করোনা ভাইরাস টেস্ট: কি, কেন, কিভাবে

অপূর্ব চৌধুরী

প্রকাশিত : মে ৩০, ২০২০

করোনা প্যান্ডেমিক কমে গেলে সামনে একটি ব্যাপার নিয়ে সুস্থদের মধ্যে চাহিদা দেখা দেবে। এই মুহূর্তে সামাজিক দূরত্ব এবং যোগাযোগের অসুবিধার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকেই তা করতে পারছে না। সেটি হলো, টেস্ট। করোনা ভাইরাস টেস্ট।

অসুস্থ হয়ে যত না টেস্ট করেছে লোকে, সামনে সুস্থ লোকজন টেস্ট করে নিশ্চিত হতে চাইবে তার হয়ে গেলো কিনা। কারণ অনেকেই মাইল্ড কিছু লক্ষণে ভুগে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। অনেকে হয়তো জানেই না, তার শরীরে ভাইরাসটি এসে ঘুরে গেছে। অনেকে নিশ্চিত হতে চাইবে তার হবার সম্ভাবনা আছে কিনা। এমনকি যাদের হয়ে গেল, তারাও চিন্তিত থাকবে আবার হতে পারে কিনা।

এমনসব জটিলতার কারণে সামনের দিনগুলোতে করোনা টেস্ট যেমন সবচেয়ে বড় বাজার, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, প্রতিটা দেশের সরকারের মাথাব্যথা, বিশাল সংখ্যক মানুষের টেস্ট করা এই মুহূর্তে করোনা প্রতিরোধের অন্যতম একটি স্ট্রাটেজি বটে। এ নিয়ে যেমন প্রতারণার বাজার, এ নিয়ে যেমন সাধারণ মানুষের খুব কম জানা, এ নিয়ে ডাক্তার কিংবা চিকিৎসা কর্মীদেরও সঠিক তথ্যটির অনেক বড় অভাব।

কথা হলো, কিসের টেস্ট? কোভিড ১৯ হলে নিশ্চিত হতে তিনটি মাত্র টেস্ট আছে। জীবাণু টেস্ট, এন্টিজেন টেস্ট ও এন্টিবডি টেস্ট। প্রতিটির বিশদ বলার আগে মজার একটি কাহিনি বলি। শুধু সাধারণ মানুষ ধরা খায় না, ইংল্যান্ডের মতো স্মার্ট সরকারও অনেক সময় ধরা খায়। ২৪ মার্চ ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টার জনগণকে সান্ত্বনা দিতে ঘোষণা দিলেন, এপ্রিল থেকে করোনা ভাইরাসের এন্টিবডি টেস্ট কীট ঘরে ঘরে পাঠানো হবে।

আড়ালে সিভিল সার্ভেন্টরা বিশ্ববাজার যাচাই বাছাই করে চায়নার একটা কোম্পানিকে অর্ডার দিলো দুই মিলিয়ন এন্টিবডি টেস্ট কীটস। চায়না বেশ চালাক। সুযোগ বুঝে অগ্রিম দাম চেয়ে বসলো। কীটস পাওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে বিশ মিলিয়ন পাউন্ড পরিশোধ করে দিলো ব্রিটিশ সরকার। কীটস হাতে আসার পর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিম পরীক্ষা করে দেখলো যে, এই কীটস প্রচুর ভুল রেজাল্ট দিচ্ছে, অনেক ফলস পজিটিভ নেগেটিভ আসছে, মোটেও রিলায়েবল নয়।

ব্রিটিশ সরকার চুপিচুপি এই পরিকল্পনা থেকে সরে গেল। টেস্ট করাতো দূরের কথা, পয়সাটাই গচ্চা গেল। সরকার আড়ালে চাইনিজ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছে। লোকলজ্জার ভয়ে এই স্ক্যান্ড্যাল তেমন বাজারে আসছে না। আরো মজার হলো, শুধু একা ব্রিটেন নয়, আমেরিকা, জার্মানি, ইতালি, তুরস্ক এবং নেদারল্যান্ডও এই কীটস নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ধরা খেয়েছে। প্যান্ডেমিক ডামাডোল এসব ব্যর্থতা আড়ালে রাখছে আপাতত। আন্তর্জাতিক প্রতারণার বাজারের সাথে লোকাল বাজারেও প্রতারণা আছে এবং থাকবে।

মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পুরো পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র ২.৫ % এর এই টেস্টগুলো করা হয়েছে। সে হিসাবে এখনো পর্যন্ত টেস্ট করা লোকের সংখ্যা মাত্র ২০ কোটি। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা এই মুহূর্তে আট বিলিয়নের চেয়ে একটু কম। মানে আটশো কোটি। প্রতি হাজারে সবচেয়ে বেশি টেস্ট করেছে এই পর্যন্ত ডেনমার্ক। প্রতি হাজারে ১৭ জনের মতো। মার্চ মাসের ৭ তারিখে বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত কারো সন্ধান পাওয়া যায় টেস্টে। তারপর থেকে মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ২.৫ লক্ষের বেশি লোকের টেস্ট করা হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন পাঁচ হাজারের চেয়ে বেশি টেস্ট করা হয় সারাদেশের ৪৯টি টেস্ট ল্যাবে। আঠারো কোটি মানুষের জন্যে ভেন্ট্রিলেটর আছে মাত্র ৫৫০ টি। ICU বেড আছে দেড় হাজারের মতো। প্রতি এক লক্ষের জন্যে একটির চেয়ে কম বেড।

ব্রিটেনে ছয় কোটি মানুষের জন্যে ICU বেড ছিল ছয় হাজারের বেশি, করোনার কারণে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে চল্লিশ হাজারের বেশি। সারাদেশে হাসপাতাল বেড আছে তিন লক্ষের উপরে। ব্রিটেনে এই মুহূর্তে প্রতিদিন গড়ে আশি হাজারের বেশি করোনা ভাইরাসের টেস্ট করা হয়।

শুরুতে বলেছিলাম, করোনা ভাইরাস SARS-CoV-2 এ আক্রান্ত হলে জানার উপায় তিনটি। মানে তিন ধরনের টেস্ট। আরেকটু সহজ করতে বলা যায়, আসলে দুই ধরনের টেস্ট। একটি হলো, শরীর জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে কিনা তার টেস্ট। আরেকটি হলো, শরীর আগে কখনো জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল কিনা তার টেস্ট। শরীরে জীবাণুটি আছে কিনা তা জানতে দুটো টেস্ট আছে। ভাইরাস টেস্ট ও এন্টিজেন টেস্ট। আগে জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল কিনা তা জানতে একটি টেস্ট।

করোনা ভাইরাসের মূল টেস্টটি ভাইরাস টেস্ট বা জীবাণু টেস্ট। সংক্ষেপে এই টেস্টটিকে বলা হয় PCR টেস্ট । PCR ভাঙলে হয় Polymerase Chain Reaction। এটি একটি রাসায়নিক পদ্ধতির নাম, যে পদ্ধতিতে একখণ্ড DNA থেকে হাজার হাজার কপি করা যায়। বিজ্ঞানের ভাষায় PCR কে মজা করে বলে, মলিকুলার ফটোকপি। একখণ্ড DNA খুব ছোট একটি অংশ। কিন্তু পরীক্ষা করতে হাজার হাজার DNA লাগে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এমনিতেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র, তারও হাজারগুন ন্যানো ক্ষুদ্র এই DNA। কোষের এই DNA এর ভেতর কোষের সব বৈশিষ্ট লুকিয়ে থাকে।

আরো চল্লিশ বছর আগে একখণ্ড DNA পৃথক করে তার থেকে হাজার-লক্ষ কপি করতে কয়েকদিন লেগে যেত। ১৯৮৩ সালে আমেরিকান রসায়নবিদ Kary Banks Mullis অল্প সময়ে অনেকগুলো DNA কপি করার এই PCR পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন। তার এই অসামান্য আবিষ্কার জেনোমিক গবেষণায় আমূল পরিবর্তন করে দিলো। ১৯৯৩ সালে এ কারণে Mullis কে রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। আজ এই PCR পদ্ধতিটাই করোনা ভাইরাস টেস্ট করার সবচেয়ে বেস্ট পদ্ধতি সারা পৃথিবীতে। কেমন করে এটি করা হয়, বলছি সহজ করে।

PCR পদ্ধতিটি যে মেশিনের মধ্যে করা হয় তাকে PCR মেশিন বলে। এই  মেশিন নিয়ে একটু পর বলবো। আগে মলিকুলারের এই কঠিন পদ্ধতিটাকে সহজ করে বুঝে নেই। যে জীবাণুটি পরীক্ষা করা হবে, তার সেম্পল থেকে তার DNA নিয়ে একটি টেস্ট টিউবে রাখা হয়, সাথে DNA Plymerase নামের একধরনের এনজাইম দেয়া হয়, আর একধরনের লবণ মিশিয়ে টেস্ট টিউবটি মেশিনে ঢুকানো হয়। পুরো মেশিনের কাজ অটোমেটেড, মানে স্বয়ংক্রিয় সব হয় একের পর এক।

DNA হলো সাপের মতো প্যাঁচ করে থাকা দুটো দণ্ড। প্রথমে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এটাকে আলাদা করা হয়। তারপর প্রতিটি দণ্ডকে বিশেষ ধরনের লবণ জলের মধ্যে থাকা নিউক্লিক অ্যাসিডকে পলিমারেজ এনজাইমগুলো জোড়া লাগিয়ে নতুন আরেকটি পূর্ণাঙ্গ DNA বানায়। এই Polymerase উপাদানটি চেইনের মতো হাজার হাজার নতুন DNA কপি করে তৈরি করে ফেলে। তাই এর নাম PCR বা polymerase chain reaction! এরকম দুই তিন ঘণ্টায় কয়েকটি সাইকেলে মিলিয়ন মিলিয়ন নতুন DNA তৈরি করা যায় PCR মেশিন দিয়ে, পরে তা পরীক্ষা করে সহজে জীবাণুটিকে ধরা যায়।

কিন্তু সমস্যা হলো, করোনা ভাইরাসের ভেতর কোনো DNA থাকে না। শুধু RNA থাকে। তাই শুধু PCR মেশিন দিয়ে করোনা ভাইরাস নির্ণয় একটু সময় সাপেক্ষ। প্রথমদিকে তাই করা হতো। কিন্তু এখন PCR মেশিনগুলো আরো উন্নত মানের। আগে আলাদা করে ভাইরাসের RNA কে একটি বিশেষ উপায়ে DNA তে রূপান্তরিত করা হয়। প্রতিটা RNA এর ভিতর থাকে আসলে DNA এর একটি কপি বা ছায়া। Reverse Transcriptase নামের একটি এনজাইম দিয়ে RNA থেকে DNA এর ছায়াটিকে বের করা হয়। এই DNA কে বলে cDNA বা Complementary DNA। পুরো পদ্ধতিটাকে বলে Reverse transcription।

এই পদ্ধতিতে RNA থেকে DNA বের করে PCR মেশিনে নতুন হাজার হাজার DNA করার পদ্ধতিটিকে বলে RT-PCR। RT মানে Reverse transcription। করোনা ভাইরাসের টেস্ট করা হয় মূলত বেসিক PCR মেশিনের থেকে আরো উন্নতমানের RT-PCR মেশিনে। এখন আরো উন্নত ব্যবস্থা আছে PCR মেশিনগুলোতে। অ্যাডভান্স টেকলোজিতে কম্পিটারাইজড qPCR এবং RT-qPCR। জার্মানি, মার্কিন, ইংল্যান্ড, চীনসহ অনেক দেশের বায়োটেকনোলজির কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ধরনের PCR মেশিন বানায়। একটি বেসিক PCR মেশিন পাঁচ লক্ষ থেকে পনেরো লক্ষ টাকা। এডভান্স RT কিংবা RT-qPCR মেশিনগুলো কোম্পানিভেদে বিশলক্ষ থেকে এক কোটি টাকা।

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সম্ভবত ৪৯টি ল্যাবে করোনা ভাইরাসের টেস্ট করানো হয়। যতটুকু জানি, বেশিরভাগ মেশিন বেসিক PCR! ঢাকায় হয়তো অল্প কয়টি RT-PCR মেশিন আছে। বিস্তারিত পরিসংখ্যান জানা নেই। করোনা বিষয়ক স্বাস্থ্য অধিদফতর নিজেই জানে কিনা সন্দেহ আছে। PCR পদ্ধতিটিকে করোনা ভাইরাস টেস্টের গোল্ডেন মেথড ধরা হয়। তাই এই পদ্ধতি WHO কর্তৃক স্বীকৃত এবং পৃথিবীর সবদেশেই করোনা ভাইরাসের একমাত্র ল্যাব টেস্ট ধরা হয়। আরো একটি পদ্ধতি আছে, নাম Isothermal amplification assays। পদ্ধতিটি কম রিলায়েবল, কিন্তু PCR এর চেয়ে সস্তা এবং দ্রুত করা যায়। PCR পদ্ধতিটি করতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে।

এন্টিবডি টেস্ট
এমন অনেকে আছে, লক্ষণ দেখা দিয়েছিল কিন্তু টেস্ট করায়নি, কিছুদিন পর ভালো হয়ে গেল। তবে নিশ্চিত নয় যে, শরীর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ছিল কিনা। আবার এমন অনেকেই আছে বা ছিল বা থাকবে যে, তারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল, কিন্তু শরীরে কোনো লক্ষণ দেখা দেয়নি। এমন অবস্থাগুলোতে আপনার শরীরে করোনা ভাইরাসের কারণে তৈরি হওয়া এন্টিবডি আছে কিনা তা জানার মধ্যে দিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। এই এন্টিবডি টেস্টটিতে রক্ত নিয়ে রক্তের মধ্যে দেখা হয়। আরেকটি বিস্তারিত বললে রক্তের সিরাম নামক অংশে এন্টিবডির উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।

এন্টিজেন টেস্ট
সহজ করে বললে, করোনা ভাইরাসের জীন চিহ্নিত করতে উপরের PCR টেস্ট। করোনা ভাইরাস এট্যাক করে চলে গেছে, কিন্তু চিহ্ন রেখে গেছে শরীরকে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এন্টিবডি তৈরি করে। সেই এন্টিবডি চেক করতে এন্টিবডি টেস্ট করা হয়। করোনা ভাইরাস শরীরে ঢোকার সাথে সাথে সিমটম ভালোভাবে প্রকাশ পাওয়ার আগেই অথবা পরে শরীরের B সেল থেকে B cell receptor নামের একধরনের প্রোটিন এসে ভাইরাসগুলোর গায়ে এসে বসে। করোনা ভাইরাসের গায়ে কতগুলো স্পাইকের মতো প্রোটিন থাকে। এই স্পাইক প্রোটিন এবং B cell receptor প্রোটিন মিলে করোনা ভাইরাসটিকে আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য দেয়। এটার কারণ হলো, পরবর্তীতে B সেল থেকে বের হওয়া এন্টিবডি এবং T সেল ডাইরেক্ট যেন জীবাণুটিকে চিনে মেরে ফেলতে পারে। না হলে ভুল করে শরীরের ভালো কোষগুলোকে যদি এট্যাক করে বসে এন্টিবডি! তো এই বিশেষ ট্যাগ সম্পন্ন ভাইরাসটিকে তখন বলে এন্টিজেন। এন্টিজেন টেস্টে এই বিশেষ প্রোটিনটিকে চিহ্নিত করার মধ্যে দিয়ে করোনা ভাইরাসটি আছে কিনা শরীরে, তা বোঝার চেষ্টা করা হয়।

এন্টিজেন পদ্ধতিটি খুব সস্তা, সহজ এবং অল্প সময় লাগে। মাত্র ১০ থেকে পনেরো মিনিট লাগে। কিন্তু একটা কথা আছে, সস্তার তিন অবস্থা। পদ্ধতিটি সহজ করে বললে, কথাটির মর্ম বুঝবেন। এন্টিজেন টেস্ট পদ্ধতিতে নাক থেকে সোয়াব নিলেই চলে। সেই সোয়াব ল্যাবে নিয়ে বিশেষ ধরনের এন্টিজেন প্রোটিন চিহ্নিত করার মেশিনে কিছু ক্যামিক্যাল সহকারে ঢোকানো হয়। দশ মিনিটের মধ্যে ফলাফল জানিয়ে দেয় করোনা ভাইরাসের সেই বিশেষ এন্টিজেন প্রোটিনটি আছে কিনা। শুনতে মনে হয় কত সহজ এবং দ্রুত। আসলে টেস্টটি মোটেও রিলায়েবল নয়। প্রচুর ফলস পজেটিভ আসে এবং আসতে পারে। এমনকি পজিটিভ ছিল কিন্তু রেজাল্ট নেগেটিভ আসতে পারে। কারণ হলো, সেই সয়াবে খুব অল্প করোনা ভাইরাস থাকতে পারে, অথবা সেই ভাইরাসগুলি গায়ে B সেল রিসেপ্টর এসে যুক্ত হয়ে এন্টিজেন প্রোটিন হয়ে ওঠেনি। ফলে ফলস রেজাল্ট আসতেই পারে সহজে। কিন্তু PCR পদ্ধতিতে একটি DNA পেলেও তাকে মিলিয়ন কপি বানিয়ে নিশ্চিত হতে হয় ভাইরাসের উপস্থিতি। তাই PCR পদ্ধতিটি তুলনামূলক নির্ভুল।

এন্টিজেন টেস্ট খুব একটা করা হয় না। তাৎক্ষণিক এবং দ্রুততার জন্যে অনেক দেশে এন্টিজেন টেস্ট করার অনুমতি আছে এবং করা হয়। যাদের ৱ্যাপিড টেস্ট বলা হয়। কিন্তু নিশ্চিতকরণের জন্যে পরে PCR পদ্ধতিতে করে ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাস টেস্টে কোন ধরনের ৱ্যাপিড টেস্টকে অনুমোদন করে না। বাজারে এ নিয়ে অনেক প্রতারণা আছে। এই প্রতারণার শিকার যাতে না হোন, তার জন্যেই এই সচেতনমূলক লেখা।

করোনা ভাইরাসের টেস্টের নাম করে বিভিন্ন হোম কীটস বাজারে দেখবেন। তাদের বেশিরভাগই এই এন্টিজেন্ট টেস্ট পদ্ধতির কীটস! ৱ্যাপিড টেস্ট কীটস। নাক থেকে সোয়াব নিয়ে তাদের ঠিকানায় পাঠালে চব্বিশ ঘণ্টায় রেসাল্ট জানায় তারা। পুরাই ভুয়া একটি ব্যবসা। এই ফাঁদে পা দেবেন না। তারা PCR পদ্ধতিতে চেক করছে কিনা নিশ্চিত হবেন। ইংল্যান্ড আমেরিকা ইউরোপের অনেক প্রাইভেট কোম্পানিও এসব প্রতারণা করে। তারা দাবি করে, ষাট থেকে সত্তর ভাগ সঠিক ফলাফল দেয়। বাস্তবে তা হয় না। প্রতিটা সরকার তাই আলাদা করে ল্যাব বেইজড PCR পদ্ধতি ছাড়া করোনা ভাইরাসের রেসাল্টকে পজেটিভ ধরে না। বাংলাদেশে এরই মধ্যে হয়তো এই প্রতারণার বাজার শুরু হয়ে গেছে। দেশে থাকি না বলে দেশের কিছু জানি না। এ প্রসঙ্গে মজার আরেকটি বিষয় বলি।

সম্প্রতি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণের কীটস `ডট ব্লট` নিয়ে মিডিয়াতে হৈচৈ দেখলাম। ওনার কীট্স সম্পর্কে কিছুই তেমন জানি না। শুধু জানি, খুব সস্তা এবং দ্রুত, ৱ্যাপিড টেস্ট দাবি করেছে তারা। খরচ মনে হয় তিনশো টাকা। সেনেগালেও একই ধরনের একটি ৱ্যাপিড টেস্ট কীটস বাজারে আছে, খরচ এক ডলার। ওই দিন দেখলাম, জাফরুল্লাহ সাহেব করোনায় নাকি আক্রান্ত হয়েছেন। কি করে বুঝলেন? খবরটি পড়ে যেটা জানতে পেলাম, ডা. জাফরুল্লা তার গণস্বাস্থের ডট ব্লট কীটস দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, তার শরীরে ভাইরাসটির এন্টিজেন পেয়েছেন। তার মানে তার কীটস এই এন্টিজেন্ট টেস্ট পদ্ধতির কীটস! যদিও কিছুই জানি না এই টেস্ট কীট্সটি সম্পর্কে, তাদের ওয়েবসাইটেও খুঁজেছি এ সম্পর্কে তথ্য, কিন্তু কিছুই পাইনি। যদি এটি সত্যি সত্যি এন্টিজেন টেস্টের কীটস হয়, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই কীটস আরেকটি প্রতারণা ছাড়া কিছুই না! এটি মানুষকে ভুল রেজাল্ট দেবে অনেক বেশি। যে কারণে এটি অনুমোদন দিলে জনগণের আরো ক্ষতি হবে। আক্রান্ত লোকে ভুল রেজাল্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াবে।

সাময়িক কিছু ভুল হোক, তারপরেও সরকারের দেয়া ল্যাবগুলোর উপর আস্থা রাখুন। সেখানেই টেস্ট করাবেন করোনার। বাজারের বা ক্লিনিকগুলোর প্রতারণায় পা দেবেন না। নিজে সচেতন হোন, অন্যকেও সচেতন করুন।

সূত্র:
ক. The Lancet
খ. British Medical Journal
গ. European Journal of Radiology
ঘ. Nature
ঙ. Oxford Academic Clinical Chemistry
চ.  ACP Journals- Annals of Internal Medicine
ছ. The Centre for Evidence-Based Medicine

লেখক: চিকিৎসক ও লেখক। জন্ম বাংলাদেশ, বসবাস ইংল্যান্ড। প্রকাশিত গ্রন্থ সাতটি। উল্লেখযোগ্য বই: অণুকথা, জীবন গদ্য, বৃত্ত।