প্রতীকী ছবি
কবিতার নিবিড় পাঠ ও অর্থের অস্থিরতা
জগলুল আসাদপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৭, ২০২০
কবিতার নিবিড় টেক্সচুয়াল বিশ্লেষণ আজকাল হয় না বললেই চলে। ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব খুঁজতে যেয়ে কবিতার উপর আরোপ করা হয় অনেক অনেক তাত্ত্বিক ও মতাদর্শিক চাপ। কবিতার ভেতর থেকে সমকালের জন্য কিছু বলিয়ে নেয়ার দায় সমালোচক বোধ করেন। নজরুল কিভাবে অসাম্প্রদায়িক, কিভাবে তার ভেতরে ধর্মনিরপেক্ষ ভাব ক্রিয়াশীল, তা-ই দেখাবার আয়োজন চলে। এগুলো মোটেই অপ্রয়োজনীয় নয়। তবে এগুলোর আধিক্য সাহিত্য পাঠের আনন্দকে যেন নিস্প্রাণ করে না তোলে। হৃদয় ছুঁয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশে সাহিত্যের দায় এখনো অস্বীকৃত হয়নি।
একদা আইএ রিচার্ডসের প্র্যাক্টিকাল ক্রিটিসিজম কবিতার শরীরকে বাক্যে, শব্দে, ধ্বনিতে ভেঙে ভেঙে শতচ্ছিন্ন করে কবিতার রূপ দেখাবার ও রস আস্বাদনের কথা বলতো। এরপর কবিতার ভেতর থেকে সমাজরূপান্তরের ইশারা, ইতিহাসের বাঁক আর মনের গহন তল খোঁজার চল শুরু হলো। এটাকে এখন প্রধান ধারা বলা চলে। অবশ্য এ-দুই ধারার মেলবন্ধন হলে সোনায়-সোহাগা। ম্যাথু আর্নল্ড কবিতা বিচারের তিন ধারার কথা বলেছিলেন— ব্যক্তিগত বিচার, ঐতিহাসিক বিচার আর সত্যকার বিচার। ব্যক্তিমনের বিশেষ ঝোঁক প্রবণতার কারণে কারো কাছে কোনো কোনো কবিতা ভালো লাগে। কোনো কবিতা তার ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠে, আর কিছু কবিতা, ম্যাথু আর্নল্ডের মতে, ব্যক্তির বিশেষ পছন্দ-অপছন্দ নির্বিশেষে, ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য ব্যতিরেকেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সকল কালের মানুষের প্রিয় হয়ে ওঠে তার ভাষায় ও ভাবে।
সত্যকার বিচারের জন্য ম্যথু আর্নল্ড এরই মধ্যে ধ্রুপদী হয়ে উঠেছে এমন কবিতার পঙক্তি ও পঙক্তিমালাকে কষ্ঠিপাথর হিশেবে বিবেচনার পক্ষপাতী। যদিও আজকাল ম্যথু আর্নল্ডের এই ‘রিয়াল জাজমেন্ট’কে টেক্সটকেন্দ্রিক ব্যাখ্যার ধারায় ফেলে পুনর্ব্যাখ্যা করা যায়। কবিতা ব্যাখ্যার আরেক ধারা কবির জীবনে কবিতার ব্যাখ্যা খোঁজে। কবিতা ও কবিকে সমান্তরালে রেখে একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করা হয় এতে। কবির জীবন দিয়ে কবিতাকে ব্যাখ্যা করার ঘটনাটি আরেকটু এগিয়ে নিয়ে কবিতা দিয়ে কবির অর্ন্তজীবনী লেখারও চল আছে। ব্যাখ্যাশাস্ত্রে এবার আবির্ভাব ঘটল পাঠকের, যে শুধু নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা নয়, সে অর্থেরও নির্মাতা। অর্থ যতটা থাকে টেক্সটের অভ্যন্তরে, তারও বেশি থাকে পাঠকের ‘পাঠে’, বলা ভালো, পাঠক ও পাঠ্যকর্মের মিথস্ক্রিয়ায়।
একই টেক্সট নারী ও পুরুষের পাঠে ভিন্ন অর্থে উদ্ভাসিত হতে পারে। অর্থকে আবার ‘ডিসেন্টার’ও করা যায়। কোনো অর্থই অনর্থ নয়। নির্দোষ-নিরপেক্ষ পাঠ বলে কোনো পাঠ নাই, কোনো ব্যাখ্যা নাই, বলা হয়। তবুও সর্বজনীন ও ধ্রুব কিছুর সাধ যায় না মানুষের। পণ্ডিতেরা যদিও বলবেন, ‘সর্বজনীন’ করার চেষ্টায় আধিপত্য নির্মাণের বাসনা থাকে, ক্ষমতার পিপাসা থাকে, শোষণের পায়তারা থাকে। কথা মিথ্যা নয়।
বলতে চাচ্ছিলাম কবিতার ব্যাখ্যা নিয়ে, যদিও কবিতার ব্যাখ্যা হয় না বলে কবিতাকে খুব একটা তুরীয় অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও আছে। টিএস এলিওয়টের ওই কথাটা কিন্তু লক্ষ্যযোগ্য যে, কবিতা পাঠের সাথে সাথে আমাদের মনে যে ‘অনুভব’ তৈরি হয় সেটাই কিন্তু কবিতার ব্যাখ্যা, আর সেই অনুভবকে ভাষা দিয়ে সকলের হৃদয়ে চাড়িয়ে দেয়াই ওই কবিতার সমালোচনা। আমার বক্তব্য হচ্ছে, কবিতার টেক্সটকে প্রান্তিক করে দেয়ার পক্ষপাতি আমি না। কবিতার বাক্যের ভেতরে হঠাৎ হঠাৎ যে চমক থাকে, অর্থের অস্থিরতা থাকে— তাতে মুগ্ধ হই। কবিতার কোনো শব্দবন্ধে কবিজীবনের কোনো দমিত বিষয়ের ইঙ্গিত আবিষ্কার কম মনোমুগ্ধকর নয়। কোনো অসামান্য শব্দসমবায় বিস্ময়ের অনুভব দিতে পারে, আমাদের ইন্দ্রিয়কে-অভিজ্ঞতাকে সম্প্রসারিত করতে পারে, দিতে পারে চেনা জিনিসকে অচেনা করে, আবার অচেনাকেও করে দিতে পারে অন্তরঙ্গ ও পরিচিত।
কোনো ধ্বনির আস্বাদ বুকের ভেতর অনুরণিত হতে পারে দীর্ঘক্ষণ। কোনো বাকবিভূতি বুকের ভেতর ঝুলে থেকে প্ররোচিত করে এই ভাবনায় যে, এর মধ্যে আছে কিন্তু বহু অর্থের সম্ভার, ক্রীড়া। আবার কবিতার কোনো কোনো পঙক্তি আমাদের ভালো লাগে শুধু পুনঃপুনঃ পাঠে, ইচ্ছে হয় না ব্যাখ্যা করবার। কোনো কোনো পঙক্তি অব্যখ্যাত হয় বা থাকে বলেই তা হয় আদরণীয়, আবার কোনো কোনো পঙক্তি ব্যাখ্যার গুণে হয়ে ওঠে আরো বেশি প্রোজ্জ্বল। কোনো কাব্য পঙক্তি মহৎ হয়ে ওঠে সমগ্র কবিতা থেকে বিযুক্ত হলে, আবার কোনোটি দ্যুতি ছড়ায় সমগ্র অর্থে অন্তর্লীন হয়ে। কোনো কাব্যগ্রন্থ যুগান্তরে নিজ জনগোষ্ঠীর প্রাণের স্পন্দন হয়ে দেখা দিতে পারে। আবার সমকালে খ্যাতির তুঙ্গে থাকা কোনো কবিতা বা কাব্যগ্রন্থ বিস্মৃতও হতে পারে অন্যকালে! হায় কবিতা, এক অঙ্গে কত রূপ, আর অরূপের ইশারা তোমার...
দুই.
কবিতার এক আশ্চর্য শক্তি আছে শব্দ দিয়ে শব্দ শোনাবার, ধ্বনি দিয়ে ছবি আঁকার। করাত কলের আওয়াজ শুনতে পাবেন The buzz-saw snarled and rattled in yard পঙ্ক্তির `র` ধ্বনির পুনরাবৃত্ত ব্যবহারে। রররররররর। হেমন্তের ভরা মৌসুমে যখন ফুটে থাকে শত পুষ্পদল, মৌমাছির মনে হয় এ মধুমাস যেন শেষ হবার নয়। অজস্র মৌমাছির গুঞ্জরণ কবি তৈরি করেন flowers, bees, days ও cease এর ক্রমোচ্চারিত জ (z) ধ্বনির মধ্য দিয়ে:
still more, later flowers for the bees,
Until they think warm days will never cease,
For summer has o`er-brimm`d their clammy cells.
এই `জ` ধ্বনির অনিবার উচ্চারণের ভেতর দিয়ে মৌমাছির `বাজিং’ সাউন্ড ধরা পরে। আবার এই পঙ্ক্তি For summer has o`er-brimm`d their clammy cellsটি ‘m’ এর ভারে যেন নুয়ে পড়ছে, ঠিক যেমন মধুতে পূর্ণ মৌচাক মধুর ভারে নুয়ে পরে। কবিতা শুনবার যেমন, তা দেখবারও, দেখাবারও।
কোলরিজের কুবলা খান নামের একটি কবিতা আছে, যেটিকে বলা হয় মেটা পোয়েম বা কবিতা বিষয়ক কবিতা। কবিতাটিকে পাঠ করা যায় কোলরিজের সাইকোপোয়েটিক ক্রাইসিসের এলিগরি হিশেবেও। এই কবিতায় একটি ঝর্ণার জন্মের উদ্দাম বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেটিকে সমালোচকেরা কবির ভেতরে কাব্যের জন্মের উন্মাদ ও আন্দোলিত মুহূর্তের প্রতিতুলনা ভাবেন। তো, কবিতার এই অংশে ভূ-গর্ভ থেকে উত্থিত ঘূর্ণায়মান শিলাখণ্ড ও পরস্পরের আঘাতে উপলখণ্ডসমূহের বিচূর্ণায়নের আওয়াজ ও দৃশ্য কবি তার ব্যবহৃত শব্দরাশির ভেতরে ধরে রেখেছেন অনবদ্য দক্ষতায়:
A mighty fountain momently was forced:
Amid whose swift half-intermitted burst
Huge fragments vaulted like rebounding hail,
Or chaffy grain beneath the thresher`s flail
ল, ম, ট ও ড ধ্বনির প্রাচুর্যে ভূ-ভাগ ভেদ করে শিলারাশির উত্থান, ঝর্ণার সজোরে নির্গমন ও উপলখণ্ডের সংঘাতে তাদের টুকরোগুলো দিকবিদিক ছড়িয়ে পড়বার দৃশ্য `শোনাবার` জন্যে দরকার ছিল এমন হার্ড সাউন্ডিং শব্দাবলির ব্যবহার। সত্যিকার কবি প্রাণ ভাষাকে বাজিয়ে তুলতে পারেন। শব্দ ঘষে তুলতে পারেন কাঙ্ক্ষিত ধ্বনি।
আবার শেলীর ‘ঔড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’ কবিতার দ্বিতীয়াংশে আছে বজ্র, বিদ্যুচমক, শিলাবৃষ্টির বর্ণনা। দিগন্তের মৃদু প্রান্ত থেকে মধ্যগগণ পর্যন্ত কালো মেঘে ছেয়ে গিয়ে আকাশের যে গম্বুজ সদৃশতা তৈরি হয় তা যেন বিগত বছরের সমাধিঘর। কাল বৈশেখি যেন একই সাথে শোক ও শক্তি হয়ে আকাশের কালো জমিন ফাটিয়ে ঝড়ায় কৃষ্ণ বৃষ্টি ও শিলাপাত:
Thou dirge
Of the dying year, to which this closing night
Will be the dome of a vast sepulchre,
Vaulted with all thy congregated might
Of vapours, from whose solid atmosphere
Black rain, and fire, and hail will burst: oh hear!
শেলীর শব্দ ব্যবহারেও আমরা যেন দেখি আসমানের বিপুল কলোরল, শব্দের ঘর্ষণে বিদ্যুৎচমক ও বজ্রধনি। ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ পঙ্ক্তিতে প্রলম্বিত "আ" ধ্বনি যে বিলাপ ও বেদনা তৈরি করে, যে হাহাকারের ব্যঞ্জনা তোলে তা রসিকের কান শুনতে পায়, অন্তর তার আর্দ্রতা বুঝে যায়। শোনা যাক আরেকটি কবিতা, কবিতা তো প্রথমত শুনবার ও শোনাবার জন্যেই:
বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকূল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল কবুল।
গাঙের ঢেউয়ের কুলকুল ধ্বনির সাথে কী আশ্চর্য দক্ষতায় আল মাহমুদ মিলিয়ে দিলেন ‘কবুল কবুল’ এর বিরতিহীন ধ্বনি। কুলকুল শব্দদ্বয় ব্যবহৃত না-হলেও পাঠকের কল্পশ্রুতি `কবুল কবুল`কে মিলিয়ে দেয় নদীর কুলকুল প্রবাহে ব্যঞ্জিত ধ্বনির সাথে। ‘মহা মাতৃকুল’ আর ‘কবুল কবুল’ এর অন্তমিলের তলদেশে প্রবাহিত নদীর দুকুলপ্লাবী কুলকুল ধ্বনির সাথে এমন আকুল কবুলের বিহ্বল সমতান আল মাহমুদ ছাড়া আর কে শুনিয়েছে! ঠাকুরের ‘ফাগুন লেগেছে বনে বনে’ পঙ্ক্তিও ‘লেগেছে’ শব্দের মধ্যস্থতায় ফাগুনের সাথে আগুনের জোড় ঘটায়। যেন কানে বাজে ‘আগুন লেগেছে বনে বনে’। যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে ফাগুন, বনে বনে, আলো ও উত্তাপ নিয়ে।
এভাবেই কবিতায় চলে ধ্বনির খেলা, শব্দ দিয়ে শব্দ করা, শব্দ দিয়ে ছবি আঁকা, অনুভব আঁকা, শব্দ দিয়ে আগুনের ফুলকি তোলা, বেদনার দীর্ঘায়িত বিলাপকে ধরে রাখা, মুহূর্তকে গ্রেফতার করা।
তিন.
কবিতা পড়ে নিজে আনন্দ পাওয়া সহজ, কিন্তু পড়ানো কঠিন। শব্দ ধরে ধরে অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করে করে কবিতা পড়ানো এক দুরূহ কর্ম। কবিতার অনুভব সঞ্চার করে দিতে পারা যোগ্যতার কাজ, তবে ব্যাখ্যার আনন্দটুকু দেওয়া তুলনামুলকভাবে সহজ। তাছাড়া দায় থাকে মূল থিমটুকু বুঝে নেয়া ও বুঝিয়ে দেয়ার। এলিয়ট বলেছিলেন, ভালো কবিতা ভালো গদ্যের মতোই সুলিখিত হয়। ইংরেজি বিভাগে পাঠ্য কবিতাগুলোর প্রায় প্রতিটাতেই একটি ভরকেন্দ্র থাকে, বা বলা যায় চাবিবাক্য থাকে, যেটি বা যেগুলোর সাহায্যে বুঝে ওঠা যায় পুরো কবিতার `মানে`। ইংরেজি কবিতা বোঝা ও উপভোগে প্রথমত প্রয়োজন হয় প্রতিটি শব্দের আক্ষরিক অর্থ জানা, তারপর শব্দবন্ধ বা বাক্যের আলংকারিক বা ব্যঞ্জনার্থ অনুধাবন করা কিংবা প্রতিটি অনুচ্ছেদের সরল সারাংশ করে বুঝে নেয়া। তারপর কবিতার কেন্দ্রীয় এক বা একাধিক মানের সাপেক্ষে কবিতার অনুচ্ছেদ বা বাক্যগুলোকে বুঝে নেয়া। বুঝে নেয়ার প্রয়োজন পরে একটি বাক্য কোথায় শেষ হলো, কেননা অনেক রান-অন সেন্টেন্স (বা যাকে Enjambmentও বলে) থাকে কবিতায়, তিন চার লাইন মিলিয়ে গড়ে ওঠে একটা বাক্য। অনেক সময় একটা ক্রিয়াপদের অধীন থাকে একাধিক বাক্যাংশ বা কর্মপদসমূহ। এগুলো বোঝাতে হয়, বুঝতে হয় ।
তাছাড়া কবিতার ভেতরে নানামুখী ধ্বনি ও ভাবের ক্রীড়া তো আছেই। কখনো কোনো একটা বাক্যের ভাবের কারণে তা হয়ে ওঠে কাব্যিক, কোনো সময়ে হয়তো অনবদ্য ধ্বনি মাধুর্য কাব্যিকতার জন্ম দেয়, কখনো-বা বুকের ভেতরে ঝুলে থাকা ‘বুঝি বুঝি বুঝি না’ ভাবও কোনো বাক্য বা বাক্যাংশকে কাব্যিক করে তোলে। কখনো আস্ত এক পাতা কথামালা হয়তো-বা শুধু শেষ লাইনটির জন্যে কবিতা পদবাচ্য হয়ে ওঠে। বাক্যের ভেতরের শব্দের যে সমাবেশ তা অনেকসময় ব্যাকরণের বিধি উল্টে নিয়ে (যাকে বলা হয় ইনভার্সন বা এনাস্ট্রফি) হয়ে ওঠে কাব্যিক। তাছাড়া নানা অলংকার ও অলংকারহীনতা কবিতার অলংকার হয়ে থাকে, পুনরাবৃত্ত বাক্য বা শব্দাংশও (এনাফোরা বা রিফ্রেইন) অনেক সময় তৈরি করে আবেগিক ঘনত্ব।
যা হোক, শিক্ষার্থীদেরকে কবিতাকে ঘিরে প্রশ্নোত্তর লিখতে হয় বলে তাদের কাছে কবিতা মানেই বক্তব্য। কবিতার ভেতরে মহৎভাব খুঁজে বের করা ও লিপিবদ্ধ করাই হয় তাদের কাজ। বক্তব্যসহই কবিতার অন্যান্য দিক আর আমাদের অনুভব করা হয়ে ওঠে না। কবিতা পড়ানো সত্যিই দুরূহ, ক্লেশকর কাজ প্রায়শই; অথচ মনে মনে জোরে জোরে কবিতা পাঠে কতই না আনন্দ! কবিতা পড়ানোর জোয়াল যাদের কাঁধে, তারা জানেন, কত পাঠ, অভিজ্ঞতা ও বিনিদ্ররাত্রি যাপনের নিয়তি তাদের বরণ করতে হয়!
আমরা দুটো কবিতা পাঠ করতে চাই এ অংশে। কবির কাব্যপ্রকৌশল— বিশেষত প্রতীক নির্মাণ ও বর্ণনাভঙ্গি— বক্তব্য প্রকাশের সাথে সাথে কীভাবে আবেগ ও অনুভবকে চাড়িয়ে দেয়, সঞ্চারিত করে তা দেখা যাবে নিচের দুটি কাব্যালোচনায়।
চার.
সর্বব্যপ্ত অশুভ নিয়ে টেড হিউজের ‘পাইক’ নামে একটি কবিতা আছে। মানুষের ভেতরকার অন্ধকার ও জিঘাংসার প্রতীক হিশেবে পাইক মাছকে উপস্থাপন করেছেন কবি। পাইক সুন্দর, সবুজ-সোনালি ডোরাকাটা। কিন্তু একই সাথে হিংস্র, বিভৎস ও হত্যাপ্রবণ। সে পরিচালিত হয় তার হিংস্র অঙ্গ দ্বারা, মস্তিস্ক বা হৃদয় দিয়ে নয়। ঠিক যেমন বন্দুক হাতে মানুষটি প্রায়শই পরিচালিত হয় নিজের বুদ্ধি ও শুভবিবেচনার দৌলতের চেয়েও ওই হাতের অস্ত্রটি দ্বারা। যেমন, অনেক মানুষ পরিচালিত হয় তার রূঢ় জিহ্বা দ্বারা। একুইরিয়ামে রাখা তিনটি পাইককে পর্যাপ্ত খাবার ও নড়বার জায়গা দেয়া সত্ত্বেও তারা উদ্যত হয় একে অপরকে হত্যা করতে। খাবার বা আবাস সংকট না থাকলেও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লোভ তাদের লালায়িত করে নিজ প্রজাতির প্রতিও সহিংস আচরণে। এদের হাড়ে- মজ্জায় অশুভ এমনই লীন যে, মৃত্যুর পরও তাদের চোখ থেকে ঠিকরে বের হয় কঠোরতা, অন্ধকার। মৃত্যুতে যেন মুক্তি পায় তাদের চোখের কোটরে বন্দি থাকা অশুভের তীর ও সূচ। গীর্জার পাথর ভেঙে পড়ছে, যাজকেরাও চলে গেছে গীর্জা ছেড়ে কিন্তু পাইক রায়ে গেছে গীর্জার পুকুরেই, অটল, অমলিন। ধর্মের চেয়েও এ অশুভ যেন দীর্ঘস্থায়ী। অথবা ধর্মের ধব্জাধারীদের (এ কবিতায় যাজক চিহ্নায়কে প্রকাশিত) একেকটার হৃদয় যেন পাইকের চোখ ও মজ্জার অশুভে গঠিত ও নিমজ্জিত। ধর্ম ও মানবিকতার বুলিধারীদের অনেকেই তো পাইক বৈ নয়। যে পুকুরে পাইকগুলো থাকে তারা যেন পুকুরের সীমানা পেরিয়ে গ্রাস করবে মানুষের আবাস। পুকুরটি হয়ে ওঠে একটুকরো ইংল্যান্ড, ইংল্যান্ডের ইতিহাসের ছবি, যেখানে ছিল ধর্ম নিয়ে হানাহানি, রাজনৈতিক রক্তপাত, ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও ক্ষমতানির্ভর হানাহানি। টেড হিউজের ‘পাইক’কে ডারউইনের ‘সার্ভাইবাল অব দ্য ফিটেস্ট’ তত্ত্বের কবিতায়ন হিশেবেও পাঠ করা যায়।
কবির চোখে চোখ রেখে পাইক এগিয়ে আসতে থাকে, তার সৌন্দর্য ও বিভৎসতা নিয়ে। পুকুর পাড়ে বসে থাকা শিকারিই যেন এবার শিকার হবে। অন্ধকারের অন্তর থেকে আরোতর অন্ধকার যেন মুক্তি পেয়ে ছড়িয়ে পড়তে চায় চারদিকে। অশুভের অন্ধকার। মানুষের মনের অন্ধকার, জিঘাংসা, পরশ্রীকাতরতা, আধিপত্য পিপাসা। পাইকের এ জগত মানুষেরই জগত। সর্বব্যাপী অশুভ ও মানুষের ভেতরকার হিংস্রতা ও বিভৎসতা নিয়ে টেড হিউজের পাইক কবিতার মতো এমন কবিতা বিরল। চারদিকে অশুভের অন্ধকার...
পাঁচ.
কবি পিবি শেলীকে অনেক সময় বিপ্লবী আশাবাদের কবি বলা হয়। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর আছে এক শৈল্পিক কণ্ঠস্বর। শোষণমুক্ত সমাজ ও জীবনের প্রতি টান তাঁর। Ozymandias নামে শেলীর একটি বিখ্যাত কবিতায় কালের গহবরে হারিয়ে যাওয়া এক উন্মত্ত-অহংকারী সম্রাটের ক্রুর ভগ্ন মূর্তির মরুভূমির ধু ধু বালুকাবেলায় ক্ষমতার সসীমতার প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চিত্র আছে। এই প্রবল ক্ষমতাবান মিশরীও ফারাওয়ের ভগ্ন-ভাস্কর্যের খবর কবিতার কথক শুনেছেন এক পরিব্রাজকের কাছ থেকে। কবি শেলী তাঁর অনবদ্য ন্যারেটিভ টেকনিকের মাধ্যমে একদার এক প্রবল স্বৈরাচারী শাসককে বানিয়ে ফেলেছেন এক সুদূর (বি) স্মৃতিমাত্র। ইতিহাসের ওজিম্যান্ডিয়াস পরিণত হয় ভাস্কর্যে, সেই ভাস্কর্য রূপান্তরিত হয় ভগ্ন-মূর্তিতে, আর এই ভগ্ন মূর্তিটিরই সাক্ষাৎ পায় পরিব্রাজক এবং এই পরিব্রাজক খবর সরবরাহ করে কবিতার কথককে। আবার আমরা পাঠকেরা কবিতার কথকের কাছ থেকে শুনি ওজিম্যান্ডিয়াসের কথা। এইভাবে কয়েক স্তরের `অস্তিত্ব` পার হয়ে ওজিম্যান্ডিয়াস ধরা পড়ে পাঠকের কাছে এক সুদূর শ্রুতির বিষয় হিশেবে, প্রায়-বিলীন এক স্মৃতি-খণ্ড হিশেবে, এক গল্পকথা হিশেবে। এইভাবে বয়ান-রীতির অনন্যতায় শেলী এক স্বৈরাচারী-দাম্ভিক সম্রাটকে করে তোলেন শক্তিহীন, করুণার পাত্র, নিস্ব। আবার যে ভাস্কর নির্মাণ করেছিলেন এই মূর্তি, তিনিও এই স্বৈর অবয়বে প্রোথিত করে দিয়েছিলেন কুঞ্চিত ওষ্ঠ, নিরাবেগ-কঠোর আদেশের ভঙ্গি। এভাবে এই নির্বিরোধ ভাস্কর্য-শিল্পীও এই অত্যাচারীকে কটাক্ষ করবার সুযোগ ছাড়েনি। তাছাড়া ওজিম্যান্ডিয়াসকে আর যে ভ্রুকুটি করে সে হলো খোদ `কাল`। তার পড়ে থাকা বিশাল দুটি ছিন্ন পা, বালিতে উবুর হয়ে থাকা ভগ্ন মুখ আর মূর্তির বেদি সাক্ষ্য দেয় স্বৈরশাসকের অনিবার্য পরিণতির। বেদীতে উৎকীর্ণ হয়েছিল:
My name is Ozymandias, king of kings;
Look on my works, ye Mighty, and despair!
আমার নাম ওজিম্যান্ডিয়াস, রাজাধিরাজ; তাকাও আমার কীর্তির দিকে, হে ক্ষমতাবানেরা, আর হও হতাশ-নিরাশা।
জগতের সমস্ত রাজাদের ওজিম্যান্ডিয়াস চ্যালেঞ্জ জানায় যে তারা দেখুক তার কীর্তি, আর ব্যর্থতার অনুভবে হতাশ হোক। ওজিম্যান্ডিয়াসের অর্জন অনতিক্রম্য। মরুভূমির বুকে শূন্য বেদিতে উৎকীর্ণ এই মূক শব্দরাশি অনুসরণ করে চারদিকে যখন তাকানো যায় ওজিম্যান্ডিয়াসের অমর কীর্তি অবলোকনে, তখন আমরা চতুর্দিকে দেখি শুধুই ধু ধু মরুবালুরাশি, আর প্রতিধ্বনিময় শূন্যতা। সম্রাট দেখতে বললো দু`নয়ন মেলে তার উন্নয়ন-কীর্তি, `অমর` অর্জন, আর আমরা দেখলাম:
Nothing beside remains. Round the decay
Of that colossal wreck, boundless and bare
The lone and level sands stretch far.
আমরা দেখলাম, বিশাল মূর্তির ধ্বংসস্তুপের চারপাশে ঠায় দাঁড়ানো অসীম শুন্যতা, উড়ন্ত বালুকারাশি, উদ্ধারহীন নিস্তব্ধতা। এভাবে খা খা জনবিরল ধুলিবালিরাশিকে শেলী এক আইরনির মধ্য দিয়ে কালের থাবায় পর্যুদস্ত এক স্বৈরাচারীর কীর্তিগাথা করে রাখলেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক