করোনা ভাইরাস: সঙ্কটের ভয়াবহতা ও উত্তরণ

পর্ব ২

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৫, ২০২০

লক ডাউন দরকার সন্দেহ নেই, কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া আবার লক ডাউন ছাড়াই সংকট কাটিয়ে উঠেছে। চীন যেমন একটা শহরকে বন্দি করে রেখেছিল সেটার যেমন যুক্তি ছিল, দক্ষিণ কোরিয়া যে আবার লক ডাউন করেনি এই চিন্তারও গুরুত্ব আছে। চীন একটা শহরকে লক ডাউন করে বাকি শহরের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রেখেছিল। চীন প্রথমেই বুঝেছিল, সারা চীনকে লক ডাউন করতে হলে সারাদেশের অর্থনীতি আর উন্নয়ন ধসে যাবে। করোনার হাত থেকে তাতে মুক্তি আসলেও মানুষ মারা যাবে না খেয়ে, জীবন ধারণের বস্তুগত সুবিধা হারিয়ে। দেশজুড়ে দেখা যাবে বিশৃঙ্খলা আর হতাশা। সুদূর প্রসারী চিন্তা ছিল সেটা। ফলে একটা শহরের মধ্যে করোনাকে প্রবলভাবে আটকে রেখে ছাড়া দেশকে বাঁচাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল তারা। চীন সেটা করেই খুব স্বল্প সময়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পেরেছে। যদি কেউ লক্ষ্য করেন দেখতে পাবেন, সাধারণভাবে যারা মঙ্গলয়েড ঘরানার তারা যেন কেমন করে করোনাকে ঠেকিয়ে দিয়েছে। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সকলেই নিজেদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়েছে। সকলেই প্রথমে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এটা রুখতে, স্বাভাবিক জীবন যাপনে খুব একটা ব্যহত না করে। মিথ্যা অহঙ্কার না করে আমাদের শেখা উচিৎ, অভিজ্ঞতা নেয়া উচিত নিজেদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থেই।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রস্তুতি কোনো ছেলেখেলা নয়। প্রথম মাথায় রাখা দরকার ছিল, লকডাউন করা হবে কি হবে না। যদি তা করা হয় তবে কারা স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি থাকবেন আর কারা নয়। খুব সহজ কথা, সকলে গৃহবন্দি হলেতো রাষ্ট্র অচল হয়ে যাবে। সবকিছুর শুরু থেকেই এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা, হিসাব আর পরিসংখ্যান করা দরকার ছিল। চাষাবাদের মানুষজনকে কি সত্যিই গৃহবন্দি করে রাখা যাবে? রাখা গেলে কতদিন? দোকানদারদের কি গৃহবন্দি করে রাখা যাবে? বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রি উৎপাদকদের কি গৃহবন্দি থাকতে বলা যাবে? যাদের গৃহবন্দি করা যাবে না, রাষ্ট্র সম্পূর্ণ অচল না করে যাদের মাধমে রাষ্ট্র সচল রাখতে হবে তাদের ব্যাপারে কী উদ্যোগ নেয়া হবে? ভিন্ন দিকে যারা গৃহবন্দি হবেন তাদের মধ্যে যারা দিনে আনে দিনে খান বা যারা মাসের সামান্য বেতনে চলেন, তাদের কী হবে; কী পদ্ধতিতে তারা গৃহবন্দি থাকবেন, তাদের খাবার দাবারের ব্যবস্থা কী হবে; রাষ্ট্র কি তা ভেবে রেখেছিলো? বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে বিশেষ কোনো জেলায় বা দু-একটা অঞ্চলে বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে যেখানে মানুষের কাছে ত্রাণ সামগ্রি ঠিকমতো পৌঁছায় না, সারা দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষকে সেখানে যদি ত্রাণ দিতেই হয়, ত্রাণসামগ্রি পৌঁছাবার উপায় কী হবে? নিশ্চিতভাবে তা জনগণের হাতে যাবে কিনা সে নিয়ে কি উৎকণ্ঠা ছিল কর্ণধর আর উপদেষ্টাদের? সাধারণ মানুষকে এত কিছু না বুঝলেও চলে, কিন্তু রাষ্ট্রের কর্ণধরদের, রাষ্ট্রের উপদেষ্টাদের এসব বুঝতে হয়।

বাংলাদেশ তখনো সংক্রমিত হয়নি, ফেব্রুয়ারি মাসে। ফলে মানুষের তখন আতঙ্কিত হবার কিছুই ছিল না। যদি তখন মানুষকে বলা যেত যে, “সামনে একটা ভয়াবহ বিপদ আসবার সম্ভবনা রয়েছে। যদি আমরা সতর্ক হই তাহলেই রক্ষা পাবো। দু-একজন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ধরা পড়লেই আমাদের অনেককে গৃহবন্দি হতে হবে। সেটা হলে বিপদ আর বেশি বাড়বে না। যদি গৃহবন্দি হতে হয়, যাদের খাবার দাবার থাকবে না, সরকার তাদের খাবার পৌঁছে দেবে।” সরকারের তাহলে প্রস্তুতি থাকতো, মানুষও প্রস্তুতি নিয়ে রাখতো। মানুষ আগে থেকেই একটা পরিকল্পনা নিতে পারতো, সেরকম পরিস্থিতি হলে কী করবে। যারা গ্রামে যেত, রাতারাতি হৈ হুল্লোর করে যেতে হতো না। সংক্রমণ ছড়াতে পারতো না। যদি বহু আগে থেকে সে পরিকল্পনা থাকতো, তাহলে বিদেশ থেকে যারা আসছেন, তাদের ব্যাপারেও কীভাবে কী করা হবে সে পরিকল্পনাটাও থাকতো। কিন্তু কারো কোনো পরিকল্পনা ছিল না। যখন করোনা ভাইরাসের আক্রমণে চীনের পর ইতালি ও স্পেন দিশেহারা হয়েছিল, বাংলাদেশের সকল টেলিভিশনগুলিকে কাজে লাগানো যেত সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মানুষকে সচেতন করলে মানুষ সচেতন হবে না, সেটা কি বিশ্বাস করতে হবে? কিন্তু সেটা আমরা করেছি কি না? না করেই জোর দিয়ে বলছি কী করে যে, মানুষ সচেতন নয়? যারা দেশের কর্ণধর, তারাই তো বিশ্বাস করেননি করোনার ভয়াবহ রূপটা কী হতে পারে। ফলে জনগণকে বিশ্বাস করানো প্রচেষ্টাও ছিল না।

এরই মধ্যে বাংলাদেশ মহামারির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে সংক্রমণের হার বিভিন্ন বিপর্যস্ত দেশের চেয়ে বেশি। মৃতের হারও অন্যদের চেয়ে বেশি। গরম আবহাওয়া আমাদের রক্ষা করতে পারছে না। নানারকম গুজব কোনো কাজে লাগছে না। বিজ্ঞানমনস্কতার অভাবে সকলেই আমরা সংক্ষিপ্ত রাস্তা খুঁজি, সর্টকাটে সব সেরে ফেলতে চাই। কিন্তু কেউ আর এখন ঘটনায় দায় স্বীকার করছে না। ছুটি দেয়ার লক্ষ্য কী, বা ‘লক-ডাউন’ আর ‘ছুটি’তে পার্থক্য কী কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। যারা গৃহবন্দি না থাকার জন্য সাধারণ মানুষের উপর ক্ষেপে যাচ্ছেন, তাদের বলতে চাই, বিভিন্ন ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা যে ত্রাণ দেয়ার নামে, দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তারা কি সংক্রমিত করছেন না? বহুজন প্রশাসন চালাবার নামে দলবল নিয়ে দেখেছি আসর জমাচ্ছেন, সেটা কি সংক্রমণের কারণ নয়? এরা তো লেখাপড়া জানা, তথাকথিত শিক্ষিত ক্ষমতাবান মানুষ। মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষ ক্ষমতাবানদের স্বভাবের বহুকিছু নিজের অজান্তে রপ্ত করে, সে দোষটা তাদের নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পোষাকশিল্পের মালিকদের উদাহরণটা টানতেই হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে এপ্রিলের এগারো পর্যন্ত ছুটি ঘোষণাার পর তারা কী করেছেন? লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে বিপদে ফেলেছেন। সত্যিই কি তারপর বলতে হবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার দায় সাধারণ শ্রমিকদের?

নিজে আমি বিশ্বাস করি, সকল কিছুর পরে বাংলাদেশকে যদি কেউ করোনা সংক্রমণের বিপদ থেকে রক্ষা করে তা হলো ঐ নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষ ছোটলোকরা। সত্যি বলতে ঐ মানুষগুলির উপর আমার অনেক বেশি আস্থা। বাংলাদেশের এই দুর্দিনে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াবার এই দিনগুলিতে আপনার মতো আমিও বিশ্বাস করি, সবচেয়ে প্রয়োজন এখন গৃহবন্দি থাকা। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও বিশ্বাস করি, এর জন্য কিছু শর্ত রয়েছে, সেটা পালিত না হলে মানুষকে গৃহবন্দি করা যাবে না। কর্মকর্তাদের একজন দেখলাম প্রস্তাব করেছেন, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে আরো বিনোদন দিতে হবে, যাতে মানুষ ঘরে আটকে থাকে। তিনি বিনোদন বলতে যে কী বোঝেন সেটা একটা দুর্বোধ্য বিষয় হয়ে রইলো। টেলিভিশনে বিনোদন দেয়ার আগে গৃহবন্দি অসহায় মানুষকে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। যেসকল দরিদ্র কর্মজীবী মানুষ এ মুহূর্তে গৃহবন্দি আছেন, মনে রাখতে হবে চিকিৎসকদের জায়গায় আগামী দিনে তারাই হবেন সার্বিক অর্থনীতির বড় সৈনিক। চিকিৎসকদের দায়িত্ব তখন অনেক কমে যাবে, কর্মজীবী মানুষের দায়িত্ব বাড়বে। ফলে তারা যেন সুস্থ থাকেন, সুগঠিত থাকেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কর্মক্লান্ত মানুষ যারা কোনোদিন বিশ্রাম পায় না, বিশ্রাম কী জানে না; খাবার পেলে নিশ্চিন্তে তারা খুশি মনে ঘরে কিছুদিন বিশ্রাম নেবে। টেলিভিশন শুধু তাদের সজাগ করে দেবে, তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে। খাবার না পেলে মানুষের মস্তিস্ক যে ঠিকভাবে কাজ করে না, মহাভারত থেকে আধুনিক বিজ্ঞান তা স্বীকার করে থাকে। চলবে