ওয়ায়েস করনির কিস্সা
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০১৯
চচ্চড়ে রোদ চিকচিক করছে মরুভূমির ওপর। বিকেল, তবু তেতে আছে চারদিক। হঠাৎ হঠাৎ ঝিরঝির যে হাওয়া ছুটছে, তা-ও তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে। খেজুরগাছের ছায়ায় সাহাবিদের সাথে বসে আছেন হযরত মুহম্মদ (স.)। চেয়ে আছেন মরুভূমির দিগন্তে। ছিটছিটে শাদা মেঘ দিগন্তের আকাশে। আর ধোঁয়াশা, কুহেলিকা। বেশি সময় টানা চেয়ে থাকলে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। মহানবিরও গেল। চোখ সরিয়ে নিলেন তিনি। এরপর উপস্থিত হযরত আলী ও ওমর ফারুককে বললেন, তোমাদের দুজনকে একটি দায়িত্ব দিতে চাই। আমার মৃত্যুর পর তোমরা তা পালন করবে।
ওমর ও আলী একইসাথে জিগেশ করলেন, কি দায়িত্ব হযরত? মহানবি বললেন, আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার গায়ের জামা নিয়ে যাবে ওয়ায়েস করনির কাছে। জামা দিয়ে তাকে বলবে, সে যেন এ জামা গায়ে দিয়ে আমার অনুসারীদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে। ওমর জিগেশ করলেন, ওয়ায়েস করনি কে? মহানবি জবাব দিলেন, তিনি একজন পুণ্যাত্মা। আলী জিগেশ করলেন, আমরা তাকে কোথায় পাব? কীভাবে চিনবো? মহানবি বললেন, তোমরা তাকে কুফা নগরীতে পাবে। আর তাকে চেনার উপায় হচ্ছে, তার দেহের পশম অপেক্ষাকৃত লম্বা। তাকে চেনার আরো একটি লক্ষণ হচ্ছে, তার দুই হাতের বাঁদিকে একটি করে শাদা দাগ আছে।
ওমর জিগেশ করলন, তার সাথে কি আপনার দেখা হয়েছে? মহানবি জবাব দিলেন, না ওমর। বাইরের চোখে আমরা কেউ কাউকে দেখিনি, তবে অন্তর্চোখে আমরা পরস্পরকে দেখেছি। আলী জিগেশ করলেন, আপনার ও তার মধ্যে আত্মার এই যোগসূত্র, অথচ তিনি কেন আপনার সাথে একবারও দেখা করতে এলেন না? মহানবি বললেন, দুটো কারণে সে আমার এখানে আসতে অক্ষম। এক. আল্লাহর প্রেমে সে এমনই বিভোর, কোথাও যাওয়ার মতো অবস্থা তার নেই। আর দুই. তার বুড়ো অন্ধ মা জীবিত আছেন। সে ছাড়া তাকে দেখাশোনা করার আর কেউ নেই। আলী আবারও জিগেশ করলেন, তার চলে কীভাবে? মহানবি জানালেন, তিনি উটের রাখাল।
মুসলিম জাহানের খলিফা ওমর ফারুক। শান্তি আর সমৃদ্ধির বার্তা ঘরে ঘরে। তিনি খলিফা, অথচ বিনয়ে কীটস্থ কীট। জনসাধারণের অতি সামান্য ক্লেশ তার ঘাড়ে পাহাড় হয়ে চেপে বসে। আর তাই তিনি পিঠে করে আটার বস্তা বয়ে দিয়ে আসেন অভুক্ত থাকা পরিবারে। রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশে মানুষের ঘরের দরজায় কান পেতে শোনেন তাদের ক্ষুধা আর অভাবের গল্প। আলী একদিন খলিফাকে বললেন, মহানবি আমাদের এক দায়িত্ব দিয়ে গেছিলেন। আপনি কি তা ভুলে গেছেন?
খলিফা একটু চুপ থেকে জবাব দিলেন, না জনাব। আমি ভুলিনি। তবে খলিফার সিংহাসন যে দায়িত্ব আমার পিঠে চাপিয়ে দিয়েছে, তা পালন করতেই আমার দিনরাত পেরিয়ে যাচ্ছে। ফুরসৎ তো পাচ্ছি না।
কিছু দিনের জন্যে বিশ্রাম নিন। চলুন, আমরা কুফা থেকে ঘুরে আসি।
সিদ্ধান্ত হলো, আগামীকাল ভোরেই তারা কুফার পথে রওয়ানা হয়ে যাবেন।
ভোরের রঙ তখনো ফোটেনি। ওমর ও আলী বেরিয়ে পড়লেন পথে। দীর্ঘপথ পেরিয়ে এক দুপুরে তারা পৌঁছলেন কুফা নগরীতে। লোকজনকে জিগেশ করলেন, ওয়ায়েস করনির কথা। কিন্তু তারা কেউ-ই তার খোঁজ দিতে পারল না। তবে একজন বলল, একটি লোককে চিনি, তবে সে তো পাগল। সে লোকালয়ে থাকে না। করন এলাকার প্রান্তরে সে উট চরিয়ে বেড়ায়। তাকে আপনারা কীভাবে পাবেন? আলী জিগেশ করলেন, আচ্ছা, আপনি কি তার বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে পারবেন, যা দেখে আমরা তাকে চিনে নিতে পারি? লোকটি বলল, শুনেছি, দিনের শেষে একবার সে শুকনো একটা রুটি খায়। আর কেউ হাসলে সে কাঁদে, কেউ কাঁদলে সে হাসে।
করনের দিকে ছুটলেন ওমর ও আলী। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা এক প্রান্তরে এলেন। দেখলেন, এক লোক উট চরাচ্ছে। পরনে ছেঁড়া আর মলিন পোশাক। লোকটিকে সালাম দিলেন তারা। রাখাল জবাব দিলেন। ওমর জিগেশ করলেন, আপনার নামটা কি জানতে পারি? রাখাল জবাব দিলেন, আব্দুল্লাহ। ওমর বললেন, দয়া করে আপনার আসল নাম বলুন। রাখাল বললেন, ওয়ায়েস। ওমর বললেন, দয়া করে আপনার হাতদুটো একটু দেখাবেন? দুহাত বাড়িয়ে দিলেন ওয়ায়েস। ওমর ও আলী দেখলেন, যে লক্ষণের কথা মহানবি বলেছিলেন, তা মিলে গেছে।
ওমর খুবই বিনয়ের সাথে রাখালকে বললেন, মহানবি মৃত্যুর পর তার গায়ের জামা আপনাকে উপহার দেয়ার জন্য আমাদের দুজনকে নির্দেশ দিয়ে যান। তিনি আমাদের বলেছিলেন, এ জামা গায়ে দিয়ে আপনি যেন তার অনুসারীদের জন্য দোয়া করেন।
কেঁপে উঠলেন ওয়ায়েস। বললেন, দেখুন, আপনারা হয়তো ভুল করছেন। এত বড় সৌভাগ্য আমার এখনো হয়নি। কষ্ট করে আপনারা একটু তালাশ করে দেখুন। যাকে আপনারা খুঁজছেন, আমি সে নই। ওমর বললেন, আপনিই তিনি। মহানবির বলে দেয়া লক্ষণ অনুযায়ী আপনার দুই হাতের বাঁদিকে শাদা দাগ আছে। এবার ওয়ায়েস জিগেশ করলেন, কিন্তু আপনাদের পরিচয়? ওমর বললেন, আমি ওমর ইবনে খাত্তাব, আর আমার সাথির নাম আলী। তিনি মহানবির জামাতা। বিগলিত হয়ে গেলেন ওয়ায়েস। ওমর ও আলীর হাত ধরে তিনি চুমু খেলেন। এরপর বললেন, আপনাদের মতো সম্মানিত মানুষ আমার মতো হতভাগার কাছে এসেছেন, এ তো আমার সৌভাগ্য। তবে আপনারা আমাকে বেআদব বানিয়ে দিলেন। আপনারাই তো দোয়া করার জন্য বেশি উপযুক্ত।
আলী এতক্ষণ শুনছিলেন। এবার তিনি বললেন, সে আমরা করি জনাব। তবে মহানবি বিশেষভাবে আপনাকেই বলে গেছেন। হয়তো তার এ বলার মধ্যে কোনো গূঢ়তত্ত্ব থাকতে পারে।
জামা হাতে নিয়ে বিনীতভাবে ওয়ায়েস বললেন, জি, হুজুরের নির্দেশ পালন করা আমার কর্তব্য।
ভিখিরির মতো দেখতে তেজদীপ্ত এই মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করেই ওমর টের পেলেন, তার বুকে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে। নিঃস্ব এই মানুষটার জ্ঞান ও আধ্যাত্ম কত উঁচুতে। কী হয় তবে ধন-সম্পদ দিয়ে? কী হয় খেলাফতি দিয়ে? বুকের ভেতর চেপে রাখা হাহাকার হঠাৎ বেরিয়ে এলো ওমরের মুখে, এমন কে আছে, যে একটি রুটির বদলে খেলাফতের দায়িত্ব নেবে? ওয়ায়েস বললেন, যে নির্বোধ, সে-ই তা নেবে। সত্যিই যদি আপনার মন তা চায় তবে ছুড়ে ফেলে দিলেই তো হয়। যার মন চায় সে কুড়িয়ে নেবে। এর মধ্যে আবার অদল-বদলের কী আছে! এরপর একটু থেমে ওয়ায়েস খলিফাকে জিগেশ করলেন, আচ্ছা, আপনি কি আল্লাহকে চিনেছেন?
খলিফা জবাব দিলেন, জি, চিনেছি। ওয়ায়েস বললেন, তবে আর কাউকে চেনার আপনার দরকার নেই। কিন্তু আল্লাহ কি আপনাকে চিনেছেন? খলিফা জবাব দিলেন, মনে হয় চিনেছেন। ওয়ায়েস বললেন, তাহলে আপনাকে আর কারো চেনার দরকার নেই। তিনিই যথেষ্ট। খলিফা বললেন, কিছু মনে না করলে আপনাকে আমি কিছু মালপত্র উপহার দিতে চাই। যা দৈনন্দিন জীবনে আপনার কাজে লাগবে। হাসলেন ওয়ায়েস। জামার পকেট থেকে কয়েকটি মুদ্রা বের করে তিনি বললেন, উট চরিয়ে এগুলো আমি পেয়েছি। আপনি যদি নিশ্চিত করতে পারেন, এগুলো খরচ করার পরও আমি জীবিত থাকবো, তবে আপনার উপহার আমি নেব। খলিফা আর কথা বলতে পারলেন না। আলীও চুপচাপ। থেকে থেকে দু’একটা উট কেবল কেবল ডেকে উঠছে।
ওয়ায়েস বললেন, আপনাদের বিনীত ধন্যবাদ, আমার কাছে এসেছেন। আমাকে সম্মানিত করেছেন। এবার আপনারা আসুন। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন খলিফা ওমর ও আলী।
এলাকায় চাউড় হয়ে গেল, স্বয়ং খলিফা এসেছিলেন পাগলটার সাথে দ্যাখা করতে। লোকজন টাসকি খেয়ে গেল। তারা ভিড় জমাতে লাগল ওয়ায়েসের বাড়িতে, মাঠে। ওয়ায়েস হয়ে উঠলেন, ত্যক্ত, বিরক্ত। শেষমেশ তিনি কুফা নগরীতে চলে এলেন। ততদিনে মারা গেছেন তার মা। পেছনের আর কোনো টান তার রইলো না। কুফায় এসে লোকালয়ের বাইরে সবার চোখের আড়ালে তিনি বাস করতে লাগলেন। লোকজন তার ব্যাপারে নানা কথা বলে। বলে, তার অলৌকিক নানা ঘটনার কথা। কোনোটা সত্যি, কোনোটা মিথ্যে। তবে তারা কেউ-ই কখনো ওয়ায়েসকে দেখতে পায়নি। যদিও তারা জানে, সেই মহাত্মা কুফাতেই বসবাস করেন।
দরবেশ হারম ইবনে জাবাল দীর্ঘদিন ধরেই লোকমুখে ওয়ায়েসের কথা শুনেছেন। নানাভাবে তার গল্প নানাজনের কাছে শুনেছেন। শুনতে শুনতে ওয়ায়েসকে দেখার ইচ্ছে তার মধ্যে তীব্র হয়ে উঠলো। তাই একদিন তিনি ওয়ায়েসের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। দীর্ঘদিন আর দীর্ঘরাত পেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন ফোরাত নদীর তীরে। দেখলেন, পাগলের মতো দেখতে এক লোক ওজু করছেন। লোকমুখে শোনা নানা লক্ষণ মিলিয়ে তিনি দেখলেন, এই লোকটিই ওয়ায়েস। মুহূর্তে শিহরিত হলেন হারম। কী যেন এক বিদ্যুৎচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ল তার সারা দেহে।
ওজু শেষ করে উঠে এলেন ওয়ায়েস। এগিয়ে গিয়ে হারম তাকে সালাম জানালেন। হাত মেলানোর জন্য বাড়িয়ে দিলেন হাত। সালামের জবাব দিলেন ওয়ায়েস। কিন্তু হাত মেলালেন না। তবে বললেন, ওহে হারম ইবনে জাবল, আমার কাছে তুমি কেন এসেছো? বিস্মিত হলেন হারম। জিগেশ করলেন, আপনি তো আমাকে কখনো দেখেননি। তবে আমার নাম জানলেন কি করে? ওয়ায়েস জবাব দিলেন, আল্লাহ আমাকে জানিয়েছেন। আমার আত্মা তোমার আত্মাকে খোঁজ দিয়েছে। কিন্তু আমার কাছে কি চাও তুমি? হারম জবাব দিলেন, আপনার প্রতি শ্রদ্ধাই আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে। ওয়ায়েস বললেন, কোনো মানুষ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভালোবেসে শান্তি পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। হারম জিগেশ করলেন, জগতে কীভাবে আমি সুখি জীবন-যাপন করতে পারি?
ওয়ায়েস বললেন, যখন ঘুমোতে যাবে, ভাববে মৃত্যু তোমার শিয়রে বসে আছে। যখন জেগে থাকবে, মৃত্যুকে সবসময় চোখের সামনে রাখবে। দেখবে, জীবন সহজ হয়ে গেছে। হারম এবার জিগেশ করলেন, এখান থেকে ফিরে গিয়ে আমি কোথায়, কীভাবে জীবন-যাপন করবো, আমাকে বলে দিন। ওয়ায়েস বললেন, তুমি সিরিয়া চলে যাও। হারম জিগেশ করলেন, সেখানে তো সবাই আমার অপরিচিত। চলব কীভাবে, খাব কি? ওয়ায়েস বললেন, যার মনে এত চিন্তা-ভাবনা, উপদেশে তার কোনো উপকার হবে না। আপনি এবার আসুন। হারম কাতর স্বরে বললেন, আরো কিছু সময় থাকি? ওয়ায়েস বললেন, না। হারম বললেন, জনাব, আমাকে শুধু বলুন, প্রেম কি? ওয়ায়েস জবাব দিলেন, যে অনুভূতির মধ্যে থাকলে দেহে তীর বিদ্ধ হলেও টের পাওয়া যায় না, তা-ই প্রেম।
হারম বিদায় নিলেন। ওয়ায়েস চললেন গোধূলির পধ ধরে। যেন সে গোধূলির জাদুকর। আল্লাহ মূসার হাতে তুলে দিলেন জুতা ও লাঠি। বললেন, যাও। এই জুতা পরে ঘুরে বেড়াও পৃথিবীর পথে পথে। আর এই লাঠি হাতে রেখো নিরাপত্তার জন্যে। মূসা জিগেশ করলেন, কতদিন ঘুরব এভাবে? আল্লাহ জবাব দিলেন, যতদিন জুতার তলা ক্ষয় না হচ্ছে। আর লাঠিও না ভাঙছে। মূসা জিগেশ করলেন, দীর্ঘ এ সময় ঘুরে বেড়ানোই কি আমার একমাত্র কাজ? আল্লাহ বললেন, হ্যাঁ। এটিই হচ্ছে প্রথম ইবাদত। পৃথিবীর পথে হাঁটতে হাঁটতে কত কত কিছু তুমি দেখবে, চিন্তা করবে। চিন্তার মধ্যে কাটাকুটি করবে। এর মধ্যে দিয়েই তো খুঁজে পাবে আমাকে।
গল্প বলতে বলতে থামলেন ওয়ায়েস করনি। তাকালেন শিষ্যদের দিকে। এক শিষ্য বলল, আপনি কি আল্লাহকে খুঁজে পেয়েছেন? ওয়ায়েস জবাব দিলেন, না। তবে চারদিকে তার নিদর্শন দেখতে পাই। এই বলে মাথা নিচু করে বসে রইলেন ওয়ায়েস। বেশ কিছু সময় পর তিনি বললেন, তাকে যে খুঁজে পায়, সে নির্বাক ও বধির হয়ে যায়। নীরবতার ভাষাই তার ভাষা হয়ে যায়। কিন্তু আমি এখনও কথা বলছি।
আবারও চুপ হয়ে গেলেন তিনি। মাথা নিচু করে বসেই রইলেন। কিছু সময় পর মাথা তুলে বললেন, যার মনে আশা-নিরাশা সমানভাবে থাকে, সে-ই দরবেশ। এখন তোমরাই বলো, আমি কি দরবেশ?