কলকাতার কত রঙ্গ এবং বাবু সংস্কৃতি

পর্ব ১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ১৩, ২০২১

বাংলার শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করবার পূর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন বঙ্গদেশে বাণিজ্য আরম্ভ করে, ঠিক তখনি অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে কিংবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চাকরি লাভ করার জন্য কাজ চালাবার মতো ইংরেজী বলতে শিখেছিলেন। এঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ পঞ্চানন ঠাকুর উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন কর্মতৎপর ও উপায় সন্ধানী মানুষ, জাতপাতের বালাই তাঁর ছিল না। গোরা সাহেবদের রসদ জোগানো এবং ফাইফরমাস খাটা ছিল তাঁর কাজ। খ্রীস্টান ফিরিঙ্গীদের মুখে তাঁর ঠাকুর নামটা বিকৃতভাবে ‘ট্যাগোর’ হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চাননের উপর গোরা সাহেবদের নেকনজর থাকায় তিনি তাঁর দুই পুত্রকেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসালো চাকরি জুটিয়ে দেন। বিশেষ করে পঞ্চানন ঠাকুরের পুত্র জয়রাম ইংরেজদের নানা কাজ কারবার তদারকী, ঠিকাদারী ও দালালীতে নিযুক্ত থেকে বেশ টাকা-পয়সা বানান। ইংরেজরা তখনো বাংলা দখল করেনি। জয়রামের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণে হাত দেয়। ধর্মাধর্ম নিয়ে যাঁরা তখন খুঁতখুঁতে ছিলেন না, সুযোগ-সুবিধা সন্ধানে যাঁরা তৎপর ছিলেন, তাঁদের পক্ষে সে সময়ে রোজগারের নানারকম নতুন পথ খোলা ছিল। জয়রামের দুই পুত্র নীলমণি ও দর্পনারায়ণ পিতার সুবাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে যুক্ত হন; ঠিক সেই সময় বাংলার শাসনভার ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে আসে। সতেরশো পয়ষট্টি সালে বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী; সে-বছরই নীলমণি উড়িষ্যার সেরেস্তাদার নিযুক্ত হন। নীলমণিই পরবর্তীকালে জোড়াসাকো ঠাকুর পরিবারের পত্তন করেন। নীলমণিরই নাতি হলেন বাংলার বিখ্যাত দ্বারকানাথ ঠাকুর। দ্বারকানাথের নাতি হলেন বিখ্যাত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদৌলার পতনের কিছুদিন পরই বাংলায় দ্বৈতশাসন শুরু হলো। রাজস্ব তোলার ক্ষমতা রইলো ইংরেজদের হাতে, নবাবের হাতে রইলো রাজ্যের শাসনভার। টাকা খরচ করবার ক্ষমতা নেই অথচ তিনিই শাসক। সত্যিকারভাবে মাত্র বারো লাখ টাকা বাৎসরিক ভাতা দিয়ে নবাবকে ইংরেজদের পুতুল সরকার বানানো হলো। রাজ্যের সব ব্যাপারে নবাবের নিস্ক্রিয় থাকা ছাড়া গত্যন্তর রইলো না। শাসক ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগে কলকাতায় সতেরশো সত্তর সালে ‘কলকাতা মাদ্রাসা’ স্থাপিত হয়। কলকাতা মাদ্রাসা ছিল এদেশে ইংরেজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর উদ্দেশ্য ছিল আরবি ফারসি শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং হিন্দু-মুসলমানদের সরকারী কাজের জন্য যোগ্য করে তোলা। যেহেতু ইংরেজ শাসনে তখনো এদেশের আইন-আদালত ও রাজস্ব বিভাগে ফারসি ভাষা প্রচলিত ছিল, সেহেতু ঐসব বিভাগের নিম্নস্তরে ফারসি ভাষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেশীয় লোকেদের কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত করা হতো। এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো মাদ্রাসাতে। সুতরাং কলকাতা মাদ্রাসা হেস্টিংসের বদান্যতায় স্থাপিত হয়েছিল একথা বলা যায় না, সরকারী প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্য এখানে ক্রিয়াশীল ছিল। কলকাতা মাদ্রাসা ঠিক মুঘল যুগের মাদ্রাসার মতো ততটা আধুনিক বা উচ্চ পর্যায়ের ছিল না।একজন ইংরেজ ছিলেন তার অধ্যক্ষ।

বাংলার শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবার পর সতেরশো চুয়াত্তর সালে কলকাতায় ‘সুপ্রিম কোর্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বঙ্গদেশে ইংরেজী শিক্ষার অর্থকরী শক্তি বেড়ে যায়। ফলে সুবিধাভোগী এবং ভাগ্যান্বেষী সুচতুর লোকদের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষার আগ্রহ তৈরি হয়। ইংরেজী শিক্ষার তখনো কোনো মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান না থাকলেও আঠারো শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের প্রথম দিকে বেশ কিছু বাঙালী বিভিন্নভাবে ইংরেজী শেখার চেষ্টা করে মোটামুটি কৃতকার্য হন। রামকমল লিখেছেন, উনিশ শতকের প্রথম দিকে গৃহশিক্ষক রেখে ইংরেজী শিখতে হলে চার থেকে আট টাকা দিতে হতো। যে-কালে দুটাকা মাইনের চাকরি পেলে লোকে উল্লসিত হতো, সেকালে অতো টাকা ব্যয় করে ইংরেজী শেখা সহজ ছিল না। ফারসীর পরিবর্তে আদালতে ইংরেজী চালু হলে স্বভাবতই ইংরেজী শিক্ষার প্রতি মানুষের অধিক ঝোঁক তৈরি হয়। উনিশ শতকের প্রথম ভাগেই কলকাতাবাসীর মধ্যে ইংরেজী শিক্ষা যথেষ্ট বিস্তার লাভ করে। এক হিসেবে দেখা যায় আঠারশো বিশ সালের মধ্যে প্রায় দশ হাজার বাঙালী ইংরেজী বলতে পারতো। তখনো আফিস আদালতের ভাষা ছিল ফারসী।

ব্রিটিশরা বাংলার ক্ষমতা লাভের পর ক্রমাগত করের চাপে, দুর্ভিক্ষে গ্রামের দরিদ্র মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহর কলকাতায় আসতে শুরু করে। কলকাতা শহর হয়ে উঠলো এই সব ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয়স্থল। সে সময়ে কলকাতা ছিল নিতান্ত গ্রাম। কলকাতা নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ইংরেজদের দ্বারা সতের শতকের শেষে। কলকাতার তখন রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল না, কলকাতা ছিল তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পণ্য আমদানী-রপ্তানীর কেন্দ্র। কিন্তু সতের শতকের শেষার্ধে ইংরেজ শাসন স্থাপিত হওয়ায় রাতারাতি কলকাতার গুরুত্ব রাজধানী মুর্শিদাবাদকে ছাড়িয়ে গেল। কলকাতায় নতুন মানুষদের আগমনের সাথে সাথে নানা রঙ্গ জমে উঠেছিল। বিনয় ঘোষ লিখেছিলেন যে, কলকাতা শহরে প্রথমে যে ইংরেজরা এসেছিল, তাদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল অস্তগামী মধ্যযুগের উচ্ছিষ্টতুল্য প্রতিনিধি। নতুন শিক্ষা বা নতুন সভ্যতার অগ্রদূত তারা ছিল না। তারা দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতো, হিন্দুদের পূজা-পার্বণে যোগ দিতো হিন্দুদের মতো তুক্তাকে বিশ্বাস করতো। তাদের সঙ্গে চুল পরিচর্যাকর, বাজিকর সাহেবরাও এসেছিল। বাংলার জমিদারদের মতো খানাপিনা ও জীবনযাপন করাটাকেই তখন ইংরেজরা আভিজাত্য মনে করতো।

বঙ্গদেশে ইংরেজ শাসন চালু হলে ছিন্নমূল মানুষের পাশাপাশি প্রতাপশালী ‘বাবু’ নামে এক নতুন শ্রেণীর দেখা মেলে। প্রায় দুশো বছর আগে থেকে শিক্ষিত, ধনী পুরুষদের নামের আগে ‘বাবু’ শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। অবশ্য তখনও বাবু শব্দের ব্যবহার মোটমুটি ধনী, শিক্ষিতদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। ‘বাবু’ পদ পূর্বে নিজে থেকে কারো ব্যবহার করার অধিকার ছিল না। এটা ছিল নবাব প্রদত্ত উপাধি। সম্মানিত ধনাঢ্য ব্যক্তি ভিন্ন নবাবেরা অন্য কাউকে এই উপাধি দিতেন না। ইংরেজ শাসনের পর সকলেই যত্রতত্র ‘বাবু’ হয়ে গেলেন। পুরানো ধনী সম্প্রদায় বিদায় নিলেন। আবির্ভাব হলো এক নতুন ধনী সম্প্রদায়ের। এরাই তখন বাবু। বাবু নামের রম্যরচনায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেলেন, ‘যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিনীর অনুরোধে লক্ষীপূজা করিবেন, উপগৃহিনীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন, এবং পাটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু’।

কলকাতার কিছু লোক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং কোম্পানীর সাঙ্গপাঙ্গদের বদৌলতে অল্পকালের মধ্যেই বেশ বড়লোক হয়ে ওঠেন। রাজা, মহারাজা উপাধি নিয়ে জুড়িগাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি, মোসাহেব আর দাসদাসীদের নিয়ে কলকাতায় জাঁকিয়ে বসেন। পাশাপাশি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পর বাংলায় নতুন জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এদের একটি অংশ প্রজাদের যারপর নাই শোষণ করে প্রভূত বিত্তশালী হয়ে উঠেছিলেন। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা এই ধনীক এবং নতুন জমিদাররাই কলকাতায় বসবাস করে বাবু সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়ে ওঠেন। নানা ধরনের আমোদ প্রমোদই এই বাবুকুলের একমাত্র আরাধ্য ছিল। নানারকম পূজা উপলক্ষ্যে বা কোনোরকম উপলক্ষ্য ছাড়াই নাচ, গান, যাত্রা, থিয়েটার, বুলবুলির লড়াই, হাফ-আখড়াই, কবিগানের আয়োজনে এই বাবুরা থাকতো সদাব্যস্ত। কার আয়োজন সব থেকে জমাকালো হলো তাই নিয়ে রীতিমতো অলিখিত প্রতিযোগিতা চলতো। এজন্য জলের মতো অর্থ ব্যয় হতো।

ইংরেজরা ক্ষমতায় এসে প্রথম নিজেরাই জমিদার হলো। তারপর নতুন একশ্রেণীর জমিদার-তালুকদার সৃষ্টি করলো এবং নিজেদের লুণ্ঠন চালু রাখার জন্য দালাল, গোমস্তা, মুৎসুদ্দি, দেওয়ান নিয়ে একপ্রকার এদেশী ‘জেণ্টু’ গড়ে তুললো। জমিদার ও জেণ্টু উভয় শ্রেণীর হাতে যথেষ্ট পয়সা জমলো কিন্তু পয়সার কোনো সদগতি হলো না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের মতো এই মজুত পয়সা শিল্পবাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবাধে নিয়োগ করা গেল না। সুতরাং হক্কের ধন ফক্কে উড়তে লাগলো; বাঁদরের বিয়েতে ও বাপের শ্রাদ্ধে লাখ লাখ টাকা খরচ করে, বাঈনাচে, টপ্পা খেউড়ে, বুলবুলির আর মেড়ার লড়াইয়ে, ইংরেজ প্রভুদের উপঢৌকন দিয়ে, উৎসব-পার্বণে বিদেশী প্রভুদের ও দেশী দরিদ্র নারায়ণের সেবা করে। নতুন জমিদারদের সম্পর্কে হুতোম প্যাঁচার নক্সায় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখছেন, ‘ক্ষুদ্র নবাব, ক্ষুদ্র নবাব দিব্যি দেখতে; দুধে আলতার মত রং; আলবার্ট ফেশানে চুল ফেরানো; চীনের শূয়ারের মত শরীরটি ঘাড়ে-গদ্দানে, হাতে লাল রুমাল ও পিচের ইষ্টিক; সিমলের ফিনফিনে ধুতি মালকোঁচা ক’রে পরা, হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, রাজারাজড়ার পৌত্তর; কিন্তু পরিচয়ে বেরোবে “হৃদে জোলার নাতি!”

হুতোম প্যাঁচার নক্সায় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন, ‘সহরে ইংরাজী কেতার বাবুরা দু’টি দল হয়েছেন; প্রথম দল উঁচুকেতা সাহেবের গোবরের গস্ত, দ্বিতীয় “ফিরিঙ্গীর জঘন্য প্রতিরূপ”; প্রথম দলের সকলি ইংরাজী কেতা, টেবিল-চেয়ারের মজলিস, পেয়ালা করা চা, চুরোট, জগেকরা জল, ডিকান্টরে ব্রাণ্ডি ও কাচের গ্লাসে সোলার ঢাক্নি, সালুমোড়া; হরকরা ইংলিশম্যান ও ফিনিক্স সামনে থাকে, পলিটিক্স ও “বেষ্ট নিউজ অব দি ডে” নিয়েই সর্ব্বদা আন্দোলন। টেবিলে খান, কমডে হাগেন এবং কাগজে পোঁদ পোঁছেন। এঁরা সহৃদয়তা, দয়া, পরোপকার, নম্রতা প্রভৃতি বিবিধ সদ্গুণে ভূষিত, কেবল সর্ব্বদাই রোগ, মদ খেয়ে জুজু, স্ত্রীর দাস; উৎসাহ, একতা, উন্নতীচ্ছা একেবারে হৃদয় হতে নির্বাসিত হয়েছে; এঁরাই ওল্ড ক্লাস।’ ’দ্বিতীয়ের মধ্যে; বাগাম্বর মিত্র প্রভৃতি সাপ হতেও ভয়ানক, বাঘের চেয়ে হিংস্র; বলতে গেলে এরা একরকম ভয়ানক জানোয়ার। চোরের যেমন চুরি কত্তে গেলে মদ ঠোঁটে দিয়ে গন্ধ করে মাতাল সেজে যায়, এঁরা সেইরূপ স্বার্থ-সাধনার্থ স্বদেশের ভাল চেষ্টা করেন। “কেমন ক’রে আপনি বড়লোক হব”, “কেমন ক’রে সকলে পায়ের নীচে থাকবে,” এই এঁদের চেষ্টা; পরের মাথায় কাঁটাল ভেঙে আপনার গোঁফে তেল দেওয়াই এঁদের পলিসী, এঁদের কাছে দাতব্য দূর পরিহার; চার আনার বেশী দান নাই।’ চলবে