করোনা ভাইরাস এবং রোজা
ড. অপূর্ব চৌধুরীপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৪, ২০২০
উপবাস, ফ্যাস্টিং কিংবা রোজা, যিনি যে বিশ্বাস থেকে বলুন, খাদ্য হতে একটি নির্দিষ্ট সময় বিরত থাকাই উপোষ রীতি। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম, পৃথিবীর প্রায় প্রধান প্রধান সব ধর্মে উপবাস রীতি বা রোজার প্রচলন আছে। যদিও শিখ ধর্মে উপবাস রীতি বারণ করা হয়েছে। পৃথিবীতে ছোট বড়ো হাজার চারেকের বেশি ধর্ম আছে। জগতের আশিভাগ লোক প্রধান ১২টি ধর্মে বিশ্বাস করে।
খুব প্রাচীন দিয়ে শুরু করি। প্রশান্ত মহাসাগরীও দ্বীপ পাপুয়া নিউ গিনির Wopkaimin এ ১৯৮০ সালে আদিবাসীদের উপর একটি গবেষণা হয়েছিল। Ulijaszek এর নেতৃত্বে রিসার্চ টিম দেখতে পেল, তারা শিকারের দিন বের হওয়ার আগে সকালে নাস্তা করে না। জিজ্ঞেস করে জানলো যে, এটি নাকি তারা করে হাজার হাজার বছর ধরে। যেদিন শিকারে বের হয়, তার আগের রাত থেকে উপবাস করে। এতে শিকারের সময় শরীরে হালকা অনুভব করে, মাথা ক্লিয়ার কাজ করে, মনোসংযোগ বৃদ্ধি পায় এবং অনেকক্ষণ শিকারে থাকতে পারে। পরবর্তীতে Mattson এবং তার বিজ্ঞানীদল ইঁদুরের কগনিটিভ স্টাডি করতে গিয়ে দেখতে পেল যে, শরীর যখন একটি নির্দিষ্ট সময় খাবার পায় না, তখন লিভার জমিয়ে রাখা ফ্যাট সেল ভেঙে কিটোন তৈরি করে শরীরের পেশিতে শক্তি যোগায়।
এই কিটোন বেড়ে গেলে সে আবার মস্তিষ্কের নিউরণে BDNF নামের কেমিক্যালটি বের করে, এই উপাদানটি নিউরণ আন্তঃসংযোগ বাড়িয়ে দেয়। স্নায়ুকোষ বা নিউরণ যত বেশি কানেক্ট করতে পারে, মেন্টাল ক্লেরিটি তত বেড়ে যায়। সাময়িক উপবাসে মাথার শক্তি এবং শরীরের শক্তি, দুটোই বেড়ে যায়। প্রাণীদের মধ্যেও উপবাস আছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কুকুর, বিড়াল, পিঁপড়া, এমনকি এককোষি ইস্ট কখনো কখনো তাদের ক্যালোরি ইনটেক ৪০% কমিয়ে দেয়। এতে তাদের শারীরিক কিছু উপসর্গ চলে যায়, অধিক সময় পর্যন্ত বাঁচে।
হিন্দু ধর্মে চন্দ্র মাসের এগারোতম দিন, যাকে একাদশী বলে, নিয়ম করে প্রতিমাসেই উপবাস করে অনেকে। সাথে পূর্ণিমার রাতে কেউ কেউ। এছাড়া নবরাত্রিতে নয়দিনের এবং শিবা`র জন্মদিন শিবরাত্রিতে অনেকে উপবাস করে। পুরো ভারতে না করলেও পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে দুর্গাপুজোর সময় আটদিনের অষ্টমীতে অনেকে উপবাস করে। বৌদ্ধ ধর্মের বিনয়া মতের ভিক্ষুরা দুপুরে ভারি কিছু খাওয়ার পর থেকে পরদিন শেষরাত্রি পর্যন্ত ভারি কিছু খায় না। খুব দরকার পড়লে বিকেল বা সন্ধ্যায় পানীয় জাতীয় কিছু খায়।
ইহুদি ধর্মে তাদের ধর্মীয় বছর শুরুর প্রথম ছয়দিন যে কোনো ধরনের খাওয়া থেকে পুরো দিন বিরত থাকে। সাথে আরো ছয়টি উৎসবের আগে-পরে উপবাস করে তারা। ইহুদিদের উপবাসে এবং মুসলিমদের রোজায় না খাওয়ার সাথে সাথে কোনো পানিও পান করা যাবে না এই সময়ে। আর কোনো ধর্মে উপবাসের সময় পানি পানের নিষেধাজ্ঞা নেই। খ্রিস্টান ধর্মে বিশেষ করে গ্রীক অর্থোডক্স খ্রিস্টিয়ানরা তিনটি ফেস্টিভেলে Fasting করে। Nativity, Lent এবং Assumption। অন্যরা Daniel Fast সময়ে কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকে। অর্থোডক্সরা সব মিলে সারা বছর প্রায় ৪০ দিন এমন না খেয়ে থাকে। তাদের কেউ কেউ সেটা বছরের ছয় মাস পর্যন্ত মানে। ১৮০ দিন।
ইসলামিক ক্যালেন্ডারের নবম মাস রমজান। এই রোজার মাসে মুসলিমরা পুরো এক মাস ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো ধরনের খাদ্য, পানীয়, এমনকি শারীরিক আনন্দ থেকে বিরত থাকে। রমজানের এই রোজা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে ফরজ বা আবশ্যকীয়। বছরের বাকি কিছু সময়ে কারো মতে সুন্নত বা মহানবি (স.) যা করতে পছন্দ করতেন, কারো মতে নফল বা যা ব্যক্তির পছন্দের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে, এমন সময়গুলোতেও কেউ কেউ রোজা রাখে। যেমন: কুরবানির সময়ে আরাফাতের দিন, মহরমের দশম দিনে, শাওয়াল মাসের প্রথম ছয়দিন।
আজ থেকে পশ্চিমের কোথাও কোথাও রোজার শুরু। বাংলাদেশ এবং ভারতে কাল থেকে রোজা। তাই এখন করোনা ভাইরাস এবং রোজা নিয়ে বলবো। করোনা পরিস্থিতিতে কি করবেন, কি করবেন না, কেন করবেন, কেন করবেন না— এখন সেটা বলবো।
পুরো মাসজুড়ে ঘরেই ইফতার করবেন। ধর্মীয় উৎসাহে কোনো ধরনের ইফতার পার্টি, হোক সেটা আত্মীয় স্বজন, আয়োজন করবেন না, এমন আয়োজনে যাবেনও না। তারাবি ঘরেই পড়বেন, কোনোভাবেই মসজিদে যাবেন না। ইফতারের পর প্রচুর পানি খাবেন। সারাদিনের ডিহাইড্রেশন শরীরের ইম্যুনিটিকে দুর্বল করে ফেলে। ইমিউনিটি কমে গেলে অল্পতেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন, আক্রান্ত হলে খুব দ্রুত শরীরের পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। ডিহাইড্রেশনে ফুসফুসের মিউকাস কমে যায়। মিউকাস ফুসফুসকে রক্ষা করে জীবাণুর আক্রমণ থেকে। মিউকাস হলো নাক মুখে জীবাণু ঠেকানোর প্রহরী। গার্ড বিদায় করে দিলে ঘরে যে কেউ ঢুকে যাবে।
রোজায় শরীরে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট যেমন বিভিন্ন ভিটামিনের ঘাটতি বেড়ে যায়। এজন্যে ইফতারে তাজা ফল, বাদাম, ডাল এসব রাখুন। সেহেরিতে নিয়মিত শাকসবজি ও মাছ খাবেন। মাংস প্রতিদিন না খেয়ে সপ্তাহে দু’দিন খান সেহেরিতে। ইফতারে তেল বেশি এমন খাবার পরিহার করলে ভালো, না পারলে অল্প খান।
তারাবির নামাজ পড়ে এক থালা ভাত না খেয়ে এক বাটি সালাদ খান। সেই সালাদে যত পারেন তাজা সবজি রাখেন। রোজার সময়টি এলে বছরের সময়ভেদে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা হয়। তার মানে খাওয়ার সময়টি আসলে আট থেকে দশ ঘণ্টা হয়। এখন ইফতার, রাতের খাওয়া, সেহেরি, এই অল্প সময়ে এমন করে তিন বেলা ঠেসে ঠেসে খেলে রোজার উপকারিতার চেয়ে নিজের ক্ষতি করবেন বেশি। ইফতার এবং সেহেরি— শুধু দু’বার খান।
ইফতারের সময় একগাদা খাবার একসাথে খাবেন না। সারাদিন অভুক্ত থেকে হঠাৎ করে একসাথে খাবার পেটের ক্ষতি করে, পরিপাকে গোলযোগ লাগায়। ভালো হয় পানি, খেজুর কিংবা শুকনো কিছু খেয়ে মাগরিবের নামাজটি পড়ুন। এই সময়ে পানি এবং খাবার পেয়ে পেট হাইড্রো ক্লোরিক এসিড সিক্রেট করবে। পেটকে প্রস্তুত করে ফেলবে পরবর্তী খাবারের জন্যে। নামাজ শেষে ধীরেসুস্থে বাকি ইফতার সময় নিয়ে খান। পারলে এই সময়টিতে যারা ভেতো বাঙালি, একবেলা ভাতের চেহারা না দেখলে ঘুমেও উৎরানো মাড় দেখেন, তারা ভারি কিছু খেয়ে নেন। রোজার সময় বিরিয়ানি, আখনির চেয়ে কম তেলের পাতলা খিচুড়ি পেটের জন্যে ভালো।
শরীরে রোগ প্রতিরোধে শক্তির ভারসাম্য থাকতে হয়। রোজায় যেহেতু দিনের বেলার ক্যালোরি কম নিচ্ছেন, রাতে যেন খাবারে বৈচিত্র্য রেখে ক্যালরিটি পুষিয়ে নিন। করোনা প্যান্ডেমিক পরিস্থিতিতে রোজার কারণে একটু শুকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, শরীর দুর্বল করে ফেলা— এসব ধ্বংসাত্মক কাজে যাবেন না। শরীর দুর্বল হলে জীবাণু সহজে কাবু করবে আপনাকে। নিজেকে এই পরিস্থিতিতে ঠেলে দেবেন না। শরীর বিশ্বাস মানে না, শরীর শরীরের ধর্ম মানে।
ডায়াবেটিস যদি ভালোভাবে কন্ট্রোলে থাকে, ডায়াবেটিকদের বলবো, রাখতে পারেন রোজা। তবে এবারের পরিস্থিতিতে যেহেতু এক্সট্রা সতর্কতা দরকার, যে কোনো ধরনের ডায়াবেটিস রোগী দয়া করে রোজা না রাখতে পারলে আপনার ভালো হবে। খুব বেশি ধর্ম বিশ্বাসে কষ্ট পেলে প্রতি তিনটে রোজা রেখে দু’দিন শরীরকে নিস্তার দিন। কোনোভাবেই টাইপ ১ ডায়াবেটিক রোগীরা এবং যারা ইন্সুলিন নেন, কোনোভাবেই রোজা রাখবেন না।
রোজায় হার্ট বিট বেড়ে যায়, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। হার্টের প্রব্লেম যাদের আছে, রক্তে কোলেস্টেরল মাত্রা কন্ট্রোলে নেই, তারা রোজা না রাখতে পারলে ভালো। ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী কাফফারা দিয়ে দরিদ্রদের এই সময়টিতে সেহেরি এবং ইফতার খাওয়ান।
রোজা হোক, নিয়ম করে যে কোনো উপবাস হোক, শরীরে তার ভালো খারাপ দুটোই আছে। বডি ফ্যাট কমা থেকে, রক্তে কোলেস্টেরল কমে যাওয়া, LDL-C/HDL-C অনুপাত পরিবর্তন যাওয়া, ইনসুলিনের সেনসিটিভিটি বেড়ে যাওয়া, যা রক্তের গ্লুকোজ কমাতে সাহায্য করে, বেশি ব্লাড প্রেশার কমে যায় রোজার সময়।
Fasting নিয়ে মেডিক্যাল সাইন্স এ সম্প্রতি কিছু গবেষণা হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে fasting তিনভাবে দেখা হয়। Calorie Restriction (CR), Alternate-day Fasting (ADF) এবং Dietary Restriction (DR)।
রোজা হলো Alternate-day Fasting (ADF)। কারণ হলো, বারো ঘণ্টা আপনি উপোষ থাকছেন, বাকি বারো ঘণ্টা খাচ্ছেন। প্রতি অর্ধ দিন কিছুই খাচ্ছেন না, পরের অর্ধ দিন সব খাচ্ছেন। অন্যভাবে বলে fast period & feast period। বাংলা করেছি, ভুক পর্ব-ভোজন পর্ব।
রোজার সময় তিনটে ভিটামিন কমে যায় বেশি। ভিটামিন A, C এবং রিবোফ্লেভিন। অনেকের আয়রন কমে যায়, রোজার পরে অনেক মেয়েদের শরীরে এনিমিয়া দেখা যায়। ব্লাড গ্লুকোজ এবং রক্তের লিপিড ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিবর্তন হয় রোজায়। পুরুষের শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বেড়ে যায় রোজায়, তবে অজানা কারণে নারীদের শরীরে ইনসুলিনের উপর রোজার তেমন প্রভাব পড়ে না।
রোজায় oxidative stress এবং antioxidant status পরিবর্তন হয়। রক্তের RBC তে MDA বা malondialdehyde concentration কমে যায় রোজার সময়, যা বার্ধক্য রোধে সাহায্য করে। ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেশারের তেমন পরিবর্তন না হলেও সিস্টোলিক প্রেসার কমে যায় রোজায়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাঝে মাঝে লম্বা সময়ের উপবাস Parkinson’s এবং Alzheimer’s রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার কমিয়ে দেয়। লস এঞ্জেলসের University of Southern California র Gerontologist Valter Longo র এরকম উপবাসের একটা ডায়েট চার্ট আছে। মাসে পাঁচ দিন কিছু খাবেন না। ProLon কোম্পানির ব্র্যান্ড ডায়েট।
শরীর যখন উপোষ করে, কোষে autophagy নামের একটা কাজ ঘটে। এটি কিছু কোষকে ভেঙে ফেলে, কোষের বিভিন্ন অংশগুলোকে রিসাইকেল করে শক্তি যোগায়। এরকম কোষের ভাঙাগড়া. কম বয়সে বেশি হয় বলে কোষের বার্ধক্যপ্রীতি কম থাকে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স বাড়লে এই autophagy কমে গেলে কোষের ভিতর জাঙ্ক বেড়ে গিয়ে কোষ বার্ধক্য থেকে ক্যান্সার, টাইপ ২ ডায়াবেটিস এসব রোগ বেড়ে যায়। তাই শরীরকে মাঝে মাঝে উপোষ দেয়া উচিত, এতে শরীর রক্ষা করা।
ইতিহাসের কোনো সময়ে পুরো পৃথিবী একসাথে এমন থেমে যায়নি। করোনা ভাইরাস সবাইকে এমন জায়গায় ঠেলে দিয়েছে, সে হিন্দু হোক, মুসলিম হোক, খ্রিস্টান হোক— আজ ভাইরাসের বিরুদ্ধে এক। হাজার বছর একে অপরকে বিশ্বাসের বিভেদে ক্ষত বিক্ষত করলেও আজ ভাইরাস একাই সবাইকে ক্ষত বিক্ষত করে ছাড়ছে। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, দেহ আমাদের সবার একই, বিশ্বাসগুলো কেবল ভিন্ন ভিন্ন। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, প্রকৃতির অভিশাপ কেউকে ধর্মের ভেদে চিনে না। রক্ত আর প্রাণ থাকলেই জীবাণু ছোবল মারে। সময় এসেছে একে অপরকে বিশ্বাসের ঘৃণার জীবাণু উপড়ে ফেলার। না হলে প্রকৃতির জীবাণু আপনাকেই উপড়ে ফেলবে।
সূত্র: 1. NewScientist 2. BMC Nutritional Journal 3. BioMed Central