কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের সঙ্গে গপসপ
প্রকাশিত : মে ৩০, ২০২০
কবি বিষ্ণু বিশ্বাসকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নাই, বিশেষত যারা কবিতাপ্রেমী বা অন্তত পড়েন বাংলা কবিতা, কবিদের খোঁজ-খবর রাখেন। তিনি বহু আগেই বাংলা কবিতায় তার পদচিহ্ন রেখেছেন। জন্মগ্রহণ করেন ঝিনাইদহ জেলার বিষয়খালিতে ২৯ মে ১৯৬২ সালে। ঝিনাইদহের নলডাঙা ভূষণ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৭৯’ সালে এসএসসি এবং ৮১ সালে ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক হন ৮৫‘ সালে। আশির দশকে প্রকাশিত প্রসূন, গাণ্ডবী, পেঁচা এবং নব্বই দশকে প্রকাশিত নদী, দ্রষ্টব্য ইত্যাদি লিটল ম্যগাজিনে বিষ্ণুর কবিতা প্রকাশিত হতো। পেঁচা লিটল ম্যাগজিনটি সম্পাদনার সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন।
আমাদের প্রিয় বিষ্ণুদা ঢাকায় এলে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল আঠারো বছর পর। কিন্তু সেই বিষ্ণু আবার চলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গে। কেন তাকে আবার চলে যেতে হল? তিনি কি নিজের মাতৃভূমিতে থাকতে পারতেন না? নিজের গ্রামের বাড়িতে? আমরা তার প্রতি নির্মম হলেও তাকে কি জনসমক্ষে প্রকাশ করে তার থাকার ব্যবস্থা করা যেত না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা দরকার। যারা এর উত্তর জানেন তাদের তা প্রকাশ করা উচিত। পশ্চিমবঙ্গে কবির মা বসবাস করেন, শুধু এটাই কি কবির চলে যাওয়ার কারণ? তিনিতো অনেক অসুস্থ ছিলেন। রানা আপার অফিসে তাকে কম্পিউটার নিয়ে বসে লিখতে দেখলাম, এ সবই এখন অতীত। তাকে খুঁজে পাওয়ার ইতিহাসটা আবার বলি।
১৯৯৩ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যান বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি নানা আগ্রাসনের কারণে। তারপর হতে খবর তেমন কিছু আর জানা যায়নি। কয়েক বছর হলো আবার খোঁজ জানা যায়, তিনি বনগাঁ অথবা নদীয়ায় আছেন। কবি নান্নু মাহবুব কবির ঠিকানা জোগার করে দেন অনেক কষ্ট করে, এ কাজে তাকে সহয়োগিতা করেছেন মধু ভাই, তিনি কবি বিষ্ণু বিশ্বাস এবং কবি নান্নু মাহবুবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বলা যায় নান্নু মাহবুব এবং মধু ভাইয়ের সহযোগিতা ছাড়া বিষ্ণুর ঠিকানা যোগার করা অসম্ভব ছিল। বিষ্ণু বিশ্বাসের একজন কাজিনের মাধ্যমে তার পশ্চিমবঙ্গের ঠিকানা পাওয়া যায় ১৮ বছর পর। কবি তমাল বন্দোপাধ্যায় বিষ্ণুর খোঁজ জানায় যে তিনি ঐ ঠিকানায় আছেন। কলকাতার কবি বিভাস রায় চৌধুরী, কবি গৌতম চৌধুরী. মৃদুল দাসগুপ্ত, বাংলাদেশের নিশাত জাহান রানা এবং নাহার মাওলা তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। তারা কবির বন্ধু। কোলকাতার কবি মিতুল দত্ত, গল্প লেখক ইচক দুয়েন্দে এবং কবি সুব্রত অগাস্টিনের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। —নভেরা হোসেন
লিটল ম্যাগাজিন `দ্রষ্টব্য` ১৯৯৩ সালে বিষ্ণু বিশ্বাসের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। এখানে তা পুনরায় প্রকাশ করা হলো:
প্রশ্ন: উন্নাসিকতা একজন ব্যক্তির জন্য কতটুকু অপরিহার্য?
বিষ্ণু বিশ্বাস: অপরিহার্যতো নয়ই, আমি বলব কোনো ব্যক্তির উন্নাসিকতা না থাকাই ভালো।
প্রশ্ন: তাহলে আপনি কি বলতে চান কবিরা উন্নাসিক নন?
বিষ্ণু বিশ্বাস: কবিরা উন্নাসিক কিনা আমি বলতে পারব না। তবে যেহেতু অনেকখানি তারা ভেতরে থাকেন, সেহেতু দেখলে মনে হয় উন্নাসিক। আসলে কথা বললে বোঝা যায় একা মূলত তাছাড়া আর কিছু নয়।
প্র: আপনি কি বলতে চাচ্ছেন কবিদের ভেতর ও বাহির দু’রকম?
বিষ্ণু বিশ্বাস: হ্যাঁ, দু’রকম হতে পারে। বাইরের দিক বলতে আমি বলতে চাচ্ছি যে তার চেহারায় যে সেটাই চূড়ান্ত কথা নয়। আরও কিছু ব্যাপার রয়েছে যেগুলো ভেতর থেকে দেখতে হয়। ভেতর থেকে দেখতে হলে কথা বলতে হয় তার সাথে। এবং যেহেতু একজন ব্যক্তির বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন প্রেক্ষিত কাজ করছে তাই ঐ ব্যক্তিটিকে আমরা বোঝার চেষ্টা করি তার ভিন্ন ভিন্ন আবেগ অনুভূতির মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে যারা কবি তাদেরকে আমার কাছে একটু আলাদা মনে হয়।
প্র: কেন, আলাদা মনে হয় কেন?
বিষ্ণু বিশ্বাস: একজন কবি অন্যান্যদের থেকে কেন আলাদা কিংবা তাদের মধ্যে পার্থক্যটা কি? সেটা আসলে অনেক ব্যাখ্যার ব্যাপার। এ মুহূর্তে এতটুকু ব্যাখ্যায় না যাওয়াই ভালো।
প্র: আচ্ছা বর্তমানে বাংলা কবিতার অবস্থা কি?
বিষ্ণু বিশ্বাস: বাংলা কবিতার অবস্থার দিক থেকে অর্থাৎ বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, সব মিলিয়ে যে চর্চাটা হচ্ছে তা খারাপ না, ভালো।
প্র: আপনি বলছেন-ভালো, ধরুন বাংলা কবিতার যে একটা ধারা আছে, ধরা যাক এক হাজার বছরের কথা। অথবা চর্যাগীতিকা থেকে আমরা যদি কবিতার চেইনটা ধরতে চাই, মানে কবিতার যে বেড়ে ওঠা- সে পথ ধরে কবিতা এখন যে অবস্থাটায় এসে দাঁড়িয়েছে এ সম্পর্কে আপনি কি বলবেন? একেবারে সাম্প্রতিক পর্যন্ত এসে আপনার কি মনে হচ্ছে, কবিতা যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে, আগাতে পারছে না, অথবা উঠে আসতে।
বিষ্ণু বিশ্বাস: হ্যাঁ তা মনে হতে পারে, তবে এখন যদি বলতে হয় কবিতার প্রগতি, সামনে এগিয়ে যাওয়া-এটা কোনোক্রমেই থাকতে পারে না। এটাই চূড়ান্ত কথা এটা চলে.....। যেহেতু চলছে চলমান তাহলে কেউ যদি সারথি হয় তাহলে অনায়াসে সে আরও ভালো চলবে। তো আমরা সেখানে যারা নতুন প্রজন্মের এ বাংলার আর ওপার বাংলার সব মিলিয়ে আর কি যে ধরনের প্রতিশ্রুতি দেখতে পাই সেখান থেকে আমার মনে হয় ভবিষ্যৎ ভালো। বাংলা কবিতায় অর্থাৎ সমসাময়িককালে যে কাজগুলো হবে তা মূলত বাংলা সাহিত্য বা পুরানো অবস্থাটা বাদ দিয়েই।
প্র: বাংলা সাহিত্যকে বাদ দিয়ে কথাটা কিন্তু অন্য রকম।
বিষ্ণু বিশ্বাস: না অন্যরকম ভাবার কোনো কারণ নেই। বাদ দেয়া বলতে আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা হলো এ সময়ের যে লজ্জা এটা ঘোচাবে এ সময়ের লেখকেরা।
প্র: এসময় বলতে কি একদম সাম্প্রতিক সময়ের কথা বলছেন?
বিষ্ণু বিশ্বাস: হ্যাঁ একদম সাম্প্রতিক এবং আর কিছুটা আগ থেকে বলছি।
প্র: আপনি কি ৩০ এর পর থেকে বলছেন? কিংবা ৫০ এর পর থেকে?
বিষ্ণু বিশ্বাস: আধুনিক কবিতার অগ্রযাত্রা যেদিন থেকে হলো আমরা সেদিন থেকেই কাউন্ট করবো। পেছনের যে ১০০০ বা ৫০০ বছরের কাজ তা মোটামুটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি কিংবা এ প্রজন্মের কবিরা তা চেষ্টা করছে।
প্র: আর একটু বুঝিয়ে বলুন।
বিষ্ণু বিশ্বাস: অবশ্যই বলব। আমি বলতে চাচ্ছি ১০০০ বছরের ইতিহাসতো আমরা জানি। তারপরে আমরা বর্তমানকে দেখতে পাচ্ছি এবং একই সাথে আমরা ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। যে ভবিষ্যতে আমরা দাঁড়িয়ে থাকব তার জন্য এই সময়ের যে লজ্জা, অসৃজনশীলতা এসব কাটিয়ে উঠতে যে ভূমিকাটা আমরা রাখব তা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য হবে যে আমরা অতীতকে চিনি, বর্তমানকে দেখছি, অতীত ও বর্তমান সময়ের আমাদের যে চিত্রগুলো, ছবিগুলো এসব থেকে জীবনানন্দ দাশ পর্যন্ত যে চিত্রপট, তা থেকে এক প্রকার গতিধারা জন্মায়। এবং তা ধরেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব। এ এগিয়ে যাওয়ার মাঝেই নতুন কিছু সৃষ্টির সম্ভাবনা নিহিত থাকবে।
প্র: যে কথাগুলো বলছেন- এ চেইনটা ধরে আমরা অর্থাৎ সাম্প্রতিককালের কবিরা আপনার মতে যারা এ সময়ের লজ্জাটাকে ঘুচাবে, যদি ঘুচানোর ব্যাপারই হয়ে থাকে তাহলে এ সময়ে এসে বাংলা কবিতায় এ অবস্থা হলো কেন? কেন কবিতাকে মনে হয় যে সঠিক পথটি খুঁজে পাচ্ছে না।
বিষ্ণু বিশ্বাস: এ অবস্থার জন্য ৩০-এর কবিদের কিছুটা দায় রয়েছে। অর্থাৎ তারা রবীন্দ্রনাথের পরে খুব উটকোভাবে ইউরোপের কাছে যাওয়ার ফলে গ্রাম বাংলার সভ্যতা বা বাংলা সংস্কৃতির যে মূল কোষাগার অর্থাৎ গ্রাম, তা এদের লেখায় বঞ্চিত হয়েছে। যেমনি গ্রামকে নিয়ে তারাশঙ্কররা লিখেছিলেন তেমনি কবিরা কিন্তু তা ধরতেই পারেন নি। তারা সরাসরি নগরকেন্দ্রিক একটা সাহিত্য তৈরি করলেন। যেহেতু সভ্যতা নগরকে কেন্দ্র করে এগুচ্ছে সেহেতু তাদেরকে এই অর্থে মানাও যায় যে তারা নগর কবি। কিন্তু সমগ্র বাংলার জগৎটা অর্থাৎ দুই বাংলাই যে গ্রাম আর কী , সে মহা মহা গ্রাম অর্থাৎ আজ পাড়া গাঁ পর্যন্ত এই নগর চেতনার কিছুই যায় নি, সেখানে তা অদিম এবং সেই আদিম লোকালয় থেকে যারা উঠে আসে এখনকার জেনারেশনে তারা বুঝতে পারবে না যে তারা কতখানি শক্তিশালী- কিন্তু ক্ষতিকরও ছিল-যে আমাদেরকে চিহ্নিত করেন নি। ৩০-এর দায়টা এখানে ভয়ঙ্করভাবে পড়েছে। কিংবা এখনকার ৭০ / ৮০এর দশকের নতুন লেখক।
প্র: গ্রামকে নিয়ে লিখলেই কি-
বিষ্ণু বিশ্বাস: একটা অংশ বাদ গেলেই যেন সমগ্রটাকে হারানো হয়। একটা অংশের যতই কমবেশি হোক আর কি তা বুঝতেই পারছেন। কম্যুনিকেশন গ্যাপ হয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ ওখান থেকে যারা উঠে আসবে যে শিক্ষিত শ্রেণীটা তারা কিন্তু ওদেরকে এক ধরনের এভয়েড করে চলতে থাকে। যার ফলে আর একটা ছন্দ সাহিত্য তৈরি হচ্ছে অর্থাৎ ছন্দ কবিতা। এ ছন্দ কবিতা কিন্তু সবাইকে কম্যুনিকেট করতে পারছে না। যেমন নগরের একটা ছেলে এবং গ্রামের একটা ছেলের সাথে গ্যাপ থেকে যাচ্ছে। এটাই মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত।
প্র: আপনি সমগ্রটা বলতে কি বোঝাতে চেয়েছেন?
বিষ্ণু বিশ্বাস: সমগ্রটা বলতে আমি শ্রেণীর পার্থক্য বোঝাচ্ছি।
প্র: এটা কি আলাদা আলাদাভাবে উঠে আসবে?
বিষ্ণু বিশ্বাস: আলাদা আলাদাভাবে উঠে আসবে বলছি না, বলছি আলাদা আলাদা ভাবে জড়িয়ে দিতে হবে। সে বাস্তবতা রয়ে গেছে। সে বাস্তবতা যতদূর পর্যন্ত আমাদেরকে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত টেনে নিযে যায়। সে বাস্ততায় যে শ্রেণীকরণটা রয়েছে সে শ্রেণীবিভাগটা মেনে যদি আমরা কথা বলি তাহলে কিন্তু এক রকমই হয় কেননা গ্রামের একটা ছেলে শিক্ষিত হলেও তার ভেতরের কুসংস্কার কিংবা তার ভেতরের নগরের যে কুহকদিকগুলো যেমন সবার সাথে মিলেমিশে থাকার একটা চমৎকার যোগ্যতা, এক ধরনের স্মার্টনেস এগুলো একধরনের ল্যাক তৈরি করে এবং ল্যাক করার ফলে অখণ্ড যে সংস্কৃতি আমাদের অর্থাৎ যুবকদের সাথে য্কুদের যে পার্থক্য-থাকবে না। সে রকম কিন্তু হচ্ছে না, একটা মিনিমাম পার্থক্য কিন্তু থাকবে। অর্থাৎ গ্রাম ও শহরের মধ্যে যে ভিন্নতা তা কোনোক্রমেই কমছে না বরং বাড়ছে।
প্র: কবিতার সমগ্র আর জীবনের সমগ্র কি তাহলে এক হবে?
বিষ্ণু বিশ্বাস: না এক রকম নাও হতে পারে। কিন্তু তা হয় আর কি? কেননা কোনো ভাবে এর প্রতিক্রিয়া সাহিত্যে পড়বেই।
প্র: তাহলে সমস্যাটা কি এক ধরনের এক্সিজটেন্স এর সমস্যা?
বিষ্ণু বিশ্বাস: হ্যাঁ, সে তো বটেই। কিছুটা তো অস্তিত্বের সংকট বটেই। এমনিতে বাংলা সাহিত্য কিন্তু খুবই হ য ব র ল। যা কোনোভাবেই সমভাবে এগিয়ে যায় নি। যেমন কবিতা এগিয়েছে তো গল্প পিছিয়ে গেছে। গল্প এগিয়েছে তো কবিতা পিছিয়েছে। এ ধরনের হ য ব র ল সাহিত্য ও অস্তিত্বের সংকট সবকিছুর ভেতর থেকেই এখনকার একজনকে দুর্দান্তভাবে উঠে আসতে হবে।
প্র: আচ্ছা কবিতার বাস্তবতা আর জীবনের বাস্তবতা কি এক হতে পারে?
বিষ্ণু বিশ্বাস: না পারে না। কবিতার আলাদা একটা ল্যাংগুয়েজ আছে, এবং সাহিত্যের আলাদা একটা ল্যাংগুয়েজ সে গ্রহণ করবে সে সমাজ থেকে। তাহলে সে সমসাময়িক হতে পারবে না অর্থাৎ সে কম্যুনিকেট করতে পারছে না। অর্থাৎ সমসাময়িক ঘটনার ভেতর দিয়ে যে ভাষাটা তৈরি হচ্ছে- সে ভাষাতেই তাকে লিখে যাওয়ার কথা, যদি সে তা না করতে পারে তার তো সমসাময়িক কবি হওয়ার কথা না।
প্র: আমার কি মনে হচ্ছে জানেন, সাম্প্রতিক পর্যায়ে এসে যে মিডিয়াটায় কবিরা কথা বলবেন এ মিডিয়াটাতেই তারা রপ্ত না। কি মিডিয়ায় তারা কথা বলবেন তা তারা নিজেরাই জানে না। আপনি কি বলবেন?
বিষ্ণু বিশ্বাস: কবিতা এতদূর পর্যন্ত এগিয়েছে গোটা পৃথিবীতে, আজ যখন একজন লোক কবি হওয়ার চেষ্টা করছে তখন থেকেই তার বর্তমান, তার জাতি, তার সমসাময়িক জ্ঞানের যত লেখক তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখতে হচ্ছে। এবং এ খোঁজ-খবর রাখতে গিয়ে তাকে টালমাটাল হয়ে যেতে হচ্ছে। অর্থাৎ সেখানে দান্তেকে দেখছে, ভার্জিলকে দেখছে, শেকস্পিয়ারকে দেখছে এবং তাদেরকে পড়তে হচ্ছে। আমাদের প্রাচীন মহাভারত থেকে বা বৈদিক সাহিত্য থেকে যে সমস্ত বিষয় আশয় রয়েছে কিংবা চর্যাপদ রয়েছে এ সবকিছুই পড়তে হচ্ছে এবং এ সমস্ত বিষয় পড়তে কিংবা জানতে গিয়ে একজন কবির ভয়ঙ্কর শ্রম হচ্ছে। এ জানার শ্রমটাও তার একার, কেউ তাকে হেল্প করছে না। আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানও এখানে হেল্প করছে না। অন্যান্য দেশের মিডিয়াগুলো থেকে আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো অত্যন্ত দুর্বল বলে, এছাড়াও আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো শিল্প-সাহিত্য নিয়ে খুব কম কাজ করে বলে তাদের উপর আমাদের কবিরা একেবারেই ডিপেন্ড করতে পারে না। যার ফলে আমাদের নিজেদের জানতে হয় নিজেদের মাধ্যমে। ফলে এ জানা পড়ার জন্য এত শ্রম ও কষ্ট করতে হয় যে, যে বিষয়টা অর্থাৎ ক্রিয়েটিভিটিটা হারিয়ে যায়। অর্থাৎ আমাদের জানতে বুঝতে গিয়েই আমাদের আসল কাজ হয় না। সুতরাং কথা বলার মিডিয়াটা জানে না সেটা সত্য নয়। তাদের জানার সুযোগ হয়ে ওঠে না।
প্র: ৩০ এর দশকে যারা ইউরোপে বা সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যর দিকে ঝুঁকে গিয়েছে তারা নিজের এ চেষ্টার পরও কিন্তু তারা একটা জেনারেশনকে তৈরি করতে পেরেছিল, তাই মনে হয় এটা আলাদা কিছু নয়।
বিষ্ণু বিশ্বাস: ঐ তো যে কথা বললাম, জানাশোনার ক্ষেত্রে এত সময় ব্যয় করতে হচ্ছে যে তা নিয়ে তরুণ লেখকরা টালমাটাল হয়ে যাচ্ছে। তারপর আছে তাদের জীবনযাপন। তবে নগরে যারা বসবাস করেন। তাদের জীবনযাপন অনেকাংশে সহজ। কিন্তু যারা মফস্বল থেকে এসেছে তাদের পক্ষে এটা একটা ভয়ঙ্কর সমস্যা। কারণ এ সমস্ত জানতে বুঝতে হবে এবং তারপর তাকে জীবনযাপন করতে হবে-অতঃপর সাহিত্যচর্চা। আর জীবনযাপনের প্রক্রিয়া এখানে খুবই কঠিন। এবং অনেকের কাছে তা আরও বেশি কঠিন যারা অতি কবি হওয়ার চেষ্টা করছে।
প্র: মানে? অতি কবি হওয়ার প্রবণতাগুলো কি রকম?
বিষ্ণু বিশ্বাস: আমার ভেতরে যে প্রবণতাটা ভয়ঙ্কর তা হলো আমি কাজ করতে পারছি না। আমি পড়াশোনা করতে পারছি না। তাই লিখতেও পারছি না। জীবন ঠিক না থাকলে লিখবো কি করে?
প্র: এটাকে কি আপনার অস্তিত্বের সংকট মনে করছেন?
বিষ্ণু বিশ্বাস: হ্যাঁ অনেকটা অস্তিত্বের সংকটইতো।
প্র: টিকে থাকা?
বিষ্ণু বিশ্বাস: হ্যাঁ টিকে থাকাই। এবং এ সমস্যাটা আমার মত যারা মফস্বল থেকে এসেছে তাদের জন্য মারাত্মক। কিন্তু যারা শহরের, যেমন সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ কিংবা তাদের মত তার ক্ষেত্রে কম।
প্র: তিনি বোধহয় বেশি লেখেন তার অন্যান্য বন্ধুদের তুলনায়। কি বলেন?
বিষ্ণু বিশ্বাস: তিনি সবসময়ই বেশি লেখেন। আমার যতটুকু জানা খুবই সিরিয়াস সে কবিতা ও সাহিত্য নিয়ে। এজন্য তার কবিতা আমার ভাল লাগে।
প্র: এবার আপনার প্রসঙ্গে আসি। আপনার সাথে আপনার কবিতার সংশ্লিষ্টতা কতটুকু?
বিষ্ণু বিশ্বাস: অনেকখানি। আমার কবিতা আমার মতই। অর্থাৎ আমার বাইরে যেরকম, ভেতরেও সেরকম। অর্থাৎ কখনও স্মার্ট, কখনও মহানাগরিক, কখনও আবার মহাগ্রাম।
প্র: বর্তমানে আপনার সমসাময়িক লেখক বন্ধুদের সাথে আপনার অবস্থাটা কেমন?
বিষ্ণু বিশ্বাস: আমি জানি না। অনেকদিন ধরে অনেকের সাথেই যোগাযোগ নেই। এবং বন্ধুদের সাথে সম্পর্কও সুনির্দিষ্ট নয়। বন্ধুদের সাথে আমার বর্তমানের যে দূরবর্তী অবস্থা তা আসলে কম্যুনিকেশন গ্যাপ।
প্র: গ্যাপটা কিসের? চিন্তা জগতের, না অন্য কিছুর?
বিষ্ণু বিশ্বাস: আমার ক্ষেত্রে যে গ্যাপটা তা মূলত জীবনযাপন প্রণালীর। আমার যে জীবনযাপন তা কিন্তু সত্যিই ভীতিকর। আমি নিজেই মাঝেমধ্যে ভয় পেয়ে যাই। যে ভয় থেকে আমার মধ্যে মৃত্যু চেতনা রক্তের ভেতর প্রোথিত হয়ে গেছে।
প্র: আমি বলতে চাচ্ছি এই মৃত্যু চেতনা কি সকলের জন্য একই ভাবনা নয়?
বিষ্ণু বিশ্বাস: হ্যাঁ তা ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে যেহেতু এ মৃত্যু ভাবনা আমার অস্বাভাবিক জীবন যাপন প্রণালীর সাথে সম্পর্কিত সেহেতু সকলের থেকে আমার ভাবনাটা একটু আলাদা। যেমন আমি বেঁচে আছি ধার করে। আমার কোনো উপার্জন নেই। তাই সেল্ফ ডিপেডেন্সিও নেই। তাই বন্ধুদের সাথে নান্দনিকভাবে সম্পর্ক রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। কিভাবে হবে বলেন , অনেকের কাছে ধার চেয়ে চেয়ে অপমানিত হয়ে হয়ে আমি অনেকটা একা হয়ে গেছি।
প্র: আপনার কবিতা নিয়ে কথা বলি। আপনার কবিতায় কতগুলো বিষয় দেখা যায় যেগুলো জীবনানন্দ দাশকে, তার বোধকে ধরার জন্য কিছু শব্দে আপনি খেলা করেন, যে শব্দগুলি আপনার কবিতায় বারবার ঘুরে ফিরে আসছে অর্থাৎ পাওয়া যায়, যেমন-নক্ষত্র, অন্ধকার, সূর্য, মৃত্যু-। এগুলো কেন? যেহেতু আপনার সময় ও জীবনানন্দের সময় এক নয় তাহলে এ বিষয়টা দেখছি কেন?
বিষ্ণু বিশ্বাস: আমি কিন্তু সময়টাকে নিচ্ছি না, তার ডাইরেকশনটাকে মেনে নিচ্ছি। অর্থাৎ একজন কবির একজন উল্লেখযোগ্য লোক থাকে যিনি ঐ কবির দৃষ্টিতে অবশ্যই প্রতিভাবান। যেমন রবীন্দ্রনাথকে অনুসরন করে অসংখ্য কবি হয়েছিল। যদিও তাঁর উপরই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে ৩০ এর কবিরা সোচ্চার ছিল। তাদের চ্যালেঞ্জ আবার যুক্তিশীলও ছিল। তারা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে অবশ্যই ঋণী।
প্র: যেমনি বিষ্ণু দে ফিরে এসেছিলেন প্রথমে ভার্জিলের সমর্থিত হয়ে। যখন দেখলেন যে আর মুক্তি নেই আবার রবীন্দ্রনাথে ফিরে এলেন-সেটা আমরা জানি কিন্তু-
বিষ্ণু বিশ্বাস: হ্যাঁ, এটাকে অমি মূলত প্রেরণা হিসেবেই দেখছি। কিছু কিছু শব্দ এবং তার তৈরি ইমেজ ইত্যাদি চলে আসে। আসলে এটা আমার দায়। কিন্তু এটাকে অতিক্রম করার যে সাধনা সেটা আমাকে আরও তীব্রভাবে করতে হবে। তবে জীবনান্দ দাশকে কখনও এভয়েড করে নয়।
প্র: না আমি এভয়েড এর কথা বলছিনা, বলছি আপনি কি স্বীকার করছেন, কবিদের প্রেরণার উৎস থাকে। মানে-
বিষ্ণু বিশ্বাস: অবশ্যই থাকে। মানে-
প্র: এটা ছাড়া কি লেখালেখি করা সম্ভব নয়?
বিষ্ণু বিশ্বাস: অনেকটা অসম্ভবই। একজন কবি যখন কবিতা লিখতে শুরু করে তখন সে তার সহযাত্রিকে খুঁজবে না এটা কখনই হয় না। এবং যে করেই হোক সে সহযাত্রীকে খুঁজে বের করবে। কারণ একজনের ওপর অনেকেই প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু তার মাঝখান থেকে কেউ কেউ প্রভাব ফেলে তীব্রভাবে বরং এ প্রভাবটা তার জন্য অত্যন্ত জরুরী।
প্র: একটা সময় পর্যন্ত মেনে নেয়া যেতে পারে, যখন সময়কে নির্মাণ করার একটা দায় থাকবে একজন কবির তখন তার যে প্রেরণা, পূর্ববর্তী শক্তিশালী কবিদের ভেতর যার প্রভাব তার ওপর সবচেয়ে বেশি তাকে যদি খেয়ে ফেলে সে প্রভাব তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়াবে।
বিষ্ণু বিশ্বাস: তাতো অবশ্যই। প্রভাবক যদি পুরোপুরি খেয়ে ফেলে তাহলে তো কবিকে আর কবি মনে করা যাবে না। কারণ কবির সবচেয়ে বড় সম্পদ যে নিজস্বতা, বলার ক্ষমতা, তাই যদি না থাকে তাহলে তাকে আর কবি বলবেন কেন? তবে প্রভাবিত হয়েও যদি সে ভাষারীতির ভেতর দিয়ে বর্তমানকে উপস্থাপন করতে পারে তাহলে কিন্তু তার গ্রেটনেস থেকেই যায়। দেখা যায় ভার্জিলের অনুপ্রেরনা নিয়ে দান্তে মহাকবিতা লিখেছেন, তারপরে শেকস্পীয়ারকে অনুসরন করে অসংখ্য কবি এসেছেন- এরকম প্রভাবতো থেকেই যায়।
প্র: জীবনানন্দ দাশের পরবর্তী বুদ্ধদেব বসু কি আপনাকে প্রেরণা দেয়, আপনার কবিতায় কিন্তু বুদ্ধদেব বা সমর সেনের ছায়াও পড়েছে? যেটাকে আমি মিশ্র প্রভাব বলব।
বিষ্ণু বিশ্বাস: হ্যাঁ বুদ্ধদেব বসুও আমাকে প্রেরণা দেয়। সমর সেনও। অনেকটা মিশ্র প্রভাবই বলতে পারেন। তবে জীবনানন্দ দাশই প্রধান বলতে পারেন। আসলে আমার ধারণায় রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দ দাশই প্রধান বলতে পারেন। আসলে আমার ধারনায় রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দের লেখায় ব্যাপক হারে শহর ও গ্রামের প্রভাব যুগপৎভাবে পড়েছিল। এই যে শহর ও গ্রামের মধ্যে কম্যুনিকেট করার ব্যাপারটা সেটাই আমাকে বেশি করে দোলা দেয। আমার ক্ষেত্রে গ্রাম বলতে ব্যাপারটা থেকেই যাচ্ছে।
প্র: গ্রামটা কি আপনার স্বপ্নের গ্রাম নাকি অন্য কিছু?
বিষ্ণু বিশ্বাস: আমার স্বপ্নের গ্রাম। সে গ্রামটা আমি আজকে চাই যে গ্রামটা আসলে স্বপ্নের এবং যে গ্রামটার আমি দুর্দশা বর্ণনা করছি সে গ্রামটা এখনকার। একটা স্বপ্নের জায়গায় জীবনানন্দ আমার সাথে মিলে যাচ্ছে। যখন বর্তমান গ্রামকে বর্ণনা করি তখন অন্যের মতবাদ অন্যের প্রভাব পড়ছে এই প্রভাবটা যে সবসময় থাকছে বা থাকবে তা নয়। এটা দূরও হয়ে যেতে পারে। এই যে গ্রেট মানুষকে ধরে কারও এগোনো তাকে আমি খারাপ মনে করি না।
প্র: যদি সে ঐ পথ ধরে নিজস্ব একটা পথ নির্মাণ করতে পারে?
বিষ্ণু বিশ্বাস: গানের ক্ষেত্রে যেমন একজন গুরু থাকা দরকার তেমন কবিতায়ও থাকতে পারে।
প্র: সন্তরণের যে ব্যাপারটা, যেমন আমাদের এখানে পুরাণের যে ব্যাপারটা আমি আমার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাকে পাড়ি দিতে হবে এবং এ পাড়ি দেয়ার যে প্রক্রিয়া, আমরা যাব, কোথায় যাব এটার ওপর নির্ভর করে আমরা পথ হাঁটি । যে পথে আমরা হাঁটি সে পথটা কিন্তু আমাদের কাছে ব্ল্যাক।
বিষ্ণু বিশ্বাস: এখন যেভাবে যাব সেভাবে পরিকল্পনা করে আমি এগুতে পারব এটা ঠিক বলা যায় না। মাঝপথে নানা প্রকার লক্ষ্যচ্ছেদ, বিঘণ্ণতা রয়েছে-যা আমাকে পার হতে হবে।
প্র: পরিকল্পনাটাও কিন্তু সেই স্বপ্নের। সেটিও কিন্তু আমাদের অজানা। আমরা ধরে নিচ্ছি যে এভাবে এটা করা যায়। আমরা আমাদের পূর্ববর্তীদের ধারণা অনুযায়ীই প্রথমটায় আগাই। কিন্তু আমরা যখন পথ হাঁটতে থাকি তখন আর পুরোপুরি সে পথটা থাকে না। কারণ আমাদের অবস্থায় এসে তাতে চরিত্র বদল হয়ে যায়।
বিষ্ণু বিশ্বাস: হ্যাঁ এটা হয় বলেইতো কোনো প্রভাবই আর গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না।
প্র: তাহলেতো আমরা শূন্যতার দিকেই এগুচ্ছি বা শূন্যতাকে চাচ্ছি বলেই যাচ্ছি বা আমরা যে ভাবনার কথা ভাবছি সে ভাবনাটা আদতেই কোথাও নেই বা ছিল না বা থাকবে না-
বিষ্ণু বিশ্বাস: আলটিমেটলি তাই মনে হয। অর্থাৎ যখন আমি হাঁটছি তখন স্বপ্ন ধরেই হাটছি এবং স্বপ্ন ধরে যাচ্ছি বলেই শূন্যের দিকে যাচ্ছি। কিন্তু ঐ আপাত শূন্যর ভেতর থেকেই বারবার নতুন একপথ বেরিয়ে এসেছে। তাই আমাদের স্বপ্নের ভেতর দিয়েই যেতে হয। অর্থাৎ আমি যখন স্বপ্নের ভেতর দিয়েই ভ্রাম্যমাণ তখন বর্তমানের এ জটিলতা থেকে পরিত্রাণ পেতে চেষ্টা করি। আমরা স্বপ্নগুলো রচিত হবে সুন্দর সুন্দরভাবে। যেখানে কোনো নৈরাজ্য থাকবে না, কোনো দুঃখ থাকবে না, অপরাধ থাকবে না ইত্যাদি। বলা যায় পুরানো ধর্মীয় রিচুয়্যাল এর মতো।
প্র: আপনিতো সাম্প্রতিক সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য কবি।
বিষ্ণু বিশ্বাস: এটা মনে করতে পারেন, আমার ব্যাপার নয়।
প্র: তাহলে আপনার কাছে কবিতা কিরকম? অর্থাৎ কবিতা কি হওয়া উচিৎ অথবা কি হলে একটি লেখা কবিতা হয়ে ওঠে?
বিষ্ণু বিশ্বাস: আমি যেভাবে ভাবি আর কি, কবিতা বিষয়ে আমার জীবন ও জটিলতা একাকার হয়ে আছে। অর্থাৎ আমার জীবন যখন সুন্দর আমি যখন ভবিষ্যতের স্বপ্নটা দেখি এবং বর্তমানে একটা চমৎকার অবস্থানে আছি তখন অমি ভবিষ্যতকে নির্মাণ করছি একটা স্বপ্নের ভেতর দিয়ে নির্মাণ করছি আমার পরিকল্পনা মতো আমি নগর বানাচ্ছি, নগরের অন্যান্য চিত্র আঁকছি। যার ফলে আমার ভবিষ্যৎ চেতনাটা অনেকক্ষেত্রে স্বর্গের যে চেতনা তার মত মনে হচ্ছে। আর যখন আমি আমার জীবনে নৈরাজ্য দেখতে পাচ্ছি আমার জীবন ধ্বংস ও মৃত্যুমুখী মনে হচ্ছে তখন আমার মৃত্যু চেতনা এবং আনুষ্ঠানিক অনেক দুশ্চিন্তা, আশংকা এগুলো আমার ভেতর তীব্র হয়ে উঠছে। এজন্য আমার কবিতা কয়েকটি ধারায় বিভক্ত। কখনও নৈরাজ্যিক কেওয়াসের ভিতর দিয়ে তৈরি হচ্ছে আর একটা বেশ শান্ত ও সমাহিত ভঙ্গিতে তৈরি হচ্ছে।
প্র: মৃত্যু বিষয়ে আপনার ভাবনাটা কি রকম?
বিষ্ণু বিশ্বাস: আসলে মৃত্যু চিন্তাটা আমার পারিবারিক জীবনে অত্যন্ত ভীতিকর একটি ব্যাপার। ওটা আমার রক্তের ভেতরও প্রবাহমান। যার জন্য আমার মৃত্যুভীতিটা একটু তীব্র। আর পারিবারিক ভীতি কি রকম সেটা আমি বলি, আমার বাবার চার ভাই ছিলেন। তাদের মধ্যে তিন ভাই অবিবাহিত অবস্থায় মারা গেছেন। তাদের এক ভাই-ই বিয়ে করেছিলেন- তার সন্তানই আমি। যে আমার এক বছর হতেই আমার বাবা আত্মহত্যা করেছিল। অমার দুই পিসিমাও আত্মহত্যা করেছিলেন। যার ফলে মৃত্যু ভীতিটা অমার ভেতর চূড়ান্ত আকার ধারণ করে আছে। ইম এগুলো চ্যালেঞ্জ করে করেই মৃত্যুকে এড়াতে চাই। কিন্তু মৃত্যু এড়াতে চাই বলেই মৃত্যু আমার প্রতি অনেক বেশি অকৃষ্ট হয়ে চলে আসে যাকে চ্যালেঞ্জ করা হয় সে তো আসবেই। যেমন আমার মৃত্যুকে নিয়ে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে বলেই আমার কবিতায় ও জীবনে মৃত্যু চেতনা খুব তীব্র।
প্র: বন্ধুদের থেকে আপনার এ চিন্তা আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখে-এমন কি মনে হয়?
বিষ্ণু বিশ্বাস: হ্যাঁ দূরে সরিয়ে রাখে বৈকি? অনেকখানি যন্ত্রণাকাতর করে, অপরাধবোধেও ভুগি-সব মিলিয়ে জীবনটা হয়ে পড়ে দূর্বিসহ। বন্ধুদের সাথে ফাঁক সৃষ্টি হয়, ব্যক্তিবাদী হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা দেয়। এটা আবার শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
প্র: ধরুন আপনার প্রিয় বন্ধুকে বললেন- আপনি আত্মহত্যা করবেন, আপনার বন্ধু কি ব্যাপারটা অন্যভাবে নিতে পারে না?
বিষ্ণু বিশ্বাস: আত্মহত্যার কথা আমি বলিনি। আমি বলছি মৃত্যু আমাকে তাড়া করে। তাড়া খুব আবেগপ্রবণতার ফল। আমার উপরেও এ আবেগপ্রবণতা খুবই কার্যকরী । আমি যখন শুভবাদী হব তখন শুভ হব। কিন্তু আমি পুরোপুরি শুভবাদী হতে পারি না। আমার এ না পারার প্রধান কারণ হচ্ছে বর্তমানে আমার অর্থিক দুরবস্থা।
প্র: এটা কি ঘুচতে পারে না?
বিষ্ণু বিশ্বাস: পারে, তবে তার আগেই অনেকগুলো ঘটনা কাকতালীয়ভাবে ঘটে যাচ্ছে। যেগুলো আমার ঘুচিয়ে ফেলার চেষ্টাটা প্রতিহত করে ফেলেছে। অর্থাৎ আমাকে স্বাবলম্বী হতে দিচ্ছে না। এসব অতি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো না হয় আলোচনা না-ই করলেন।
প্র: চলুন আমরা আর একদিন বসি।
বিষ্ণু বিশ্বাস: বেশতো কোথায় বসবেন?
প্র: এখানেই, কুন্দনে। ঠিক আছে?
বিষ্ণু বিশ্বাস: ঠিক আছে।
(এরপর বিষ্ণু বিশ্বাসকে আমরা খুঁজে বের করতে পারিনি। একদিন হঠাৎ করেই নির্বাহী সম্পাদক পিজির বটতলায় বিষ্ণু বিশ্বাসকে পেয়ে গেছে ক্রোড়পত্রের স্কেচের জন্য স্টুডিওতে ঢুকিয়ে একটি ছবি তুলে নেয় এবং বিষ্ণু বিশ্বাস জানান তিনি খুব শীঘ্র কলকাতা চলে যাচ্ছেন।)
সূত্র: দ্রষ্টব্য সংখ্যা ৯