কলকাতার কত রঙ্গ এবং বাবু সংস্কৃতি
পর্ব ৪
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুন ১৭, ২০২১
মধ্যযুগের বাংলার নগরের অন্যতম ভূষণ ছিল বারাঙ্গনাপল্লী। রাজার পারিষদ ও আমলা-অমাত্যরা প্রকাশ্যে বারাঙ্গনাগৃহে যাতায়াত করতো, সকলে মিলেমিশে আমোদ আহ্লাদে অংশ নিতো। মধ্যযুগে তা ছিল পৌরুষ ও আভিজাত্যের প্রতীক। পতিতাসঙ্গ দোষে সামাজিক মর্যাদাহানি হতো না। আধুনিক যুগে ব্যাপারটার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন আসে। বারাঙ্গনাপল্লীতে গমনকে খুব সম্মানের বিষয় বলে দেখা হয় না। তবুও বারাঙ্গনাপল্লী নিষিদ্ধ নয়। কলকাতার নগরজীবনের বারাঙ্গনাপল্লী গড়ে উঠতে শুরু করে ইংরেজ আমলে। পূর্বে কৃষ্ণনগরের শুধু আমিনবাজারে পতিতালয় ছিল। গোয়াড়ীতে গোপ মালো প্রভৃতি জাতি বাস করতো। পরে ইংরেজরা যখন ঐ এলাকায় বিচারালয় স্থাপন করে তখন সেখানে তার আশেপাশে পতিতালয় প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করে। ইংরেজ সরকার এই স্থানটি প্রশস্থ এবং নদী তীরস্থ দেখে সেখানে বিচারালয় স্থাপন করে। তারপর সাহেবরা বিচারালয়কে কেন্দ্র করে গোয়াড়ীর পশ্চিম দিকে ও তাদের আমলা-আইনজীবী মোক্তাররা পূর্বদিকে নিজ নিজ বাসস্থান নির্মাণ করে। তৎকালে বিদেশে পরিবার সঙ্গে নিয়ে যাবার প্রথা না থাকায় প্রায় সকল আমলা-আইনজীবী ও মোক্তারদের এক একটি উপপত্নী দরকার হতো।
সুতরাং তাদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে স্থানে গণিকালয় প্রতিষ্ঠা পেতে থাকলো। সেজন্যই উত্তর কলকাতার প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত শহরবাসীদের বসতিকেন্দ্রের আশেপাশেই শহরের বিখ্যাত গণিকাপল্লী প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। শহর কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এইসব বেশ্যালয়। বাবুদের মেয়েমানুষ নিয়ে আমোদ করবার জন্য যেমন সাধারণের জন্যও তেমন শহরে গড়ে উঠেছিল নতুন তীর্থক্ষেত্র; বারাঙ্গনা পল্লী। সুতরাং এমন পাড়া নেই যেখানে অন্তত দশঘর বেশ্যা নেই। শহরে তখন যত্রতত্র এদের বসবাস। গৃহস্থের বাটীর পার্শে সদর রাস্তার উপর, যেখানে ইচ্ছা বেশ্যারা বাস করছে। এমনকি জোড়াসাঁকোর মূল ব্রাহ্ম সমাজটি বেশ্যাপল্লীর মধ্যখানে। হুতোম প্যাঁচার নক্সার মন্তব্যে কলকাতা শহর তখন বেশ্যাসহর হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর বেশ্যা সংখ্যা বাড়ছে বই কমছে না। এমনকি একজন বড় মানুষের বাড়ির পাশে গৃস্থের বৌ-ঝি নিয়ে বাস করবার যো নেই। বারবণিতারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গ আর গালিগালাজ করতো। সাধারণ পথিকরাও তাদের হাত থেকে নিস্তার পেতো না। কখনো দেখা গেল এক বেশ্যা রসিক বাবুকে দেখে পানের পিক ফেলতে গিয়ে তা অফিস ফেরত এক কেরাণির মাথায় পড়লো।
কিন্তু কেরাণিটি ভয়ে কিছু না বলে মানসম্মান নিয়ে চলে গেল। দু-একজন তরতাজা কেরানী কখনো এসব ইতরামী সহ্য করতে না পেরে প্রশাসনের ভয় দেখালে বেশ্যারা খিলখিল শব্দে হেসে উঠে বলতো, ‘বেশ্যাবৃত্তি করি বটে কিন্তু তোদের মতন সাতটা কেরাণীকে পুষতে পারি। কলম পিষে তোর তিন পুরুষ যা না করতে পারবে আমরা একপুরুষে তাই করেছি।’ খুবই রমরমা ছিল বেশ্যাদের জগৎ। কলকাতার বর্ণনায় দেখা যায়, গৃহস্থের বাড়ির পাশে বেশ্যা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে বেশ্যা, চিকিৎসক কবিরাজ বাসস্থানের পাশে বেশ্যা, এমনকি ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের আষ্টে পৃষ্টে বেশ্যা। চিৎপুর রোড ছিল এই সকল ফাঁদে আচ্ছন্ন। এ রাস্তাটায় গৃহস্থের বাস একবারে ছিল না বল্লেই চলে। থাকলেই বা কী হতো? কলকাতার বেশ্যা নিবাসের পরিবেশটি ছিল জঘন্য।
‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকার খবরে জানা যায়, গণিকারা প্রত্যহ সন্ধ্যা হতে রাত দশটা পর্যন্ত রাজপথে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের মধ্যে যে-সব কুভাষা বা কদর্যলাপ করতো তাতে সাধারণ পথিকরা বিব্রত হতেন। স্বভাবতই পথিকদের দেখলে গণিকারা আমন্ত্রণ জানাতো, পথিকদের নানাভাবে উৎপাত করতো, এমনি পথিকদের উদ্দেশ্যে নানারকম কুকথাও বলতো। পুলিশের কাছে আবেদন করা সত্ত্বেও এর কোনো প্রতিকার হয়নি। কারণ গণিকারা কলকাতা শহরের বনেদী রাজা মহারাজা, জমিদার ও ধনিক বড়বাবুদের পক্ষপুটে পরম নিশ্চিন্তে বসবাস করতো। কলকাতার পুলিশ ধনীদের আশ্রিত প্রমোদপল্লী এলাকায় হস্তক্ষেপ করতে সাহস পেতো না। স্থানীয় বর্ধিষ্ণু সাধারণ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের নীতিবোধ ও রুচিবোধ গণিকাদের এই প্রকাশ্য ইতরামিতে ক্ষুন্ন হতো এবং তারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন নিবেদন করতো। কিন্তু তাতে ফল কিছুই পাওয়া যেত না। বিত্তবানদের আশ্রিত বারাঙ্গনারা শহরের প্রকাশ্য রাজপথে নৃত্য করতেও ভয় পেতো না। দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার একটি এলাকাতেই তেতাল্লিশটি বেশ্যালয়ের মালিক ছিলেন। মানে বাড়িগুলির ভাড়াটেদের পেশা ছিল বেশ্যাবৃত্তি। কলকাতায় তাঁর আরো এরকম অনেক বাড়ি ছিল। সেকালে বেশ্যাদের নিকট বাড়ি ভাড়া দিলে ভাড়াটা বেশি পাওয়া যেতো।
বারাঙ্গনাপল্লী যে শুধু সাহেব আর বাবুদের জন্য গড়ে উঠেছিল ব্যাপারটা এমন নয়। চোর-ডাকাত. বদমাস এবং ইতরজনরাও এসব বারাঙ্গনাদের কাছে যেতো। সব বারাঙ্গনাপল্লী তাই একরকম ছিল না। মানুষভেদে, শ্রেণীভেদে নানা ধরনের বারাঙ্গনাপল্লী গড়ে উঠেছিল। সন্দেহ নেই এই বারাঙ্গনাপল্লীগুলো কলকাতা শহরের এক বৈচিত্র ছিল এবং বিভিন্ন বারাঙ্গনাপল্লীতে বিভিন্ন ধরনের রঙ্গ চলতো। মধ্য রাতে শহরের রাস্তায় সজ্জিতভাবে বহু বারাঙ্গনাকে খদ্দরের হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো। ভদ্রলোক বাবুরা তখন নিজেদের ঘরের স্ত্রী-কন্যাদের পর্দনসীন করে ফেলেছিলেন আর নিজেরা ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে বাগান বাড়িতে বসে বারাঙ্গনাদের হাট বসাতেন। ঘরের স্ত্রী-কন্যাদের এসব জেনেও মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে এর অন্যথা হয়নি। তিনি গোমাংস খেতেন, ইংরেজদের সঙ্গে একত্রে বসে মদ আর নারী নিয়ে হৈ হুল্লোর করতেন; তাঁর বাগান বাড়িতে বাঈজীদের নাচ-গানের আসর বসতো প্রায় রাতেই। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ঘরে বা অন্দরমহলে বসে ধর্মকর্ম পালন করতেন। হিন্দু ধর্মের সকল আচার অনুষ্ঠান দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাড়িতে নিয়ম মেনে পালিত হতো। তাঁর ধর্মপ্রাণ স্ত্রীর নির্দেশেই অন্দরমহলে পুরোহিত রেখে সকল পূজা-অর্চনা চলতো আর অন্দমহলের বাইরে হিন্দুধর্মের সকল শাস্ত্রকে উপেক্ষা করতেন দ্বারকানাথ।
প্রথম জীবনে ব্রিটিশের চাকরি করলেও পরের দিকে দ্বারকানাথ ছিলেন একজন জমিদার, খনি ও জাহাজ ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কার। কলকাতা শহরের এই যে রঙ্গঘরে এক বাইরে আর এক এটা আঠারো-উনিশ শতকের একটা সাধারণ ঘটনা উচ্চবিত্ত ভদ্রপরিবারে। সাধারণ মানুষরা ধর্ম নিয়ে যতো বাড়াবাড়ি করছিল বাবুরা ততধিক ধর্মবিচ্যুত হচ্ছিলো। বঙ্গদেশের কলকাতা শহরে এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এইরকম নানা বৈপরীত্যে কলকাতা শহর তখন উচ্চকিত। চলবে