কবিতার ফেরিঅলা
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৮
সন্ধের আবছায়া আঁধার ঢেকে ফেলছে চারদিক। টিনের চালের ওপর কোথায় যেন হুতোম পেঁচা ডাকছে। বাড়ির পেছনদিকে বাঁশঝাড়ের ওপর গোলগাল চাঁদ ঝুলছে। লাল, তবে গাঢ় নয়। রাত যত বাড়বে, চাঁদের আলো তত বাড়বে।
বাড়িটা ঘিরে বেশ গাছপালা। ফরফর শব্দ তুলে এগাছ থেকে ওগাছে উড়ে যাচ্ছে বাদুড়। ডানায় সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে পাতার আবডালে আশ্রয় নিয়েছে পাখি। ডানার ঝটপট আওয়াজ পাওয়া যায়।
মাগরিবের আজান শেষ হয়ে গেছে। শ্বশুর বের হচ্ছিলেন মসজিদে। কলতলায় ছায়া ছায়া অন্ধকারে তিনি দেখলেন, সূর্যবান বসে আছে। চেয়ে আছে বাঁশবাগনের মাথার ওপর। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কী দেখছে? চাঁদ? ভারি পাগলি এই মেয়েটা। এগিয়ে গেলেন তিনি।
সাবের কই মা?
শ্বশুরকে দেখে মুখ ফেরালো সূর্যবান। জিগেশ করল, নামাজে যান আব্বা?
শ্বশুর বললেন, শোনো গো মা, আল্লাহ আল্লাহ করো। সাবের কই? তারে কইও, মাথা গরম না করতে। আর ওজু করে নামাজ পড়ে ন্যাও। আল্লার কাছে চাও মা, মানুষ কাউরে কিছু দিতে পারে না।
আর কিছু বললেন না তিনি। থমথমে তার মুখ। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে ঘাসপাতার রাস্তা ধরে বেরিয়ে গেলেন।
সূর্যবান কলতলায় বসে থালাবাসন মাজতে লাগল। ভারি বিচ্ছিরি ব্যাপার। ভাসুর আনিস মানুষ হিশেবে মোটামুটি ভালোই বদমাশ। সকালের ছবিটা চোখের সামনে ছবির মতো দেখতে পেল সূর্যবান। গাছের গুড়ি নিয়ে ভাসুর বেজায় হম্বিতম্বি দেখাচ্ছে, আর সাবের ক্রমাগত বলেই যাচ্ছে, আপনে ঠক। আপনে আমারে ঠকাইতেছেন। যান, ওই ছয় হাত জায়গা আপনেরে আমি সদকা দিলাম।
ভাবি মুখ ঝামটা দিয়ে জবাব দিল, ক্ষমতা তো নাই। আর কী করবি...!
ভাসুর বলছে, যা পারিস করগে, যা। আমার সীমানা আমি ঠিক করে নিছি। এদিকে আর এক পা বাড়াবি না। তোরে রাস্তাও দেব না। কোত্থেকে বাইর হবি, আমি জানি না।
ধুর ছাই, মেজাজ খচে যাচ্ছে। ক্ষমতার জন্য নয়, সূর্যবান জানে, সাবের অন্য ধাতের মানুষ। জমিজমার ভেতর কখনো সে থাকে না। কী এক ঘোরের ভেতর যেন তার বেঁচে থাকা। বিয়ের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে তাদের। মানুষটাকে যত দেখছে সূর্যবান, তত মুগ্ধ হচ্ছে।
এই যে এখন, নতুন বিয়ে করা বউ রেখে সে চলে গেছে নদীর পারে। গোধূলি তার সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্য। এরচে মুগ্ধকর কোনো দৃশ্য সাবেরের চোখে নেই, জানে সূর্যবান।
বিয়ের আগে শ্বশুরের কাছে কোরআন পড়ত সূর্যবান। তখন তো তাকে চাচা ডাকত। একদিন কী এক ভুল করায় এমনভাবে তার কান মলে দিলেন যে, চোখে তার পানি এসে গেছিল। তিনিই সাবেরের জন্য তাকে পছন্দ করলেন। প্রস্তাব দিলেন বাড়িতে। সূর্যবানের আব্বা কিন্তু রাজি হলেন না। সাবের কবিতা লেখে। আর বই ছেপে স্কুল-কলেজগুলোতে ঘুরে ঘুরে বেচে বেড়ায়।
পাত্র কি করে? কবিতার ফেরিঅলা। বেশ তো মজা। নিজে বানিয়ে বানিয়ে কবিতা লেখে, এরপর তা বেচে বেড়ায়। এই হচ্ছে একজন মানুষের পেশা। কী রকম যেন টান সে টের পেল কবিতার ফেরিঅলার প্রতি। কিন্তু সূর্যবানের দৈনিক মজুরি দেয়া রাজমিস্তিরি আব্বার কাছে মনে হয়েছিল, এ ছেলের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ঠুকো কাজে কখনো সংসার চলে না। এর জন্য নিশ্চিত আয়ের কোনো উৎস দরকার।
এদিকে সাবের একদিন একগাদা বই নিয়ে তাকে দেখতে এলো। সূর্যবান পরেছিল স্কার্ট। এমনিতে গোলগাল তার দেহ। স্কার্টে বেশ পুতুল পুতুল দেখাচ্ছিল। মুখোমুখি বসে কিছু সময় তারা কথাটথা বলল।
ব্যস। এরপর প্রেমে পড়ে গেল সে সাবেরের। তার পাগলামিতে রাজি হলেন আব্বা। এরপর বিয়ে। এরপর ভাসুরের জমি মাপামাপি। ঠকানো। যেন ছবির মতো...! প্রজাপতির ডানার ফুরফুরে ঢেউ সূর্যবানের বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল। কবির সাথে চাঁদের নিচে তার সংসার। বাড়ির চারদিকে উঁচু উঁচু কোন আমলের সব গাছপালা। আর কী সুনসান। রাতের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ এখানে থাকে না।
হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে সাবের তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। উঁ উঁ করতে করতে শরীর মোচড়ামুচড়ি করে সূর্যবান। এতে খুব একটা কাজ হয় না। সাবের তাকে প্রায় কোলে তুলে নেয় আর কী। তো সূর্যবানকে উঠতেই হয়। চৌকাঠে পাশাপাশি বসে তারা। বসেই থাকে। তার একটা হাত সাবেরের মুঠোয় ধরা। চুপচাপ ভূতের মতো বসে থাকে সাবের। আর ঘুমে ঢুলতে থাকে সূর্যবান।
এই ছয় মাসে সাবের তাকে ছয়টা বই পড়িয়ে ছেড়েছে। এ বইগুলো নাকি ক্লাসিক। ও বলে। বইয়ের বিশাল ডাঁই এ সংসারে। আর কিছু থাকুক না-থাকুক, বইয়ের অভাব নেই। অসভ্যের মতো একদিন সূর্যবান বলে ফেলেছিল, এত বই যোগাড় করতে পাগলরেও তো কোনোদিন দেখিনি।
তখন দুপুর। উঠোনে পাটি পেতে তার ওপর বই বিছিয়ে দিচ্ছিল সাবের। চৌকাঠে দাঁড়ানো সূর্যবানের মুখের দিকে চেয়ে সে খুব হেসেছিল। হেসেছিল সূর্যবানও।
ট্রিট ট্রি... ট্রিট ট্রি...
বাঁশবাগান থেকে ভেসে এলো কী এক পাখির ডাক। মুখ তুলে সেদিকে তাকালো সূর্যবান। বাঁশবাগানের নিচে ঘন অন্ধকার ভূতের মতো ছমছমে, আর ওপরে স্নিগ্ধতার নরম আলো।
হাসনাহেনার গন্ধ অনেক দূর ছড়িয়ে দিচ্ছে সন্ধের ঝিরঝির হাওয়া। কী মিষ্টি এই গন্ধ, বেশ লাগে সূর্যবানের। সারাদিন যেমন তেমন, সন্ধের পর থেকে হাসনাহেনার গন্ধে নেশার মতো মাথা ধরে যায় তার। এই গাছ নিয়েই তো সাবেরের মন খারাপ।
পাশাপাশি জমিতে দুভাইয়ের বাড়ি। আজ সকালে আমিন ডেকে ভাসুর তার সীমানা ঠিক করে নিলেন। এরসাথে ছয় হাত সাবেরের ভেতরে ঢুকে গেলেন। শ্বশুরের কথা শুনলেন না ভাসুর। সাবের প্রতিবাদ করতে গেলে মারমুখো হয়ে ওঠেন। ওই ছয় হাত জায়গাতেই হাসনাহেনা গাছটা। সাবের লাগিয়েছিল।
ওই তো, আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে গাছটা। চাঁদের আবছায়া আলোয় তারার মতো দেখাচ্ছে ছোট ছোট শাদা ফুলগুলো। বুক ভরে নিশ্বাস টেনে নিল সূর্যবান। আহ, এত মিষ্টি...
ডেকে উঠল হুতোম পেঁচা। ফরফর শব্দ তুলে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল বাদুড়। আর তখন হঠাৎ তার মন খারাপ হয়ে গেল। আজ থেকে ওই গাছ আর তাদের নয়। কিন্তু... ভাবল সে, তাতে কি? সে তো ঠিকই হাসনাহেনার ঘ্রাণ পাচ্ছে। ঘ্রাণের তো কোনো মালিকানা নেই। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল সূর্যবান। তাই তো, পাখিরা যেখানে খুশি উড়ে চলে যেতে পারে। তাদের তো কোনো মানচিত্র নেই। গাছ যার, শুধু তারই জন্য হাসনাহেনা ফোটে না। সে প্রকৃতির সন্তান। তার ঘ্রাণ সবার জন্য।
মানুষ তবু সীমানা নিয়ে মারামারি রক্তারক্তি করে। যা নিয়ে এতকিছু, সে কিন্তু কারো মালিকানায় থাকে না। যদিও মানুষ মনে করে, সে ওর মালিক।
গুনগুন গান ভাজতে ভাজতে বাসন মাজতে লাগল সূর্যবান। হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ পাখিটি ছাড়িল কে...
গান থেমে যায় হঠাৎ। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে সূর্যবান। তার সামনে কার যেন ছায়া। পেছন ফিরে দ্যাখে, সাবের দাঁড়িয়ে মিটমিট হাসছে।
কী, তোমার বেড়ানো হলো?
হুঁ। বলতে বলতে সাবের বসে পড়ল কলতলায়। জিগেশ করল, তোমার খুবই মন খারাপ হইছে, না? কী বিচ্ছিরি ব্যাপার। আসতে সময় মসজিদের সামনে আব্বা কইল, চুপচাপ থাকতে। কও তো, আমি কি কিছু কইছি? কেউ যদি আমার ওপর অন্যায় করে, আমি কি কথা বলব না? তবে আমি আনিসকে ঘেন্না করি। ওর ভেতর লোভের ইবলিস বাস করে।
বাসন মাজতে মাজতে সূর্যবান বলল, বাদ দ্যাও। একটু থেমে এরপর বলল, গন্ধ পাচ্ছ হাসনাহেনার?
সাবের ঠিক বুঝতে পারল না সূর্যবানের কথার মানে। সে ভুরু কুচকে জিগেশ করল, হ্যাঁ, পাচ্ছি তো।
বাসন মাজা থামিয়ে সূর্যবান বলল, জোরে নিশ্বাস টানো।
সাবের জিগেশ করল, কেন? কী হবে তাইলে?
সূর্যবান বলল, আহা, জোরে নিশ্বাস টেনেই দ্যাখো না।
সাবের বুক ভরে বাতাস টেনে নিল। এরপর ধীরে ধীরে শ্বাস ছেড়ে তাকালো সূর্যবানের দিকে। সূর্যবান হাসছে। চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করছে তার শাদা মসৃণ দাঁত।
কী ব্যাপার, ভূতে ধরছে নাকি তোমারে? এমনে হাসতেছ কেন?
এমনি। একটা বিষয় নিয়া ভাবনা আসছে। তাই হাসতেছি। কী মিষ্টি না হাসনাহেনার গন্ধ?
তো?
প্রতিদিন যে রকম পাও, আজ কী তারচে কম পেয়েছ হাসনাহেনার ঘ্রাণ?
সাবের ঝুঁকে আসে সূর্যবানের দিকে। জিগেশ করে, কেন?
আহা, বলো না, হাসনাহেনার ঘ্রাণে কোনো হেরফের ঘটেছে?
সাবের জবাব দিল, তা কেন হবে? ঘ্রাণ তো ঘ্রাণই।
এই কারণে হাসতেছি। ঘ্রাণের কোনো মালিকানা নেই। গাছের মালিকানা আছে। যদিও এসব মালিকানা দিয়ে গাছের কিছুই এসে যায় না।
থ হয়ে সূর্যবানের মুখের দিকে কিছু সময় চেয়ে থাকে সাবের। এরপর বলে, এই না হলে আমার সূর্যবান। শোনও, তোমারে নিয়া একটু আগে একটা কবিতা হইছে। শুনাই তোমারে?
সূর্যবানের জবাবের তোয়াক্কা না করে মোবাইলে রেকর্ড করা কবিতা ছেড়ে দিল সাবের। কাগজে কলমে সে খুব একটা লেখে না। যা মনে আসে, গড়গড় করে রেকর্ড করে যায়। পরে আবার এসব কাগজে লিখে দিতে হয় সূর্যবানকে। বেশ লাগে এসব লিখতে। মনে হয়, যেন সে-ই কবিতা লিখছে। একথা একদিন বলায় সাবের খুব হেসেছিল। তার মাথায় ছোট্ট এক চাটি মেরে বলেছিল, আসলে তুমিই তো লেখো। কিন্তু সংসারের কাজটাজ করে তুমি সময় করে উঠতে পারো না, তাই তোমার হয়ে আমিই লিখে দেই।
সূর্যবান বাসন মাজতে মাজতে শুনল সাবেরের ভরাট স্বর:
আমাদের খুব কাছাকাছি এক
নদী আছে গোধূলির
ঝিরঝির তার ঢেউগুলি আর
স্নিগ্ধ দুই তীর।
গোধূলির মুখোমুখি দ্যাখা সূর্যবানের সাথে
গোধূলির মধ্যে দিয়ে সে এসে দাঁড়ালো ওইপারে
নেমে এলো পানির কাছাকাছি
আর, এইপারে আমি বসে আছি।
পানিতে সাঁতরে চলা হাঁস
ডেকে ডেকে তুলে নিল সে
এরপর হাঁসের পিছু পিছু গোধূলিরঙা মেয়েটি চলে গেল
হাঁসেরা সূর্যবানের বাড়ি নিয়ে গেল ডানায় লেগে থাকা
গোধূলিরাঙা নদী
আমাদের খুব কাছাকাছি এই নদী
আমাদের খুব ইচ্ছে হলো তাই
নদী সাঁতরে যাওয়ার
আমাদের নদী উত্তেজনায়
কাঁপতেছে তিরতির
সূর্যবান স্রোতস্বিনী, এখন
আমার উন্নত হবে শির।
ফেনায়িত জল
নদী টলোমল
এরপর ঘুঘুর ডাক নদীতীরে একটানা।
শুনতে শুনতে এক ঘোরের মধ্যে থেকে সূর্যবান তাকালো সাবেরের মুখের দিকে। সাবের মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে একটু হেসে চোখ নামিয়ে নিল সূর্যবান।
আর ঠিক তখন গোলগাল চাঁদ বাঁশবাগান ছাড়িয়ে আরো একটু ওপরে উঠে এলো। এমনিভাবে রাতভর একটু একটু করে উঠতে থাকবে চাঁদ। আর মানুষ চাঁদের থই থই আলোর ভেতর রাতের নীরবতায় ঘুমিয়ে থাকবে।