করোনা ভাইরাস এবং ধর্মের বাণী
সাদ্দাম হোসেনপ্রকাশিত : এপ্রিল ০১, ২০২০
চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস দিনের পর দিন গোটা বিশ্বে বেড়েই চলেছে। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে মৃতের সংখ্যা ১৩ হাজার আর আক্রান্ত তিন লাখের উপরে। আমরা সবাই জানি যে, এই ভাইরাসকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ১৩ গুণ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ১১ মার্চ মহামারি ঘোষণা করেছে। এই ভাইরাসকে নিবারণ করতে কেউ ধর্মের আশ্রয় নিচ্ছে। কেউ এটা নিয়ে হাস্যকর রূপে বিভিন্ন রকম ভিডিও, কবিতা, গান আর ছবি তৈরি করছে।
গ্রামগঞ্জে ধর্মের বিভিন্ন বাণীগুলোই হয়ে উঠেছে করোনার বিরুদ্ধে সচেতনতার মূল প্রচার। করোনা সংক্রান্ত সরকারি বিভিন্ন নির্দেশিকাগুলোকে পেছনে ফেলে রেখে ধর্মের বিভিন্ন সূত্রগুলোকে নির্দেশিকা হিসাবে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। কেউ বলে গরুর মুত্র সেবন করতে, কেউ বলে করোনা মানেই ক-রো-না। ক এ কোরআন পড়া, রো এ রোজা রাখা আর ন এ নামাজ পড়া। তবেই করোনা ভাইরাস নিবারণ করা যাবে। ইদানীং ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়েছে জনৈক মৌলভি সাহেবের ভিডিও। উনি নাকি সরাসরি করোনা ভাইরাসের সাথে কথা বলেছেন। করোনা তাকে বলেছে, যারা নামাজ-রোজা করবে না আর যারা মুসলিম নই তাদেরকে করোনা ভাইরাস আক্রমণ করবে।
এদিকে থেমে নেই সনাতনি ধর্মের লোকজনও। কেউ বলে মন্দিরে পিণ্ডদান করার কথা, গোমুত্রের কথা, বাড়িতে বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে ঘণ্টা, কাসর বাজানোর সাথে সাথে গো-করোনা ধ্বনি উচ্চারণের হিড়িক। খুব কম জায়গাতেই শোনা যাই মাস্ক ব্যবহার করার কথা, অযথা ভিড় না করার কথা, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, হাত ধুয়ে পরিষ্কার পরিছন্ন রাখার কথা। আসলে তাদের কাছে ধর্মের নির্দেশিকাগুলোই হয়ে উঠেছে সতর্ক বাণী। করোনার আতঙ্ক চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেও গ্রামগঞ্জে এখনও গুরুত্বসহকারে ব্যাপারটা নেয়া হচ্ছে না।
গ্রামের লোকজন বলছে, আল্লাহ-ভগবান এই ভাইরাস দিয়েছেন, উনিই আবার ঠিক করবেন। অনেকে আবার বলে উঠছেন, মানুষ পাপ করেছে। তাই এই মহামরি। করোনা ভাইরাস রুখতে সরকার যে নির্দেশিকাগুলো পালন করতে বলেছে সেগুলো কোনোভাবেই অনুসরণ না করে সম্পূর্ণটাই ধর্মের উপর নির্ভর হয়ে পড়ছে তারা। মনে হচ্ছে, তারা সেই আদিম যুগে বাস করছে। গ্রামগঞ্জে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে যে, এক মাস ধরে সব কিছু বন্ধ থাকবে। তাই অনেকেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা আতঙ্কে দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছে, কীভাবে সংসার চালাবে আর কীভাবে খাবার জোগাড় করবে। তাই তারা আগে থেকে চাল-ডাল, আলু বেশি দামে কিনে বাড়িতে সঞ্চয় করতে শুরু করেছে
অনেকেই এটা হাস্যকর ভাবতে নিতে শুরু করছে। অনেকে এটাকে ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়া আর টিকটকের মধ্যদিয়ে বিভিন্ন রকম মেমে ও ভিডিও তৈরি করে মানুষকে ভুলভ্রান্তি তথ্য প্রচার করছে। গ্রামের লোকজনকে বিভ্রান্ত করে আতঙ্কে ফেলে দিচ্ছে। গ্রামগঞ্জে প্রতিটি মানুষের কাছে ধর্মের কথা হয়ে উঠেছে করোনার ভাইরাসের নিবারক হাতিয়ার। গ্রামগঞ্জে আরেকটা সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে যে, করোনা সম্পর্কিত শব্দগুলো তাদের কাছে অজানা। যেমন- স্যানিটাইজার, কোয়ারেন্তিন, আইসোলেশন ইত্যাদি। তারা এসব শব্দগুলোকে নিজেদের মতো ভুল অর্থ বের করে একে অপরকে ভ্রান্তির মধ্যে ফেলছে।
সচেতনতার জন্য সরকারকে শহর ও মফস্বলের গ্রামগঞ্জেও কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া বা অন্য মিডিয়ার মধ্যদিয়ে যেসব ভিডিও সাধারণ মানুষকে ভ্রান্তির মধ্যে ফেলছে, তাদের প্রতি কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে। এই মুহূর্তে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, গ্রামে গ্রামে মৌলভি ও পুরোহিতদের সঠিকভাবে সরকারি নির্দেশিকাগুলো ভালোভাবে তাদের বুঝিয়ে দেয়া এবং তাদের বলে দেয়া যে, তারা জেনো মন্দির-মসজিদে সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপগুলোকে গ্রামবাসীকে সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়।
এছাড়া গ্রামের করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত জ্ঞানী মানুষদের প্রতি অনুরোধ যে, আপানার নিজের এলাকায় সরকারি পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে প্রচার করুন। গ্রামবাসীদের বলুন, খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের না হতে, ভালো ভাবে হাত মুখ ধুয়ে খাবার খেতে, অকারণে এক জায়গায় ভিড় না করতে।
লেখক: সহায়ক অধ্যাপক
সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ
নেতাজি নগর কলেজ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)