে একবার এক বাঁদরের বিয়ে দেয়া হয়েছিল বেশ ধুমধাম করে। এই বিয়েতে এক লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। বানরকে মাথায় মুকুট পরিয়ে দিয়ে পাল্কীতে চড়িয়ে একদল বাঈজী বরের পেছনে দাঁড়িয়ে গান গাইতে ছিল।
ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ ‘হিন্দু প্রথানুযায়ী’ মন্ত্র পাঠ করেছিলেন। একইরকমভাবে জাঁকজমক করে বেড়ালের বিয়ে দিয়েছিলেন পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্র নারায়ণ সিংহ। জমিদার ব্রজনারায়ণের এক রক্ষিতা ছিল। রক্ষিতার সখ হয়েছে তার বেড়ালের বিয়ে দেবে ধূমধাম করে; তখন বাবু কি আর না করতে পারে। সুতরাং সব খরচ বাবুকে দিতে হলো। বিয়েতে একলাখের বেশি টাকা খরচ হলো। বিয়ে শেষে বাড়ি ফিরে এসে জমিদার ব্রজনারায়ণ স্ত্রীর প্রশংসা লাভের আশায় গর্ব করে স্ত্রীকে বললো, কার কলজে হবে লাখ টাকা খরচা করে বেড়ালের বিয়ে দেয়। স্ত্রী তখন বললো, কিন্তু আমি জানি একজন মানুষ বাঁদরের বিয়েতে এর চেয়ে দশগুণ টাকা খরচ করেছে। ব্রজনারায়ণ কথাটা শুনে বিরক্ত হয়ে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে জানতে চাইলে; কে সে যে বাঁদরের বিয়েতে এত টাকা খরচ করে। স্ত্রী জবার দিলো, কেন আমার শশ্বর মশাইতো তোমার বিয়ে দিতে বিপুল টাকা খরচ করেছিলেন।
বাবুরা তখন বাংলার মানুষকে শোষণ করে সেই টাকা এভাবেই উড়াতেন। নিমাই চাঁদ মল্লিকের নাতি রামরতনের বিয়েতে চিৎপুরের দু-এক মাইল রাস্তা গোলাপ জলে ভেজানো হয়েছিল, নইলে ধুলো উড়বে আর তাছাড়া দুগন্ধ সহ্য করবে কে! সাধারণ মানুষ এবং নিমন্ত্রিতদের কাছে টাকার গরম দেখানোই ছিল এসবের উদ্দেশ্য। কলকাতায় তখন নতুন সব রঙ্গের আমদানি হচ্ছে যার বহু কিছুর সাথে মানুষের পূর্ব পরিচয় ছিল না। যেমন ঘড়ি, ফিটন গাড়ি, কলকারখানা, প্রেস, বরফকল, থিয়েটার, মুদ্রিত গ্রন্থ ইত্যাদি। সবচেয়ে দুটি প্রধান বিষয় ছিল বারাঙ্গনা এবং মদ্য। মদ এবং মেয়েমানুষ না হলে বাবুদের চলতো না। চলবে